২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মালদ্বীপের নির্বাচন ও আমাদের জন্য শিক্ষা

মালদ্বীপের নির্বাচন ও আমাদের জন্য শিক্ষা - ছবি : সংগৃহীত

২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ছিল মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ছোট দেশ, মোট জনসংখ্যা মাত্র সাড়ে চার লাখের (৪৪৪,২৫৯) মতো, যার মধ্যে এবারের রেজিস্টার্ড ভোটার প্রায় আড়াই লাখ (২৬২,১৩৫)। আর নির্বাচনে মাত্র দু’জন প্রার্থী ছিলেন চলতি ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন ও বিরোধী দলের নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত ইব্রাহিম মোহম্মদ সলিহ। সলিহ ছিলেন চারদলীয় এক জোটের প্রার্থী, ৫৮ শতাংশ ভোট পেয়ে তিনি জিতেছেন। যদিও ভোটদানের সুযোগ ছিল ভোটের দিন সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত। তবু আড়াই লাখ ভোট গুনতে বেশি সময় লাগার কথা নয়, তাই নির্বাচনের দিন না হোক পরের দিন মালদ্বীপের রাজধানী মালের সকাল (২৪ সেপ্টেম্বর) থেকেই দেশী-বিদেশী সবাই জেনে যায় ভোটের ফলাফল। যদিও তখনো সেটা আনুষ্ঠানিক ফলাফল নয়, মানে মালদ্বীপের নির্বাচন কমিশন তখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়েছে এমন ফলাফল নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারতের প্রকাশ্য অস্থিরতা ও নড়াচড়া ছিল খুবই অকূটনীতিসুলভ। কূটনৈতিক আচার-আচরণ ভেঙে আনুষ্ঠানিক ফলাফল আসার আগেই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতি শুধু সলিহকে অভিনন্দন জানানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, ইয়ামিন ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন কি না, সে আশঙ্কা সৃষ্টি ও ছড়িয়ে পড়ে। বিবৃতিটা লেখা হয়েছে এভাবে, ‘আমরা আশা করি, নির্বাচন কমিশন এখন এই ফলাফল তাড়াতাড়ি অফিসিয়ালি নিশ্চিত করে ঘোষণা দেবে।’ এই নির্বাচন কেবল মালদ্বীপের গণতান্ত্রিক শক্তির বিজয়ের চিহ্ন নয় বরং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও আইনের শাসনের প্রতি কমিটমেন্টের প্রকাশ।’

এই বিবৃতিটা স্পষ্টতই ভারতের এক চরম হস্তক্ষেপমূলক কাজ। ব্যাপারটা শুধু আমরাই নই, টাইমস অব ইন্ডিয়াও আমল না করে পারেনি। লিখেছে, ফলাফলের ‘অফিসিয়াল ঘোষণা দেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা না করে’ দেয়া ভারত বিবৃতি দেয়। দ্বিতীয়ত মালদ্বীপের নির্বাচন কমিশন সলিহর নির্বাচনে বিজয়ের ফলাফল ঘোষণা নাও করতে পারে- এই বিবৃতিতে আগাম এ ধরনের সন্দেহ ও ইঙ্গিতে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে ফলে স্বভাবতই এই বিবৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে, পরিস্থিতিকে খামোখা উত্তেজিত করার চেষ্টার এক সীমা ছাড়ানি হস্তক্ষেপ।

বিবৃতির ভাষাও লক্ষণীয় যে, ভারত বলতে চাচ্ছে নির্বাচনী ফলাফল তো এসেই গেছে, এখন কমিশনের কাজ হলো ঘোষকের, তাই তাড়াতাড়ি ওই ফলাফল ঘোষণা করে দিক। ভারতের এমন বক্তব্য, অপর রাষ্ট্রের নির্বাচন কমিশনের কাজ ও এখতিয়ারের মধ্যে ঢুকে পড়া। আর এর চেয়ে বড় কথা, এতে কমিশনকে পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়ার পরিচালক নয় যেন কেবল ফলাফল ঘোষক- এরকম এক আপত্তিকর অনুমানের ওপর দাঁড়িয়ে লেখা হয়েছে। ভারতের বিবৃতিতে দাবি করছে নির্বাচনের ফলাফলে সলিহ জিতেছে- এই দাবি করাটাই অবৈধ হস্তক্ষেপ। কারণ নির্বাচন কমিশনের ফল ঘোষণার (গেজেট নয়) আগে কোনো ফলাফল আনুষ্ঠানিক ঘোষিত বলে বিবেচিত হতে পারে না। ফলে এর আগেই বিদেশী রাষ্ট্র ফলাফল সে জানে এই দাবি করে বিবৃতি দেয়া অনধিকার চর্চা। কিন্তু ভারত সেটাই করেছে।

চলতি বছরের শুরুর আগে পর্যন্ত বিগত দশ বছর ধরে আমেরিকার হয়ে ‘চীন ঠেকানোর ঠিকা’ নিয়ে কাজ করে গেছিল ভারত। কিন্তু ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের আমেরিকায় রফতানির ওপর শুল্ক আরোপ করার কারণ বস্তুত সেসব সম্পর্ক কার্যকর হয়ে পড়ে। অর্থাৎ এতে আগের সব বোঝাপড়া যে ভারত কী সার্ভিস দিলে বিনিময়ে কী পাবে, তা অকেজো হয়ে যায়। তবু ভারত চীন বিরোধী কোনো স্ট্র্যাটেজিক অবস্থান নিলে আমেরিকা তাতে চোখ বন্ধ করে সমর্থন দেবে- এমন একটা কাঠামো এখনো থেকে গেছে দেখা যাচ্ছে। তাই মালদ্বীপ প্রসঙ্গে ভারতের অবস্থান বা বিবৃতির পর, ভারতের আবদারে আমেরিকাকেও একই লাইনে বিবৃতি দিতে দেখা যাচ্ছে। তাই মালদ্বীপের ফলাফল নিয়ে আমেরিকাও হস্তক্ষেপমূলক এক বিবৃতি দিয়েছে। তফাত এতটুকু যে, স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র হিদার নওরেট নিজেই আগে বলে নিয়েছেন, ‘অফিসিয়াল ফলাফল এখনো ঘোষিত হয় নাই’ তবে ‘স্থানীয় মিডিয়া ও এনজিও রিপোর্টের ওপর ভিত্তি’ করে তিনি কথা বলছেন।

অর্থাৎ আমেরিকা তাদের একটু হলেও আক্কেল আছে যে, কোনো রাষ্ট্রের নির্বাচনে কে জিতেছে এই ফলাফলের নির্ধারণের একমাত্র অথরিটি ওই রাষ্ট্রের নির্বাচন কমিশন। ভিন রাষ্ট্র এর বাইরে গেলে মানে তারা যদি ধরে নিয়ে বিবৃতি দেয়া শুরু করে যে, ‘অমুকে জিতেছে’ তাতে সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপের বড় নজির হয় সেটা এটা সে আমল করেছে। আসলে ব্যাপারটা আবার এমনো নয় যে, কমিশনের কোনো গড়িমসি দেখা গেছে। কারণ নির্বাচনের পরের দিন ২৪ তারিখ বেলা বাড়তেই কমিশন নিয়ম মাফিক সলিহকে নির্বাচিত বলে ফলাফল ঘোষণা করেছিল। আর এর দু-এক ঘণ্টা পরেই প্রেসিডেন্ট অফিসে ইয়ামিন সলিহকে আমন্ত্রিত করে ডেকে নিয়ে বিজয়ের অভিনন্দন জানিয়েছে। আর এর পরেই নিজে মিডিয়ার সামনে ঘোষণা করেছে, ‘মালদ্বীপের জনগণ তারা যা চায় সেই সিদ্ধান্ত দিয়েছে। আমি গতকালের সেই ফল মেনে নিয়েছি। ইতোমধ্যে আমি সলিহর সাথে দেখা করেছি, তাকে অভিনন্দন জানিয়েছি।’ নির্বাচনে একজন প্রেসিডেন্টের পরাজিত হওয়ার পর এর চেয়ে স্পষ্ট ও সবল ঘোষণা আর কী হতে পারে!

অথচ ভারত নিয়মিতভাবে ইয়ামিনের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে গিয়েছে যে, নির্বাচন হয় কি না, অথবা নির্বাচনে কারচুপি হবে, অথবা নির্বাচনে বিরাট গোলযোগ হবে, বিরোধী প্রার্থী সলিহ জিতলেও ফল ঘোষণা করা হবে না ইত্যাদি সবকিছু। আর সময়ে ভারতের অনুসারী হয়ে আমেরিকা ভারতকে সমর্থ করে নিজের খারাপ কূটনৈতিক ইমেজের নজির সৃষ্টি করেছে। অথচ ভারত ও আমেরিকা নির্বাচন কমিশনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার জন্য অন্তত ২৪ সেপ্টেম্বর পার হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারত। আর সেটাই সবাই আশা করে। কিন্তু এই অতি উৎসাহ দেখিয়ে এই দুই রাষ্ট্র নিজেই এক হস্তক্ষেপের নজির সৃষ্টি করে রেখেছে, নিজের মুখে কালি লাগিয়েছে।

বরং প্রতিক্ষেত্রে উল্টা- নির্বাচন এতই শান্তিপূর্ণ ও নিয়মমাফিক হয়েছে এক সাবেক গোয়েন্দা আমলা নিজেই ২৪ তারিখ সকালে ‘ফলাফল ঘোষণা ও ক্ষমতা হস্তান্তর’ নাও হতে পারে নিজের এ ধরনের মনগড়া আশঙ্কা যাচাই করতে মালদ্বীপে দু’জন গুরুত্বপূর্ণ এমপির সাথে ফোনে কথা বলেছেন। ওই এমপি দু’জন এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দিলে এবার তিনি আশ্বস্ত হন বলে লিখেছেন।
যার সবশেষ নিজেই লিখছেন, ‘সলিহ যেহেতু জিতেছে অতএব মালদ্বীপের নির্বাচনে কারচুপি হয়নি।’ এই হলো মালদ্বীপের নির্বাচন নিয়ে ভারতীয় প্রপাগান্ডার মুখ থুবড়ে পড়া পরিণতি!

মালদ্বীপের ফলাফল দেখে ফেসবুকে একটা ছোট মন্তব্যে লিখেছিলাম, ‘এটা বিপর্যয়’। মালদ্বীপের থেকে আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ কী শেখার আছে, তা বোঝার উদ্দেশ্যে সেখানকার রাজনৈতিক ঘটনাবলির এক সংক্ষিপ্ত বর্ণনা এখানে আনব। মালদ্বীপের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি স্পষ্ট পরস্পরবিদ্বেষী দুই ভাগে বিভক্ত। তবু ঘটনাবলির একটা বর্ণনা মানে বর্ণনার জন্য যতটুকু দরকার তাই করা হবে আর তাতে কোন পক্ষ সঠিক ছিল অথবা এর কোনো একটা পক্ষ নিয়ে কথা বলাটা এখানে এর একেবারেই উদ্দেশ্য নয়। তাই এই রচনায় কোনো পক্ষকে ভালো বললাম কি না, তা খোঁজা সেদিক থেকে বুঝতে যাওয়া ভুল হবে।

প্রথমত, মালদ্বীপের রাজনৈতিক অসন্তোষ অস্থিরতা অনেক পুরনো, গত শতক থেকে। এর একটা বড় উৎস হলো ক্ষমতাসীন পরিবারের প্রভাবশালী দুই সৎ ভাইয়ের রেষারেষি, স্বার্থ ঝগড়াকে কেন্দ্রে রেখে এবার এর সাথে সমাজের অন্য স্বার্থগুলো একেক ভাইয়ের পক্ষ বেছে নিয়ে রাজনৈতিক পোলারাইজেশন হিসেবে হাজির হওয়া- এ ধরনের। দ্বিতীয়ত, ১৯৮৮ সালে মালদ্বীপে ভারত ‘অপারেশন ক্যাকটাস’ নামে নিজ সামরিক বাহিনী নামিয়ে পছন্দের সরকার বসিয়ে প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ করেছিল; এই বিরাট খারাপ নজির সেই থেকে জ্বলজ্বল করছে। তৃতীয়ত, ২০১২ সালের পর থেকে সাবেক প্রেসিডেন্ট নাশিদের সাথে রাজনৈতিক বিবাদ, টেরোরিজমের অভিযোগে তাকে আদালতে নিয়ে শাস্তি দেয়া, পরে পার্লামেন্টকে কাজ করতে না দেয়া, বিচারককে গ্রেফতার ইত্যাদি ঘটেছে যা মালদ্বীপের রাজনৈতিক তৎপরতা ও চর্চা হিসেবে সব খুবই খারাপ উদাহরণ।

কিন্তু এসবের বিপরীতে আদালতের ঘটনার পর সাবেক প্রেসিডেন্ট নাশিদের (যিনি এখন রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী হিসোব শ্রীলঙ্কায় বসবাস করেন) খোলাখুলি ভারতকে সামরিক হস্তক্ষেপে ক্ষমতা দখলের জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন, যা আরো খারাপ এক উদাহরণ। সৌভাগ্যবশত এটা গত শতক নয়। অল্প কথায় বলতে জাপানি টাইমসসহ রয়টারের খবর অনুযায়ী চীন ১১ জাহাজের বহর ভারত মহাসাগরে হাজির হওয়াতে, চীনের সাথে মুখোমুখি সঙ্ঘাত এড়াতে ভারত মালদ্বীপে হস্তক্ষেপের চিন্তা বাদ দেয়। ফলে আরো খারাপ কিছুর হাত থেকে নাশিদ এবং মালদ্বীপ বেঁচে যায়।

মালদ্বীপ রাষ্ট্রের স্বার্থের দিক থেকে বিচারে, প্রথমটার ক্ষেত্রে অপরাধ হলো, যেসব প্রতিষ্ঠানের কারণে রাষ্ট্র কার্যকর ও প্রাণবন্ত থাকে, কেউ ক্ষমতায় আছে বলে সেগুলো প্রত্যেকটার (যেমন আইনশৃঙ্খলার প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন, বিচার বিভাগ ইত্যাদি) স্বাধীন বা সংবিধান নির্ধারিত এখতিয়ার ও আইনসম্মত কাজে নির্বাহী প্রধানের অযাচিত ও বেআইনি হস্তক্ষেপ- এক চরম আত্মঘাতী কাজ। ইয়ামিন বেপরোয়াভাবে সেই বিপজ্জনক কাজটাই করেছেন আর বিপরীতে দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, নিজ তথাকথিত রাজনৈতিক স্বার্থে পুরো রাষ্ট্রকেই অস্তিত্বহীন করে ফেলার আরো এক অপরাধ করেছেন নাশিদ।

সব দেশেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক স্বার্থের লড়াই, প্রতিযোগিতা ও রাজনৈতিক অবস্থান ভিন্নতা থাকা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এর কিছু ‘নো গো এরিয়া’ থাকে, যা থেকে দলগুলোকে দূরে থাকতে হবে।

মোটামুটি চলতি শতকের শুরু থেকেই এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বা এর শৃঙ্খলায় ব্যাপক উলটপালট পরিবর্তন আসন্ন। [আমার প্রায় সব লেখাই এখানে দাঁড়িয়ে দেখে লেখা] বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও এর শৃঙ্খলা চীনের নেতৃত্বে পরিবর্তন হতে থাকবে। আর নতুন করে সাজানো হতে থাকবে। দুনিয়ায় আমেরিকান নেতৃত্ব ও প্রভাব ক্রমশ দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যাবে; একেবারে নাই না হলেও। আর তাতে পশ্চিম বা ইউরোপ নয়, দুনিয়ার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রীয় নাট্যশালা হয়ে উঠছে এশিয়া। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এশিয়ার বাকি রাষ্ট্রগুলোর জন্য এই কাঁধ-বদল বা শিফটিং ভালো এবং মন্দ দুটোই। ভালো সুযোগ পাওয়া আবার তছনছ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা- দুটোই।

সবচেয়ে মন্দের দিকটা হলো, অস্থির ও চলতি এই শিফটিংয়ের সময়কালটা। দুনিয়া নতুন করে সাজানোর এই কালে :
১. চীন, আমেরিকা আর ভারত এই তিন পক্ষের রেষারেষি থেকে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে দূরে থাকতে পারতে হবে। তাদের স্বার্থে নিজেরা বিভক্ত হওয়া থেকে ক্ষতি শুরু হবে।
২. দলগুলোর মধ্যে স্বাভাবিক প্রতিযোগিতা ও বিরোধে ওই তিন রাষ্ট্রকে ডেকে আনা যাবে না, সংশ্লিষ্ট করে ফেলা যাবে না।

৩. অথবা উল্টা করে বললে, ওই তিন রাষ্ট্র স্বার্থের কোনো একটার পক্ষ নিয়ে আমাদের কোনো রাজনৈতিক দল দেশের ভেতর কাজ করতে পারবে না। ‘প্রো-ইন্ডিয়ান বা প্রো-চাইনিজ দল ক্ষমতায়’- এ ধরনের পরিচিতি আমাদের পতনের ইঙ্গিত।
৪. একমাত্র নিজ রাষ্ট্রস্বার্থই প্রধান, এটাকে সব সময় প্রাধান্যে রেখে সিদ্ধান্ত নিতে পারতেই হবে।
৫. যে দলই ক্ষমতায় থাকুক- তার ভারত, আমেরিকা অথবা চীনকে কোনো সুবিধা দেয়া বা ঋণ নেয়া তা করতে হবে নিজ রাষ্ট্রস্বার্থ প্রাধান্যে রেখে, অবিতর্কিত এবং স্বচ্ছ ও আইনি প্রক্রিয়ায় যাতে অহেতুক তর্ক-বিতর্কের সুযোগ কেউ না নিতে পারে ইত্যাদি।

কিন্তু এসবই বজায় রাখা যাবে যদি নিয়মিত ও স্বচ্ছ নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ও ক্ষমতাহস্তান্তরের প্রক্রিয়াকে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে এক স্থায়ী ব্যবস্থায় রূপ দেয়া যায়। এ ছাড়া যে সরকার বিরোধী তারও মৌলিক মানবাধিকার রক্ষা করতে ক্ষমতাসীনের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে।
এক কথায় বললে, মালদ্বীপের রাজনীতি ও দল এসব মৌলিক করণীয়গুলো করতে সবাই ব্যর্থ হয়েছে। ইয়ামিনের দিক থেকে এই রাজনৈতিক ফলাফল বিপর্যয়কর এজন্য যে, হয়তো সে বিদেশীকে হস্তক্ষেপের জন্য ডেকে আনা নাশিদের উদ্যোগকে ঠেকাতে পেরেছে। কিন্তু তা এমন প্রক্রিয়ায় করেছে তাতে রাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠানগুলোকে (যেমন আদালত ও পার্লামেন্টকে) অকেজো করে ফেলেছে। আর সবচেয়ে বড় কথা জনগণ এই কাজ পছন্দ করেনি। অনুমোদন করেনি। উল্টা করে বললে ইয়ামিন তার কাজকে জনগণ সাথে নিয়ে করতে পারেনি। এরই ফলাফল হলো নির্বাচনে সহানুভূতি বিরোধী দলের দিকে চলে গেছে, যার প্রকাশ নাশিদের প্রার্থী বেশি ভোট পাওয়া বা ইয়ামিনের পরাজয়। তবে অবশ্যই আবার ইয়ামিন প্রশংসার দাবি রাখে যে নির্বাচন শুরু হওয়ার পর থেকে ভারত ও তার বন্ধুদের নিয়মিত শত প্রপাগান্ডা যে [নির্বাচন হয় কি না, অথবা নির্বাচনে কারচুপি হবে, অথবা নির্বাচনে বিরাট গোলযোগ হবে, বিরোধী প্রার্থী সলিহ জিতলেও ফল ঘোষণা করা হবে না ইত্যাদি] এসব সত্ত্বেও এগুলোর প্রতিটা যে ডাহা মিথ্যা তা ইয়ামিন প্রমাণ করে দিয়েছেন- একটা সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন সম্পন্ন করে দিয়ে, যা ভারত ও আমেরিকাসহ পশ্চিমাদের গালে এক বিরাট চপেটাঘাত।

কিন্তু এখন আগামী ১৭ নভেম্বর প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা হস্তান্তরের পর, এবার পালটা সলিহ ও নাশিদের দল ও জোট কী পালটা প্রতিশোধ নেয়া শুরু করবে আর একইভাবে রাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকেজো করে রাখবে? জবাব সম্ভবত হ্যাঁ, সেই সম্ভাবনাই বেশি। এক ভারতীয় ‘বিদ্বজ্জন’ অধীর আগ্রহে কি লিখেছেন লক্ষ করা যাক। তিনি বলছেন, ‘নতুন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য মালদ্বীপ এবার ভারতের দিকে ফিরতে পারে এবং অবশ্যই ফিরবে।’ অর্থাৎ সে সম্ভাবনা বাস্তব হলে, নাশিদ ও তার দলবলের মালদ্বীপকে চীন-ভারতের হাতে পিংপং বল করে ফেলা- এক বিরাট অযোগ্যতা, আনফিট রাজনীতিক হওয়া হবে।

আসলে মালদ্বীপ নিয়ে ভারতের এখনই উৎফুল্ল হওয়ার কিছু নেই। মালদ্বীপে পার্লামেন্টারি নির্বাচন হবে ২০১৯ সালের মে মাসে। অতীতের রেকর্ড বলে, সে নির্বাচনে ইয়ামিনের দল আবার পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ নিয়ে ফিরে এসে যেতে পারে। এ ছাড়া নাশিদের জন্য আরো বড় বিপদ হলো, তারা জিতেছে জোট হিসেবে। একদিকে জোটের মেনিফেস্টো অসম্পূর্ণ, আবার বলা আছে জোটের এগ্রিমেন্ট পার্লামেন্ট বসার ৩০ দিনের মধ্যে স্বাক্ষরিত হতে হবে।
এ ছাড়া নাশিদের দল চায় রাষ্ট্রপতির নির্বাহী ক্ষমতা উঠিয়ে দিয়ে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকারে চলে যায়। কিন্তু জোট শরিকেরা এতে একমত নয়। ফলে বহু যদি, কিন্তু ও অনিশ্চয়তা অপেক্ষা করছে।

তবে আমাদের জন্য সার কথা হলো, আমাদের দলগুলো একেকটা চীন অথবা ভারতের এজেন্সি নিয়ে বিভক্ত হয়ে যেতে পারবে না। চীন, ভারত অথবা আমেরিকার আগে সবসময় বাংলাদেশের রাষ্ট্রস্বার্থ প্রাধান্যে ও স্বচ্ছতা নিয়ে হাজির হতে হবে। নইলে নিজেরাই তছনছ হয়ে যাওয়ার শুরু হবে সেখান থেকেই।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com


আরো সংবাদ



premium cement