১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বিদেশী মিডিয়ার নির্বাচনী কাভারেজ

-

বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন শেষ হয়েছে। সেই সাথে শেষ হয়েছে এ নিয়ে ইতি-নেতি বিভিন্ন উচ্ছ্বাসও। এই নির্বাচনে বিদেশী মিডিয়ার নজর পড়া যথেষ্টই ছিল বলা যায়। নির্বাচন কাভার করতে এসে তাদের তৎপরতা শুরু হতে দেখা গিয়েছিল নির্বাচনের আগে-পরে মিলিয়ে মোট প্রায় দশ দিনের মতো, যা এখন আস্তে আস্তে কমে আসছে বা নেই।

নির্বাচনের আগে বা ফল প্রকাশের পরে বিদেশী মিডিয়া বিশেষ করে যারা অর্থনীতি-ফোকাসের মিডিয়া যেমন, লন্ডন ইকোনমিস্ট বা আমেরিকার ব্লমবার্গ- এদের রিপোর্ট হলো মুখ্যত জিডিপি-দেখাকেন্দ্রিক। আর এদের সাফাইয়ের সরল বয়ান কাঠামোটা হলো- বাংলাদেশের জিডিপি ভালো মানে, বাংলাদেশের উন্নয়ন হয়েছে, অতএব হাসিনা আবার জিতবে। এ ছাড়া অন্যরাও আছে যেমন, লন্ডনের গার্ডিয়ান, আমেরিকার ভোয়া, গ্লোবাল বার্তা সংস্থা রয়টার্স, দক্ষিণ ভারতের দ্য হিন্দু অথবা নিউইয়র্ক টাইমসের কলাম- এভাবে এরা সবাই অন্য যে বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছে তা হলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অধিকারহীনতার দুর্দশা। অর্থাৎ নাগরিক অধিকারের অভাব, গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা তথা বিরোধী দল বা সরকার-বিরোধীদের পালিয়ে বেড়ানো বা গ্রেফতার; আর নির্বাচনে সমান সুযোগ না পাওয়া ইত্যাদি। যদিও এই দ্বিতীয় তালিকার মিডিয়াগুলোও দ্বিতীয় পয়েন্ট হিসাবে ‘ভালো জিডিপি’ বিষয়টাকে সরকারের পুনর্বার জেতার ক্ষেত্রে প্লাস পয়েন্ট হিসাবে উল্লেখ করেছে। অর্থাৎ কমবেশি সব বিদেশী মিডিয়া যে তর্কের চক্কর তৈরি করে রিপোর্ট লিখেছে তা পশ্চিমের ভাষায়- ‘ডেমোক্রেসি বনাম ডেভেলপমেন্ট’-এর নির্বাচন। অর্থাৎ রাষ্ট্রে ‘নাগরিকের রাজনৈতিক অধিকার’ থাকা জরুরি নাকি ‘উন্নয়ন’ হলেই চলে- এতে ‘উন্নয়নের’ কারণে হাসিনার জেতা উচিত বা জিতবে। এই হলো বয়ান।

খুবই চাতুরী তর্ক সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই তর্কের আরেক রূপ অনেক পুরনো, সেই পাকিস্তান আমলের। আইয়ুব খানের শাসনের দশককে (১৯৫৮-৬৮) প্রশংসা আর সাফাই দিতে তখন যা বলা হতো ওর সার কথা হলো- পাকিস্তানের জন্মের পর থেকে ঠিকমতো ওর একটা কনস্টিটিউশন রচনা করতে সক্ষমতা না থাকলেও আইয়ুব খান প্রচুর উন্নয়ন করেছে। সুতরাং আইয়ুবের শাসন জায়েজ। পুরনো এই তর্কটাই এবার আবার বাংলাদেশে ভেসে উঠেছে। কিন্তু কবে থেকে? অনেকে আবার সেটা খেয়াল করেনিই হয়তো।

ব্যাপারটা ঘটেছিল গত ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচনে সরকার গড়ার পর। আসলে সে সময় হাসিনার ওই ‘বিশেষ নির্বাচন ও সরকারের’ পক্ষে একটা সাফাই দেয়া খুব জরুরি হয়ে পড়েছিল। তাই আমরা দেয়ালে চিকা মারা দেখেছিলাম যে ‘হাসিনা হলেন বাংলাদেশের মাহাথির’। মাহাথির এজন্য যে, মালয়েশিয়ার ‘উন্নয়নের’ প্রতীক মাহাথির, তবে নাগরিকের রাজনৈতিক অধিকারের নন। এ ছাড়া বাংলাদেশে এবারের নির্বাচন শুরুর এক বছর আগে থেকে উন্নয়নের স্লোগান দিয়েই হাসিনা ভোট বা পাবলিক মোকাবেলা বা তার সমালোচনা মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন।

সব জিনিসের বিকল্প হয় না, আমরা করি না। একটার বদলে অন্য একটা হলেও চলে এই অর্থে বিকল্প খুঁজি না বা সন্তুষ্ট হই না। মানুষের জীবন চাহিদায় এমন বহু কিছু বিষয় আছে। ইংরেজিতে এ রকম বিষয়টা বুঝাতে একটা শব্দ আছে ‘নন-নেগোশিয়েবল’। মানুষের জীবনের যেসব বিষয়ের বিকল্প হয় না বলে মনে করা হয়, বিকল্প খুঁজি না, সেগুলোই আসলে নন-নেগোশিয়েবল। যেমন ‘মায়ের ইজ্জত’ নিয়ে নেগোসিয়েশন চলে না, নন- নেগোশিয়েবল। ঠিক তেমন কোনো রাষ্ট্রে নাগরিকের রাজনৈতিক অধিকার, মৌলিক মানবিক অধিকার নন-নেগোশিয়েবল। বইয়ের ভাষা থুয়ে, ব্যাপারটা আরো ভেঙে বলা যাক। যেমন বলা হলো- রাষ্ট্র আপনাকে পেট পুরে খেতে দেবে, চাকরি আরাম আরো বহু কিছু দেবে এবং একদম নিশ্চয়তার সাথে। কিন্তু আপনি বেমালুম গুম, খুন হয়ে যেতে পারেন সে সম্ভাবনাও সাথে আছে; রাষ্ট্রের দিক থেকে সেসব থেকে কোনো সুরক্ষার নিশ্চয়তা নেই, প্রতিশ্রুতি নেই। এখন আপনি কি রাজি আছেন? এটাই উন্নয়ন দিয়ে নাগরিক রাজনৈতিক অধিকারকে নেগোশিয়েবল করা বা ভাবার প্রশ্ন। আসলে রাজনৈতিক অধিকারকে নেগোশিয়েবল করে ফেলা যায় মনে করা আর এর বিকল্প হিসাবে উন্নয়ন, জীবনমানের উন্নতিকে মুখ্য ও বিকল্প কাম্য মনে করা- এটাই ‘উন্নয়নের রাজনীতির’ ভাবনা।

বস্তুত নাগরিক রাজনৈতিক অধিকার নন-নেগোশিয়েবল। তাই এটা নেগোশিয়েবল বলে মনে করার সোজা মানে হলো আসলে রাষ্ট্রটাই নেই। কারণ রাষ্ট্র- এই প্রতিষ্ঠানের মুখ্য উদ্দেশ্য ও কাজ হলো নাগরিক রাজনৈতিক অধিকারের প্রতিশ্রুতি দেয়া, বাস্তবে এই সুরক্ষা দেয়া, প্রতিরক্ষা করা। রাষ্ট্র যদি তা না করতে পারে, না দেয় তাহলে সে রাষ্ট্র অপ্রয়োজনীয়, খামোখা। এর বদলে রাষ্ট্র হয়ে যায় তখন বড়জোর একটা পৌরসভা। কিন্তু রাষ্ট্র কখনই পৌরসভা নয়।

কাজেই কোনো দেশের নির্বাচনের আসরে এসে বিদেশী বা দেশী মিডিয়ায় সরকারের নাগরিক রাজনৈতিক অধিকার রক্ষার রেকর্ডের আলোচনাকে পেছনে ফেলা বা আড়াল করে ফেলাটা চাতুরী। জেনে বা না জেনে নাগরিক রাজনৈতিক অধিকারকে নেগোশিয়েবল বিষয় করে ফেলা- বিকল্প হিসাবে উন্নয়ন বা জিডিপির ফিরিস্তি তোলার মিডিয়া রিপোর্ট- এটা এক বিরাট চাতুরী। তারা অর্থনীতির লোক তাই রাজনীতি বোঝে না- এমন বুঝে নাই ভাব ধরে পিঠে ছুরি মারা।
অথবা এই চাতুরী যেন উট আর বিড়ালের গল্প। যেমন একবার এক হাটে এক উট বিক্রেতা উটের দাম চাচ্ছে মাত্র এক টাকা। কিন্তু শর্ত হলো ওই উটের সাথে একটা বিড়াল নিতেই হবে; যে বিড়ালের দাম পাঁচ লাখ টাকা।

এই ব্যাপারগুলো বিদেশী প্রভাবশালী মিডিয়াতেও এমন হচ্ছে, হয়। এর পেছনের কারণ, এই মিডিয়াগুলো মূলত আমাদের মতো দেশে দেখতে আসে বিদেশী ব্যবসায়ী বা বিনিয়োগকারীদের চোখ- এমন মিডিয়া হিসাবে। বিদেশী ব্যবসায়ী বা বিনিয়োগকারীদের পয়সাতেই তাদের আয় ও জীবিকা। তাই উন্নয়ন ও জিডিপি দিয়ে তাদের একটা নির্বাচন পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করার ঝোঁক দেখা যায়।
প্রকাশিত যাদের রিপোর্ট আমাদের নজরে এসেছে এদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী হিসেবে অনেকে ব্লমবার্গকে মনে করেন। তাদের রিপোর্টের সার কথাকে শুরুতে দেয়া দুই বুলেট বাক্য হলো- ১. দ্রুত বেড়ে চলা অর্থনীতি হাসিনাকে তৃতীয়বার ক্ষমতায় আনতে পারে। ২. বিরোধী নেতা জেলে বলে ভায়োলেন্স নতুন করে বাড়তে পারার শঙ্কা।

অর্থাৎ সরাসরি বলা হচ্ছে, রাজনীতিক অধিকারের দশা পরিস্থিতি নয়, জিডিপিই নির্বাচনে বিজয়ের একমাত্র নির্ণায়ক- এই আগাম অনুমানের ভিত্তিতে কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া এখানে আবার বলে রাখা ভালো যে, ব্লমবার্গ- এই মিডিয়া গ্রুপ না হলেও অন্য অনেকে আবার অনেক সময় ‘পেজ-বিক্রি’ করার কারণেও এমন রিপোর্ট করে থাকে।

কিন্তু তবুও জিডিপিভিত্তিক আগাম অনুমানের এমন রিপোর্ট- এটাও যথেষ্ট সাফাই নয় বলে মনে করা যেতে পারে। কারণ জিডিপি বাড়লেই তা সরকারের সাফল্য কি না, এর সপক্ষে এই রিপোর্টে কোনো সাফাই নেই। কারণ, বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের তাই জিডিপি বাড়া-কমা দিয়ে এর হদিস করা ভুল হওয়ার সম্ভাবনা। কারণ দেখা গেছে, বাংলাদেশে বছরে ১৭০ দিন হরতাল থাকলেও জিডিপিতে এর প্রভাব নেই। এর সম্ভাব্য কারণ বলা যেতে পারে, এ নিয়ে কোনো ফরমাল স্টাডি নাই। সে সম্ভাব্য কারণ রেমিট্যান্স। বিদেশে গরিব শ্রমিকের শ্রম বেচা অর্থ- বিদেশী মুদ্রা নিয়মিত আসা। আর বলা বাহুল্য, এর সাথে হরতালের সম্পর্ক নেই। এ ছাড়া আরেক গুরুত্বপর্ণ দিক হলো, ৯০ শতাংশের বেশি বৈদেশিক মুদ্রার আয় আসে গার্মেন্ট থেকে। এখন এর থেকে কাঁচামাল, মেশিনারিসহ ইত্যাদি বৈদেশিক মূল্য পরিশোধে বাদ দেয়ার পর যা নিট বৈদেশিক মুদ্রা আয় থাকে; দেখা যায় প্রতি বছর, সেটা আবার মোট রেমিট্যান্স আয়ের প্রায় সমান।

রেমিট্যান্স আয় লাভের সাথে সরকারের পারফরমেন্স খুব কিছু নেই। মূলত এ কারণে আমাদের অর্থনীতিকে বলা হয় রুটিন অর্থনীতি, মানে বিশেষ সরকারের খুবই বিশেষ ভূমিকা এখানে থাকে না। বিদেশি সাংবাদিকেরা এসব দিক আমল না করে যেকোনো দেশের মতো শুধু জিডিপি দেখে ধারণা বা অর্থনীতি বুঝতে চাওয়া তাৎপর্যহীন। তবে কোনো রিপোর্ট যদি জিডিপি ফিগারকে দেখিয়ে তা সরকারের প্রত্যক্ষ পারফরমেন্স বলে দাবি করতেই চায়, সে ক্ষেত্রে তাকে সম্পর্ক বা প্রমাণ দেখাতে হবে যে সরকারের অমুক বিশেষ নীতি-পলিসি-পদক্ষেপের কারণে জিডিপি বেড়েছে।
অতএব সার কথাটা হলো, জিডিপি বা উন্নয়নের সাফাই দিয়ে বিদেশি মিডিয়ার নির্বাচনী রিপোর্ট- এগুলো সারবত্তাহীন প্রপাগান্ডা।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com


আরো সংবাদ



premium cement