জীবনের জয়-পরাজয়
- ইয়াসিন মাহমুদ
- ১৪ জুন ২০২৪, ০০:০৫
কোনো ব্যক্তি যখন কোনো বিশেষ বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করে তখন আমরা তাকে বিশেষজ্ঞ বলে ডাকি। শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ নানা পেশায় একেকজন একেক বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান লাভ করে থাকেন। আর সে বিষয়ে তাকে আমরা স্পেশালিস্ট মনে করি। খ্যাতির খেতাব দিই। চার দিকে অনেক সুনাম ছড়িয়ে পড়ে তার। কিন্তু জীবনবিষয়ক কোনো বিশেষজ্ঞ পাওয়া বড়ই কঠিন।
ক্ষণে ক্ষণে জীবনের মোড় পরিবর্তন হয়; সব ঠিকঠাক দেখতে দেখতে ওলটপালট। তছনছ হয়ে যায় গোছানো বাগান। আবার ধীরে ধীরে সাজাতে হয় জীবনসংসারের বাগান। এর কারণ আজও কেউ উদঘাটন করতে পেরেছে? জীবনসংসারে নানা মানুষের সাথে আমাদের বসবাস। উঠাবসা। একেকজনের মাইন্ড একেকরকম। কোনো সমীকরণ এখানে কাজে আসে না। এই ভালো তো- দেখতে দেখতে সব কিছু বেসামাল। মাঝে মাঝে আমরা আহত হই; কান্নায় ভেঙে পড়ি। চরম হতাশা আমাদের ঘিরে ধরে। আমরা কেউ কেউ সব কিছু ফেলে থুয়ে পালাতে চাই। এমনও অনেকে বলে ফেলি-সংসার আমার ভাল্লাগে না। সংসার বিষের বড়ি...। আর যাই হোক আমার দ্বারা সংসার করা হবে না। এই উপলব্ধি কী শুধু আপনার, আমার? নাকি আমাদের সবার যাপিত জীবনের অভিজ্ঞান।
দুই.
জীবন মানেই সংগ্রাম। পদে পদে নানা বাধা-বিপত্তি আর অসহনীয় যাতনা পার করতে হয় প্রতিটি মুহূর্তে। এই জীবনে নানা পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে এটা অবধারিত ও অনিবার্য। এটাকে উপেক্ষা করার সাধ্য কার! প্রতিদিন আমরা ধাপে ধাপে নানা কাজ সম্পাদন করে থাকি। কোনো কোনো কাজ বিশেষ থাকে, বিশেষ ঝক্কি ঝামেলার। আবার কোনো কাজ খুব সহসা এক নিমিষেই শেষ করে ফেলি। এটা কাজের ধরন প্রকৃতির উপর নির্ভর করে। আপনি চান বা না চান জীবনের কোনো না কোনো সময় আপনাকে পেরেশানি পোহাতে হবেই। কারণ নিশ্চয় দুঃখের সাথে সুখ রয়েছে; সুখের সাথে দুঃখ রয়েছে। জীবনের এপিঠ-ওপিঠ। এটা আসবে আজ অথবা কাল। এই সময়কে আড়াল করবার সুযোগ কারো নেই। এই জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগও নেই। বরং ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে এই জীবনকে গুছিয়ে নেয়ার সুযোগ রয়েছে। তাই বুদ্ধিমানরা যেমন হতাশ হয় না তেমনি নিরাশ হয়ে পড়ে না। বরং এই জীবনকে গড়বার নিয়তে প্রভুর কাছে সঁপে দেয়। আর যারা এই পথ অবলম্বন না করে সহজ রাস্তা অন্বেষণ করে তারা সফলকাম তো হতেই পারে না, বরং শয়তানের খপ্পরে পড়ে জীবনকে বিসর্জন দেয়। জীবনের অর্জিত আমলগুলো বিনষ্ট করে ফেলে।
তিন.
আমরা কখনো একটু ঝামেলায় পড়লে বলে থাকি- আজকে যদি অমুকের মতো টাকা-পয়সা থাকত, ধনদৌলত, বাড়ি-গাড়ি থাকত তাহলে কী আমাকে সমস্যায় পড়তে হতো? একটা নির্ঝঞ্ঝাট জীবন ও সময় পার করতে পারতাম। ইশ! এমনটা কেবল আমাদের জীবনে আসে না। আমাদের জীবনে শুধু পরীক্ষা আর পরীক্ষা। সারাটা জীবন শুধু পরীক্ষাই দিয়ে গেলাম। এই জীবনে কি আর পেলাম! নানা দুঃখ যাতনায় আমরা অধিকাংশই মুষড়ে পড়ি। কিন্তু মূলত বিষয় হলো-আমাদের সবাইকে কোনো না কোনো সময় খারাপ দিন পার করতে হয়। এটা জীবনেরই অংশ। কিছুদিন আগে কিংবা পরে। জীবন কখন বদলে যায় কিছুই বলার থাকে না। সকাল বেলার ধনীরে তুই ফকির সন্ধ্যাবেলা। এই ছোট্ট জীবন। ঘড়ির কাঁটার মতো টিক টিক টিক করতে করতে এক সময় থেমে যাবে জীবনঘড়ি। একেবারে চিরতরের জন্য থেমে যাবে। মূল্যহীন হয়ে পড়বে। ঘড়ির কাঁটা যতক্ষণ টিক টিক টিক করে ততক্ষণই তার মূল্য; আমাদের জীবনের অভিধাও তেমনি।
চার.
মেঘ দেখে চাঁদ যায় কি দূরে পালিয়ে? পাহাড় দেখে নদীও কি হারায় মনোবল? বজ্রপাতের ভয়ে পাখি কি সব অঙ্গ লুকিয়ে ফেলে? নিশ্চয় না। বরং ঝড় তুফানের ভয় পিছে ফেলে সাগর পাড়ি দেবার স্বপ্ন আঁকে বুকে। জীবনে জয় আর পরাজয় থাকবে। কখনো জয়ী হয়ে উল্লসিত হবার খুব বেশি কারণ নেই; আবার সামান্য আঘাতে ভেঙে পড়ারও সুযোগ নেই। এ প্রসঙ্গে কবি কাজী নজরুলের একটি কাব্যগীতি উল্লেখযোগ্য-
চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়
আজিকে যে রাজাধিরাজ কাল সে ভিক্ষা চায়।
ভালো কোনো খবরে ত্বকের উজ্জ্বলতা বেড়ে যায়। মুখভরা হাসির ঝিলিক। আনন্দের বন্যা। খুশির জোয়ার। আবার খারাপ খবরে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থা। মুখটা মলিন হয়ে যায়। ভরাট মুখটাও শুকিয়ে যায়। চেহারার লাবণ্যতা হারিয়ে যায়। পরিস্থিতির সংজ্ঞা অনেকটা এমনই। এখন প্রশ্ন একটাই এমন পরিস্থিতিতে আমরা কী করব?
পাঁচ.
জীবনের খারাপ সময়গুলোতে প্রতিটি মানুষ বড়ই নিঃসঙ্গ- একাকী হয়ে পড়েন। নিজের দুঃখটা শেয়ার করবার মানুষটাও খুঁজে পায় না কখনো কখনো। অবশ্য এটা সবার ক্ষেত্রে নয়। একটা টালমাটাল সময় পার করতে হয় জীবনে। এই সময় মনটা অস্থির থাকে। মনের ভেতর রাগ ও ক্ষোভের তীব্রতা বেড়ে যায়। আর এমন সময়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ না রাখতে পারলে ঘটে যায় বড় দুর্ঘটনা। খুব কাছের মানুষকেও হারাতে হয়। অল্পতেই উত্তেজিত হয়ে অন্যের সাথে রূঢ় আচরণ করলে সম্পর্কে ফাটল ধরে। দূরে সরে যায় প্রিয়জনেরাও। তাই এমন সঙ্কট মুহূর্তে নিজেকে ধরে রাখতে হয় শক্তভাবে। ধীর মস্তিষ্কে গুনে গুনে পা ফেলতে হয় প্রতিটি কাজে। একটুতেই ঘটে যেতে পারে বিশাল ঘটনা। এমন অনেক ঘটনা আমাদের জীবনের সাক্ষী। লেনদেন ফেরত দেয়া যায়। কিন্তু খারাপ ব্যবহার কখনো ফেরত নেয়া যায় না। যেমন মুখের থুথু একবার ফেলে দিলে সেটা আর গ্রহণ করা অসম্ভব। খারাপ ব্যবহারটা এমনই। যেমন মানুষের সম্পর্কে ভালো কথা কিংবা প্রশংসনীয় বাক্য বারবার পুনর্পাঠ করা যায় কিন্তু খারাপ ব্যবহার একবারের বেশি কেউ শুনতে চায় না। সেজন্য যেকোনো দুঃসময়ে খুব খেয়াল করে চলতে হয়। একবার মানুষের মন ভেঙে গেলে সেটা সহজে জোড়া লাগানো যায় না। কোনোরকম জোড়াতালি দিয়ে মিলিয়ে দিলেও সম্পর্কের সেই আগের সুর আর বাজে না। শুধু এতটুকুই সম্ভব-অনুতপ্ত হওয়া। আত্মসমালোচনার মাধ্যমে নিজেকে শুধরে নেয়া। এমন অসৌজন্য আচরণের জন্য নিজেকে আয়নার সামনে বারবার দাঁড় করানো। আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তির কাছে ক্ষমা চাওয়া। কেননা এটা হক্কুল ইবাদ- বান্দার হক। বান্দা ক্ষমা না করলে কেউ ক্ষমার অধিকার রাখে না।
ছয়.
বিবেকই মানুষের শ্রেষ্ঠ আদালত। আর আল্লাহ মানুষকে বিবেক দান করার মাধ্যমে সবার সেরা করেছেন। শ্রেষ্ঠত্ব উপাধি দিয়েছেন। মহান আল্লাহ কতই না নেয়ামতে আমাদেরকে ভরে দিয়েছেন তার শুকরিয়া শেষ করা যাবে না। এই যে আমরা কথা বলেই যাচ্ছি- একটুও থামছি না কোথাও। সেমিকোলন, দাঁড়ি, কমা, হাইফেন কোনো কিছুর তোয়াক্কা করছি না। শক্তিসামর্থ্য প্রদর্শন আবার কখনোবা কথার তুবড়িবাজিতে অন্যকে পরাজিত করে আনন্দ উল্লাসে নাচছি। একবারও কি ভেবে দেখেছি-আমি সারাক্ষণই বকবক করছি। কথার মাধ্যমে মানুষকে আহত করছি। সেই আঘাতে কারো হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। হয়তো মাজলুম সেই মানুষটি পৃথিবীর সবার কাছে অগ্রাহ্য হয়ে তার অসহায়ত্বের কথাগুলো প্রভুর কাছে আকুতিভরা কণ্ঠে জানিয়ে জায়নামাজ ভিজিয়ে ফেলছে।
সাময়িক ক্ষমতার দাপটে হয়তো ভাবছি- আমাকে কে রুখবে? কার এতো শক্তি আমার ওপর কথা বলবে; আমার চোখের উপর চোখ রাখবে? আল্লাহকে ভয় করুন। আপনার সব গর্ব, অহঙ্কার মুহূর্তের মধ্যে ধুলায় মিশে যাবে।
মুখ থাকলেই কি সব জায়গায় কথা বলতে হবে? মাঝে মাঝে চুপ থাকা উচিত। নিজেকে চেনা উচিত। কী আমার পরিচয়? আমার কী দায়িত্ব তা নিয়ে গভীর অনুধাবন করা দরকার। অন্যের মাঝে নিজের প্রভাব বিস্তার করা যায়; অন্যের কাছে নিজেকে প্রিয় করে তোলবার টেকনিকও রয়েছে। অন্যকে মর্যাদা দিন। অন্যের কথাও শুনুন। অন্যের ভেতরে প্রবেশ করুন। শুরুতেই চোখে পড়বে একটি সতর্কবাণী বিজ্ঞাপন- সংরক্ষিত এলাকা। প্রবেশ নিষেধ। তারপরেও আপনি চেষ্টা করুন। দুয়ার খুলে যাবে। এই চেষ্টা কেবলই করতে হবে আপনার চারিত্রিক মাধুর্য দিয়ে।
সাত.
প্রভাব প্রতিপত্তি দিয়ে জমি দখল করা যায়। দোকানপাট, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ আরো কত কিছু। এগুলো দখলের জন্য অত প্রস্তুতি লাগে না। অনেকটা ধুমধাম করে দখল করা যায়। কিন্তু মানুষের মন দখলের বিষয়টা খুবই কঠিন। এখানে মনের সাথে মনের মিল হতে হয়। মনের সাথে মনের বিনিময় করতে হয় আগে। তারপর ধীরে ধীরে সম্পর্কের ভিত মজবুত হয়। মনের ভেতরে মনের কথাগুলো থরে থরে সাজানোর বাগান তৈরি করতে হয়। যেখানে প্রতিদিন জমা হয় জীবনের নানা গল্প। এটাকে মনস্তাত্ত্বিক বিপ্লব বলা যায়। কোনো মানুষ একবার মানুষের মনে ঢুকতে পারলে সে আর সেখান থেকে খুব সহজে বের হতে পারে না। এটাকেই বলে ভালোবাসা। হিংসা মানুষের ভেতরে তৈরি করে বিভেদের দেয়াল। হিংসা অনেকটা ঘুণ পোকার মতো। ধীরে ধীরে সব কিছু নিঃশেষ করে দেয়। তুষের আগুন। যার দাহ একটু কম থাকে কিন্তু একবার পুড়তে শুরু করলে সমূলে নিপতন হয়ে যায়। তবে তুষের অনলের তোড়জোড় কম থাকে কিন্তু তার ধ্বংসক্ষমতা উল্লেখযোগ্য। আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কগুলো আজ হিংসারে অঙ্গারে পুড়ে ছারখার।
আট.
মানুষ দুটি সত্তার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত। সেটি হলো-রূহ ও নফস। কোনো খারাপ কাজের দিকে ধাবিত হলে সর্বপ্রথম রূহ তাকে বাধা দেয়। প্রথমে থমকে যায়। একপা দুপা করে পিছিয়ে আসে। আবার কেউ ফিরে আসে না। দৌর্দণ্ড প্রতাপে সামনে এগিয়ে যায়। কোনো কিছুর বাছবিচার ছাড়াই সম্মুখে ছুটে চলে। যখন কোনো পাপ কাজে অহরহ লিপ্ত হওয়ার পরও নিজের ভেতর কোনো অপরাধবোধ কাজ করছে না। বুঝতে হবে আমাদের রূহটি মরে গেছে অথবা অর্ধমৃত। ফলে আমরা নফসের কাছে পরাজিত হচ্ছি। তার গোলামিতে আবদ্ধ হচ্ছি। আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের রূহকে শক্তিশালী না করব ততক্ষণ আমরা হৃদয়হীন ও মনুষ্যত্বহীন এক নাদান থেকে যাব। যেখানে নিজেকেই শুধু শুদ্ধি মনে হবে। বাদ বাকি সব কিছু যেন অন্ধকার। আলোহীন।
প্রতিটি ভালো কাজে মনের ভেতর প্রশান্তি জাগে। ভালোর সাথে সম্পৃক্তের উৎসাহ জোগায়। আর নফস দ্বারা প্রভাবিত হলে নিজের ভেতর না কোনো শান্তি, না কোনো স্বস্তি পাওয়া যায়। শুধু গন্তব্যহীন এক ছুটে চলা। আর সে মোহ কেবল মরীচিকা।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা