২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হাকিম নড়বে; নাকি হুকুম নড়বে?

হাকিম নড়বে; নাকি হুকুম নড়বে? - ছবি : নয়া দিগন্ত

এক.
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণার পর বলেছিলাম, সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ে ভয়াবহ সঙ্কটের মুখোমুখি সরকার। বলেছিলাম, প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ সরকারের বৈধতার বিষয়ে যে বড় ধরনের প্রশ্নের অবতারণা করেছে, তা গায়ের জোরে মনে করার শক্তি সরকারের নেই।
কিন্তু খুবই আশ্চর্যজনকভাবে রায়ের দু’দিন না যেতেই অর্থমন্ত্রী গায়ের জোর দেখিয়ে বললেন, আদালত যতবার ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করবে, আমরা ততবার সংসদে বিল পাস করব। তা আমরা অনবরত করতে থাকব। দেখি জুডিশিয়ারি কতদূর যায়। জুডিশিয়াল কন্ডিশন আনটলারেবল। সংসদের ওপর তারা পোদ্দারি করবে। এদেরকে আমরা চাকরি দেই।

দুই.
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালতকে অর্থমন্ত্রীর চ্যালেঞ্জের পর বলেছিলাম, আবুল মালরা ছাড় পেয়ে গেলে আইন আদালতের ওপর মানুষের আস্থা উঠে যাবে। বলেছিলাম, অর্থমন্ত্রী সংবিধান সংরক্ষণ ও সুরক্ষার শপথ ভঙ্গ করেছেন। অর্থমন্ত্রী সংবিধানে বর্ণিত বিচার বিভাগের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয়কে পরাহত করেছেন। যা সংবিধানের ৭ক(২) অনুচ্ছেদ মোতাবেক রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ। যা মৃত্যুদণ্ডের সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডণীয় একটি অপরাধ। অথচ অর্থমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ না করার সুবাদে বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ক্ষোভ দেখিয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘এই রায় একটা ষড়যন্ত্রের অংশ’। তিনি সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার ঘোষণা পর্যন্ত দেন।

তিন.
এবার প্রধানমন্ত্রীর গ্রিন সিগনাল পেয়ে একে একে সরকারের মন্ত্রীরা সরাসরি বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যুদ্ধে নেমে পড়েন। শুরু হয় হুমকি-ধামকি, গালাগালি ও চরিত্র হননের মহোৎসব- প্রধান বিচারপতি ‘ধৃষ্টতা’ দেখিয়েছেন। আমরা ধিক্কার জানাই। এ রায় আবেগ ও বিদ্বেষতাড়িত।
প্রধান বিচারপতির অপসারণ দাবিতে টানা আন্দোলনের ঘোষণা। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের সাথে আঁতাত করে বেশি দিন এই মসনদে থাকতে পারবেন না।’

বিচারপতিরা ইম-ম্যাচিউরড।
‘আদালতের হাত এত বড় লম্বা হয়নি যে সংসদ ছুঁতে পারে’।
‘প্রধান বিচারপতি শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন।’
প্রধান বিচারপতি হিন্দু নন।
এটা পেনড্রাইভ জাজমেন্ট। কোন পেনড্রাইভ থেকে এবং কোন ল্যাপটপ থেকে এ
রায়ের উৎপত্তি হয়েছে সেটা আমাদের জানা আছে। রায়ের ড্রাফট লিখেছেন একটি
ইংরেজি পত্রিকার সম্পাদক
ইত্যাদি...

চার.
সরকারি চাকরিরত আইন কমিশনের চেয়ারম্যান খায়রুল হক বললেন, ‘ওই রায় ছিল পূর্বধারণাপ্রসূত, অগণতান্ত্রিক ও আগে থেকে চিন্তাভাবনার ফসল। এটা মেনে নেয়া যায় না।’
পরদিন আইনজীবীরা আপিল বিভাগে খায়রুল হকের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল চাইতে গেলে প্রধান বিচারপতি জানান, আমরা কারো ট্র্যাপে পা দেবো না। প্রধান বিচারপতি অন্যত্র এটাও বলেন যে, রায়ের গঠনমূলক সমালোচনার অধিকার রয়েছে।
কিন্তু এটা কি রকমের গঠনমূলক সমালোচনা?
এর আগে একই আদালত থেকে যাদের বিরুদ্ধে কনটেম্পট প্রসিডিং ড্র করা হয়েছে এবং মাহমুদুর রহমানের মতো যাদের আদালত অবমাননার অভিযোগে জেলে যেতে হয়েছে সেগুলো কি আজকের অবমাননার চেয়েও মারাত্মক ছিল?

পাঁচ.
সর্বোচ্চ আদালত নিশ্চয়ই পর্যবেক্ষণ করছেন, এগুলো গঠনমূলক সমালোচনার মধ্যে পড়ে কি না? এভাবে একের পর এক বিচার বিভাগকে হুমকি-ধমকি দিয়ে সাংবিধানিক শপথকারী এ সব ব্যক্তি সংবিধান সংরক্ষণ ও সুরক্ষার শপথ ভঙ্গ করেছেন। যা আইনের দৃষ্টিতে গুরুতর অসদাচরণ। এটা গুরুতর ফৌজদারি অবমাননা ও সংবিধানেরও লঙ্ঘন। এটাও নিশ্চয়ই সর্বোচ্চ আদালতের নজরে আছে বলে আমাদের বিশ্বাস।
সমূহ বিপদের আশঙ্কায় প্রশ্ন রেখে তখন বলেছিলাম, সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত আইন হিসেবে গণ্য এবং তা সবার ক্ষেত্রেই মানা বাধ্যতামূলক। প্রশ্ন রেখে বলেছিলাম, এ সব প্রভাবশালী ব্যক্তি কি আইনের ঊর্ধ্বে? তাহলে আদালত অবমাননা কারে কয়?

ছয়.
আইনমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করে জানান, সরকার আদালতে গিয়ে আইনগতভাবেই এ রায়ের মোকাবেলা করবে। সরকারের পক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জানিয়েছেন, রায়ের তারিখেই সরকার সার্টিফায়েড কপির জন্য দরখাস্ত করেছে। তাই এটা নিশ্চিত যে, সরকার এ রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউর আবেদন করবে। তা ছাড়া এক্সপাঞ্জও নাকি চাওয়া হবে। তার মানে, বিবাদীয় বিষয়টি এখনো সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে যায়নি। রিভিউর আরেকটি আইনি ধাপ এখনো বাকি আছে।
কিন্তু আদালতে বিচারাধীন বিষয়ে সংক্ষুব্ধ পক্ষ হিসেবে সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক, যিনি সরকারের মন্ত্রীও বটে, কিভাবে বিচারকের বাসভবনে গিয়ে বিচারাধীন বিষয়ে আলাপ আলোচনা করে আসেন, সেটা বোধগম্য নয়! আশ্চর্য, সেটা আবার তিনি জনসম্মুখে এসে প্রকাশ্যে স্বীকারও করেন!

সাত.
প্রধান বিচারপতির সাথে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের সাক্ষাতের পাঁচ দিনের মাথায় দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সাথে আলোচনাও করেছেন। রাষ্ট্রপতি শপথ গ্রহণের পর আর কোনো দলের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন না। অথচ রাষ্ট্রপতি সেদিন প্রধানমন্ত্রী ও দলের সাধারণ সম্পাদক ছাড়াও আইনমন্ত্রী ও রাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেলের সাথে বৈঠক করে পরবর্তী কর্মপন্থা ঠিক করেছেন বলে গণমাধ্যম সূত্রে প্রকাশ পেয়েছে!
জানা গেছে, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ নাকি রাষ্ট্রপতিকে তার সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য অনুরোধ করতে পারে। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে তদন্তের জন্য নাকি রাষ্ট্রপতিকে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দেবে সরকার। রাষ্ট্রপতি নাকি বিষয়টি তদন্ত করার জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে নির্দেশ দেবেন।

আট.
একটি জাতীয় দৈনিক জানিয়েছে, প্রধান বিচারপতির ‘অসদাচরণ’ প্রমাণের জন্য সাথে বৈঠক, আবেদনকারীর অনুরোধে আপিল বিভাগের বেঞ্চ পরিবর্তনসহ প্রধান বিচারপতির বিভিন্ন বক্তব্যের অডিও এবং ভিডিও জোগাড় করা হচ্ছে। উদ্ভূত বিষয়গুলো নিয়ে যেকোনো সময় রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতিকে বঙ্গভবনে আমন্ত্রণ জানাতে পারেন। সেখানে রাষ্ট্রপতি পুরো বিষয়টি নিয়ে প্রধান বিচারপতির সাথে কথা বলবেন। এর পরই নাকি নির্ধারিত হবে, আসলে প্রধান বিচারপতি এবং সরকারের টানাপড়েনের পরিণতি কী।

নয়.
সরকারের প্রথম টার্গেট, চায়ের দাওয়াত দিয়ে প্রধান বিচারপতির প্রস্থান। কিন্তু বর্তমান প্রধান বিচারপতিকে এমন শক্তিহীন বলে ধারণা করাটাই বরং শক্তিহীনতার পরিচায়ক। সরকারের দ্বিতীয় টার্গেট, রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে তদন্তের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে নির্দেশ প্রদান।
কিন্তু ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পর সরকারের এই স্বপ্নও বাস্তবায়নযোগ্য নয়। কেননা, প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে তদন্তপূর্বক অভিসংশন করানোর মতো পর্যাপ্ত সময় সরকারের হাতে একেবারেই নেই।
সরকারের তৃতীয় টার্গেট, আগামী বছরের ১ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতির অবসরের পরেই রিভিউ পিটিশন করা। প্রধান বিচারপতির অবসরে যাওয়ার আগে বেশি কার্যদিবস নেই। ২৫ আগস্ট থেকে ২ অক্টোবর পর্যন্ত টানা ছুটি চলবে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকেও লম্বা ছুটি। যদিও আপিল বিভাগের বিধি মোতাবেক রায় ঘোষণার ৩০ দিনের মধ্যে রিভিউর জন্য দরখাস্ত করতে হয়। এ ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির অবসরের পরেই এর রিভিউ চাওয়ার ফন্দি করতে পারে সরকার। অজুহাত হিসেবে বিলম্ব মার্জনার আবেদনের সুযোগ নেয়া হতে পারে। কিন্তু আগামী বছর জাতীয় নির্বাচনের পূর্বাহ্নে পরবর্তী প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বর্তমান আপিল বিভাগের বিচারপতিরা তাদের নিজেদের রায়ের বিরুদ্ধে যাবেন কি না, সন্দেহ আছে। তা ছাড়া পরবর্তী প্রধান বিচারপতির জ্যেষ্ঠতার সিরিয়ালে থাকা বিচারপতিরা যথেষ্ট আত্মমর্যাদাশীল বলেই আমরা জানি।

দশ.
আসলে ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কঠিন এক বিপদের মুখে পড়েছে। সর্বশেষ অতি সম্প্রতি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া আইন সচিব বিচার বিভাগকে যে ভাষায় গালমন্দ দিলেন তাতে এটা স্পষ্ট যে, এবার বিচার প্রশাসনের মেরুদণ্ডটাও ভেঙে গেছে!
এভাবে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংসের পর এবার বিচার বিভাগকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে যাচ্ছে! গণমানুষের আস্থার জায়গাগুলোকে ধ্বংস করে একদলীয় স্বেচ্ছাচারী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রণয়নের নীলনকশার হিংস্র ছোবল এবার পড়েছে বিচার বিভাগের গায়ে।

এগার.
দু’দিন আগে প্রধান বিচারপতি আদালতে অ্যাটর্নি জেনারেলকে বললেন, আপনি প্রশাসনের সাথে কমপ্রোমাইজ করে চলছেন। প্রধান বিচারপতির এই কথায় স্বভাবতই বিশ্বাস জন্মে, তিনি নিজেও কোনো কমপ্রোমাইজ করবেন না। কারণ, এটা শুধু একজন ব্যক্তি প্রধান বিচারপতির মর্যাদার বিষয় নয়। এর সাথে জড়িত পুরো বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্ন। এতে দীর্ঘদিনের সংগ্রামের ফসল মাজদার হোসেন মামলার অর্জনটুকুও এক নিমেষেই মুখ থুবড়ে পড়বে! প্রধান বিচারপতি যদি এবার একটুও নড়ে পড়েন; কিংবা হুকুমটাও যদি একটু নড়ে পড়ে, তাতে পুরো বিচারব্যবস্থাই নড়ে পড়বে।

বারো.
প্রধান বিচারপতির সামনে হয়তো রাষ্ট্রপতির পদ কিংবা নির্বাচনী সরকার প্রধানের পদ খোলা থাকতে পারে। কিন্তু সেটার গ্রহণযোগ্যতা কখনোই প্রধান বিচারপতি পদের মর্যাদাকে বিকিয়ে দিয়ে সম্ভবপর নয়।
ইতিহাসে বিচারপতি মোরশেদরা খুবই ক্ষণজন্মা হন। তাই প্রধান বিচারপতিকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তিনি বিচারপতি মোরশেদ হবেন; নাকি খায়রুল হক হবেন। তাকেই জবাব দিতে হবে, তিনি ছিটকে উকিল ছিলেন না!হ

লেখক : আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
Email:- drtuhinmalik@hotmail.com


আরো সংবাদ



premium cement