২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
আত্মপক্ষ

উদার গণতন্ত্র বনাম বাকশাল

উদার গণতন্ত্র বনাম বাকশাল - সংগৃহীত

শেখ মুজিবুর রহমান একসময় উদার গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। উদার গণতন্ত্র বলতে তিনি মূলত বুঝতেন, ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রকে। তিনি ২০১২ সালে প্রকাশিত তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে এক জায়গায় বলেছেন, তিনি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করলেও কমিউনিস্ট নন। কাজে কাজেই বিশ্বাস করা চলে, তিনি ভাবতেন আইনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক উপায়ে ধাপে ধাপে সমাজে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার কথা। বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে এক দলের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে রাষ্ট্রীক পরিকল্পনা অনুসারে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লেনিনবাদী দর্শনে তার আস্থা ছিল না।

ব্রিটেনে লেবার পার্টি বিশ্বাস করত গণতান্ত্রিক উপায়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণে। শেখ মুজিবের কথাতে মনে হয় তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন ব্রিটিশ লেবার পার্টির ভাবাদর্শে। কমিউনিস্ট মতাদর্শে নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমাজতান্ত্রিক দর্শনে বিশ্বাস না করলেও গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রীদের ভাবে না মার্কিন ধ্যান ধারণার শত্রু হিসেবে।

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট যা ঘটেছে তার মূল কারণ শেখ মুজিবুর রহমান গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী না থেকে সোভিয়েট কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে পড়া। আমাদের পত্রপত্রিকায় বলা হচ্ছে শেখ মুজিব নিহত হওয়ার কারণ ছিল, তার বাঙালিত্ব বোধ। কিন্তু তিনি তার বাঙালিত্ব বোধের জন্য যে নিহত হয়েছিলেন তা বলা যাবে না। কেননা, যারা সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল, তাদের মধ্যেও বাঙালিত্ব বোধের অভাব ছিল না। কেন শেখ মুজিব সোভিয়েট ইউনিয়নের প্রতি ঝুঁকে পড়েছিলেন তা নিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন। তা না হলে, শেখ মুজিবের মৃত্যুর পটভূমি অস্পষ্ট হয়েই থাকবে।

সম্প্রতি বাংলাদেশের খ্যাতনামা জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান (পদ্মভূষণ) তার একটি স্মৃতিচারণমূলক লেখায় বলেছেন : ‘আমরা টের পাই, আমাদের সবার মধ্যে শেখ মণিকেই বেশি খাতির করছে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ। মস্কোর এক সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলে বুঝি, তার ধারণা এবং নিশ্চয় আরো অনেকের- যে, মণি আসলে কমিউনিস্ট এবং বাংলাদেশে যদি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে তার নেতৃত্বেই হবে। ঢাকায় রুশ দূতাবাসের অতি সজ্জন কাউনসেলরকে দেখি মণির সেবায় সদাব্যস্ত। মস্কোর নানাজন আসেন মণির সঙ্গে দেখা করতেÑ কাউনসেলর দোভাষী কাজ করেন, হাবেভাবে মনে হয়, দর্শনপ্রার্থীরা সকলেই কমিউনিস্ট পার্টির বিশিষ্টজন’ (নতুন যুগের ভোরে, শব্দঘর, জানুয়ারি ২০১৮)।

শেখ ফজলুল হক মণি ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগের মধ্যে হয়ে উঠেছিলেন একজন খুবই শক্তিমান ব্যক্তিত্ব। তিনি চাচ্ছিলেন, বাইরে থেকে দেখে আমাদের মনে হয় বাংলাদেশে রাষ্ট্রক্ষমতা পেতে। আর তিনি ভেবে ছিলেন, এ ক্ষেত্রে তার সহায়ক হবে সোভিয়েত ইউনিয়ন। কিন্তু তার অদৃষ্ট সিদ্ধ হতে পারেনি। পারেনি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটতে পারার ফলে। যার পশ্চাতে ছিল মার্কিন সমর্থন। সেটা ছিল ঠাণ্ডা লড়াইয়ের যুগ। তাই সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে মার্কিন সমর্থন মোটেও অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না। এই অভ্যুত্থানে কেবল শেখ মুজিবুর রহমান নয়; শেখ মণিও হয়েছিলেন খুন।

একসময় শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খুবই কাছের লোক। অনেকে তাকে বলতেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন আজ্ঞাবহ ব্যক্তি। বিশেষ করে এ দেশের বামপন্থীরা। ১৯৫৬ সালে ১২ সেপ্টেম্বর শেখ মুজিবুর রহমানের নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন এবং প্রধানমন্ত্রী থাকেন ১৯৫৭ সালের ১১ অক্টোবর পর্যন্ত। তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় রাজনৈতিক সফরে যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এই সফরে তিনি তদানীন্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইজেন হাওয়ারের সাথে এক যুক্ত ইশতেহারে ঘোষণা করেন, ‘স্বাধীন বিশ্বের জন্য আন্তর্জাতিক কমিউনিজম এক বিরাট হুমকি হয়ে উঠেছে।’ সোহরাওয়ার্দীর এই বক্তব্যের জন্য মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী খুবই ক্ষুব্ধ হন এবং বাধ্য হন আওয়ামী লীগ পরিত্যাগ করতে।

সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানীর মধ্যে এই মতবাদিক বিরোধে শেখ মুজিবুর রহমান গ্রহণ করেছিলেন সোহরাওয়ার্দী সাহেবেরই পক্ষ; ভাসানীর পক্ষ নয়। অর্থাৎ তিনিও মনে করতেন আন্তর্জাতিক কমিউনিজম প্রতিরোধ করতে হবে। অথচ ১৯৭৫ সালে তিনি হাত মেলান সোভিয়েট ইউনিয়নের সাথে। কেন, কী কারণে? তিনি এটা করেছিলেন আমরা তা জানি না। আমরা তাই মনে করি, বাংলাদেশের ইতিহাসকে বুঝতে হলে বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তা আছে।

শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী লিখিত হয়েছিল ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সালের মধ্যে। এ সময় শেখ মুজিব ছিলেন কমিউনিস্ট বিশ্বের বিরোধী। তার চিন্তাধারায় বিরাট পরিবর্তন এসেছিল এর অনেক পরে। শেখ মুজিবের অসমাপ্ত আত্মজীবনী পাঠের সুবিধার জন্য বইটিতে নিযুক্ত করা হয়েছে বিভিন্ন ব্যক্তির ‘জীবনবৃত্তান্তমূলক টীকা’। যাদের সাথে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবন কোনো না কোনো সময় হয়ে পড়েছে জড়িত। যেমন, খোন্দকার মোশতাক আহমদ (১৯১৮-১৯৯৬) সম্বন্ধে লেখা হয়েছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ইনি ছিলেন বিতর্কিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকারের (১৯৭১-১৯৭৫) বিভিন্ন দফতরের মন্ত্রী ১৯৭৫-এ শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের ষড়যন্ত্রমূলক হত্যায় ছিল তার সংশ্লিষ্টতা, এই রকমই অনুমান করা হয়। ১৯৭৫ এর সামরিক অভ্যুত্থানের পর মোশতাক হন রাষ্ট্রপতি।

এ প্রসঙ্গে আমার ব্যক্তিগত জ্ঞান থেকে আরো কিছু কথা যোগ করতে চাই। মোশতাক আহমদ এবং শেখ মুজিব উভয়ই হলেন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। এরা ছিলেন একে অপরের সাথে খুবই ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। ১৯৭১ সালে মোশতাক কলকাতায় যান, কিন্তু শেখ মুজিব কলকাতায় যান না। পাকিস্তান থেকে শেখ মুজিব কলকাতায় মোশতাককে নির্দেশ পাঠান, কলকাতা থেকে আওয়ামী লীগের এমএনএ-দের সাথে নিয়ে ঢাকায় যেতে। ঢাকায় গিয়ে পাকিস্তানের পূর্ব এবং পশ্চিম অংশের মধ্যে কনফেডারেশন করা যায় কিনা সে বিষয়ে আলোচনা করতে। মোশতাকের কাছে শেখ মুজিব এই বাণী পাঠিয়েছিলেন কলকাতায় অনুষ্ঠিত মার্কিন কনসালের মাধ্যমে। মোশতাক এটা করতে চান। কিন্তু ভারত সরকার তাকে করেন গৃহবন্দী। আর এমএনএদেরও আসতে দেয় না ঢাকায়।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ মুজিবের সাথে বিপুল মতভেদ দেখা যায় তাজউদ্দীন আহমদের। শেখ মুজিব বাধ্য হন তাজউদ্দীনকে তার মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিতে। কিন্তু মোশতাককে তিনি কখনোই তার মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেননি। এমনকি বাকশাল পর্যন্ত গঠন করেছিলেন তাকে একজন মন্ত্রী রেখেই। অর্থাৎ মোশতাককে শেখ মুজিব কখনোই তার রাজনৈতিক শত্রু ভাবেননি। যদিও হয়তো কিছু মতোবিরোধ তার সাথেও ছিল। একটা বিষয় লক্ষ করার মতো, তা হলো মোশতাক সরকারকে ভারত সরকার কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিয়েছিল ২৭ আগস্ট। আর চীন মোশতাক সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিয়েছিল ৩১ আগস্ট।

কেন ভারত চীনের আগেই তড়িঘড়ি করে মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, তার কোনো ব্যাখ্যা এ পর্যন্ত কেউ দিয়েছেন বলে আমার জানা নাই। যদিও শুনেছিলাম ঢাকায় সামরিক অভ্যুত্থান হওয়ার পরপরই ইন্দিরা গান্ধী নাকি বাংলাদেশে পাঠাতে চেয়েছিলেন ভারতীয় সৈন্য। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল, ভারত সৈন্য পাঠালে সেও পাঠাবে। রাজশাহী সীমান্ত-শহর। পদ্মা পেরুলেই শুরু হয় ভারত। নদীর ওপার থেকে অনেক সহজে অনেক খবর বাতাসে ভেসে আসে এখানে। এরকম বাতাসে ভেসে আসা খবরের ওপর নির্ভর করেই আমার বর্তমান মন্তব্য করা।

১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে হয়েছিল এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। এই দুর্ভিক্ষে একটি হিসাব অনুসারে মারা যান প্রায় ৫৪ হাজার মানুষ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ সময় দিয়েছিল যথেষ্ট খাদ্য সাহায্য। যার পরিমাণ ছিল আড়াই লাখ টন (ব্রিটিশ টন)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই খাদ্য সাহায্য না দিলে আরো বহুলোক বাংলাদেশে অনাহারে মারা যেতেন। কিন্তু এ সময়ও একদল বামপন্থী রাজনীতিক বলছিলেন, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক। আর আওয়ামী লীগের একাংশ শেখ মণির নেতৃত্বে ঝুঁকে পড়ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি। এই ইতিহাস যথেষ্ট বিচিত্র।হ

লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement
সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে সন্ত্রাসনির্ভর হয়ে গেছে : রিজভী রাশিয়ার ৯৯টি ক্ষেপণাস্ত্রের ৮৪টি ভূপাতিত করেছে ইউক্রেন আওয়ামী লীগকে ‘ভারতীয় পণ্য’ বললেন গয়েশ্বর দক্ষিণ আফ্রিকায় সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে দাগনভুঞার যুবক নিহত কাশ্মিরে ট্যাক্সি খাদে পড়ে নিহত ১০ অবশেষে অধিনায়কের ব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছল পাকিস্তান জাতিসঙ্ঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থাকে আবার অর্থায়ন শুরু করবে জাপান শেখ হাসিনার অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি বিএনপিকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে : ওবায়দুল কাদের রাশিয়া সমুদ্র তীরবর্তী রিসোর্টে ১৬.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে সিরিয়ায় ইসরাইলি হামলায় নিহত ৩৬ সেনা সদস্য দৌলতদিয়া ঘাটে পন্টুন থেকে নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু

সকল