২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

স্বজন না হলেও আপন মানুষ ছিলেন

তরিকুল ইসলাম -

তিনি আমার স্বজন ছিলেন না। তার পরিবারের দ্বিতীয় কোনো সদস্যকেই আমি জানতাম না। তার সাথে আমার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা দীর্ঘ দিনের, তাও নয়। তবুও তিনি আমার আপন ছিলেন। তিনি আমার খোঁজ নিতেন, আমিও তার শারীরিক অবস্থার কারণে উদ্বেগের মধ্যে কাটাতাম। তিনি উচ্চ ডায়াবেটিক রোগী ছিলেন এবং প্রায়ই তাকে হাসপাতালে কাটাতে হতো। কিছুটা সুস্থ হয়ে ফিরে আসতেন। কিছু দিন পরই সংবাদপত্রে তার পুনরায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার খবর পাঠ করতাম। এবার হাসপাতালে গিয়ে তিনি আর ফিরে এলেন না। ডায়াবেটিসের সাথে দীর্ঘ লড়াইয়ে তিনি হেরে গেলেন এবং গত ৪ নভেম্বর পাড়ি জমালেন পরলোকে। খবরটি জানার পর ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন (নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর কাছ থেকেই এসেছি এবং আমাদের তার কাছেই ফিরে যেতে হবে), উচ্চারণ করেছি। আমরা কেউ সুনির্দিষ্টভাবে জানি না কত দিন এ নশ্বর পৃথিবীতে বেঁচে থাকব। যত দিন বেঁচে থাকব, আমাদের পথে যে দুর্ভোগ ও যাতনা আসবে; আমরা তা-ও জানি না। আমরা বেঁচে থাকি আশা নিয়ে এবং সাধ্যমতো কোনো উদ্দেশ্য সাধনের জন্য। আমাদের নিয়ে সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনার কথা আমরা জানি না। এসব বাস্তবতা সত্ত্বেও তরিকুল ভাই তার কর্মজীবনের প্রতিটি দিন দেখাতে চেষ্টা করেছেন, তিনি মানুষের কতটা কাছের এবং তাদের ব্যাপারে কতটা মনোযোগী।

যে প্রিয়জনের চিরবিদায়ে আমরা কাঁদি, তরিকুল ইসলাম সে ধরনের ব্যক্তিত্ব ছিলেন। কারণ, তিনি সব ধরনের অহমিকার ঊর্র্ধ্বে ছিলেন। রাজনীতি অনেক শত্রু সৃষ্টি করে, কিন্তু তিনি অজাতশত্রু ছিলেন। তার রাজনীতি ছিল দেশের জন্য, মানুষের জন্য, বন্ধু সৃষ্টির জন্য; সম্পদ আহরণ ও ক্ষমতার দাপট দেখানোর জন্য নয়। তার জীবনাবসানে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারিনি। নিরহঙ্কারী, সহজ-সরল এই প্রিয় মানুষটিকে আর কখনো দেখতে পাবো না। স্নেহাস্পদ হারুনের কাছে আর জানতে চাইব না, ‘তরিকুল ভাই কেমন আছেন?’ হারুনও আর বলবে না, ‘তরিকুল ভাই আপনাকে সালাম দিয়েছেন।’

প্রায় ৯ বছর আগে দেশ ছেড়ে চলে আসার পর তার সাথে টেলিফোনে কথা হয়েছে মাত্র এক দিন। হয়তো নিয়মিতই তার সাথে কথা বলা উচিত ছিল। কিন্তু তার সাথে কথা বলতে বিব্রত বোধ করতাম। কারণ, তার অবস্থান ও জ্যেষ্ঠতার ব্যত্যয় ঘটিয়ে আমাকে ‘মঞ্জু ভাই’ বলে সম্বোধন করতেন। হয়তো তার আচরিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণেই এ কাজটি করতেন। এমনকি তিনি তথ্যমন্ত্রী থাকাকালে তার মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন তথ্য অধিদফতরের প্রধান তথ্য অফিসার (পিআইও) খন্দকার মনিরুল আলম এবং বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) প্রধান সম্পাদক আমানুল্লাহ কবীরকেও ‘ভাই’ বলেই ডাকতেন। অন্যরা বিষয়টিকে কিভাবে গ্রহণ করতেন জানি না; কিন্তু আমি আসলেই যথেষ্ট বিব্রত বোধ করে একাধিকবার তাকে অনুরোধ করেছি আমার নাম ধরে ডাকতে। কিন্তু তিনি তা করেননি।

চার দশক আগে ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে যখন তরিকুল ইসলাম শপথ নিতে আসেন, তখন তাকে প্রথমবার দেখি একজন তরুণ সংসদ সদস্য হিসেবে। ৩২-৩৩ বছর বয়স ছিল তার। প্রথমবার নির্বাচিত নবীন সংসদ সদস্য হিসেবে তখন তার সংসদীয় রীতিনীতি শেখার বয়স। সংসদে যদিও অনেক হাসি-মশকারার ব্যাপার ঘটে, কৌতুক করতে করতে মানুষকে আইনানুগভাবে হত্যা করার বিল পাস করা হয়; নিরঙ্কুশ ক্ষমতাসীন সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে অথবা সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তির মর্জিতে সংসদে সরকার ব্যবস্থার খোলনলচে পাল্টে ফেলা যায়। সম্ভবত এ কারণেই প্রায় আড়াই শতাব্দী আগে সুইজারল্যান্ডের রাজনৈতিক তাত্ত্বিক জ্যাঁ লুউ ডিলোমে তার বিখ্যাত ‘দ্য কনস্টিটিউশন অব ইংল্যান্ড’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘একজন নারীকে পুরুষে এবং একজন পুরুষকে নারীতে পরিণত করা ছাড়া পার্লামেন্ট সব কিছু করতে পারে।’ বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে এ ঘটনাই ঘটিয়েছিল এবং এর পরিণতিতে চার বছর দেশ ছিল সংসদবিহীন। ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।

ক্ষমতায় থেকে নতুন দল গঠন করলে যা ঘটে থাকে, বিএনপির ক্ষেত্রেও তা ঘটেছিল। বিভিন্ন মত ও পথের সুবিধা শিকারি বহু পুরনো রাজনীতিবিদের সমাবেশ ঘটেছিল। পাশাপাশি অনেক তরুণ এগিয়ে এসেছিলেন নতুন দলে তাজা রক্তের প্রবাহ সঞ্চালন করতে। তাদেরই একজন ছিলেন তরিকুল ইসলাম। সাংবিধানিক ধারা অনুযায়ী, প্রতি বছরের প্রথম অধিবেশনের সূচনায় জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণ এবং বার্ষিক বাজেটের ওপর বক্তৃতা করা এবং কোনো বিল বা প্রস্তাব পাস করানোর জন্য স্পিকারের ‘হ্যাঁ বলুন’ আহ্বানে সরকারদলীয় সদস্যদের সাথে সমস্বরে ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’ বলুন - এ সাড়া হিসেবে ‘না’ উচ্চারণ করা ছাড়া নতুন সদস্যদের করণীয় তেমন কিছু থাকে না। অনেক উৎসাহী নবীন সদস্য বৈঠক শুরু হওয়ার প্রথম এক ঘণ্টা মৌখিক প্রশ্নোত্তর পর্বে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন; তাদের মধ্যে বিএনপির আনিসুজ্জামান খোকন ও ফরহাদ আহমদ কাঞ্চন ছিলেন এগিয়ে। তরুণদের মধ্যে তরিকুল ইসলামকে তখন এতটা তৎপর না দেখলেও তার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারি, যখন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তাকে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন। তিনি ধীরস্থির হলেও তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং দলের মধ্যে ও নিজ জেলা যশোরে তার জনপ্রিয়তার স্বীকৃতি মেলে।

এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বিএনপি যখনই সরকার গঠন করেছে, তরিকুল ইসলাম কোনো-না-কোনো মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার সাথে আমার প্রথম আলাপচারিতা বিএনপি যখন সরকারে ছিল বা তিনি যখন মন্ত্রী ছিলেন, তখন নয়। তাকে সংসদ সদস্য হিসেবে প্রথম দেখার ১৮ বছর পর ১৯৯৬ সালে বিএনপি যখন বিরোধী দলে তখন একদিন তরিকুল ভাইয়ের ¯েœহভাজন সাংবাদিক, বর্তমানে নয়া দিগন্তের বিশেষ প্রতিনিধি হারুন জামিলের সাথে তার সিদ্ধেশ্বরীর বাসায় যাই। আমার অনুবাদ করা কোনো একটি বই নিয়েছিলাম তার জন্য। শিক্ষাজীবন শেষ করার পর বাংলাদেশের খুব স্বল্পসংখ্যক রাজনীতিবিদই পড়াশোনা করেন বলে আমার যে ধারণা, তরিকুল ইসলাম তা ভ্রান্ত প্রমাণ করলেন। সময় পেলেই তিনি পড়তেন। অনেক বইয়ের নামও বললেন তিনি, যেগুলো আমার পড়া উচিত। ওই সময় যেহেতু বিএনপি বিরোধী দলে, অতএব তার বই পড়ার সুযোগ তুলনামূলকভাবে বেশি। প্রথম দিনই অনেক বিষয়ে দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা করলাম আমরা। আমাদের দেখাসাক্ষাৎ অব্যাহত থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে দিন বিদায় নিয়েছিলাম। এরপর মাঝে মধ্যে টেলিফোনে কথা হয়েছে। কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি বা কোনো দেশের দূতাবাসের অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছে। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার গঠন করার পর ২০০৬ সালে ক্ষমতা ছাড়ার আগ পর্যন্ত তরিকুল ইসলাম একে একে তিনটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন- তথ্য মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয় ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়।


১৯৯৮ সালের শেষ দিক থেকে আমি দৈনিক বাংলার বাণীর বার্তা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলাম। তখন ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম শেখ ফজলুল হক মনি বাংলার বাণী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৯৭২ সালে এবং বাংলার বাণী ‘আওয়ামী লীগের মুখপত্র’ হিসেবেই পরিচিত ছিল। কোনো দলের ছাপ্পড় পড়েছে এমন দৈনিক পত্রিকার খুবই দৈন্যদশা বাংলাদেশে। বাংলার বাণীও এর ব্যতিক্রম ছিল না। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে এসে দৈনিক বাংলার বাণীকে টেনে তোলার বহু চেষ্টা করেও সার্কুলেশন বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়নি। শেখ ফজলুল করিম সেলিম সম্পাদক হিসেবে থাকলেও পত্রিকাটি পরিচালনা করছিলেন শেখ মনির ছোট ছেলে ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস। বাবার স্মৃতি ধরে রাখার জন্য তার প্রচেষ্টা ছিল আন্তরিক এবং তিনি প্রচুর পরিশ্রম করতেন। কিন্তু কোনো আভাস না দিয়েই এবং শ্রমিক-কর্মচারীদের দেনা-পাওনা পরিশোধের কোনো ব্যবস্থা না করেই পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের আগে, ২০০১ সালের এপ্রিলে বাংলার বাণী বন্ধ করে দেয়া হয়।

অন্যান্যের মতো আমিও সাময়িক বেকার হয়ে পড়ি। ওই বছরের অক্টোবর মাসে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং বিএনপি সরকার গঠন করে। তরিকুল ইসলাম তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। প্রতিটি রাজনৈতিক সরকার যা করে থাকে, মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত ও বিধিবদ্ধ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে পূর্ববর্তী প্রতিপক্ষ সরকারের দেয়া নিয়োগ বাতিল এবং নতুন করে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দেয়া শুরু হয়। এর ব্যতিক্রম কখনোই ঘটে না। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাসসে নিয়োগকৃত ৩৬ জন সাংবাদিক-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করা হয় এবং নতুন নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু হয়। তরিকুল ইসলাম আমার সাময়িক বেকারত্বের খবর জানতেন এবং তিনি চাইছিলেন, আমি যাতে বাসসে যোগ দেই। এ কথা তিনি হারুনকে একাধিকবার বলেছেন। হারুন আমাকে কয়েকবার বলেছে তার সাথে দেখা করতে, কিন্তু আমি রাজি হইনি। কারণ, বেকার অবস্থায় একজন মন্ত্রীর সাথে দেখা করতে গেলে তার মনে হতে পারে যে, আমি চাকরির জন্য তার কাছে গেছি। অতএব, আমি যাইনি। বাসস থেকে নিয়োগপত্র পাওয়ার পর তার সরকারি বাসভবনে দেখা করতে যাই এবং তাকে ধন্যবাদ জানাই।
তরিকুল ইসলাম পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেয়ার পর ওই মন্ত্রণালয়ে অনেকবার যেতে হয়েছে।

বাসস অফিস ও সচিবালয়ের অবস্থান রাস্তার এপার এবং ওপারে। ওই সময় পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন আমার বন্ধু জাফর আহমেদ চৌধুরী। তার সাথে আড্ডা দিতে অথবা বিনা আমন্ত্রণে তার মধ্যাহ্নভোজে ভাগ বসাতে সচিবালয়ে চলে যেতাম। শুধু এটুকু জেনে নিতাম যে, তার ব্যস্ততা কেমন। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের (এফইজেবি) ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে ফোরামের চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম চৌধুরী এবং অন্যান্য নির্বাহীর সাথে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে কখনো মন্ত্রী, কখনো বা সচিবের সাথে সাক্ষাতের জন্য যেতে হতো। এ ছাড়া, আমি যে মাসিক ম্যাগাজিন ঢাকা ডাইজেস্ট সম্পাদনা করতাম, সেটি প্রকাশনার ১৪ বছর পর আর্থিক সঙ্কটে পড়ে এবং প্রকাশনা বন্ধ রাখতে হয়।

একটি ব্যবসায়ী গ্রুপ ঢাকা ডাইজেস্টের জন্য আর্থিক সহযোগিতা ছাড়াও আমাকে চারজন সহকর্মী এবং বাসস অফিস থেকে হাঁটা দূরত্বে একটি অফিসের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। জাফর আহমেদ চৌধুরী ঢাকা ডাইজেস্টের প্রায় সূচনাকাল থেকেই লিখতেন। তার প্রশাসনিক দায়িত্ব বেড়ে যাওয়ায়, অর্থাৎ যখন তিনি ইউএনও এবং পরবর্তীকালে ডিসি হিসেবে ঢাকার বাইরে কাটিয়েছেন, তখন লেখালেখির ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যত্যয় ঘটেছে। পরিবেশ সচিবের দায়িত্ব পাওয়ার পর জাফর ভাইয়ের বিদেশ সফর নিয়মিত হয়ে উঠেছিল। দু-এক মাস পরপরই তাকে বিভিন্ন দেশে ছুটতে হতো পরিবেশ বিষয়ক আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেয়ার জন্য। বেশির ভাগই মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন। কিন্তু স্বাস্থ্যগত কারণে তরিকুল ভাই তখন বিদেশ সফরে না যাওয়া বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে জাফর ভাইকে যেতে বলতেন। আমিও জাফর ভাইকে তাগিদের ওপর রেখেছিলাম, যাতে ফিরে এসেই তার সফর বৃত্তান্ত লিখে ফেলেন এবং তিনি তা করতেন। আমি প্রতি মাসে ঢাকা ডাইজেস্টে তার লেখা প্রকাশ করতাম। পরে লেখাগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশও করেছেন।

২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপি সরকার থেকে পদত্যাগ করে এবং কেয়ারটেকার সরকার গঠন নিয়ে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত সেনাসমর্থিত এক-এগারোর সরকার এসে দেশে বলতে গেলে তাণ্ডব শুরু করে। ব্যবসায়ী, কর্মজীবী, রাজনীতিবিদ নির্বিশেষে সরকারের অজ্ঞাত রোষের শিকারে পরিণত হতে থাকে। বিএনপি নেতাদেরই এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। এ সময় আমার একটি পারিবারিক অনুষ্ঠান ছিল বিমানবাহিনীর শাহীন মিলনায়তনে। বিএনপি নেতাদের ওপর ধকল চলছে তা আমার জানা। তবুও অনুষ্ঠানে তরিকুল ভাইয়ের উপস্থিতি কামনা করছিলাম। প্রথমে তাকে ফোন করলাম। তিনি উদ্ভূত পরিস্থিতির কথা বলে ক্ষমা চাইলেন। তিনি তখন শান্তিনগরের এক বাসায় থাকেন।

তার বাসায় গিয়ে আনুষ্ঠানিক দাওয়াত দেয়ার পরও তিনি অপারগতা প্রকাশ করে বললেন- ‘মঞ্জু ভাই, কিছু মনে করবেন না। এরশাদের সময় মিলিটারিরা ধরে নিয়ে অনেক পিটিয়েছে। ওরা কিছু মানে না। এরশাদও যা, মইন উদ্দিনও তা। অনুষ্ঠান শেষ করুন। দোয়া থাকল। আমি বাসায় গিয়ে ভাবীর হাতের রান্না খাবো।’

এর ওপর আর কথা চলে না। তার সাথে এটাই আমার শেষ সাক্ষাৎ ছিল। পরবর্তী সময়ে সেনাসমর্থিত সরকার তাকে গ্রেফতার করেছিল এবং এক বছরের বেশি সময় তিনি আটক ছিলেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে তিনি মুক্তি পান এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু সাজানো সেই নির্বাচনে বিএনপি মাত্র ৩০টি আসন লাভ করেছিল। আমি তরিকুল ভাইয়ের খবরাখবর রাখলেও আর দেখা হয়ে ওঠেনি। তবে দেখা হবে না, এমন ভাবিনি কখনো। তার অন্তর্ধানে এখন ভাবব, আবার দেখা হবে পুনরুত্থান দিবসে। বিশ্বাসীদের কাছে সেটিই আমাদের অনন্ত জীবন। তার সাক্ষাতের প্রতীক্ষায় থাকব।


আরো সংবাদ



premium cement