কোটা সংস্কার আন্দোলন
- প্রফেসর আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী
- ১৭ জুলাই ২০১৮, ১৮:৫৬, আপডেট: ১৭ জুলাই ২০১৮, ১৯:০২
চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন সম্পর্কে দেশবাসী কম-বেশি জ্ঞাত আছেন। আন্দোলনের এ পর্যায়ে এতে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের ওপর যে নগ্নহামলা হয়েছে, তাতে যেকোনো বিবেকবান মানুষ ব্যথিত না হয়ে পারেন না। সরকারের মদদপুষ্ট ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা ও নির্যাতন চালায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একই ধরনের হামলা চালিয়েছে তারা। শহীদ মিনারে হামলার ঘটনা টিভি চ্যানেলসহ মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছে। এতে হামলাকারীদের পরিচয় স্পষ্টভাবে জানা গেছে। বীরদর্পে তারা ঘটনাস্থলে আবির্ভূত হয়েছে এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রকাশ্যে কিল, ঘুষি ও লাথি মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে। শহীদ মিনারে ও ক্যাম্পাসে ছাত্রীদের ওপরও তারা অমানবিক ও নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছে। আন্দোলনরত এক ছাত্রকে হাতুড়ি দিয়ে পেটানোর নির্মম ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে। এ দৃশ্য যারা প্রত্যক্ষ করেছেন, তারা এতে বিস্মিত ও উদ্বিগ্ন না হয়ে পারেননি। শুধু তা-ই নয়, এই আন্দোলনের নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। তাদের পরিবার-পরিজনের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে এবং তাদের নানাভাবে হয়রানি ও অসম্মান করা হচ্ছে, যেন আন্দোলনের পথ থেকে সরে আসে। পুলিশ ও সরকারদলীয় ছাত্রদের নানাবিদ হুমকি ও নির্যাতন অব্যাহত আছে।
এসব নির্যাতন আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় ষাটের দশকে তদানীন্তন পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের মদদপুষ্ট ছাত্রসংগঠন এনএসএফের অত্যাচার, অনাচার ও নিপীড়নের কাহিনী। এনএসএফের পুরো নাম ছিল National Students Federation এবং এর মূল নেতারা ছিল ছাত্র নামধারী গুণ্ডা, মাস্তান। আইয়ুব খান, মোনেম খান ও তাদের পেটোয়া বাহিনী, পুলিশবাহিনীর ছত্রছায়ায় এনএসএফ বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। তখনকার স্বাধিকার আন্দোলন তথা পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ ও বঞ্ছনার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছিল, তাকে স্তব্ধ করার জন্য আইয়ুব শাহী এনএসএফ সন্ত্রাসী ও গুণ্ডাদের ব্যবহার করেছে। তাদের লেলিয়ে দেয়া হয় আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের ওপর। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের অগণিত নেতাকর্মী তাদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন। কিন্তু কোনো স্বৈরশাসক ও ফ্যাসিবাদী শাসক নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়ে ক্ষমতার মসনদে টিকে থাকতে পারেনি। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আইয়ুবের মসনদ তাসের ঘরের মতো খান খান হয়ে যায়, আর আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের পথ বেয়ে ১৯৭১ সালে শুরু হয় বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা সংগ্রাম। আমরা প্রতিষ্ঠা করেছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আন্দোলন-সংগ্রাম চলাকালে এনএসএফের গুণ্ডারা জনতার রুদ্ররোষে পতিত হয় এবং তাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়।
আজ যারা কোটা সংস্কারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছে, রাজপথে নেমেছে, তারা তো কোনো অন্যায় করেনি। তাদের দাবি ন্যায়সঙ্গত ও যৌক্তিক। অন্দোলনকারীরা মূলত বিভিন্ন কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। শিক্ষাজীবন শেষ করে তারা কর্মজীবনে প্রবেশ করবে। অবশ্যই সরকারি চাকরি কর্মজীবনে প্রবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সোপান। কিন্তু দেশে একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোটাপ্রথা চালু রয়েছে। এতে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে একধরনের বৈষম্য ও বঞ্চনার সৃষ্টি হয়েছে। তাই দাবি উঠেছে প্রচলিত কোটাব্যবস্থার সংস্কারের। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা কখনো কোটাপ্রথার বাতিল বা বিলুপ্তি চায়নি, চেয়েছে এটাকে rationalize করতে। অর্থাৎ কোটাপ্রথার যেন একটি যৌক্তিক ভিত্তি থাকে। আবারো উল্লেখ করতে চাই- এটি কোটা সংস্কারের আন্দোলন, কোটা বাতিলের আন্দোলন নয়।
একজন মেধাবী তরুণ যদি শুধু অযৌক্তিক কোটাপদ্ধতির কারণে চাকরি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হন, তাহলে স্বভাবতই তিনি হতাশ হবেন, তার মনে ক্ষোভের সৃষ্টি হবে। শিক্ষার্থীরা দেখেছেন, অযৌক্তিক কোটাপদ্ধতির কারণে বহু মেধাবী ও যোগ্যতাসম্পন্ন চাকরিপ্রার্থী তরুণ নিয়োগ পাচ্ছেন না। প্রচলিত বৈষম্যমূলক কোটাপদ্ধতি তাই তাদের বিক্ষুব্ধ করেছে। এরই বহিঃপ্রকাশ চলমান কোটাসংস্কার আন্দোলন। আরেকটি কথা এখানে বলা প্রয়োজন এবং তা হলো- দেশে বর্তমানে ভয়াবহ বেকার সমস্যা। তীব্র বেকার সমস্যার কারণে কোটা সংস্কারের জোর দাবি উঠেছে। বেকার সমস্যা যতই গভীর হবে, কর্মহীন তরুণ-তরুণীর সংখ্যা যতই বৃদ্ধি পাবে, সমাজ ততই অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে, সঙ্কট হবে ঘনীভূত। আজ যদি শিক্ষিত যুবাদের পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা থাকত, তাহলে হয়তো কোটা সংস্কার আন্দোলন এতটা বেগবান হতো না। বেকারত্ব একটি সমাজের জন্য অভিশাপ। তাই যেসব সমাজ সুপরিকল্পিত, সেখানে এ সমস্যা কখনো প্রকট হয় না। আমাদের মতো অপরিকল্পিত সমাজে বেকারত্ব একটি প্রধান সমস্যা। বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। লেখাপড়া শেষ করে যদি একজন তরুণ বা তরুণীকে বেকার জীবনযাপন করতে হয়, তাহলে সে জীবন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে। এমনটি কাম্য নয় বলে আজকের শিক্ষার্থীরা কোটার সংস্কার দাবি করছেন। শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক ইস্যুতে নয়। তারা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য রাজপথে নামেননি। রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার জন্য তারা আন্দোলন করছেন না। কোনো রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের জন্য তারা সেøাগান-মিছিল করেননি। উদ্দেশ্য একটাই, তা হলো- তাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে কিছুটা নিশ্চিত করার জন্য প্রচলিত কোটাপদ্ধতির কিছু সংস্কার। সংস্কারের বিষয়টা এমন জটিল নয় যা সরকারি আমলারা বলার চেষ্টা করছেন। এই আন্দোলন শুরু হয়েছে বেশ কয়েক মাস আগে। সরকার তথা সংশ্লিষ্ট মহল আন্তরিক হলে ইতোমধ্যে এর একটি সুন্দর সমাধানে পৌঁছা যেত।
সমাজের পিছিয়ে পড়া তথা অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার জন্য সীমিত আকারে কোটাপ্রথা চালুর যুক্তি অস্বীকার করার উপায় নেই। বিশেষ করে, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটার মাধ্যমে তাদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। শুধু আমাদের দেশে নয়, অনেক দেশেই এ নিয়ম চালু আছে। আমাদের দেশের বেশ কয়েকটি প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সুবিধাবঞ্চিত। আমি মনে করি, এসব জনগোষ্ঠীর জন্য সীমিত আকারে কোটা থাকতে হবে। আমাদের দেশে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের জন্য কোটা বরাদ্দ আছে। এটাও যৌক্তিক। এগুলো বাতিল করার কোনো প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন হলো- সমগ্র কোটাপদ্ধতিকে ৎধঃরড়হধষরুব করা। অর্থাৎ সীমিত পরিমাণ কোটা রাখতে হবে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার জন্য। তা ছাড়া এমন একটি বিধান রাখতে হবে যদি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের কোটা অপূর্ণ থেকে যায়, তাহলে সে চাকরিগুলো মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পূরণ করতে হবে। এভাবে একটি যৌক্তিক কোটাপদ্ধতি চালু হলে অসন্তোষ দূর হবে বলে আশা করা যায়।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্রছাত্রীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলাটা কি সঠিক বা শোভন হয়েছে? কেমন করে এত বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী ‘রাজাকারের বাচ্চা’ হয়? যিনি এটা বলেছেন তিনি কি আরেকবার ভেবে দেখবেন? সরকারপ্রধান কোটা বাতিলের ঘোষণা দিলেন বটে কিন্তু তা কার্যকর হলো না আজ পর্যন্ত। অথচ আন্দোলনকারীরা কোটা বাতিল চাননি, চেয়েছেন সংস্কার। এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারির অপেক্ষায় ছিলেন শিক্ষার্থীরা। কিছুই যখন পেলেন না, তখন পুনরায় তারা আন্দোলন শুরু করেছেন স্বাভাবিকভাবেই।
এবার তাদেরকে প্রতিহত করতে মাঠে নেমেছে ক্ষমতাসীন দলীয় ছাত্রসংগঠন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নির্যাতন-নিপীড়নের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। শিক্ষার্থীদের গ্রেফতার ও নির্যাতনের প্রতিবাদে শিক্ষক ও অভিভাবকেরা প্রতিবাদ করতে গেলে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে তাদেরকে শান্তিপূর্ণ সভা করতে দেয়া হয়নি। প্রতিবাদী কোনো কোনো শিক্ষককে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। এর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা প্রতিবাদ, মিছিল এবং শহীদ মিনারে সমাবেশ করেছেন। ছাত্র-শিক্ষকেরা এ হামলা, নির্যাতন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে হয়েছেন সোচ্চার। শিক্ষার্থীরা ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করে চলেছেন। আন্দোলন সংগ্রামে আজ উত্তাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা প্রতিবাদী শিক্ষকদের ধন্যবাদ জানাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসমাজ সবসময় স্বৈরশাসকদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নির্যাতন-নিপীড়নের বিরোধিতা করে এসেছেন, ন্যায় ও সত্যের পথে অবিচল থেকেছেন। তাদের প্রতিবাদ কখনো বৃথা যায়নি, বৃথা যেতে পারে না। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে এহেন নির্যাতন ও নিপীড়ন চলতে পারে না। আজকের বাংলাদেশে গণতন্ত্র অনুপস্থিত। জনগণের অনেক মৌলিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত। শাসক শ্রেণীর নির্মম দমন ও শোষণে জনগণ দিশেহারা। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা যে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলাম, সেই বাংলাদেশের এমন অবস্থা হবে তা কখনো ভাবিনি। এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য জনগণকে খুব বড় ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত হতে হবে। গণতন্ত্র অর্জিত হলে কোটাপদ্ধতিসহ সর্বক্ষেত্রেই সংস্কার করা সম্ভব হবে।
লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, সাবেক রাষ্ট্রদূত
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা