২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

প্রিয় অবন্তিকা...

প্রিয় অবন্তিকা... - ছবি : সংগৃহীত

-'এই অলক্ষী মেয়েকে বাসা থেকে বের করবে কিনা বলো?'

-'ছিঃ!!! নিজের সন্তান, মেয়েকে কেউ অলক্ষী বলে?'

-'নিজের সন্তান?!!! মেয়ে?!!!! হাহ্।আগে যদি জানতাম তাহলে ওকে এই দুনিয়াতেই আসতে দিতাম না।ভুল করেছি ওর জন্মের পর যদি ওকে মেরে ফেলতাম তাহলে এখন ওকে দু'চোখে দেখতে হতো না আর আমিও শান্তিতে থাকতে পারতাম। ভেবেছিলাম ছেলে হবে। মেয়ে হলেও মেনে নিতাম। কিন্তু এমন একটা অপয়া, অলক্ষী মেয়ে আমার ঘরে আসবে তা কি জানতাম?'

-'তুমি কি মানুষ নাকি অন্য কিছু? আজ আমার মা, বাবা, শ্বশুর, শাশুরি বেঁচে থাকলে হয়ত আমাকে, অবন্তিকাকে সাপোর্ট করত। তোমার আমাদের সাথে থাকতে ভালো না লাগলে আরেকটা বিয়ে করো। কিন্তু আমি আমার সন্তানকে কোথাও পাঠাব না। কারণ আমি যে ওর মা। মেয়েটার জন্মের পর থেকেই তুমি ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করে আসছ। জানি না আল্লাহ্‌ তোমাকে কবে হেদায়েত করবে।'

-'হ্যাঁ হয়েছে তোমার বকবক থামাও অসহ্য লাগে। অফিসে গেলাম।'

-'খেয়ে যাও।'

-'তোমার খাওয়া তুমি-ই খাও।এই এখানে কি হা?'
সর এখান থেকে।"

অবন্তিকাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে অফিসে চলে গেল ওর বাবা।

এতক্ষণ কথা হচ্ছিল ইলিয়াস আর নীরার মধ্যে। কথা না, একপ্রকার ঝগড়াই হচ্ছিল তাদের মধ্যে।আর এই ঝগড়া তাদের প্রতিদিনই হয়।তার মূল কারণ তাদের একমাত্র মেয়ে অবন্তিকা। অবন্তিকা জন্মের পর থেকেই কানে শোনে না। কথা বলতে পারে না। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছে। চিকিৎসা করিয়েছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।

ইলিয়াস তাই অবন্তিকাকে সহ্য করতে পারে না। প্রতিনিয়ত অবহেলা করে। অবন্তিকা তার মা, বাবার ঝগড়া প্রতিদিন দেখে। কানে শুনতে না পারলেও বুঝতে পারে তাকে নিয়ে অশান্তি হয়। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে দেখে আর চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে অবন্তিকার।

কিন্তু অবন্তিকার মা অর্থাৎ নীরা অবন্তিকাকে খুব ভালোবাসে। সবসময় অবন্তিকাকে সাপোর্ট করে। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে একমাত্র নীরাই অবন্তিকার সবকিছু।

অবন্তিকার বয়স এখন সাত। নীরা অবসর সময় অবন্তিকাকে হাতের লেখা শেখায় কারণ অবন্তিকার ইশারা কেউ না বুঝলেও ও যেন ওর মনের কথা লিখে সবাইকে বোঝাতে পারে।

একদিন অবন্তিকার বাবার খুব জ্বর আসে।অফিসে যেতে পারেনি। অবন্তিকার মা ওর বাবার মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। সাথে অবন্তিকাও আছে।তারপরও জর কমছেনা।
"ঘরে কোনো ওষুধ-ও নেই।এখন কি করা যায়? ফার্মেসিতে যেতে হবে। কিন্তু অবন্তিকাকে একা রেখে কিভাবে যাব? আর বাইরেও বৃষ্টি। ওকে নিয়ে তো যাওয়া সম্ভব না। পাশের বাসার ভাবীও গ্রামে গেছে। এখন যে কি করি?" মনে মনে ভাবতে থাকে নীরা।

অবশেষে অবন্তিকাকে বুঝিয়ে বাইরের দরজায় তালা দিয়ে ফার্মেসিতে গেল নীরা।

ওষুধ কিনে বাসায় ঢুকেই নীরা অবাক।অবন্তিকা তার বাবার মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে আর কাঁদছে। মাঝে মাঝে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এসব দেখে নীরার চোখে পানি চলে আসে। যে বাবা তার সন্তানকে দু'চোখে দেখতে পারে না, সে আজ তার বাবার জন্য কাঁদছে বাবা অসুস্থ দেখে।

ইলিয়াস জ্বরে অজ্ঞানের মতো পড়েছিল। জ্ঞান ফিরে আসার পর নীরা রাতের খাবার খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দেয়। ইলিয়াসের জ্ঞান আসার পর অবন্তিকা অন্য ঘরে চলে যায়। কারণ তার বাবা যে তাকে ভালোবাসে না তা সে খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারে।

- 'তোমার শরীর এখন কেমন?'

-'আগের চেয়ে একটু ভালো।কিন্তু এখনও শরীরে ব্যথা আছে।'

-'মাত্র ওষুধ খেলেতো, তাই সুস্থ হতে একটু সময় লাগবে। তোমাকে কিছু বলার ছিল আমার।'

-'হুম বল কি বলবে?'

-'আমি যখন ফার্মেসিতে যাই তোমার জন্য ওষুধ কিনতে, এসে দেখি অবন্তিকা তোমার মাথায় জলপট্টি দিচ্ছিল আর কাঁদছিল। তোমার মাথায় হাত বুলিয়েও দিচ্ছিল।'

ইলিয়াস অবাক হয়ে,
-'বলো কী?তুমি কি সত্যি বলছ?'

-'একদম সত্যি বলছিগো।দেখ,আমি তুমি ছাড়া অবন্তিকার আর কে আছে বলো?ওতো আমাদেরই সন্তান তাইনা?প্রতিবন্ধী বলে কি ওর ভালোবাসা পাওয়ার কোনো অধিকার নেই? তুমিতো ওকে আদর-ভালোবাসা দেয়াতো দূরের কথা, ওকে দেখলেই কুকুরের মতো দূর দূর করে তাড়িয়ে দাও।কিন্তু আমিতো পারি না গো।আমি যে ওর মা।'

আমার ছোট্ট সোনামণিকে যদি আমরা একটু আদর করি, ভালোবাসি, সাপোর্ট করি তাহলে ও অন্য সুস্থ বাচ্চাদের মতো জীবনে অনেককিছু করতে পারবে।ও না হয় শারীরিক প্রতিবন্ধী, মানসিক তো নয়। মানসিক প্রতিবন্ধী তো তুমি। তোমার চোখ থাকতেও অন্ধ, মন থাকতেও অবুঝ তুমি। আমি মা হয়ে যদি ওকে ভালোবাসতে পারি, তাহলে তুমি বাবা হয়ে কেন পারবে না বল?আর কত পাষাণ হয়ে থাকবে তুমি? বলো তুমি বলো?"

বলতে গিয়ে নীরা হু হু করে কেঁদে উঠে। ইলিয়াসও বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।নিজের ভুল বুঝতে পারে। চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরতে থাকে। নীরার হাত দুটো ধরে বলে,
-'আমি এত দিন আমার মেয়ের সাথে অনেক অন্যায় করেছি গো।আর করব না।এখন থেকে ওকে শুধু ভালোবাসব। ওকে স্কুলে পাঠাব।সবরকম সহযোগিতা করব। আমাদের ভালোবাসা আর সহযোগিতায় দেখ ও একদিন ঠিকই সবার 'প্রিয় অবন্তিকা' হয়ে উঠবে। ও এখন কোথায়?নিয়ে এসো ওকে।'

নীরা খুশিতে চোখের পানি মুছতে মুছতে যায় অবন্তিকার ঘরে।নিয়ে আসে ওর বাবার কাছে কিন্তু অবন্তিকা খুব ভয় পায় যদি আবার বকা দেয় এই ভয়ে।

ইলিয়াস অবন্তিকাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কাঁদতে থাকে।
-"মা আমাকে ক্ষমা করে দিস মা। তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। অবহেলা করেছি।আর দিব না মা।আর দিব না।"

অবন্তিকা অবাক হয়ে যায়।কিছুই বুঝতে পারে না। মাকে ইশারা করে বোঝায়, 'বাবা কাঁদছে কেন আর আমাকে জড়িয়ে ধরল কেন?'

নীরাও ইশারা করে বোঝায়, 'তোমার বাবা তোমাকে খুব ভালোবাসে তাই।'

অবন্তিকা খুশিতে কেঁদে উঠে। দৌড়ে তার রুমে চলে যায়। নীরা আর ইলিয়াস অবাক হয়ে যায়।কিছুই বুঝতে পারে না।

তার কিছুক্ষণ পর অবন্তিকা একটি বড় পেজে লিখে নিয়ে আসে 'I LOVE YOU বাবা' আর সাথে অবন্তিকা আর ওর মা, বাবা তিনজনের কার্টুন ছবি এঁকে ওর মনের ভালোবাসা প্রকাশ করে।

আমাদের সমাজে অনেক প্রতিবন্ধী আছে।যাদের মধ্যে কেউ শারীরিক প্রতিবন্ধী আবার কেউ মানসিক প্রতিবন্ধী।তাদের দরকার একটু ভালবাসা আর সহযোগিতা।তাহলেই তাদের মনে ঘুমন্ত সুপ্ত প্রতিভা জাগ্রত হবে।

প্রতিবন্ধীরা আমাদের দেশের বোঝা নয়,সম্পদ।
তাদেরও অধিকার আছে সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচার।
আসুন, আমরা সবাই এগিয়ে আসি তাদের সাহায্য করার জন্য।

ধন্যবাদ।

 


আরো সংবাদ



premium cement