১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

লিওপোল্ড লুইস থেকে মুহম্মদ আসাদ ইউরোপ থেকে আরব

-

এক বিভ্রান্ত অবস্থায়, একধরনের অনিশ্চয়তার ভিতর যখন সময় কাটছে। কী করব কী করব না। কেন করব, কেন করব না। এ রকম সময়ে আমার চোখে পড়ে ‘রোড টু মক্কার’ বাংলা অনুবাদ মক্কার পথ, অনুবাদক শাহেদ আলী, লেখকের নাম লিওপোল্ড লুইস। লেখক শাহেদ আলী সম্পর্কে আমার ধারণা অনেক উঁচুতে। বাংলা সাহিত্যে তাকে আমার অন্যতম একজন সেরা গল্পকার মনে হয়। ছাত্রবয়সে তার ‘জিব্রাইলের ডানা’ পড়ে দীর্ঘসময় আমি মুগ্ধতার আবেশ নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি। কিন্তু লিওপোল্ড লুইসের নাম তখনো শুনিনি। একদিন আল্লামা ইকবালের ওপর একটা লেখা পড়তে গিয়ে লিওপোল্ড লুইসের নাম পাই তার স্পষ্ট গর্বিতমুখে। তখনই আগ্রহ জন্মায় লিওপোল্ড লুইস সম্পর্কে। যে বইটির কারণে তিনি জগৎজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন। সে বইটির নাম ‘রোড টু মক্কা’ নাম শুনলেই মনে হবে তীর্থযাত্রীর দল যাচ্ছে মক্কায়। বিষয়টা আসলে তা না; বিষয়টা হচ্ছে আত্মিকশূন্যতা থেকে পূর্ণতা, হতাশা নৈরাশ্য থেকে প্রবল আশা উদ্দমের ভিতর জীবনের গতিপথ খুঁজে পেয়ে সেই পথের যাত্রী হওয়া। এ হওয়ার সাথে জড়িত আছে কাহিনীর পর কাহিনী, ভ্রমণের পর ভ্রমণ, রহস্য এডভেঞ্চারে ভরা পথের বাঁকে বাঁকে ইতিহাস ঐতিহ্যের হাতছানি। সেই ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা বা জ্ঞান থাকলে অসাধারণ স্মৃতিকাতরতা নিয়ে কল্পনায় অবগাহন করা সহজ হয়ে যায়, মনের ভেতর ঠাণ্ডা প্রশান্তির আবহ নিজের অজান্তেই নির্মাণ হয়ে যায়। তারপর লাইন থেকে লাইন, বাক্য থেকে বাক্য যেন একেকটা রাস্তা হয়ে আমার মতো পাঠককে নিয়ে চলে ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়, কফিশপ, ঝড়তোলা আড্ডা থেকে একটানে সব ছেড়েছুড়ে আরবের পথে প্রান্তরে মরুতে বাজারঘাটে, তাঁবুতে বালুঝড়ে ভয়ে আতঙ্কে নিঃসঙ্গতায় পিপাসায় খুঁজে ফেরা শান্তির সুপেয় পানির আশায়। এরই সাথে সম্মান, স্নেহ দেশপ্রেম, যুদ্ধবিগ্রহ সবই তোলা আছে এ বইয়ে সুনিপুণভাবে।

ছিলেন ইহুদি রাবি পরিবারের সন্তান। বাবার ইচ্ছা ছিল ধর্মযাজক হয়ে ইহুদিধর্মের প্রচার ও প্রসার ঘটাবে। এ জন্য মাত্র ১৩ বছর বয়সে হিব্রু ভাষা অনর্গল পড়তে এবং লিখতে শেখেন। ফলে তালমুদের মূল পাঠের সাথে তার পরিচয় ঘটে। ওল্ড টেস্টামেন্ট পড়ে তার মনে হলো ওল্ড টেস্টামেন্টের স্রষ্টা পুরো মানবজাতির স্রষ্টা না হয়ে যেন একটি উপজাতির স্রষ্টা, যে কি না বিশেষ জাতি কিভাবে তার উপাসনা করবে তা নিয়েই ব্যস্ত। এ সঙ্কীর্ণ মতবাদে তার মন টিকল না। পাঠানো হলো ভিয়েনায় লেখাপড়ার জন্য। কিন্তু সে হাজির হলো অস্ট্রীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে। তখনো বয়স ১৮ না হওয়ায় ব্যর্থ মনোরথে আবার গেলেন ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্প ও দর্শনের ইতিহাস পড়তে। এখানেই ইউরপের ফ্রয়েড ও তৎকালীন ইউরোপীয় মনোবিকলন তত্ত্বের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেন এবং সেখান থেকে কমিউনিস্ট আন্দোলনে যুক্ত হন। ফলে ভিয়েনার ক্যাফে শপগুলোতে তুমুল তর্ক-বিতর্কে যোগ দেন। একসময় ফ্রয়েড ও নিটসের এসব আপেক্ষিকতা তার কাছে ফাঁকা ফাঁকা মনে হয়। নারী-পুরুষের দেহগত মিলনের ভিতরই শুধু নিঃসঙ্গতা ও বিচ্ছিন্নতা দূর করার মন্ত্র তার পছন্দ হলো না। লেখালেখি করার উদ্দেশ্যে ভিয়েনা থেকে পাড়ি জমান প্রাগে। এখানেই তার সাথে পরিচয় হয় বিশ্বখ্যাত লেখক ম্যাক্সিম গোর্কির স্ত্রীর সাথে। সমাজকে বদলে দেয়ার উদ্দেশ্যে ইউরোপের তরুণরা তখন দলে দলে যোগ দিচ্ছে কম্যুনিস্ট আন্দোলনে। নতুন কিছু করার প্রত্যয়ের ইউরোপে তখন পুরনো সমস্ত ধ্যানধারণা, নিয়মনীতিকে ভেঙে নতুনে মত্ত ইউরোপের মানুষ, বিশেষ করে তরুণ-যুবারা। এর কিছুকাল পরই দেখা গেল বিপ্লবী ভাবাবেগে নতুন করে যা গড়া হয়েছে তার পুরোহিত হচ্ছে ব্যাংকার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, সৈনিক, সিনেমার নায়করা এবং এর উপাসনালয় হচ্ছে সিনেমা, থিয়েটার হল, ব্যাংক, বীমা কোম্পানি, অফিস আদালত আর এর গাইডলাইন হচ্ছে নাটক, সিনেমার সংলাপ সুদ ঘুষকেন্দ্রিক লাভ-লসের হিসাব। নতুন এ জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে কমফোর্ট আরাম আয়েশ। ফলে অচিরেই এ আরাম আয়েশের প্রয়োজনে যে যার মতো নীতিনৈতিকতা বিবর্জিত নিজেকে টাকা উপার্জনের কল বানিয়ে এমন এক সমাজ তৈরি করে ফেলেছে যেখান থেকে মুক্তির পথ তাদের অজানা। জীবনের সব সুখ-শান্তি প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি সম্মান ধ্যানেজ্ঞানে সবই টাকার ভেতর নিহিত। আরেক শ্রেণীদর্শন এবং বিজ্ঞানের চাপে তাপে আবিষ্কার ও যুক্তির দ্বারা সব জয় করতে মরিয়া। কিন্তু নিজের মনে সে ক্রমেই একা। এ একাকিত্ব কাটাতে তার প্রয়োজন বন্ধুত্ব মদ আড্ডা। বন্ধুবান্ধবীদের দুনিয়াটা মস্তবড় খাও-দাও ফুর্তি কর। এরই মাঝে আবার নিত্যনতুন অস্ত্র আবিষ্কার, অস্ত্র পরীক্ষার শক্তিসামর্থ্যরে মানদণ্ডে জেগে উঠা দেশপ্রেমের হুংকার। মন বিষণœ, পালানোর পথ খুঁজতে ব্যস্ত। যেখানে নিজের সাথে নিজের বোঝাপড়ার, নিজেকে ভালোবাসার আত্মিক একাকিত্ব থেকে নিজেকে বিচার-বিশ্লেষণ করা সব মাধ্যমে নিজেকে হারিয়ে ফেলা। ফলে কিছুদিন ইউরোপের এ তারুণ্য এ যুক্তি এ উন্নতিতে তার মন ভরল না। এখানে মনের ভিতর মনের নিজের সাথে নিজের পলায়নপরতা তার ভালো লাগল না। মন অন্য কিছুর তৃষ্ণায় বিভোর। মন খুঁজে ফিরছে শান্ত সুনিবিড় নির্জনতা, যেখানে নিজের সাথে নিজের বোঝাপড়া, নিজেকে ভালোবাসার, নিজেকে বিশ্লেষণের সক্ষমতা তৈরি করা। যেই সক্ষমতা পলায়নপরতা থেকে মুক্তি দেবে, নির্জনতায় মনকে পুলকিত করবে। একা একা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলেও নিঃসঙ্গতা কেটে যাবে। এ সময় চৈনিক দার্শনিক লাওসের দর্শন কিছুকাল তাকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখলেও ক্রমেই তার মোহ ভঙ্গ হলো, মনে হলো, এ স্রেফ সুন্দর কবিতার বাহন ছাড়া আর কিছুই না। ছেলের বহেমিয়ান স্বভাবের কথা জানতে পেরে বাবা ছেলেকে চিঠি লিখে জানালেন, ’আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, তুমি এক ভবঘুরে বাউন্ডুলে হিসেবে মরে পড়ে আছ রাস্তার নর্দমায়।’ আত্মবিশ্বাসী লুইস জবাবে জানালেন, ‘না আমার জন্য রাস্তার পাশে নর্দমা নেই, দেখবেন আমি উঠব একেবারে শীর্ষচূড়ায়।’

বার্লিনের রাস্তায় দিনের পর দিন না খেয়ে, সাবওয়ে বা ট্যাক্সি ভাড়া না থাকায় হেঁটে বেড়িয়েছেন কাজের সন্ধানে। চরম আর্থিক সঙ্কটে উপবাস করেছেন। এ সময়ে চলচ্চিত্র প্রযোজকের সহকারী হিসেবে কাজ করেন। এর কিছুদিন পর তার ভিয়েনিজ বন্ধু এন্থন কুহের জন্য ফিল্মের চিত্রনাট্য লিখে অর্থ উপার্জন করেন। এরপর ইউনাইটেড টেলিগ্রাফের বার্তা সংস্থার টেলিফোনিস্টের কাজের মধ্য দিয়ে সংবাদপত্রের জগতে ঢুকে পড়া। ১৯২১ সালে রাশিয়ার দুর্ভিক্ষের সময় ত্রাণ কার্যের জন্য জনমত গঠন করতে গিয়ে রিপোর্টার হয়ে যাওয়া। ইউরোপজুড়েই তখন তরুণেরা হাঁপিয়ে উঠেছে। একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতায় তারা অস্থির। আশাবাদের জায়গাগুলো তখন বেপরোয়া। জীবন প্রচণ্ড অসুখী, মানুষ বিভ্রান্ত, আত্মা সঙ্কীর্র্ণ। তিক্ত, ঘৃণ্য, বেসুরো এ জগতের সাথে তাল মিলাতে না পেরে ১৯২২ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে ফ্রাংকফুর্টার শাইটুম নামক এক নামকরা পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে জেরুজালেম সফরের সুযোগ এলে তিনি তা লুফে নেন। এখানেই তিনি প্রথম ইসলামের সংস্পর্সে আসেন, আরবদের সাথে অন্তরঙ্গভাবে মেলামেশার সুযোগ পান এবং গভীরভাবে সে জীবনকে পর্যবেক্ষণ করেন। এখানেই তিনি আবিষ্কার করেন মুসলিম সমাজের মন ও ইন্দ্রীয় জগতের এক সহজ-সুন্দর উপস্থাপন, ইউরোপ যা হারিয়ে ফেলে দিশেহারা। এখানে হৃদয়ের পূর্ণতা, আত্মার অবিশ্বাস থেকে মুক্তি, জীবনের প্রতি আস্থা এবং বিশ্বাস তাকে মুগ্ধ করে। যে মুগ্ধতা ইউরোপের জীবনে কল্পনাতীত। এরপর একে একে সফর করেন প্যালেস্টাইন, ইরাক, ইরান, মিসর ও জর্ডান। এবং ১৯২৬ সালে ইউরোপে ফিরে এসে সস্ত্রীক ইসলাম গ্রহণ করেন।

ছিলেন ইহুদি, হলেন মুসলিম, লিওপোল্ড লুইস হয়ে গেলেন মুহম্মদ আসাদ। বিশ্বখ্যাত সংবাদপত্র ফ্রাংকফুর্টার শাইটুমের সাংবাদিকতা থেকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত, জাতিসঙ্ঘের শুভেচ্ছাদূত, মুসলিম বিশ্বের ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত হিসেবে কাজ করে গেছেন মৃত্যুপূর্ব পর্যন্ত। লিখেছেন দ্য ম্যাসেজ অব কোরআন, ইসলাম এট দ্য ক্রসরোডস, মাই ডিসকভারি অব ইসলাম, দ্য স্পিরিট অব ইসলাম এবং রোড টু মক্কার মতো অনবদ্য সব বই। যে বইগুলো মানবজীবনের হতাশা নৈরাশ্য ভয় সংশয় থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর জীবন সংগ্রামী অনিবার্য পাঠ্য, সেসব বইয়ের মধ্যে অন্যতম সেরা বই ‘রোড টু মক্কা’। এ বইয়ে সে সময়ের ইউরোপের অন্যতম বিখ্যাত শহরের মানুষদের চালচিত্র যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে সে সময়ের মধ্যপ্রাচ্যে আরব ভূখণ্ডের বিখ্যাত সন নগর বন্দর শহরের বর্ণনা, জীবনযাত্রা। এখানে ব্যক্তি সমাজ রাষ্ট্রীয় জীবনব্যবস্থাকে একাকার করে ঐতিহাসিক সময়কে ধরে ধরে এগিয়ে গেছেন লেখক। কখনো উটের পিঠে যাত্রী হয়ে কখনো ধূসর মরুতে পায়ে হেঁটে, কখনো দিশেহারা মরুর বালুঝড়ে। কখনো পথ হারিয়ে একা নিঃসঙ্গ মরুতে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে ভেবেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন তার দেখা সময় ও জীবনকে।
‘রোড টু মক্কা’য় উঠে এসেছে সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা ইবনে সৌদের যুদ্ধজয়, বাদশাহী জীবন, তৎকালীন বাগদাদ নগরী, ইরানের জনজীবন। আব্দুল ওহাব নজদি থেকে আল্লামা ইকবালের মতো ব্যাপক জনপ্রিয় চরিত্রের অসাধারণ বিস্তৃতি লাভ করেছে। ঘটনা হিসেবে এসেছে সৌদি রাজ পরিবার, কুয়েতের রাজ পরিবার, তুরস্কের সংস্কার, আশপাশের নগরগুলোকে কেন্দ্র করে ইহুদিদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার গোপন ষড়যন্ত্র, মরুজীবনের অতুলনীয় এডভেঞ্চার, আরব বেদুঈনদের দুঃসাহসিকতা এবং মদিনার জনজীবন। হারিয়ে যাওয়া ফিরে পাওয়া ঐতিহ্য ঐতিহাসিক বর্ণনার সাথে আরবের ঘর গৃহস্থালি, জর্ডান, জেরুজালেমের উচ্চমানের সংস্কৃতি, দামেস্ক, ইস্ফাহানের বাজারঘাট, আমদানি-রফতানি থেকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, আফগান রাষ্ট্রের ইসলামী অনুসন্ধান অসাধারণভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বিস্তীর্র্ণ মরুপথ দিয়ে পায়ে হেঁটে মক্কার হজ কাফেলার সাথে প্রত্যাবর্তন। মরুর বুকে তেজোদীপ্ত সূর্য, রাতের তারকা-উজ্জ্ব¡ল চকচকে বালুতে মরুর আকাশের নিচে তাঁবুতে শুয়ে নিজেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলার উচ্ছ্বাস, অন্ধকার ঝড়ের রাতে উট হারিয়ে সাথী হারিয়ে একা গাছপালাহীন মরুর ঝড়ে বাঁচা মরার সংগ্রাম, অজানা অচেনা বেদুঈন কাফেলার আতিথ্য। রাতের পর রাত, দিনের পর দিন পথ হারিয়ে উত্তপ্ত মরুতে ক্লান্তিতে পথ খোঁজা। রাজনীতি-সমাজনীতি-অর্থনীতি যুদ্ধ, সংঘাত, এডভেঞ্চার রহস্য, ইতিহাস ঐতিহ্য, গল্প, ভ্রমণ কী নেই? সব মিলিয়েই ‘রোড টু মক্কা’ এবং মুহম্মদ আসাদ। ১৯৯২ সালে মুসলিম বিশ্বের সেতুবন্ধনকারী এ মহান লেখকের মৃত্যু হয়, স্পেনের গ্রানাডায় মুসলিম কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।


আরো সংবাদ



premium cement