আত্মমর্যাদাবোধ ও বিকাশ
- ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
- ০৯ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০৫
মানুষ তার নিজের বোধ-বিশ্বাসের বিশ্বে বাস করতে চায়। সে তার সব পদক্ষেপকে নিজের নিরিখেই যৌক্তিক ভাবতে ভালোবাসে। জগত ও সংসার সংক্রান্ত উপলব্ধি ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলো যার যেমন চিন্তাচেতনা তদনুযায়ী পরিচালিত হয়ে থাকে। মনসচক্রবালের চৌহদ্দিভেদে দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্য হয়ে থাকে।
নৃতত্ত্ববিদ আর সমাজতত্ত্বাবিদ যথাক্রমে পৌরুষ ও পরিবেশকে মানুষের বোধ বিশ্বাস সৃষ্টির নিয়ামক ভেবে থাকেন। উভয়ের মতবাদের মধ্যে বৈরিতা নেই- বরং পরিপূরকের সম্পর্ক আছে। অস্থি-মজ্জার সঙ্গে মিশে থাকা জাত্যাভিমানে এবং পরিবেশ প্রভাবের মেলবন্ধনে যে অয়োময় প্রতীতি গড়ে ওঠে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে তা ব্যাষ্টি ও সমষ্টির সমাজকে গতিদান করে। সমাজ এগোচ্ছে না পিচ্ছাচ্ছে- ভাঙছে না গড়ছে তা শনাক্তকরণের কাজে নৃতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিকের সমীক্ষা সমীকরণের বিকল্প নেই।
সবার ওপর মানুষ সত্য এ উপলব্ধিরও কোনো বিকল্প নেই। মানুষই নিজকে ও সবাইকে, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের অবয়বে সময়কে, পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণকে নিয়ন্ত্রণ করে। অবকাঠামো গড়ে যে সভ্যতা সংস্কৃতির বিকাশ সে ঘটায়, তার ধ্বংসের কারণও আবার সেই সৃষ্টি করে। মুক্তবুদ্ধি মানুষ যেমন দৃষ্টির প্রসারে আলোকিত হয়, অবরুদ্ধ চিন্তা চেতনায় বন্দিত্ব বরণের ফলে অন্ধকারে ডুবে যাওয়াও তার ভাগ্যে ঘটতে পারে। ভালো পথ যাচাই ও গ্রহণ-বর্জনের প্রশ্নটিও আদিকাল থেকেই অব্যাহতভাবে অমীমাংসিত আছে বলেই জীবন ও সমাজ গতিশীল। বৈধ অবৈধর প্রতি আসক্তি ও আকর্ষণের তারতম্যের মধ্যে সমাজের পরিবেশ-পরিচয় প্রকাশ পায়।
সৃজনশীলতা মানুষের অন্যতম ধর্ম। প্রকৃতির অপার সম্পদ ও সৌন্দর্যকে রূপান্তর ও বহুমাত্রিক ব্যবহারোপযোগী করে তুলতে মানুষ তার মেধা ও মননকে কাজে লাগায়। মানুষের মধ্যে যে সুকুমার বৃত্তিগুলো সৃজন সম্ভাবনায় উন্মুখ হয়ে আছে উপযুক্ত পরিবেশের পরিপোষক সমর্থনে ফলগুধারার মতো তা বেরিয়ে আসতে পারে। এখানেও সৃজনশীলতা গঠন ও ধ্বংসের উভয় পর্যায়েই হতে পারে। সৃজনশীলতা গঠন না ধ্বংসের তা নির্ভর করে পরিবেশের প্রযতœ প্রয়াস ও চাহিদার ওপর। ঘটনার প্রকৃত কারণ নিহিত থাকে নেপথ্যে। যার দ্বারা ঘটনা ঘটে সে উপলক্ষ মাত্র, যে কারণে ঘটনা ঘটে কিংবা যে ঘটনা ঘটায় সেটিই মুখ্য। ভাড়াটিয়া খুনিকে দোষী সাব্যস্ত করার পাশাপাশি কার দ্বারা এবং কেন খুনি ভাড়া করা হলো তার যথাযথ হদিস হওয়া বাঞ্ছনীয় সমস্যার প্রকৃত নিষ্পত্তির লক্ষ্যেই। নইলে সমাজের নৈতিক ভারসাম্য আর মূল্যবোধের প্রতি আস্থার ভিত্তিতে ধরতে পারে ভাঙন। এটা প্রকৃতির অমোঘ বিধান যে- অন্যায় অনিয়মের পরিবেশ সৃষ্টিকারী ও ইন্ধনদাতা অন্যায়কারীর চাইতে বেশি দায়ী। একে সুকৌশলে পাশ কাটিয়ে এড়িয়ে যাওয়ার অবকাশ নেই- কেননা প্রকৃতির নিয়ম লঙ্ঘনকারীর অনিবার্য পরিণতিও অলঙ্ঘনীয়। কার্যকারণ ছাড়া কোনো কিছু যেমন ঘটে না তেমনি কোনো ক্রিয়াই প্রতিক্রিয়াহীন থাকে না।
মানবকল্যাণকামিতার আদর্শ সময় ও সমাজভেদে নানান চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে থাকে। মানবকল্যাণধর্মী মূল্যবোধের বিকাশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত জরুরি যে, শত বাধা বিপত্তি সংশয় সংকট সন্ধিক্ষণেও সত্য সুন্দরের সনাতন উপলব্ধি থাকবে জাগ্রত। বিভ্রান্তির বেড়াজালে শাশ্বত মূল্যবোধ হারিয়ে যাবে কিনা কিংবা নিরুদ্দিষ্ট হবে কিনা তা নির্ভর করে ব্যাষ্টি ও সমষ্টির আকাক্সক্ষার আকৃতি আর সজাগ দৃষ্টিভঙ্গির প্রকৃতির উপর। জনকল্যাণের নামে, সংস্কারের নামে কুশাসন-শোষণ মুক্তির নামে নানান মতবাদ-উপায়-উপলব্ধির অবয়বে শাশ্বত মূল্যবোধের ভাঙা-গড়া চলে। শুভ উদ্যোগে বিশ্বাস ও প্রত্যয় হয় সুদৃঢ়। আত্মমর্যাদাবোধের বিকাশ আর কল্যাণকামিতায় আসে প্রাণ-প্রাচুর্য। পক্ষান্তরে ক্ষুদ্র স্বার্থ চিন্তাচেতনা দ্বারা তাড়িত পদক্ষেপে সৃষ্ট হতবাক পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে নেতিবাচক মনোভাবের জন্ম দেয় সকল ক্ষেত্রে। বিশ্বাস আর আস্থায় ধরে ভাঙন। মানুষ বিশ্বাসের বিশ্বে নিরাপত্তা নির্ভরতায় বাস করতে চায়। আস্থা নিজের প্রতি, সমাজের প্রতি অতীব প্রয়োজন। আস্থার অবর্তমানে কিংকর্তব্যবিমূঢ় ব্যক্তি সমাজে জগদ্দল পাথর হয়ে দাঁড়ায় এবং কিয়ৎকাল পরে তার চলৎশক্তির গতিধারায় ঘটতে পারে অশুভ দিকপরিবর্তন। নিয়ন্ত্রণহীন ট্রাফিক যেমন পদে পদে কারণে অকারণে অহেতুক যানজটের হেতুতে পরিণত হয়। অসহিষ্ণুতা আর পারস্পরিক দোষারোপের বেড়াজালে সহযোগিতা সহমর্মিতার মেলবন্ধন হয়ে পড়ে সুদূর পরাহত। রক্তে শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি যেমন বহু রোগ সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, চিন্তাচেতনার ক্ষেত্রে, আত্মস্বার্থ উদ্ধারের ভেদবুদ্ধি প্রবল হলে ব্যাষ্টি ও সমষ্টির সর্বনাশের সঙ্গে নিজের সর্বনাশও যে জড়িত- এ উপলব্ধিটাও হারিয়ে গেলে সমূহ বিপদ।
সমাজে নানান উপায় ও উপলক্ষে এমন সব ঘটনাবলির উদ্ভব হয় যা সমাজের গতিপ্রকৃতির দিকনির্দেশ করে। গঠনমূলক কর্মকাণ্ডে সমাজ সমৃদ্ধ হয়। অবকাঠামোগত উন্নয়নের দ্বারা বিজ্ঞান ও সভ্যতার অনেক সুযোগ সহজে হাতের কাছে এসে যায়- ধ্যানধারণায় তা যেমন নতুন মাত্রা যোগ করে, মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও সূচিত হয় নানান সুযোগ। শোষণ বঞ্চনা বৈষম্যের অবসান ঘটাতে মানুষ সংগ্রাম করে- শোষণহীন বঞ্চনা বৈষম্যরহিত সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশায় বুক বাঁধে। প্রত্যাশা পূরণের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে দেখলে সংগ্রামের সার্থকতা সে খুঁজে পায়, উদ্দীপ্ত চেতনায় দীপান্বিত হয়ে ওঠে। তার এবং সবার ঐকান্তিক প্রয়াস প্রচেষ্টায় উন্নয়ন ও সংহতি সুদৃঢ় হয়ে ওঠে। আকাক্সক্ষা ও প্রত্যাশা পূরণের পরিতৃপ্তিতে তুষ্ট জনগোষ্ঠীকে কোনো বাদ বিসংবাদ বিভ্রান্ত করতে পারে না। আগে যেমন বলা হয়েছে- মানুষ তার কর্মকাণ্ডের যৌক্তিকতা খুঁজে ফিরে নিয়ত নিজের নিরিখে। যদি দেখা যায় ক্ষুদ্র ও খণ্ডিত স্বার্থবাদিতায় নানান বিভ্রান্তি ও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে তার আত্মত্যাগের মহৎ উদ্দেশ্যগুলো তাহলে তার সক্রিয় অংশগ্রহণের যৌক্তিকতার ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায়। তার উদ্দেশ্য-অভিপ্রায়ের, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির খতিয়ানের আঙিনায় অপব্যাখ্যার আগাছা জন্ম হয়। প্রয়োজনে অনুরূপ সে আগাছা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সমাজের চলৎশক্তির জন্য সেটা এক দারুণ দুঃসংবাদ।
অথচ ব্যাষ্টি ও সমষ্টির মধ্যে নিয়ত এ প্রয়াস প্রত্যাশিত থেকে যায় যে তীব্র প্রতিযোগিতাময় প্রাগ্রসরমান বিশ্ব ব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তুলনামূলক সমৃদ্ধি অর্জনের। এটা অত্যন্ত জরুরি ও প্রয়োজন যে, প্রতিনিয়ত সফলতা ব্যর্থতার খতিয়ান পর্যালোচনা, ভুল পদক্ষেপকে শনাক্ত করে শ্রেয়তর পদক্ষেপ গ্রহণের ঐকান্তিকতার পরিপোষণ এবং বিভ্রান্তি ও বিভক্তি সৃষ্টির ষড়যন্ত্র প্রশ্রয় পেয়ে যাতে উন্নয়নের ধারায় বাধা সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র একসূত্রে গাঁথা এবং তার বর্তমান অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহ্যমণ্ডিত অতীতকে সফল বর্তমানে যুক্তিগ্রাহ্য করে তুলতে পারলেই তা সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের সোপান হিসেবে স্বীকৃত হবে। আজকের বর্তমানও একদিন ইতিহাসের বিবেচ্য বিষয় হবে। সব সময় অতীত বন্দনা ও প্রতিষ্ঠায় দৃষ্টি ও মনোযোগ নিবদ্ধ থাকলে বর্তমানের কী হবে? কোনো পরিচয়ে বর্তমান ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নেবে সে বিবেচনাও যথেষ্ট জরুরি। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েই বর্তমানকে বিনির্মাণ প্রয়াস প্রচেষ্টার দ্বারা সোনালি ভবিষ্যৎ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন সার্থক হতে পারে।
অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্র নির্বাচন ও পন্থা নির্ধারণেও সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই। অতীতের উদাহরণ এনে বর্তমানের ভুল ভ্রান্তিকে জাস্টিফাই করার চেষ্টার চাইতে আত্মঘাতী প্রতারণা আর নেই। গুড প্রিসিডেন্স বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে সমৃদ্ধ হতে যতখানি সহায়তা করে ব্যাড প্রিসিডেন্স তার চাইতে বেশি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অতীতেও এমনটি করা হয়েছে এই বলে যদি বর্তমানের অপকর্মের যৌক্তিকতা দাঁড় করানো ও সাফাই বন্দনা শুরু হয় তাহলে গঠনমূলক মূল্যবোধের বিকাশকে অসম্ভবই শুধু করে তোলা হবে না, চক্রবৃদ্ধি হারে তার মাশুল গুনতে হয় অতীতের ন্যায় ভবিষ্যতকেও। অথচ কথা ছিল ‘তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?’
স্বাধীনতার পর বিগত ৫৩ বছওে গণপ্রজাতন্ত্রী আমাদের এই সময় ও সমাজে বয়স, বর্ণ, পর্যায় ও প্রকারভেদে নানান কিসিমের মানুষ এখনো রীতি পদ্ধতি, নীতি ও নিয়মে ঔপনিবেশিক। শ্রমজীবী কর্মক্লান্ত মানুষের পাশাপাশি অতি চালাক ফিটফাট ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ও কর্মী, শিক্ষাবিহীন শিক্ষিতের সমারোহের পাশে প্রযুক্তি প্রখর মেধাবী মুখ, মুক্তবুদ্ধি শান্ত সমাহিত চিন্তাচেতনার সারিতে সহসা মৌলবাদী চেহারার মানুষ, উন্নয়নকর্মীর পাশাপাশি নিজের আখের গোছাতে তৎপর এনজিও কর্ণধার, সন্ত্রাসীর ভয়ে আতঙ্কিত মানুষ, চ্যালেঞ্জ গ্রহণকারী আত্মোৎসর্গীকৃত সেই পুলিশ সার্জেন্ট, ষড়যন্ত্রের শিকার গৃহহীন মানুষ, খবরে আশ্রয়ণ প্রকল্পে হাসিমুখের মানুষের পাশাপাশি বানভাসী মানুষ, নিঃস্বার্থ ত্রাণকর্মীর পাশে সুযোগসন্ধানী- অসৎ উদ্দেশ্য অভিলাষী চোখের মানুষ, কোণঠাসা সৎ ও নিষ্ঠাবান চাকুরে, ধান্দাবাজ আর আত্মস্বার্থের শর্করা সমৃদ্ধ জনস্বার্থসেবী আমলা, অবিবেচক বাসের হেলপার, ট্রাকের মাতাল ড্রাইভার, নীল সাদা অধ্যাপক, একচোখা আঁতেল, রাজনৈতিক শিল্পী, ঋণখেলাপি, ব্রিফকেসবাহী নতুন শিল্পপতি, নকল সরবরাহকারী, উদ্ধত ছাত্রনেতার সামনে অসহায় অধ্যক্ষ, জামিনপ্রাপ্ত সন্ত্রাসী, কুকুরের মাংস বিক্রেতা আর এসিডে দগ্ধ তরুণীর দেশে সেঞ্চুরি করা ক্রিকেটার।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা