২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

উগ্রবাদ ও ‘কমনওয়েলথ অব হিউম্যান কমিউনিটিজ’

-

বর্তমানে আমাদের সমাজে অসহিষ্ণুতা মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। মনে হবে যেন এটা আমাদের সংস্কৃতির অংশ। অথচ কোনো ধর্ম বা সমাজ অসহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয়া হয়নি, বরং এর উল্টোটা হয়েছে। বৌদ্ধরা বলছেন, অহিংসা পরম ধর্ম। ইসলামে বলা হয়েছে, যার যার ধর্ম তার তার কাছে। হিন্দু, শিখ, জৈন কোনো ধর্মেই সহিংসতাকে অনুমোদন করা হয়নি। অন্য দিকে সহিষ্ণুতা কিভাবে মানবতার বিজয় ঘোষণা করে, সেটিও আমরা দেখেছি।

১৯৭১ সালে আমি নিজে তখন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান ইউনিভার্সিটির ছাত্র, পিএইচডি করছিলাম। পড়াশোনা ও জীবন চালানোর মতো অর্থ তখন আমার কাছে ছিল না। অর্থের প্রয়োজনে যেখানে খণ্ডকালীন যে কাজ পাচ্ছি, তাই করছি। একদিন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমার কাছে জানতে চাইলো একটি ক্লাস নিতে পারব কি না। সেই ক্লাসটি হলো ‘এশিয়ান রিলিজিয়ন’-এর ওপরে। আমাকে বলা হলো, ১৭ জন স্টুডেন্ট হলে ক্লাসটি চালু করা যেতে পারে। রাজি হলাম। কিন্তু দেখা গেল, স্টুডেন্ট ১৬ জনের বেশি হচ্ছে না। তখন আমার স্ত্রীকে বললাম, তুমিও কোর্সে নাম লেখাও। নিজের পয়সা খরচ করে তাকে কোর্সে ভর্তি করালাম। ফলে কোর্সটি চালু করা গেল।

আমাকে কেন এই কোর্সের প্রশিক্ষক হিসেবে বাছাই করা হলো? কারণটি পরে যেটা বুঝতে পেরেছিলাম তা হলো, আমি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের সাথে ভালোভাবে মিশতে পারতাম। আমার পিএইডডি থিসিসের জন্য একটি স্টাডি গ্রুপ তৈরি করেছিলাম। এই গ্রুপে বিভিন্ন ধর্মের স্টুডেন্ট ছিলেন। গ্রুপের কয়েকজনের নাম মনে আছে। বিনোদ সাহা নামে একজন হিন্দু ছিলেন। ইকন নামে একজন ছিলেন নাইজেরিয়ান খ্রিষ্টান। আর্জেন্টিনার এক ছাত্র ছিলেন, তবে নামটি মনে নেই। আর আমি নিজে তো ছিলামই। সবাই আমাকে ‘মডারেট’ মনে করত। কেউ কেউ মুসলিম অ্যাক্টিভিস্টও ভাবত। কারণ, মিশিগান ইউনিভার্সিটিতে প্রথমবারের মতো পুরো নর্থ আমেরিকা থেকে আসা ১২০০ স্টুডেন্টের একটি কনভেনশন আয়োজনের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলাম।

ভালোভাবেই ক্লাস নিচ্ছিলাম। তবে শুরুতে একটি সমস্যায় পড়ে যাই। ক্লাসে আমার স্ত্রী বেশি বেশি প্রশ্ন করত। সবাই বুঝে ফেলল, উনি কে। ভাবছিলাম, তাকে কিভাবে বাদ দেয়া যায়। এর মধ্যে আরো দু’জন স্টুডেন্ট পাওয়া গেল। তারা ছিলেন আমেরিকান। এই কোর্সের প্রতি তাদের আগ্রহের কারণ ছিল- তারা যখন এশিয়ার কোনো দেশে ঘুরতে যেতেন, তখন সেখানকার সংস্কৃতি, ধর্ম এসব জানতে চাইতেন। আমার পড়ানোর বিষয় ছিল বৌদ্ধ ধর্ম, হিন্দু ধর্ম ও ইসলাম। কোর্সের শেষে আমি প্রত্যেক স্টুডেন্টকে জিজ্ঞেস করি, তুমি বলো, আমি কোন ধর্মের অনুসারী। মজার ব্যাপার হয়েছিল, ৮০ শতাংশ স্টুডেন্টই আমাকে বৌদ্ধ মনে করেছিল।

নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানব সভ্যতা আজকের এই পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। অতীতে শিকারি সমাজ ছিল। সেখান থেকে প্রাক-কৃষি সমাজ জন্ম নিল। পানির উৎসকে ঘিরে বসতি গড়ে উঠতে শুরু করে। এরপর এলো কৃষিভিত্তিক সমাজ। মানুষ জমি চাষ করে ফসল উৎপাদন করা শিখেছে। এরপর সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি ‘শিল্প বিপ্লব’ হলো। তার আগ থেকেই ইউরোপীয় শক্তিগুলো উপনিবেশ বিস্তার শুরু করে। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে, ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তান ছাড়া এমন কোনো মুসলিম রাষ্ট্র ছিল না যা ইউরোপীয়দের কলোনি বা উপনিবেশ হয়নি।

ইউরোপীয়রা যখন গোটা বিশ্বে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করে, তখন সেখানকার অধিবাসীদেরকেও তাদের বাক্য-বুলি শিক্ষা দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বে নেশন স্টেটের যে ধারণা বিস্তার লাভ করেছে, সেই ধারণার জন্ম ইউরোপে। ইসলামে ‘নেশন স্টেট’ বলে কিছু নেই। ইসলামে রয়েছে ‘মুসলিম উম্মাহ’র ধারণা। স্বাধীনতা, মুক্তি, গণতন্ত্র ইত্যাদি যেসব কথা বলা হয়, তা মূলত ইউরোপীয় সভ্যতা থেকে এসেছে। মুসলমানেরা নিজেদের শিক্ষা-সভ্যতা-চেতনা ভুলে ইউরোপীয়দের কথিত সভ্যতা অনুকরণ করেছে এবং স্বীকার করে নেয়। অথচ এই নেশন স্টেটের ধারণা পরপর দু’টি বিশ্বযুদ্ধের জন্ম দিয়েছে। বিশ্বশান্তি রক্ষার জন্য জাতিসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তা কিন্তু শান্তি রক্ষা করতে পারেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলেও বিশ্বযুদ্ধের শঙ্কা থেকে মুক্তি পায়নি বিশ্ববাসী। আজ পর্যন্ত সব সময় বিশ্বের কোথাও-না-কোথাও যুদ্ধ লেগেই ছিল এবং এখনো চলছে। হয়তো এই নেশন স্টেটের ধারণার প্রয়োজন ছিল। একটি ধারণা যে অনন্তকাল আঁকড়ে থাকতে হবে, তার কোনো মানে নেই। যুগে যুগে ‘রুলস অব গেমস’-এ পরিবর্তন হয়েছে। প্রাচীন গ্রিক যুগে যে অলিম্পিক ছিল, তার নিয়ম আর আজকের অলিম্পিকের নিয়ম এক নয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে আমার জন্ম। আমি যেন যুদ্ধ নিয়ে দুনিয়াতে এসেছিলাম। যখন যুদ্ধ কাকে বলে, বুঝতে শুরু করলাম তখন যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। ব্রিটিশ প্লেন যখন আমাদের সিরাজগঞ্জের আকাশ দিয়ে উড়ে যেত তখন আমার বয়স ছয়-সাত বছর। আমরা ছোটরা চিৎকার করে বলতাম, আমাদের রাজার প্লেন এসেছে। তখন আমাদের গ্রাম থেকে ওসমান আলী ও শুকুর আলী নামে দুইজন বার্মা ফ্রন্টে জাপানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাদলের হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন। যুদ্ধে জাপান-জার্মানি হেরে যায় এবং এর পরের ইতিহাস সবার জানা। এ জন্য জাতিরাষ্ট্রের ধারণা দায়ী। সীমানাভিত্তিক এই জাতিরাষ্ট্রের কারণে বর্তমানে দেশে দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হচ্ছে। জাতিসঙ্ঘে তো পাঁচটি রাষ্ট্রের মনোপলি বা একচেটিয়া কর্তৃত্ব। তাদের কাছে আমরা জিম্মি, পুরো বিশ্বই জিম্মি।

পশ্চিমা মূল্যবোধগুলোকে ‘সার্বজনীন’ হিসেবে প্রচার করা হলেও তাতে কিন্তু বিত্তশালী দেশগুলোর ক্ষমতার ঔদ্ধত্যই প্রকাশ পেয়েছে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, উদার নৈতিকতাবাদ, মানবতাবাদ, সমতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা, আইন, গণতন্ত্র, মুক্তবাজার, চার্চ ও রাষ্ট্র পৃথকীকরণ ইত্যাদি সম্পর্কে পাশ্চাত্যের ধারণা শুধু ইসলাম নয় কনফুসীয়, হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মেরও পুরোপুরি পরিপন্থী। তাই বর্তমান বিশ্বের সঙ্কট কাটাতে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। এই হানাহানির পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতে এখন প্রয়োজন ‘কমনওয়েলথ অব কমিউনিটিজ’ গঠনের। তা বর্ণ, গোত্র, সম্প্রদায়, জাতি বা উপজাতি সব কিছুর ঊর্ধ্বে। আমরা মানবতার কথা বলছি। কিন্তু মানবতার শিক্ষা বা দীক্ষাটি কোথায়?

আজকে এই উপমহাদেশে যে উগ্রবাদের বিস্তার ঘটছে, তা মোকাবেলার জন্য ধর্মের মর্মবাণীগুলো আঁকড়ে ধরার গুরুত্ব অনেক বেড়েছে। এ অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার কারণ, মানুষকে ভালোবাসতে মানুষ ভুলে গেছে। এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য কমনওয়েলথ অব হিউম্যান কমিউনিটিজ গড়ে তোলা প্রয়োজন। এই বাংলা অঞ্চলেই ৬০০ বছর বৌদ্ধ শাসন ছিল। এই হিউম্যান কমিউনিটি গড়ে তোলার মূল চেতনা হলো, উগ্রবাদ পরিহার করো। তোমার আসল পরিচয়, তুমি মানুষ। এই পরিচয় তো কেউ অস্বীকার করেনি। আমরা নিজেদের ‘সভ্য’ বলে দাবি করছি, কিন্তু কাজ করছি অসভ্যের মতো। উগ্রবাদিতা মানবজাতির কলঙ্ক। সভ্যতার শীর্ষে পৌঁছার পর এখন আমরা উগ্রবাদকে প্রশ্রয় দিচ্ছি। আমরা যদি মানুষকেই ভালোবাসতে না পারি, তাহলে ধর্ম চর্চা করে কী হবে? তাই বলছি, বাংলাদেশের মতো ছোট অথচ বৈচিত্র্যময় ধর্মের মানুষের বসবাসের এই ভূখণ্ড থেকেই কমনওয়েলথ অব হিউম্যান কমিউনিটির যাত্রা শুরু হতে পারে।

রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে কেন এই নৃশংসতা? ১৯৩৫ সালেও বার্মা বা মিয়ানমার ছিল ব্রিটিশ ভারতের অংশ। অর্থাৎ আমাদের দেশের অংশ। শ্রীলঙ্কাও তাই ছিল। আমরা ব্রিটিশকে তাড়িয়েছি ঠিকই, কিন্তু সভ্য হতে পারিনি। এর পেছনে দায়ী জাতিরাষ্ট্র। আমার সীমানা, আমার রাজ্য, আমার শাসনক্ষমতা- এসবই আজ যত সমস্যার সৃষ্টি করছে। জাতিরাষ্ট্রের ধারণা ইউরোপ থেকে এসেছে। এটা কোনো বৌদ্ধ, মুসলমান বা হিন্দু ধর্মের ধারণা নয়; কোনো হিউম্যান কনসেপ্ট নয়। তাই বলে এই জাতিরাষ্ট্রের ধারণা রাতারাতি বদলে দেয়া সম্ভব নয়। তবে সব ধর্মের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে তাদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, সহিষ্ণুতা সৃষ্টির কাজ আমরা করতে পারি।

আজকে জাতিরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিছু বললে অনেকে হয়তো বাঁকা চোখে দেখতে পারেন, কিন্তু আমরা তো মুক্তচিন্তা করতে পারি; ভালোবাসার বার্তা দিতে পারি। প্রতিহিংসা শুধু প্রতিহিংসারই জন্ম দেয়, ঘৃণা থেকে ভালোবাসার জন্ম হয় না। ভালোবাসার জন্ম হয় ভালোবাসা থেকেই। বিদ্বেষ, বিভাজন কখনো শান্তি আনতে পারে না। ইতিহাস বলে, ভালোবাসার মধ্যেই শান্তি নিহিত। শান্তি আছে ত্যাগ ও ক্ষমায়।

আমাদের বাংলাদেশে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, উপজাতিসহ অনেক সম্প্রদায় ও গোত্রের মানুষ আছে। তাদের আছে নিজস্ব সংস্কৃতি। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে আমরা কমনওয়েলথ অব হিউম্যান কমিউনিটিজ গঠন করতে পারি। এখানে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের মানুষ অংশ নিতে পারেন। এই কমনওয়েলথের বাণী হবে শান্তি ও ভালোবাসা। সৃষ্টিকর্তা আমাকে মুসলিম পিতামাতার ঘরে না পাঠিয়ে, হিন্দু বা খ্রিষ্টান পিতামাতার ঘরেও পাঠাতে পারতেন। তাই একটি ধর্মীয় তকমা থাকলেই কি আরেকজনকে ঘৃণা করতে হবে? আমার আসল পরিচয় মানুষ, হিউম্যান। আমরা এই ভালোবাসা বিস্তারের কাজটি শুরু করছি না কেন? আমরা উগ্রবাদের বিরুদ্ধে, মানুষকে ভালোবাসার বাণী ছড়াতে পারি। লেট আস বিগিন ‘চ্যারিটি অ্যাট হোম’।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা
hmct2004@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement