০৯ অক্টোবর ২০২৪, ২৪ আশ্বিন ১৪৩১, ৫ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

অবৈধ ট্রাইব্যুনালের বিচারে জীবনহানি- দায় কে নেবে

- ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের সংবিধান গণপরিষদে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গৃহীত হওয়ার পর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ সাল হতে কার্যকর হয়। সংবিধান কার্যকর হওয়া পরবর্তী প্রথম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ। নির্বাচনটি দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত হওয়ায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনটিকে নগ্ন হস্তক্ষেপে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে দলটির একচেটিয়া বিজয় নিশ্চিত করে। নির্বাচনটিতে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের ২৯৩টি আসনে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। অন্য দিকে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ও বাংলাদেশ জাতীয় লীগ উভয়কে একটি করে আসনে এবং স্বতন্ত্রকে ৫টি আসনে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।

সংবিধান কার্যকর হওয়ার সাত মাসের মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিতে ১৫ জুলাই ১৯৭৩ সালে সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যাজনিত অপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধের বিচারে আইন তৈরির ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়। সংশোধনীটির মাধ্যমে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৭ এ দফা (৩) এবং নতুনভাবে অনুচ্ছেদ ৪৭ক সন্নিবেশিত হয়।
অনুচ্ছেদ ৪৭ এর দফা (৩) এ বলা হয়- এ সংবিধানে যা বলা হয়েছে, তা সত্ত্বে ও গণহত্যাজনিত অপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীন অন্যান্য অপরাধের জন্য কোনো সশস্ত্রবাহিনী বা প্রতিরক্ষা বাহিনী বা সহায়ক বাহিনীর সদস্য বা অন্য কোনো ব্যক্তি, ব্যক্তি সমষ্টি বা সংগঠন কিংবা যুদ্ধবন্দীকে আটক, ফৌজদারিতে সোপর্দ কিংবা দণ্ডদান করার বিধান-সংবলিত কোনো আইন বা আইনের বিধান এ সংবিধানের কোনো বিধানের সাথে অসামঞ্জস্য বা তার পরিপন্থী, এ কারণে বাতিল বা বেআইনি বলে গণ্য হবে না কিংবা কখনো বাতিল বা বেআইনি হয়েছে বলে গণ্য হবে না।

সংবিধানের প্রথম সংশোধনী প্রণয়নকালে অভিযুক্ত হিসেবে শুধু সশস্ত্রবাহিনী, প্রতিরক্ষা বাহিনী বা সহায়ক বাহিনীর সদস্যের বিষয় উল্লেখ ছিল। পরবর্তীতে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অনুচ্ছেদ ৪৭-এর দফা (৩) এ অভিযুক্ত হিসেবে উপরিউক্ত তিনটি বাহিনীর সদস্যের সাথে ব্যক্তি, ব্যক্তি সমষ্টি বা সংগঠন সংযোজিত হয়। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অভিযুক্তদের ব্যাপ্তি বৃদ্ধিকরত মূলত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ যারা মুক্তিযুদ্ধকালীন কোনো বাহিনীর সদস্য ছিলেন না তাদের বিচারের পথ উন্মুক্ত করা হয়।

দৃশ্যত সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদে দফা (৩) সন্নিবেশনে প্রতীয়মান হয় সামরিক বা বেসামরিক যে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের গণহত্যাজনিত অপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধবিষয়ক প্রণীত কোনো আইন এবং উক্ত আইনের অধীন বিচার ও দণ্ডের বিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হলেও তার প্রাধান্য অক্ষুণ্ন থাকবে।

সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে সংযোজিত ৪৭ক অনুচ্ছেদে দু’টি দফা রয়েছে। দফা (১) এ বলা হয়েছে- যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে এ সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের (৩) দফায় বর্ণিত কোনো আইন প্রযোজ্য হয়, সে ব্যক্তির ক্ষেত্রে এ সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ, ৩৫ অনুচ্ছেদের (১) ও (৩) দফা এবং ৪৪ অনুচ্ছেদের অধীন নিশ্চয়কৃত অধিকারসমূহ প্রযোজ্য হবে না।

সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারবিষয়ক। অন্য দিকে ৩৫ অনুচ্ছেদের দফা (১) কোনো কার্য সংঘটনকালে সেটি কোনো আইনের অধীন অপরাধ না হয়ে থাকলে দণ্ডদানে বারিত এবং অপরাধ সংঘটনকালীন যে দণ্ড ছিল তার চেয়ে অধিক দণ্ড না দেয়া বিষয়ক এবং দফা (৩) অভিযুক্ত ব্যক্তির দ্রæত ও প্রকাশ্য আদালতে বিচার লাভের অধিকার বিষয়ক। সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদ মৌলিক অধিকার বলবৎকরণ বিষয়ক।

সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদ পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় অনুচ্ছেদটির মাধ্যমে সংবিধানের তৃতীয়-ভাগে বর্ণিত মৌলিক অধিকারসমূহ বলবৎ করতে এ সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের দফা (১) অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগে মামলা দায়ের করার অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হলেও ৪৭ক(১) অনুচ্ছেদে বর্ণিত ব্যক্তি এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হিসেবে বিবেচিত হবে।

সংবিধানের ৪৭ক অনুচ্ছেদের দফা (২) এ উল্লেখ করা হয়েছে- এ সংবিধানে যা বলা হয়েছে, তা সত্তে¡ও যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে এ সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের (৩) দফায় বর্ণিত কোনো আইন প্রযোজ্য হয়, এ সংবিধানের অধীন কোনো প্রতিকারের জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করার কোনো অধিকার সে ব্যক্তির থাকবে না।

দফা (২) অনুধাবনে প্রতিভাত হয় যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে ৪৭ অনুচ্ছেদের দফা (৩) প্রযোজ্য হবে তিনি এ সংবিধানের অধীনে প্রতিকার প্রাপ্তির নিমিত্ত আবেদন করার জন্য অধিকারী হবেন না। দফাটির মাধ্যমে ধারণা পাওয়া যায় দফাটি প্রযোজ্য হয় এমন ব্যক্তির সংবিধানের অধীন প্রতিকার পাওয়ার অধিকার খর্ব করায় তা যেকোনো আইনের অধীন প্রতিকার পাওয়ার অধিকারও সমভাবে খর্ব করে।

১৫ জুলাই ১৯৭৩ সালে সংবিধানের প্রথম সংশোধনী প্রণয়ন পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যাজনিত অপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচার নিশ্চিতে ১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আইন প্রণীত হয়। আইনটি প্রণয়ন পরবর্তী প্রথমত ২০০৯ সাল এবং অতঃপর ২০১৩ সালে আইনটি সংশোধিত হয়। ২০০৯ সালে সংশোধনীর মাধ্যমে দণ্ড দ্বারা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল দায়েরের অধিকার দেয়া হয়। ২০১৩ সালের সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপক্ষ, ফরিয়াদি বা বাদিকে খালাস বা দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল দায়েরের অধিকার দিয়ে ভূতাপেক্ষ ১৪ জুলাই ২০০৯ সালে হতে কার্যকর করা হয়।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন, ১৯৭৩ এ ট্রাইব্যুনালের বিচারকের যোগ্যতার বিষয়টি ধারা ৬(২) এ বিবৃত হয়েছে। ধারাটিতে উল্লিখিত হয়েছে একজন ব্যক্তি যিনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারক অথবা বিচারক হওয়ার যোগ্য অথবা বিচারক হিসেবে কর্মরত তিনি ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বা মেম্বার পদে নিয়োজিত হতে পারবেন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ধারা ৬(২) এর বিধান পরিত্যক্ত ভবন (সম্পূরক বিধানাবলী) অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ এর ধারা ৯(৩) এর অনুরূপ। ধারাটিতে কোর্ট অব সেটেলমেন্টের চেয়ারম্যানের যোগ্যতা বিষয়ে বলা হয়েছে একজন ব্যক্তি যিনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারক, বিচারক হিসেবে কর্মরত অথবা বিচারক বা অতিরিক্ত বিচারক হওয়ার যোগ্য তিনি কোর্টের চেয়ারম্যান পদে নিয়োজিত হতে পারবেন।

পরিত্যক্ত ভবন (সম্পূরক বিধানাবলী) অধ্যাদেশ এরধারা ১০(৬) ও (৭) এ বলা হয় কোর্ট অব সেটেলমেন্টের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত এবং এর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অন্য কোনো আদালতে প্রতিকার চাওয়া বা আপিল দায়ের করা যাবে না। কোর্ট অব সেটেলমেন্টের সিদ্ধান্ত প্রদান পরবর্তী অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে প্রতিকার চাওয়া বা আপিল দায়েরের অধিকারের অনুপস্থিতিতে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রিট মামলা দায়েরপূর্বক ক্ষেত্র বিশেষে প্রতিকার প্রাপ্ত হয়েছেন।

সুপ্রিম কোর্টে কর্মরত বিচারকদের ক্ষেত্রে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৪ দফা (৩) এ বলা হয়েছে- প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগে নিযুক্ত বিচারকগণ কেবল উক্ত বিভাগে এবং অন্যান্য বিচারক কেবল হাইকোর্ট বিভাগে আসন গ্রহণ করবেন।

বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতিসহ সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে আসীন ব্যক্তিরা শপথের অধীন। শপথগ্রহণ ছাড়া তারা যেমন পদে আসীন হন না; অনুরূপ পদ হতে অবসর পরবর্তী শপথ হতে অবমুক্ত হয়ে যান। প্রধান বিচারপতিসহ সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকগণ বিচার কার্য পরিচালনার নিমিত্ত প্রকাশ্য আদালতে আসন গ্রহণ করেন। উল্লিখিত বিচারপতি ও বিচারকদের বিচারিক সিদ্ধান্ত প্রদানে বর্ণিত আদালতে আসন গ্রহণ ছাড়া অপর কোনো বিচারালয়ে আসন গ্রহণের মাধ্যমে বিচারকার্য পরিচালনার অধিকার বা ক্ষমতা দেয়া হয়নি।

যেসব বিষয়ে সংবিধানের ব্যক্ত অবস্থান স্পষ্ট হওয়ায় সংবিধান বিষয়ে সাধারণ জ্ঞান আছে এমন যেকোনো ব্যক্তির পক্ষে বিধানটির সহজ পাঠে এর ব্যাখ্যা অনুধাবন সম্ভব সেসব বিষয় নিয়ে যেকোনো ধরনের বিতর্ক পরিহার উত্তম মর্মে বিবেচিত।

উল্লেখ করা প্রয়োজন ’৭২-এর সংবিধানে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অবসর পরবর্তী প্রজাতন্ত্রের যেকোনো ধরনের লাভজনক পদে নিয়োগ লাভ সম্পূর্ণরূপে বারিত ছিল। পরবর্তীতে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অবসর-পরবর্তী প্রজাতন্ত্রের লাভজনক বিচারিক বা আধা-বিচারিক পদে নিয়োগের যোগ্য করা হয়। হাইকোর্ট বিভাগ হতে অবসর পরবর্তী আপিল বিভাগে ওকালতি করার অধিকার দেয়া হয়। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের দ্বারা সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল বা অবৈধ ঘোষণা করা হলেও সংশোধনীটি কার্যকর পরবর্তী সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অবসর পরবর্তী নিয়োগের বিধান ও ওকালতি করার বিধান অক্ষুণ্ন রাখা হয়।
উচ্চাদালতের বিচারকদের অবসর পরবর্তী প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদে নিয়োগ বা ওকালতি করার বিধান বারিতের পেছনের মূল কারণ তারা যেন অবসরের পূর্বে রাষ্ট্রের নির্বাহী কর্তৃপক্ষের সব ধরনের প্রলোভনের ঊর্ধ্বে থেকে বিচারকার্য পরিচালনা করতে পারেন। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের পরও প্রলোভনের বিধান অক্ষুণ্ন রাখায় অবসরের আগ-মুহূর্তে আগেকার ন্যায় উচ্চাদালতের অধিকাংশ বিচারককে অবসর-পরবর্তী নিয়োগ লাভের অশুভ প্রতিযোগিতার দৌড়ে মর্যাদাহানিকরভাবে লিপ্ত থাকতে দেখা যায়।

মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতা আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। দণ্ডাদেশ প্রদানকালীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন, ১৯৭৩ এ দণ্ডাদেশ দ্বারা রাষ্ট্রপক্ষ সংক্ষুব্ধ হলে রাষ্ট্রপক্ষ, বাদী বা ফরিয়াদির সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল দায়েরের বিধান ছিল না। দণ্ডাদেশটি প্রদানের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন, ১৯৭৩ এর ধারা ২১পুনঃসংশোধনকরত সংক্ষুব্ধ হিসেবে রাষ্ট্রপক্ষ, বাদি বা ফরিয়াদিকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল দায়েরের অনুমতি দেয়া হয়। রায় প্রদানের পর সাজা বর্ধিতের বিধান সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫ দফা (১) এর বিধানের আলোকে হানিকর হওয়া সত্তে¡ও এর উপেক্ষা ও অবজ্ঞা ন্যায়বিচারে অন্তরায় হিসেবে বিবেচিত নয় কী!

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৭ক দফা (২) এ সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে, যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে অনুচ্ছেদ ৪৭ দফা (৩) এ বর্ণিত আইন প্রযোজ্য হয় সে ব্যক্তির সুপ্রিম কোর্টে প্রতিকার চেয়ে আবেদন করার অধিকার বারিত। সংবিধানে এরূপ অধিকার বারিত করায় স্বভাবত প্রশ্নের উদয় হয় কোনো আইনে এরূপ অধিকার দেয়ার সুযোগ আছে কি না? সংবিধান দ্বারা বারিত হলে আইনে সুযোগ থাকবে না বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে ২০০৯ সালে ও ২০১৩ সালে সংশোধনীর মাধ্যমে সুযোগের বিধান করা সংবিধানের বিধানের অন্তরায় নয় কী!

সংবিধানের প্রথম সংশোধনী কার্যকর পূর্ববর্তী এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন, ১৯৭৩ প্রণয়ন পূর্ববর্তী ২৪ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ যোগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশ জারি করা হয়। আদেশটি দালাল আইন নামে সমধিক পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধকালীন দেশীয় যারা পাকিস্তান বাহিনীর সহযোগী হিসেবে দেশবাসীর ওপর অত্যাচার নিপীড়ন করেছিল তাদের বিচারের আওতায় এনে সাজাদানের উদ্দেশ্যে আইনটি প্রণীত। ২৮ মার্চ ১৯৭৩ সালে আদেশটির অধীন ৭৩টি ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। অক্টোবর ১৯৭৩ সাল অবধি ৩৭,৪৭১টি মামলা দায়ের হয়। অক্টোবর ১৯৭৩ সাল অবধি ২,৮৮৪টি মামলা নিষ্পত্তির মাধ্যমে ৭৫২ ব্যক্তিকে সাজা প্রদান করা হয়। ১ ডিসেম্বর ১৯৭৩ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ৩৬,৪০০ কথিত যোগসাজশকারী বা দালাল বিষয়ে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন; তবে এ ঘোষণা হতে যুদ্ধকালীন নরহত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের বারিত রাখা হয়। আদেশটি কার্যকর আইন হিসেবে সংবিধানের প্রথম তফসিলে অন্তর্ভুক্ত হয়। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশ যোগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশটি বাতিল হলে সংবিধানের প্রথম তফসিল হতে আদেশটি বিলুপ্ত হয়। অতঃপর সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ২০১১ সালে পুনঃ আদেশটি সংবিধানের প্রথম তফসিলে সন্নিবেশিত হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের সাধারণ ঘোষণা-পরবর্তী দালাল আইনের অধীন নরহত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সচল থাকবে বলা হলেও এর বিচারে ছেদ পড়ে। ২০১১ সালে দালাল আইনটি পুনর্জীবিত করা হলেও বর্ণিত অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের এ আইনের অধীন বিচারের আওতায় আনা হয়নি।

প্রসঙ্গত, ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের রাজধানী হতে একযোগে প্রকাশিত তিনটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যথাক্রমে আজিজ আহমেদ, স্বরণ সিং ও ড. কামাল হোসেন স্বাক্ষরিত চুক্তিটি ছিল সমঝোতামূলক। উক্ত চুক্তিতে উল্লেখ ছিল পাকিস্তান সরকারের যেকোনো অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকলে তার জন্য তারা নিন্দা জানায় এবং অনুশোচনা প্রকাশ করে। চুক্তিটিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর বরাতে উল্লেখ ছিল, বাংলাদেশের জনগণ অতীতের ভুল ক্ষমা করে এবং ভুলে গিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে অবদান রাখবেন। অনুরূপ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের বরাতে উল্লেখ ছিল, তিনি চান ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত নৃশংসতা ও ধ্বংসের বিষয়ে জনগণ অতীত ভুলে যাক এবং আবার নতুন করে শুরু করুক। চুক্তিটির মূল উপপাদ্য বিবেচনায় নিয়ে দু’টি ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম দেশ নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক নিবিড় করে সব ক্ষেত্রে সহযোগিতার হাত প্রশস্ত করবে পাকিস্তানের জনমানুষের পক্ষ হতে এমন ধারণা ব্যক্ত করা হয়।

১৯৭৩ সালের ১ ডিসেম্বর যুদ্ধাপরাধে সম্পৃক্ত দেশীয় ব্যক্তিদের শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষমা ঘোষণা এবং ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল দিল্লিতে তিন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর স্বাক্ষরিত চুক্তিটির মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল ভারতে আটক ৯২ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যসহ যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ১৯৫ সেনা কর্মকর্তার ক্ষমা ঘোষণা। শেখ মুজিবুর রহমানের গৃহীত উভয় পদক্ষেপ বিবেচনায় নিলে এটি স্পষ্ট প্রতিভাত যে, তিনি জাতীয় ও আঞ্চলিক ক্ষেত্রে বিভাজন এড়িয়ে সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হওয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের গৃহীত পদক্ষেপ হতে বিচ্যুত হয়ে অতীতের রুদ্ধ বিষয়ের পুনঃচালু করা কতটুকু যৌক্তিক যখন দিল্লি চুক্তির দায় হতে উদ্ভূত বাধ্যবাধকতায় কথিত যুদ্ধাপরাধের সাথে মূল অভিযুক্ত পাকিস্তানের ১৯৫ সেনাকর্মকর্তাকে বিচারের আওতায় আনার অধিকারের পথ রুদ্ধ।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন, ১৯৭৩ এ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পাঁচজন শীর্ষস্থানীয় নেতা এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত প্রতিটি ব্যক্তির বিচারে মনগড়া সৃজিত সাক্ষির মাধ্যমে কিভাবে বিচার বিভ্রাট করা হয়েছিল এর বিস্তারিত আলোচনা প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার লিখিত ‘এ ব্রোকেন ড্রিম’ পুস্তকে উল্লেখ রয়েছে, যদিও বিচারপতি সিনহার সাথে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সখ্য থাকাকালীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দণ্ডাদেশগুলো সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মাধ্যমে অনুমোদনে তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ধারা ৬ দফা (২) এর অধীন যে দু’টি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয় এর প্রতিটির চেয়ারম্যান ও সদস্য পদে সুপ্রিম কোর্টের কর্মরত বিচারকদের পদায়ন করে বিচারকার্য সমাধা করা হয়েছিল। এ ধরনের পদায়ন সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৪ দফা (৩) এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘনের মাধ্যমে কার্যকর করায় এসব ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে কৃত বিচারকার্য সংবিধান ও আইনের যেকোনো ব্যাখ্যায় বেআইনি ও অবৈধ। সুতরাং সংবিধানের সুস্পষ্ট বিধানের ব্যত্যয়ে অবৈধ ট্রাইব্যুনাল গঠন ও অবৈধ বিচারের মাধ্যমে যেসব জীবনহানির ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এর দায় নিরূপণ যেমন অত্যাবশ্যক অনুরূপ সামগ্রিক প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত সবার সংশ্লিষ্টতা নির্ধারণ অপরিহার্য।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement