১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অসুস্থ বেগম জিয়া ও মানবিক আচরণ

অসুস্থ বেগম জিয়া ও মানবিক আচরণ - ছবি : সংগ্রহ

বাংলাদেশের তিনবারের নির্বাচিত, সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপি চেয়ারপারসন গুরুতর অসুস্থ বেগম খালেদা জিয়াকে অবশেষে রাজধানীর বিএসএমএমইউ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দীন রোডের পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে সোমবার দুপুর সোয়া ১২টায় তাকে এই হাসপাতালে আনা হয়েছে। নতুন করে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়নি। তবে সরকার কর্তৃক গঠিত মেডিক্যাল বোর্ডের সদস্যরা তার সাথে দেখা করে অসুস্থ সম্পর্কে বিস্তারিত শুনেছেন এবং তাকে পর্যবেক্ষণ করে ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন। হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে মাহবুবুল হক সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়ে বলেছেন, খালেদা জিয়ার ডায়াবেটিসের মাত্রা বেশি; খাওয়ায় অরুচি আছে। তার ঘুমও কম হচ্ছে। নিজে হাঁটাচলা করতে পারেন না, অন্যের সাহায্য নিয়ে তাকে হাঁটতে হয়। তার হাত ও পায়ে ব্যথা রয়েছে। পরিচালক আরো জানান, বেগম জিয়ার স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ ও চিকিৎসার জন্য একজন চিকিৎসক প্রতিদিন নিয়োজিত থাকবেন। চিকিৎসার খোঁজখবর নেয়ার পাশাপাশি তার শারীরিক অগ্রগতি সম্পর্কে প্রতিবেদন দেবেন।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছেন না। তার শারীরিক অবস্থা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। আমরা বারবার দাবি জানিয়ে আসছি, তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য অবশ্যই বিশেষায়িত হাসপাতালে পাঠানো হোক। সেখানেই সিদ্ধান্ত হতে পারে, তার ট্রিটমেন্ট কিভাবে হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘বিএসএমএমইউতে তাকে এমনভাবে যেন রাখা না হয়, যাতে তিনি মনে করেন যে, বন্দী অবস্থায় তার চিকিৎসা হচ্ছে।

বেগম খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ। অসুস্থ অবস্থায়ই এক বছর আগে তাকে জেলে নেয়া হলো। রাখা হয়েছে পরিত্যক্ত কারাগারের স্যাঁতস্যাঁতে কক্ষে। এই নির্জন কারাগারে তিনিই একমাত্র বন্দী। জেলে নেয়ার পর চিকিৎসায় সরকারের অবহেলার কারণে তার অসুখের মাত্রা বেড়ে যায়। রোগের নতুন নতুন উপসর্গ দেখা দেয়। একপর্যায়ে খালেদা জিয়া নিজেই আদালতে তার শারীরিক অবস্থার কথা জানাতে বাধ্য হন। দল থেকেও বারবার তার শারীরিক অবনতির কথা তুলে ধরা হয়। এ অবস্থায় গত অক্টোবর মাসে তাকে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই চিকিৎসা অসমাপ্ত রেখে তড়িঘড়ি করে তাকে কারাগারে ফিরিয়ে নেয়া হয়। এভাবে গত ৩০ ডিসেম্বর সবচেয়ে বিতর্কিত সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে তাকে অযোগ্য ঘোষণা করে সম্পন্ন করা হয় এ নির্বাচন। কারাগারে বেগম জিয়ার অসুখের মাত্রা অনেক বেড়ে গেলে বিএনপির পক্ষ থেকে আবারও সংবাদ সম্মেলন করা হয় এবং কয়েকবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে দেখা করে চিকিৎসার দাবি জানানো হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সরকার গঠিত মেডিক্যাল বোর্ড পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে। অধ্যাপক ডা: আবদুল জলিল চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন মেডিক্যাল বোর্ড ২৫ ফেব্রুয়ারি যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তাতে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের মারাত্মক অবনতির চিত্রই ফুটে ওঠে। এতে বলা হয়, তার শরীরের বিভিন্ন অংশ ব্যথায় আক্রান্ত। তিনি অন্যের সাহায্য ছাড়া দাঁড়াতে কিংবা চলতে পারেন না।

তার বাম কাঁধে ব্যথা বাড়ার পাশাপাশি তিনি বাম কাঁধ ঠিকমতো নাড়াতেও পারেন না। বাম বাহু, বাম পা এবং শরীরের অন্যান্য অংশে ব্যথায় তিনি অস্থির থাকেন। তার হাতের ‘গ্রিপ’ও দুর্বল হয়ে পড়েছে। চিকিৎসকেরা তার ‘কার্পাল টানেল সিনড্রোমের’ কথাও উল্লেখ করেন। মেডিক্যাল বোর্ড তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেয়ার পরামর্শ দেয়। কিন্তু বোর্ডের সুপারিশের দীর্ঘ এক মাস চার দিন পর অবশেষে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী, একটি বড় দলের চেয়ারপারসন এবং ৭৪ বছর বয়সী প্রবীণ একজন নারীর প্রতি এই অমানবিক আচরণ এবং এক ধরনের নিপীড়নের দ্বিতীয় কোনো নজির নেই। দেশের স্বার্থের জন্য, জনগণের কল্যাণের জন্য এবং গণতন্ত্রের জন্য জীবনের একটি বড় অংশ তিনি বিসর্জন দিয়েছেন। এর প্রতিদান হিসেবে এটাই কি তার প্রাপ্য? বেগম জিয়ার স্বামী জিয়াউর রহমান প্রথম বাঙালি সৈনিক, যিনি তদানীন্তন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার এবং জেড ফোর্সের অধিনায়ক।

বেগম খালেদা জিয়া নিজে দুই শিশুপুত্রকে নিয়ে একাত্তরের বন্দিশিবিরে বন্দী ছিলেন। ১৯৮৯ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়ার শাহাদাতের কিছু পর তিনি রাজনীতিতে আসার ৩৭ বছর পূর্ণ হয়েছে। এর মধ্যে বিএনপির চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘ ৩৫ বছর। স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে তিনিই গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন এবং নব্বইয়ে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র মুক্তি পায়। তিন তিনবার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে যমুনা সেতুর মতো বড় বড় উন্নয়ন কাজ তার নেতৃত্বেই হয়েছে। দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীকে আত্মকর্মসংস্থানমূলক প্রকল্পে তিনিই জড়িত করেছেন নানা ধরনের স্বকর্মসংস্থানমূলক প্রকল্প চালু করে।

বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে বেগম জিয়ার অবদান অতুলনীয়। আজ ঘরে ঘরে মেয়েরা শিক্ষিত হচ্ছে তার নেয়া কর্মসূচির ফলেই। নারী সমাজের উন্নয়নে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ‘এক-এগারো’ সরকারের বিরাজনীতিকরণ ষড়যন্ত্রও তিনি নস্যাৎ করে দেন এবং ওই সরকারকে জরুরি অবস্থা তুলে নিতে বাধ্য করেন।

দেশপ্রেমের অনন্য নজির স্থাপনকারী বেগম খালেদা জিয়া এসব কারণে ষড়যন্ত্রকারীদের চক্ষুশূল। তারা তাই তাকে কৌশলে শেষ করে দিতে চায়। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে যেভাবে তারা সরিয়ে দিয়েছিল, ঠিক তেমনি বেগম খালেদা জিয়াকেও সরিয়ে দিতে চায়। তারা চায় জিয়া পরিবার যেন শেষ হয়ে যায়। তাদের ধারণা, তাহলেই বিএনপি ছারখার হয়ে যাবে এবং বাংলাদেশ তাদের হাতের পুতুল হয়ে থাকবে। এ জন্য বেগম জিয়া আজ ভয়াবহ প্রতিহিংসার শিকার। একটি ভিত্তিহীন মামলায় জড়িয়ে তাকে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। অথচ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের লেনদেনের সাথে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। তা ছাড়া যে দুই কোটি টাকা নিয়ে এই মামলা, সেই দুই কোটি টাকার একটি টাকাও খরচ হয়নি। সেই টাকা ব্যাংকে তিন গুণ বেড়ে ছয় কোটি টাকারও বেশি হয়েছে। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে ‘শাস্তি’ পাচ্ছেন বেগম জিয়া। এই মামলায় উচ্চ আদালত থেকে তার জামিন হলেও নানা টালবাহানা করে একের পর এক মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে তাকে জেলে বন্দী করে রাখা হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। তার বিরুদ্ধে মামলা এখন ৩৪টি।

দেশের মানুষ আজ বেগম জিয়াকে নিয়ে শঙ্কিত। তাদের আশঙ্কা, সরকার তার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ মাত্রায় প্রতিহিংসা চরিতার্থ করছে। এমন কি, অনেকে মনে করেন, তাকে হয়তো জেল থেকে জীবিত বের হতে দেয়া হবে না। সোমবার তার জন্য দোয়ার আয়োজন করেছে বিএনপি। এ অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেন, সরকার খালেদা জিয়াকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এদিকে সরকারি মহলের ইন্ধনে তার সম্পর্কে বিভ্রান্তিও ছাড়ানো হচ্ছে। কোনো কোনো পত্রিকা ও অনলাইন পোর্টালে প্রকাশ করা হচ্ছে যে, প্যারোলে মুক্তি দিয়ে তাকে সৌদি আরব পাঠানো হচ্ছে। আবার কোথাও বলা হচ্ছে, বেগম জিয়াকে প্যারোলে মুক্তি দেয়া হবে যাতে বিএনপি থেকে নির্বাচিত সদস্যরা সংসদে যান। খালেদা জিয়ার সুনাম ক্ষুণœ করার জন্য তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার এবং কুৎসাও ছড়ানো হচ্ছে।

কিন্তু ক্ষমতাসীনদের বোঝা উচিত ক্ষমতা কখনো কারো চিরস্থায়ী নয়। প্রতিহিংসার ফল কখনোই ভালো হয় না। দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। সব প্রতিষ্ঠানেই চলছে এক ধরনের অস্থিরতা। সর্বত্র নৈরাজ্য। এ দুঃসহ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে এবং স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে সব ধরনের প্রতিহিংসা ত্যাগ করতে হবে। চোখের সামনেই উদাহরণ রয়েছে। মমতা ও ভালোবাসার কী প্রবল শক্তি সেটা দেখিয়ে দিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের তরুণ প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন। বিশ্বের দেশে দেশে আজ তিনি আলোচিত ও প্রশংসিত। তার বিরল নেতৃত্বের প্রশংসা করছে সবাই। শুধু উদারতা ও ভালোবাসা দিয়ে তিনি সবার মন জয় করে নিয়েছেন। অভাবনীয় একটি বড় সঙ্কট তিনি মোকাবেলা করেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কিংবা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মতো চরম ও একগুঁয়েমির পথে তিনি হাঁটেননি। সে পথে হাঁটলে তিনি সফল হতেন না। বরঞ্চ সঙ্কট আরো বাড়ত।

জেসিন্ডা আরডার্ন একজন শ্বেতাঙ্গ নারী। ইচ্ছা করলে, ক্রাইস্টচার্চে শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীর পৈশাচিক কাজটি তিনি দেখেও না দেখার ভান করতে পারতেন। এতে ইসরাইলসহ পাশ্চাত্যের ক্ষমতাশালী অনেকের সমর্থনও তিনি পেতেন। কিন্তু ওই জঘন্য অপকর্মে তিনি জড়াননি। মানবতাকে তিনি বড় করে দেখেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুলের ভাষায়, আজ তাই তিনি ‘ট্রু মাদার অব হিউম্যানিটি’ অর্থাৎ ‘সত্যিকারের মানবতার মাতা’ হতে পেরেছেন। বিশ্বে নানা প্রান্তের মানুষ তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করার দাবি তুলেছেন। তথাকথিত শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের ষড়যন্ত্রে হয়তো এ পুরস্কার তিনি পাবেন না। কিন্তু একজন প্রকৃত মানবতাবাদী ও শান্তিকামী হিসেবে তার নাম থাকবে মানুষের হৃদয়জুড়ে।

ঘৃণার সংস্কৃতি নয়, প্রতিহিংসার নীল ছোবল কিংবা বিভাজনের অপরাজনীতি নয়। মানুষকে ভালোবাসা দিয়ে জয় করতে হবে। বেগম খালেদা জিয়া একজন অসাধারণ মানুষ, বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একজন অসামান্য নেত্রী, এ দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। সনির্বন্ধ অনুরোধ, তাকে আর কষ্ট দেবেন না, প্রতিহিংসায় দগ্ধ করবেন না। তিনি ভীষণ অসুস্থ। তার বয়সটার কথা ভাবুন। এই বয়সে প্রতিটি মানুষই একটু শান্তি চান। তাকে মুক্তি দিন অবিলম্বে। মুক্তি দিয়ে অসুস্থ খালেদা জিয়াকে নিজের মতো করে চিকিৎসা করার সুযোগ দিন।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক


আরো সংবাদ



premium cement
১ হাজার টাকার জন্য পেশাদার ছিনতাইকারীরা খুন করে ভ্যানচালক হারুনকে দেশের মানুষ পরিবর্তন চায় : মতিউর রহমান আকন্দ টানা ১১ জয়ে ডিপিএলের প্রথম পর্ব শেষ করলো আবাহনী দেশে করোনায় আরো একজনের মৃত্যু উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনের অংশ নিতে মানা সবল-দুর্বল ব্যাংক একীভূত করার কাজ শেষ হতে কত দিন লাগবে? জনগণের শক্তির কাছে আ'লীগকে পরাজয় বরণ করতেই হবে : মির্জা ফখরুল টাইম ম্যাগাজিনের ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় মেরিনা তাবাসসুম বিএনপি নেতারা সন্ত্রাসীদের সুরক্ষা দেয়ার অপচেষ্টা করছে : ওবায়দুল কাদের ট্রাকচাপায় নিহত ১৪ : তদন্ত কমিটি গঠন, চালক-হেলপার গ্রেফতার নেতানিয়াহুর একগুঁয়েমির কারণে মধ্যস্তকারীর ভূমিকা থেকে সরে যাবে কাতার!

সকল