১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

প্রায় দেড় যুগ পর বঙ্গবন্ধুতে ক্রিকেটাররা

-

ফুটবল, ক্রিকেট, অ্যাথলেটিকস- অনেক খেলার অতীত ও বর্তমান বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম। সেই অতীতেই যেন ফিরে গেলে বাংলাদেশ জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা। অনেক বছর পর ক্রিকেটীয় ব্যস্ততায় মুখর হলো এই স্টেডিয়াম। স্মৃতিময় মাঠে গতকাল ফিটনেস মূল্যায়নের পরীক্ষা দিলেন ৩৫ ক্রিকেটার। মাঠে ঢুকে এদিক-ওদিক তাকিয়ে জাতীয় দলের ম্যানেজার নাফিস ইকবাল বললেন, সব কিছুই যেন বদলে গেছে। চার পাশে চোখ রেখে বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের সহকারী ম্যানেজার শাহরিয়ার নাফীসও ফিরে গেলেন অতীত স্মৃতিতে।
দেশের ক্রিকেটে একসময় তীর্থস্থান হিসেবে বিবেচনা করা হতো এই বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামকে। ২০০৬ সালে এই স্টেডিয়াম বরাদ্দ পায় ফুটবলে। আর ক্রিকেট চলে যায় মিরপুর শেরে বাংলায়। এর পর থেকে সব ধরনের ক্রিকেটীয় ব্যস্ততা মিরপুরের মাঠে। মাঝে ২০১১ বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়েছে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। দীর্ঘ দিন পর নাজমুল হোসেন শান্ত, লিটন কুমার দাসদের ফিটনেস মূল্যায়নে বেছে নেয়া হয়েছে দেশের খেলাধুলার অনেক ইতিহাসের সাক্ষী এ মাঠটিকে। ক্রিকেটারের পদচারণায় গতকাল সকালে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ফিরে এলো হারিয়ে যাওয়া ক্রিকেটীয় আবহ।
স্বাভাবিকভাবেই বর্তমান প্রজন্মের ক্রিকেটারদের জন্য বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম স্মৃতিময় অতীত। দলের ক্রিকেটারদের মধ্যে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ও মুশফিকুর রহীমের এই মাঠে খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে। সেটিও কোনো স্বীকৃত ক্রিকেটে নয়। ২০০৪ সালে ঘরোয়া একটি টুর্নামেন্ট খেলেছিলেন মাহমুদুল্লাহ। বিকেএসপির হয়ে বয়সভিত্তিক ক্রিকেট খেলেছেন মুশফিক। লম্বা সময় পর এই মাঠে এসেই গ্যালারির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখা গেল মাহমুদুল্লাহকে। আঙুল উঁচিয়ে কিছু একটা বললেন তিনি বিসিবির মিডিয়া ম্যানেজার রাবিদ ইমামকে। কাছেই থাকা নাফিস ইকবাল তখন যেন নিজের খেলোয়াড়ি জীবনের সুখস্মৃতিতে ডুব দিয়েছেন।
ক্যারিয়ারের একমাত্র টেস্ট সেঞ্চুরি এই মাঠেই করেছিলেন নাফীস ইকবাল। ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তার সেঞ্চুরিতে ভর করে প্রথমবার টেস্ট সিরিজ জয়ের স্বাদ পেয়েছিল বাংলাদেশ। এখন সংস্কারকাজ চলতে থাকা মাঠের ঘাস, নতুন অ্যাথলেটিকস ট্র্যাক ও অন্যান্য স্থাপনা দেখে নিজের খেলোয়াড়ি সময়ের সাথে মেলাতে পারছিলেন না সাবেক এই ওপেনার।
শাহরিয়ার নাফীসও এই মাঠে এসে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লেন। পরিচিত এক সাংবাদিককে দেখেই কাছে এসে বললেন, ‘কী স্টেডিয়াম ভাই! তখন তো খেলা হলে এই (ভিআইপি) গেট বন্ধ করে রাখতে হতো। আম্মা সবসময় এই গ্যালারিতে বসে থাকতেন। সব কিছু ভাসছে চোখে।’ সেই অতীতে ফিরে গেলেন বাংলাদেশের প্রথম টি-২০ অধিনায়ক।
‘খুব সম্ভবত ১৯৯৪ সালে প্রথম এই মাঠে খেলা দেখতে এসেছিলাম। আমার কাজিন ফারুক ভাই (ফারুক আহমেদ) জাতীয় দলের অধিনায়ক ছিলেন। বাংলাদেশের যে আইকনিক প্লেয়াররা ছিলেন, এই মাঠে তাদের দেখে খেলা শুরু। ঘরোয়া ক্রিকেটেও এখানেই আমার শুরু। ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে আমার জীবনের প্রথম সেঞ্চুরিটা এই মাঠেই। আমি অনূর্ধ্ব-১৯ দল থেকে বাদ পড়েছিলাম। (২০০৪) বিশ্বকাপ শুরুর আগে ভারতের বিপক্ষে অনুশীলন ম্যাচে আমি সেঞ্চুরি করি। তেমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না যে, ভালো খেলতে হবে। তবে এই ইনিংসটা যে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে, সেটা বুঝতে পারিনি। এই মাঠে ঢুকে ওই ইনিংসের কথাই প্রথম মনে পড়েছে।’
ক্রিকেটের জন্যই ছিল মূলত বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে ১৯৫৫ সালে অবিভক্ত পাকিস্তান প্রথম টেস্ট খেলে এই মাঠেই। ভিনু মানকাডের ভারতের বিপক্ষে এখানে খেলেছিল আবদুল হাফিজ কারদারের পাকিস্তান। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে এখানে সাতটি টেস্ট ম্যাচ হয়েছে। পরে ২০০০ সালে বাংলাদেশও নিজেদের প্রথম টেস্ট খেলে এখানেই। এটিই ক্রিকেট বিশ্বের একমাত্র মাঠ, যেখানে অভিষেক টেস্ট খেলেছে দু’টি দেশ।
স্বাধীনতার পর এখানে ক্রিকেট ও ফুটবল চলেছে হাত ধরাধরি করেই। গ্রীষ্মকালে ফুটবল আর শীতকালে ক্রিকেট। ফুটবলের জন্য মিরপুরে আলাদা স্টেডিয়াম গড়া হলেও বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম ছাড়েনি তারা। বাংলাদেশ টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ব্যস্ততা বাড়তে থাকে, তখন ফুটবলের মিরপুর স্টেডিয়ামকেই নতুনভাবে সংস্কার করে গড়ে তোলা হয় ক্রিকেটের জন্য।
২০০৫ সালের ৩১ জানুয়ারির পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট হয়নি বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। ২০১১ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপের জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয় এই ক্রীড়াকেন্দ্রে। এরপর গতকালের আগে আর কোনো ক্রিকেটীয় ব্যস্ততা দেখা যায়নি। বর্তমান জাতীয় দলের অনেক ক্রিকেটারই তাই এবারই তীব্র গরমে প্রথম ক্রিকেটীয় প্রয়োজনে এলেন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। ইতিহাসের অংশ এই মাঠে আসার রোমাঞ্চ ছুঁয়ে গেছে ক্রিকেটারদের। নতুন প্রজন্মের ক্রিকেটারদের ভালো লাগার কথা শোনালেন শাহরিয়ার নাফীসও।
‘যারা একদম নতুন, এই মাঠে তারা না খেললেও সবসময় এই মাঠের কথা শুনেছে। জাতীয় দলে এমন খেলোয়াড়ও আছে, যার জন্ম ২০০০ সালের কাছাকাছি সময়ে। তারা খুবই রোমাঞ্চিত। শুধু ক্রিকেটার নয়, আপনারাও হয়তো খুব রোমাঞ্চ অনুভব করেছেন। সাধারণত ভোর ৬টায় ফিটনেস টেস্ট দেখতে এতো মানুষ আসার কথা না। আমি নিশ্চিত বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে দেখেই এসেছেন। সবার জন্য এটা দারুণ অভিজ্ঞতা ছিল।’
ক্রিকেটারদের জন্য অবশ্য রোমাঞ্চের পাশাপাশি অভিজ্ঞতা বেশ কঠিনই ছিল। হালকা গা গরমের পরই শুরু হয় শারীরিক মূল্যায়নের পরীক্ষা। প্রথমে দুই দফায় ৪০ মিটার ¯িপ্রন্টে অংশ নেন ক্রিকেটাররা। জাতীয় দলে সদ্য যোগ দেয়া স্ট্রেংথ অ্যান্ড কন্ডিশনিং কোচ নাথান কিলির সাথে বিসিবির দুই ট্রেনার মীর ইফতি খায়রুল ইসলাম ও তুষার কান্তি হাওলাদার কাছ থেকে তাদের পর্যবেক্ষণ করেন। প্রয়োজনীয় তথ্য খাতায় টুকে রাখেন।
তানজিম হাসান ও নাহিদ রানা ৪*৪০০ মিটার দৌড়ে প্রথম হন। দৌড় শেষ করে বিশ্বের দ্রুততম মানব উসাই বোল্টের মতোই উদযাপন করেন নাহিদ। তবে এই দৌড়ে প্রথম-দ্বিতীয় বলতে কিছু নেই, সেটিও মনে করিয়ে দেন ট্রেনার ইফতি।
মূলত টানা খেলার মধ্যে থাকায় জাতীয় দল ও আশপাশে থাকা ক্রিকেটারদের ফিটনেসের সবশেষ অবস্থা বোঝার জন্য এই মূল্যায়ন নতুন ট্রেনার কিলির। চোটের কারণে সৌম্য সরকার ও তাইজুল ইসলাম, আইপিএলে ব্যস্ত মোস্তাফিজুর রহমান ও টানা খেলার ধকলের কারণে তাসকিন আহমেদ আসেননি এ দিন।
সাধারণত মিরপুর স্টেডিয়ামের সবুজ ঘাসেই ক্রিকেটারদের ফিটনেসের নানান পরীক্ষা করা হলেও এবার কিলির পরামর্শই বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের অ্যাথলেটিকস ট্র্যাকে। এ ছাড়া ভিন্ন একটি কারণও জানিয়েছেন ইফতি। ‘অ্যাথলেটিকস ট্র্যাক বেছে নেয়ার কারণ আসলে টাইমিংয়ের বিষয় বিবেচনা করে। আমরা যদি আন্তর্জাতিকভাবে টাইমিং দেখি, তা হলে বেশ কিছু পদ্ধতি আছে। আমরা আজ (গতকাল) এক হাজার ৬০০ মিটার টাইম ট্রায়াল নিলাম। অ্যাথলেটিকস ট্র্যাকে যথাযথ টাইমিংটা পাব। এটা ক্রিকেটারদের কাছে নতুন মনে হলেও সব মিলিয়ে ভালো।’
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের এই দৌড়ঝাঁপেই অবশ্য ক্রিকেটারদের মূল্যায়ন শেষ নয়। শের-ই-বাংলার জিমনেশিয়ামে কিলির সাথে বিশেষ সেশনে অংশ নেয়ার কথা রয়েছে শান্ত, লিটন, মুশফিকদের। সবশেষ অবস্থা বুঝে ক্রিকেটারদের পরবর্তী কার্যক্রম ঠিক করা হবে সেখানেই। বিশ্বকাপের কথা মাথায় রেখেই এই কার্যক্রম।


আরো সংবাদ



premium cement