১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’

-

‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’- আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের এ কথার সাথে বাস্তবজীবনের অঙ্ক একেবারেই বেমিল। অনেকেই বলেন, প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের কারণে বিভিন্ন অপরাধ ঘটছে। আবার অনেকে বলেন, বিচারহীনতার কারণে মূল্যবোধের এই চরম অবনতি। বাংলাদেশে প্রতিদিন ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় ১৫ থেকে ২০ জন মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। আহতের সংখ্যাও কম নয়- প্রায় অর্ধশতাধিক বলা চলে। কর্মস্থলে যাতায়াত নিরাপদ নয়। ৫৬ হাজার বর্গমাইলজুড়ে ডেঙ্গু এখন মহামারী রূপ ধারণ করেছে। ছোট একটা পোকার কাছে আমরা অসহায়, অনেকটা নমরুদের শাসনামলের কথা মনে করিয়ে দেয়। নমরুদ বাহিনী এই ক্ষুদ্র মশক বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়। বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ তাদের কর্মসংস্থান নিয়ে ঝুঁকির মধ্যে থাকেন।

কারণ তাদের আইনি ও সামাজিক সুরক্ষা নেই। এরপর অর্থনৈতিক বিষয়- সাম্প্রতিককালে পত্রিকায় এসেছে, বছরে ৪০০ কোটি টাকার বিজ্ঞাপন চলে যাচ্ছে বিদেশী চ্যানেলে। এই আয় থেকে দেশ বঞ্চিত হচ্ছে। হুমকিতে কৃষিজমি ও খাদ্য নিরাপত্তা। স্বাধীনতার পর দেশে কৃষি জমি কমেছে ১২ লাখ ৪২ হাজার হেক্টর। দেশের তিন-চতুর্থাংশ মানুষ সরাসরি কৃষি অর্থনীতির সাথে জড়িত। সেখানে জমি কমে গেলে কার ক্ষতি, শুধুই কৃষকের, নাকি ১৮ কোটি মানুষের? বিগত এক দশক ধরে ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাবে অরাজকতা চলছে। টেকসই ব্যাংক ব্যবস্থা এবং গ্রিন ব্যাংক কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার কোনো উদ্যোগ নেই। পুঁজিবাজারে সূচকের পতন। ১৩টি সেক্টর করপোরেশন মুখ থুবড়ে পড়েছে। মানসিক সুস্থতা থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। জীবনের চেয়ে বড় স্মার্টফোন। সারা দেশে ভয়ঙ্কর আত্মহত্যা, ভয়ঙ্কর অপরাধে তরুণেরা। মাত্র ৭২ ঘণ্টায় শুধু চট্টগ্রাম নগরীতে চাঞ্চল্যকর এ চারটি হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা কিশোর ও উঠতি যুবক। দীর্ঘ বছর ধরে নগর এবং দূরপাল্লার পরিবহনে চলছে অরাজকতা। গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট থাকলেও কিন্তু বাহ্যিক চেহারাই বলে দেয় এগুলো ফিটনেস সার্টিফিকেটের যোগ্য নয়। বাংলাদেশের অর্থ পাচার করছে তারাই, যারা বহিঃরাষ্ট্র ও প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে এসেছে।

শুধু ভারতীয় ১০ লাখ মানুষ ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া বাংলাদেশে কাজ করছে। অন্য দিকে, এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে দেশে তিন কোটি বেকার শিক্ষিত মানুষের ওপর। কর্মের অভাবে এরা বিদেশে যাওয়ার জন্য ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে আছে। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে পারলেই সোনার হরিণের দেখা মিলবে- অর্থাৎ চাকরি পেয়ে যাবেন। কিন্তু ঘটছে উল্টোটা। তারা লাশ হচ্ছেন। এখানেও সরকার ব্যর্থ। পত্রিকায় এসেছে, দেশে ৩১ শতাংশ মানুষ মানসিক রোগে আক্রান্ত। শিশু গণধর্ষণ বাংলাদেশে একটি কদর্য ফ্যাশনে রূপ নিয়েছে। ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে গণধর্ষণের শিকার। দেশে স্মার্টফোনের বদৌলতে সমকামীর বিস্তার ঘটেছে। দেশে রুচির বিকৃতি ঘটেছে। পশুর রাজ্যেও এসব কখনোই ঘটে না।

পত্রিকায় এসেছে তিন বছরের শিশুকেও ধর্ষণ করেছে এ দেশের মানুষ। শুধু ধর্ষণ নয়, ধর্ষণের পর হত্যা করেছে শিশুটিকে। এই নিবন্ধ লেখার দিন পর্যন্ত বাংলাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৫২ হাজার ছাড়িয়েছে। অপ্রিয় সত্য, নগরবাসী যখন ডেঙ্গু নিয়ে উদ্বিগ্ন সে সময় ঢাকা সিটির দুই মেয়র বিদেশে (ইনকিলাব, ৩০-০৮-১৯) গেছেন। বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, আমাদের কাছে পরিসংখ্যান আছে, সেই পরিসংখ্যানে ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সারা দেশে গুম হওয়া মানুষের সংখ্যা ১২০৯। যার মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গুমের সংখ্যা ৭৮১।

উল্লেখ্য, পৃথিবীর সব মুসলিমপ্রধান দেশ কাশ্মিরিদের রক্ষার ইস্যুতে তাদের পক্ষে সমর্থনের কথা জানিয়েছে কিন্তু বাংলাদেশ বলেছে, এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। একটি সাম্প্রদায়িক দল বিশেষ করে কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) মতাদর্শ গোটা ভারতকে গ্রাস করেছে, ঠিক যেমনটি নাৎসি পার্টি জার্মানি দখল করে নিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের শাসক দল বলছে একটা করছে আরেকটা। জন্মলগ্ন থেকে তাদের ভাষ্য ছিল- আওয়ামী লীগ পৃথিবীর সব শোষিত, নির্যাতিত- সে যে দেশেই থাকুক না কেন তার পক্ষে কথা বলবে। অথচ তাদের কাশ্মির নিয়ে কোনো বক্তব্য নেই। তাহলে তারা নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত মানুষের পক্ষে কথাটি কিভাবে বলে। কোনো কিছু ঘটলেই ক্ষমতাসীন দল বিরোধী দলকে দায়ী করে। এমনকি ডেঙ্গু নিয়ে তারা রাজনীতি করছেন, ডেঙ্গু নাকি নয়াপল্টন অফিস থেকে আসে।

সরকার দেশের মূল সমস্যা আড়াল করার জন্য সব দোষ নন্দ ঘোষের ভূমিকা পালন করছে। মানুষ ভয়ে চুপচাপ থাকলেও এটা যে গণবিস্ফোরণে রূপ নেবে না কোনোকালে, তা সময়ই বলে দেবে। দেশে আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়ছে। গড়ে ১০ হাজার মানুষ প্রতি বছর আত্মহত্যা করছে। আত্মহত্যার হারে পুরুষের চেয়ে নারীদের সংখ্যা বেশি এবং বয়সের স্তর হিসেবে কিশোর-কিশোরীদের সংখ্যাই বেশি। আরেকটি নিউজ- দিনে শ্রমিক লীগ নেতা, রাতে চোরের সরদার। ফুটপাথ বাণিজ্য দেশ থেকে যাবে না, কারণ এর সাথে জড়িত পুলিশ প্রশাসন। ভালো একটা ইনকাম এখান থেকে আসে। লোক দেখানো কিছু প্রচার-প্রচারণা চলতে দেখা গেলেও আবার দু-একদিন পর একই অবস্থা শুরু হয়। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলতে না দিলে এর সার্বিক অবস্থা কখনোই ভালো হবে না।

আমরা দেশকে খুব ভালোবাসি, সেজন্য আমরা জাতীয় সঙ্গীত গাই- আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। বিষয়টি কতটুকু সত্য, আদৌ সত্য কি না- নিজেকে প্রশ্ন করুন, উত্তর পেয়ে যাবেন। আমাদের দেশে পত্রিকার পাতা ভরে যেসব খবর নিত্যদিন বের হচ্ছে তার সাথে কি জাতীয় সঙ্গীতের কোনো মিল আছে? বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বেমিল লক্ষ করা যাবে। আমরা ৪৮ বছরে যে অবস্থানে যাওয়া বা থাকার কথা ছিল, সেই অবস্থানে পৌঁছতে না পারার মূল কারণ- আমরা বদলাতে পারিনি। এই বদলানো নিয়ে আমি একটি বই লিখি ২০১৩ সালে। আসল কথা হলো, আমরা না বদলালে দেশ বদলাবে না। পৃথিবীর বর্তমান সাড়ে সাত শ’ কোটি মানুষ যদি ভালো হয়ে যায় তাহলে পৃথিবীর ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে। এই ক্ষুদ্র গ্রহে তখন হিংসাবিদ্বেষ, অহঙ্কার, ঘুষ, দুর্নীতি এসব আর থাকবে না। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভিয়েতনাম অনেক বদলিয়েছে। তারা আমেরিকার আঘাত সহ্য করেছে কয়েক বছর, তারপর তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।

বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ থেকে সত্তরের দশকে টানা ২১টি বছর ধরে পৃথিবী সাক্ষী হয়েছিল এক অবিরত প্রাণক্ষয়ের। ১৯৫৪ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ চীন সাগর তীরের এক বিস্তীর্ণ জনপদে বয়ে গিয়েছিল অবিরাম এ রক্তের স্রোতধারা। সেই রক্তপাতের দুটো পক্ষ ছিল; একপক্ষ মুক্তি চায়, অন্যপক্ষ চায় মুক্তির আকাক্সক্ষাকে গলা টিপে ধরতে। ইতিহাস সাক্ষী, লাখো প্রাণের বিনিময়ে সে যুদ্ধে জয় হয়েছিল মুক্তিকামী মানুষেরই। অনাগতকাল ধরে মানুষের স্বাধীনতা স্বপ্নে প্রেরণা জোগানোর ইতিহাস তৈরি করা সেই জনপদের নাম ভিয়েতনাম। বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়াতে এত সময় লাগছে কেন? উত্তর নিশ্চয়ই আছে- দুর্নীতি এবং ব্যাপক স্বজনপ্রীতি আমাদের আগাতে দিচ্ছে না।

লেখক : সমাজবিশ্লেষক ও গ্রন্থকার
ই-মেইল : harunrashidar@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement