২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

লক্ষ্য বনাম প্রক্রিয়া

- ফাইল ছবি

আমরা কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় ‘এন্ড’ বা চূড়ান্ত লক্ষ্যের সাথে ‘মিন্স’ অর্থাৎ প্রক্রিয়াকে গুলিয়ে ফেলি, যার ফলে ভালো এবং নৈতিক কাজ করার সময় দেখা যায়, ভুল ও অনৈতিক পথ অনুসরণ করেছি। মনে মনে এটাকে বৈধ করে নেই এই ভেবে যে, আমাদের চূূড়ান্ত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তো সঠিক তাই সৎ, সোজা পথের বদলে না হয় ‘একটু বাঁকা’ পথেই গেলাম, তাতে অসুবিধাটা কী? কাজটা যে সহজে তাড়াতাড়ি হয়ে গেল। আমরা অনেক সময় বুঝি, আবার কোনো সময় বুঝতে চাইও না; কিন্তু এর অসুবিধা আছে বৈকি। একটা নয়, বরং দুটো অসুবিধা। প্রথমত, এটা বেআইনি এবং নিয়মনীতিবিরোধী। যা বেআইনি, তা-ই বর্জনীয়। দ্বিতীয়ত, একজনকে অনৈতিক পথে পা বাড়াতে দেখলে আরো দশজন এ পথে চলতে উদ্যোগী হতে পারেন এবং তারা সবাই যে সৎ লক্ষ্য ও গন্তব্যে পৌঁছাতে চান, তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? নেই। তাই সঠিক কাজটা, সঠিক সময়ে, সৎ উদ্দেশ্যে, শুদ্ধ পন্থায় করা উচিত। এখানে যেকোনো ধরনের ব্যত্যয় অবাঞ্ছিত অযাচিত ও অপ্রত্যাশিত। সব সময় আমাদের মনে রাখা উচিত, কাজের শেষ ফলটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি কিভাবে কাজটা সম্পন্ন করা হলো, সেটাও সামান্য বিষয় নয়।

সমস্যাটা পাঠকদের সামনে আরেকটু খোলাসা করে তুলে ধরার জন্য একটা গল্পের আশ্রয় নিতেই হচ্ছে। গল্পটা পশ্চিমা দুনিয়ায় খুব মশহুর। এটি বিশেষ করে একটি কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। প্রায় সব সরকারি-বেসরকারি অফিসের ‘ইক্যুয়াল অপরচুনিটি ও অ্যাফারম্যাটিভ অ্যাকশন বিভাগ’ সততা, সদাচরণ ও নীতিনৈতিকতার স্বপক্ষে এ কাহিনীকে একটি মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে অহরহ কাজে লাগিয়ে থাকে। এতে তিনজন পেশাজীবী জড়িত। বিপদে পড়ে কখন কোনো পেশাজীবীর দ্বারস্থ হতে হয় তার কোনো ঠিক নেই, তাই ইচ্ছে করে এ গল্পে কোনো পেশার নামই উল্লেখ করছি না। এতে গল্পের সৌন্দর্যে, সম্পূর্ণতায় কিংবা তার মর্মার্থে কোনো ঘাটতি হবে না। যারা গল্পটি শুনেছেন তারা তো জানেনই, আর যারা শোনেননি তারা যদি প্রাইভেটলি আমার কাছে জানতে চান তাহলে আমার প্রতিশ্রুতি রইল, আপনাদের ইমেল মারফত সংশ্লিষ্ট তিনটা পেশারই নাম গোপনে জানিয়ে দেব।

একবার এক ধনাঢ্য ব্যক্তি মৃত্যুশয্যায় শায়িত। তিনি বুঝতে পারলেন, তার আর বেশি সময় নেই, যেকোনো মুহূর্তে আজরাইল আ: তার জান কবজ করতে পারেন। এরকম অবস্থায় তিনি তার খুব ঘনিষ্ঠ তিন বন্ধুকে ডেকে পাঠালেন। যখন তারা এলেন, তাদের প্রত্যেকের হাতে এক লাখ ডলারের একটা করে প্যাকেট তুলে দিয়ে বললেন, ‘বন্ধুরা, তোমাদের সাথে হয়তোবা আমার আর দেখা হবে না, কথাও হবে না। মৃত্যুর পর ওপারে আমার ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে, জানি না। তোমাদের প্রতি আমার বিনীত অনুরোধ, আমার মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার সাথে সাথে তোমরা এখানে ছুটে আসবে এবং আমার শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করবে। তার আগে আমার কফিনের ভেতর টাকাসহ এই প্যাকেটগুলো গুঁজে দেবে। আশা করি এতে করে কবরে আমার টাকা-পয়সার কোনো অসুবিধা হবে না।’ তিনজনই মুমূর্ষু বন্ধুকে এই বলে আশ্বস্ত করলেন, ‘প্রিয় বন্ধু, তুমি কোনো চিন্তা করো না। আমরা তোমার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব।’ এই বলে তিন বন্ধু টাকা নিয়ে বাড়ি চলে গেলেন। দু’দিন পরই এ রোগীর মৃত্যু হলো। মৃত্যু সংবাদ শোনে তিন বন্ধু যথারীতি যার যার প্যাকেট হাতে এসে হাজির হলেন। মৃত বন্ধুর দাফন-কাফনে শরিক হলেন।

বন্ধুর কথামতো তারা প্যাকেটগুলো কফিনে গুঁজে দিয়ে লাশের সৎকার সেরে একসাথে তিনজনই বাড়ি ফিরছিলেন। যেতে যেতে তাদের মধ্যে কথা হচ্ছিল, প্রথম বন্ধু বললেন, ‘এ মুহূর্তে আমার মধ্যে একটা দারুণ অপরাধবোধ কাজ করছে। তোমাদের না বলা পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছি না। আমি কিন্তু পুরো এক লাখ ডলার দেইনি। দিয়েছি মাত্র ২০ হাজার, বাকি ৮০ হাজার আমাদের বাড়ির কাছের হাসপাতালে ‘গরিব রোগীদের চিকিৎসা ফান্ডে’ দান করে ফেলেছি। আমার যুক্তি, সব টাকাই তো মাটির নিচে পোকামাকড়ের পেটে যাবে, অন্তত কিছুটা মানুষের কাজে লাগল।’ দ্বিতীয় বন্ধু বললেন, ‘আমিও একই ধরনের কাজ করেছি, আমি ৫০ হাজার দিয়েছি’ বাকিটা আমাদের চার্চের গৃহহীনদের জন্য রিলিফ ফান্ডে জমা দিয়েছি। কারণ হিসেবে তিনি প্রথমজনের মতো একই যুক্তি দেখালেন। তৃতীয় বন্ধু বললেন, ‘তোমরা তো ভারী অন্যায় কাজ করে ফেলেছ। মৃত বন্ধুর শেষ ইচ্ছে পুরোপুরি পূরণ করোনি। কথা দিয়েও কথা রাখোনি। আমার কথা আমি ষোলোআনা রক্ষা করেছি। পুরো টাকাটাই দিয়েছি। আমার ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিপরীতে এক লাখ ডলারের একটা চেক বন্ধুর নামে লিখে সই করে প্যাকেটে ভরে কফিনে গুঁজে দিয়েছি।’ নগদ না দিয়ে চেক দেয়ার কারণস্বরূপ প্রথম দু’জনের মতো তিনি কোনো যুক্তি দাঁড় করালেন না।

ক্লাসে এই গল্পটি বলার পর ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে প্রশ্ন করি, আচ্ছা, বলো তো, এখানে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিবাজ কে? বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উত্তর আসে, ‘তৃতীয় বন্ধু’; কারণ তিনি পুরো টাকাটাই সাবাড় করে ফেলেছেন। অতএব, তিনিই সবচেয়ে বেশি লোভী, বড় অপরাধী। এসব কথাই ঠিক, তথাপি সংজ্ঞার মারপ্যাঁচে কোনো বন্ধুই দুর্নীতি করেননি। অর্থাৎ আদৌ কোনো দুর্নীতি হয়নি। দুর্নীতির সাথে রাষ্ট্র ও সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার জড়িত। এখানে সেরকম কিছু নেই, তাই তো তিন বন্ধুর নয়ছয়কে আর যা-ই বলি না কেন, ‘দুর্নীতি’ বলতে পারি না, বরং যা হয়েছে তা হলো সততা, সদাচরণ ও নীতিনৈতিকতার চরম বরখেলাপ।

প্রথম ও দ্বিতীয় বন্ধু যদি সাচ্চা বাত বলেও থাকেন, তাহলে বলতে হয় তারা তাদের বন্ধুর বেশ কিছু টাকা নিশ্চিতভাবেই অপচয়ের হাত থেকে বাঁচিয়ে গরিবের উপকারে লাগিয়েছেন। তারপর আমার শাগরেদদের প্রতি দ্বিতীয় ও তৃতীয় সওয়াল একসাথে ছুঁড়ে দেই, ‘এবার বলো দেখি, বন্ধুর কাছ থেকে তিন বন্ধু তিন লাখ ডলার নিয়ে যা করলেন তাকি ঠিক হলো? যদি না হয়ে থাকে তাহলে তাদের কী করা উচিত ছিল?’ দু’নম্বর প্রশ্নের দু’ধরনের উত্তর পাই। এক দল বলে, ‘উদ্দেশ্য যখন খাঁটি, পন্থায় একটু গলতি হলেই বা কী, এটা ঠিক আছে।’ আরেক দল বলে, ‘না, কাজটি একবারেই দুরস্ত হয়নি। ‘দি অ্যান্ড ডাজ নট জাস্টিফাই মিন্স’। তৃতীয় প্রশ্নের জবাবে আমার শিক্ষার্থীরা মাসুম বাচ্চার মতো আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। এবার আসি শেষ প্রশ্নে; বলো তো, ধনাঢ্য ব্যক্তিটি মৃত্যুর আগে সচেতনভাবে এরকম তিন লাখ ডলার হাতছাড়া করে গেলেন কেন? এখানেও আমার প্রিয় ছাত্রছাত্রীরা নিশ্চুপ, লা-জওয়াব!

গল্পটাকে কোনো বন্ধুর বিরুদ্ধে ব্যবহার না করে আমরা যদি এটাকে সততা ও নীতিনৈতিকতার মানদণ্ডে বিচার করি, তাহলে দেখা যাবে, এখানে আমাদের জন্য বেশ কিছু শিক্ষণীয় বিষয় রয়ে গেছে। প্রথমত, আমরা জানলাম, দুর্নীতি কী এবং জানলাম যে, এখানে কোনো দুর্নীতি হয়নি। দ্বিতীয়ত, তৃতীয় বন্ধু যা করেছেন, তা তো রীতিমতো বাটপারি। আর প্রথম ও দ্বিতীয় জন যদি সত্য কথা বলেও থাকেন, তথাপি তারাও যা করেছেন তার কোনোটাই ঠিক হয়নি; তা নৈতিকতার বিচারে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ ‘পরের টাকায় পোদ্দারি’ কোনো সৎ ও নীতিবান লোক করতে পারেন না।

এবার আসি তৃতীয় প্রশ্নে, এমতাবস্থায় তাদের কী করা উচিত ছিল? পুরো তিন লাখ ডলার নগদ কফিনে গুঁজে দেয়া? অবশ্যই না। প্রথমত, উচিত ছিল, জেনেশোনে এভাবে টাকা গ্রহণ না করা। মুমূর্ষু রোগীর প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে তিন বন্ধু একযোগে বলতে পারতেন, ‘কফিনের সাথে টাকা নিয়ে কবরে যাওয়া বিরাট পাগলামি ছাড়া কিছু নয়। এটা করা উচিত নয় মোটেও। আর যদি তুমি নেহায়েত এমন কাজ করতেই চাও, তাহলে তোমার ছেলেমেয়ে বা ওয়ারিশ যারা আছেন, তাদেরই করতে বলো; আমরা এর মধ্যে নেই। বন্ধু, তোমার টাকা তুমি রেখে দাও। আমরা গেলাম। মৃত্যু সংবাদ পেলে এসে যথারীতি তোমার সৎকার করে যাবো। এ জন্য কোনো টাকা-পয়সার দরকার হবে না।’ টাকা নিয়ে বাড়ি যাওয়ার পরও যদি তাদের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদ্রেক হতো, তাহলে তারা দাফন-কাফনের সময় টাকাগুলো মৃত ব্যক্তির সন্তান অথবা তার ওয়ারিশদের হাতে তুলে দিয়ে বলতে পারতেন, এ টাকা তোমাদের প্রাপ্য, তোমরা নিজেদের পছন্দমতো এটাকে কাজে লাগাও।

অর্থাৎ চূড়ান্ত লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য ভালো হলেই একটা কাজ সঠিক এবং ভালো হতে পারে না, হয় না। ভালো কাজ, ভালো উদ্দেশ্যে, সময়মতো, ভালো ও নির্ভেজাল কায়দায়ই করতে হয়। সব শেষে আসি শেষ প্রশ্নে। এটুকুই বলব, আলোচ্য গল্পটি ‘গল্প’ হিসেবে চমৎকার এবং এখানে আমাদের জন্য শেখার অনেক উপাদান আছে। তথাপি এ কথাটি ভুলে গেলে চলবে না যে, এটি নিছক একটি কল্পকাহিনী। কোনোকালে কোনো দেশে একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি তার মনের মাধুরী মিশিয়ে গল্পটি রচনা করেছেন। বাস্তবে কোথাও এ রকম হয়তো ঘটেনি।

পুনশ্চ : ক্ষমা করবেন, আমার বকবকানি শেষ হয়েও হচ্ছে না শেষ। আরো দুটো কথা বাকি রয়ে গেছে। ১. আধুনিক জমানায় পুরোদস্তুর অবাস্তব হলেও এ কথা সত্য- প্রাগৈতিহাসিক আমলে রাজা-বাদশাহরা কবরে সোনা-দানা, টাকা-পয়সা ইত্যাদি নিয়ে যেতেন। ২. শেষের অনুচ্ছেদে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ একান্তই আমার মনের মতো করে আপনাদের সামনে হাজির করেছি। এতে আপনারা একমত হতে পারেন, নাও হতে পারেন।

লেখক : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি; এডিটর- জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ
E-mail : wahid2569@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement