২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
স্বাধীনতার বায়ান্ন বছরের ভাবনা

অর্থনৈতিক মুক্তির সোপানতলে

-

বাঙালির ঐতিহাসিক ‘মুক্তির সংগ্রাম’-এর প্রকৃত অর্জন বা বিজয় বিবেচনার জন্য বিগত পাঁচ দশকে অর্থনৈতিক উন্নয়নে স্বয়ম্ভরতা অর্জনের প্রত্যয় ও প্রতীতির স্বরূপ পর্যালোচনার অবশ্যই অবকাশ রয়েছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশ্নে দল-মত, গোত্র ও গোষ্ঠী নির্বিশেষে গোটা দেশবাসীকে ভাববন্ধনে আবদ্ধকরণে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস যেমন জরুরি, তেমনি জাতীয় উন্নয়নপ্রয়াস প্রচেষ্টাতেও সমন্বিত উদ্যোগের আবশ্যকতা একইভাবে অনস্বীকার্য। জাতীয় সঞ্চয় ও বিনিয়োগে থাকা চাই প্রতিটি নাগরিকের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অবদান। অপচয় অপব্যয় রোধ, লাগসই প্রযুক্তি ও কার্যকর ব্যবস্থা অবলম্বনের দ্বারা সীমিত সম্পদের সুষম ব্যবহার নিশ্চিতকরণে সবার মধ্যে অভ্যাস, আগ্রহ ও একাগ্রতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠা দরকার। নাগরিক অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা ও উপলব্ধির জাগৃতিতে অনিবার্য হয়ে ওঠে যে নিষ্ঠা ও আকাক্সক্ষা, তা অর্জনের জন্য সাধনার প্রয়োজন, প্রয়োজন সব পক্ষের ত্যাগ স্বীকারের। দায়দায়িত্ব পালন ছাড়া স্বাধীনতার সুফল ভোগের দাবিদার হওয়া বাতুলতা মাত্র। পারস্পরিক দোষারোপের দ্বারা নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার প্রবণতায় প্রকৃত অর্জন অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। বিভ্রান্তির বেড়াজালে দেশগত সমৃদ্ধির স্বপ্ন আত্মপ্রবঞ্চনার পর্যায়ে চলে যেতে পারে। নিজেরাই নিজেদের শত্রু সেজে দূরের ও কাছের শত্রুদের কাছে ভূরাজনীতির দাবার ঘুঁটিতে পরিণত হওয়ার অশুভ পরিণতি পরিলক্ষিত হয়েছে সার্কভুক্ত দু’টি দেশে অতি সাম্প্রতিককালে।

একজন কর্মচারী কিংবা রাজনৈতিক কর্মীর পারিতোষিক বা আয় উপার্জন তার সম্পাদিত কাজ কিংবা ‘রাগ অনুরাগ বর্জিত’ দেশসেবার পরিমাণ বা পারদর্শিতা অনুযায়ী না হয়ে কিংবা কাজের সফলতা-ব্যর্থতার দায়দায়িত্ব বিবেচনায় না এনে যদি দিতে হয় অর্থাৎ কাজ না করেও সে যদি আয় উপার্জন করতে পারে, তাহলে দক্ষতা অর্জনের প্রত্যাশা আর দায়িত্ববোধের বিকাশভাবনা মাঠে মারা যাবেই। এ ধরনের ব্যর্থতার বজরা ভারী হতে থাকলেই যেকোনো উৎপাদনব্যবস্থা কিংবা উন্নয়নপ্রয়াস ভর্তুকির পরাশ্রয়ে যেতে বাধ্য। দারিদ্র্যপ্রপীড়িত জনবহুল কোনো দেশে পাবলিক সেক্টর বেকার ও অকর্মণ্যদের জন্য যদি অভয়ারণ্য কিংবা কল্যাণরাষ্ট্রের প্রতিভূ হিসেবে কাজ করে তাহলে সেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। যদি বিপুল জনগোষ্ঠীকে মানবসম্পদ ও সরকারি শক্তিতে পরিণত করা না যায় উপযুক্ত কর্মক্ষমতা অর্জন ও প্রয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করে, তাহলে উন্নয়ন কর্মসূচিতে বড় বড় বিনিয়োগও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে। সরকারি চাকরিকে সোনার হরিণ বানানোর কারণে সে চাকরি পাওয়া এবং রাখার জন্য অস্বাভাবিক দেনদরবার চলাই স্বাভাবিক। দায়দায়িত্বহীন চাকরি পাওয়ার সুযোগের অপেক্ষায় থাকার ফলে নিজ উদ্যোগে স্বনির্ভর হওয়ার আগ্রহতেও অনীহা চলে আসে। মানবসম্পদ অপচয়ের এর চেয়ে বড় নজির আর হতে পারে না। দরিদ্রতম পরিবেশে যেখানে শ্রেণিনির্বিশেষে সবার কঠোর পরিশ্রম, কৃচ্ছ্রতা সাধন ও আত্মত্যাগ আবশ্যক সেখানে সহজে ও বিনা ক্লেশে কিভাবে অর্থ উপার্জন সম্ভব সে দিকেই ঝোঁক বেশি হওয়াটা সুস্থতার লক্ষণ নয়। নানান ভুলভালে ভরা, বিকৃত ইতিহাস পাঠে বাধ্য করতে, মুক্তবুদ্ধি চিন্তাচেতনাকে প্রজন্মান্তরে সীমাবব্ধকরণে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ জাতির মেরুদণ্ড বলে খ্যাত শিক্ষাব্যবস্থাকে পঙ্গুত্ব বরণে সহায়তা করা যা কিনা দূরের ও কাছের স্বাধীনতার শত্রুদের দীর্ঘমেয়াদি সর্বনাশ সাধনের নীলনকশারই বাস্তবায়ন। এটি বোঝার ক্ষমতাটিও হরণ হতে দিলে সমূহ সর্বনাশ। ট্রেড ইউনিয়ন নির্বাচনে প্রার্থীর পরিচয়ে যে অঢেল অর্থব্যয় চলে তা যেন এমন এক বিনিয়োগ যা অবৈধভাবে অধিক উসুলের সুযোগ আছে বলেই। শোষক আর পুঁজিবাদী উৎপাদনব্যবস্থায় বঞ্চিত নিপীড়িত শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থ উদ্ধারে নিবেদিত চিত্ত হওয়ার বদলে ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব নিজেরাই যখন উৎপাদনবিমুখ আর শ্রমিকস্বার্থ উদ্ধারের পরিবর্তে আত্মস্বার্থ উদ্ধারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে শোষণের প্রতিভূ বনে যায় তখন দেখা যায় যাদের তারা প্রতিনিধিত্ব করছে তাদেরই তারা প্রথম ও প্রধান প্রতিপক্ষ। প্রচণ্ড স্ববিরোধী এই পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে উৎপাদন, উন্নয়ন তথা জনকল্যাণ সবই বালখিল্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

যেকোনো অজুহাতে অপচয় অপব্যয় তহবিল তছরুপ আত্মসাৎ যেকোনো সবল অর্থনৈতিক উন্নয়নধারাকেও করে দ্বিধান্বিত, বাধাগ্রস্ত। এসব রোধে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই। প্রত্যেক নাগরিকেরই তার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ হওয়ার মধ্যেই সুখী, সমৃদ্ধশালী সমাজ ও অর্থনীতি পুনর্গঠনের সুযোগ নিহিত। আগেই বলা হয়েছে, মানুষই তার পরিবেশের নিয়ন্তা। তাকে সজ্ঞান সচেতনতায় সিদ্ধান্ত নিতে হবে সাধ্যমতো দায়িত্ব পালনের। সংসার, সমাজ ও দেশের উন্নয়নে তার নিজের অংশগ্রহণকে অর্থবহ করতে ঐকান্তিক নিষ্ঠা দরকার। সংসারে নানান বাদ-প্রতিবাদে মানুষ বেড়ে ওঠে, তার দায়দায়িত্ব তদানুযায়ী নির্ধারিত হয় এবং তা যথাযথভাবে পালনে সংসারের গতির চাকা সচল থাকে নির্র্দিষ্ট নিয়মে।
বিদ্যমান ব্যবস্থাপনার সংস্কার কিংবা উন্নয়নকামী যেকোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাস্তবায়নযোগ্যতার এবং বাস্তবায়নের দৃঢ়চিত্ততার বিষয় বিবেচনা অগ্রগণ্য না হলে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আন্তরিক প্রয়াস নিশ্চিত হয় না। জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য দূরদৃষ্টি রূপকল্প প্রণয়নকারীর প্রগাঢ় প্রতিশ্রুতি ও দৃঢ়প্রত্যয় প্রয়োজন। সমস্যা গোচরে এলে ব্যবস্থা নিতে নিতে সব সামর্থ্য ও সীমিত সম্পদ নিঃশেষ হতে দিলে প্রকৃত উন্নয়নের জন্য পুঁজি ও প্রত্যয়ে ঘাটতি তো হবেই। সমস্যাগুলো পরস্পরের মিত্র; একটির সাথে আরেকটির যেন নাড়ির যোগাযোগ। আইনশৃঙ্খলার সাথে ব্যক্তিনিরাপত্তার, ব্যক্তিনিরাপত্তার সাথে সামাজিক নিরাপত্তার, সামাজিক নিরাপত্তার সাথে আয় উপার্জনের সব কার্যক্রমের কার্যকরণগত সম্পর্ক রয়েছে। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে চাই আয় উপার্জনের সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ। শিক্ষা কর্মদক্ষতাকে, স্বাস্থ্যসেবা কর্মক্ষমতাকে, কর্মদক্ষতা ও কর্মক্ষমতা উৎপাদন ও ব্যবসায়-বাণিজ্যে প্রসার ঘটবে এটিই প্রত্যাশা। সর্বত্র সেই পরিবেশের সহায়তা একান্ত অপরিহার্য; যেখানে সীমিত সম্পদের ও সুযোগের সর্বোত্তম ব্যবহার সম্ভব। একটিকে উপেক্ষা মানে যুগপৎভাবে অন্য অনেক সমস্যাকে ছাড় দেয়া। সমস্যার উৎসে গিয়ে সমস্যার সমাধানে ব্রতী হতে হবে। এ কাজ কারো একার নয়, এ কাজ সবার। সমস্যার মোকাবেলায় প্রয়োজন সমাধানের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সমস্যা পরিপোষণের জন্য নয়। যেকোনো সংস্কারমূলক পদক্ষেপ বাস্তবায়নের জন্য জনমত সৃষ্টিতে, আস্থা আনয়নে ও একাগ্রতা পোষণে গঠনমূলক উদ্যোগ গ্রহণ অপরিহার্য। সংস্কার বাস্তবায়ন কোনো মতেই সহজসাধ্য নয় বলেই সর্বত্র দৃঢ়চিত্ততা আবশ্যক। এখানে দ্বিধান্বিত হওয়া, দ্বিমত পোষণ কিংবা প্রথাসিদ্ধবাদী বশংবদ বেনিয়া মুৎসুদ্দি মানসিকতার সাথে আপস করার সুযোগ থাকতে নেই। অতীতে এই ভূখণ্ডে যতগুলো রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্কার কর্মসূচি কিংবা ধ্যানধারণা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাদের কমবেশি ব্যর্থতার পেছনে বিরুদ্ধবাদীদের বিরুদ্ধে দৃঢ়চিত্ত অবস্থান গ্রহণে অপারগতাই মুখ্য কারণ ছিল।

খাদ্যাভাবের অর্থনীতি থেকে খাদ্যে স্বয়ম্ভর অর্থনীতিতে পরিণত হওয়াটাই অন্যতম সফলতা
স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সফলতা কৃষি খাতে। দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। খাদ্যাভাবের অর্থনীতি থেকে খাদ্যে স্বয়ম্ভর অর্থনীতিতে পরিণত হওয়াটাই অন্যতম সফলতা। কারণ বাংলাদেশের জনসংখ্যা স্বাধীনতার সময় থেকে এখন পর্যন্ত অনেক বেড়েছে। চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমে গেছে। তারপরও কৃষি গবেষণা এবং কৃষিতে ভর্তুকি দিয়ে এখন তিন ফসল করা যাচ্ছে। খাদ্য, মৎস্য ও শাকসবজি উৎপাদনে আমরা বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছি। দ্বিতীয়ত, আমাদের স্বতঃপ্রণোদিত একটা উদ্যোক্তা শ্রেণী গড়ে উঠেছে। আমরা মূলত একটি ট্রেডিং-নির্ভর অর্থনীতি ছিলাম। ট্রেডিং ও আমদানিনির্ভর অর্থনীতি থেকে আমরা এখন উৎপাদন ও রফতানিমুখী দেশ হতে পেরেছি বেশ কয়েকটি খাতে। রফতানি আয় এখন আমাদের বড় একটি আয়ের উৎস। বেশকিছু পণ্যে আমরা এখন আন্তর্জাতিকভাবে ব্র্যান্ডিং হতে সক্ষম হয়েছি। এটি বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে একটি মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার পথ সৃষ্টি করেছে। তৃতীয়ত, আমরা আমাদের জনসম্পদকে পুরো বিশ্বে পাঠাতে সক্ষম হয়েছি। সেখান থেকে প্রত্যাবাসিত রেমিট্যান্স বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম উৎস হয়েছে। রেমিট্যান্স আসার ফলে আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতি সচল সজীব এবং সব জায়গায় মানুষের জীবন-মানের পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। চতুর্থত, সফলতা হচ্ছে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির ঊর্ধ্বমুখিতা, বিশেষ করে শেষের তিন দশকে ধরে রাখতে পেরেছি। এটি আমাদের অর্থনীতিতে একটি শক্তিশালী কনফিডেন্স বা আত্মবিশ্বাসের ভিত রচনা করতে পেরেছে। পঞ্চমত, আমরা রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি করে বিদেশী সাহায্যনির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছি বা এর পথে আছি। আশির দশকে আমাদের এডিপি বাস্তবায়নের জন্য পুরো শতভাগ বা তার বেশি বিদেশী ঋণ বা সাহায্যের ওপর নির্ভর ছিল। সেখান থেকে এখন সেই অনুপাত ৪৮:৫২। অর্থাৎ আমরা স্থানীয় সম্পদ দিয়ে আমাদের নিজেদের সক্ষমতা দিয়ে এডিপি বাস্তবায়ন করতে পারছি এবং বিদেশী সাহায্যনির্ভরতা থেকে আমরা মুক্ত হতে পেরেছি। বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধে আমরা কখনো অপারগ হইনি। আমাদের বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ যথেষ্ট ভালো ছিল। ষষ্ঠ, আমরা গুরুত্বপূর্ণ খাত ও উৎস থেকে বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছি। চীন, জাপান, যুক্তরাষ্ট্রসহ শক্তিশালী বহু রাষ্ট্র এবং বহুমুখী সংস্থা থেকে আমাদের এখানে বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে। আমাদের এখানে বড় বড় শিল্প বা বহুজাতিক কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সপ্তম, এমডিজির বেশ কয়েকটি সূচকে আমরা যথেষ্ট সাফল্য দেখাতে পেরেছি, এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতের চেয়েও বেশি। এর জন্য আমরা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও পুরস্কারও লাভ করেছি। এটিই আমাদের সামনে আরো মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য সহায়ক হয়েছে। এলডিসি থেকে বেরিয়ে আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে সক্ষমতা ও স্বীকৃতি লাভের পথে অগ্রসরমান আছি।
সফলতার এই জায়গুলোতে আমাদের আরো ভালো করার পথে প্রয়াস প্রচেষ্টাতে আছি আমরা। যেসব জায়গায় আমাদের আরো কাজ করতে হবে : ১. খাদ্য উৎপাদনের বিষয়টিকে টেকসই করার ব্যাপারে আমাদের আরো উদ্যোগী হতে হবে। লোনা পানিতে মাছ চাষ ও ফসল উৎপাদনের ফলে জমির উপযোগিতা ক্রমান্বয়ে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। পরিবেশের ওপর এর একটি প্রভাব পড়ছে। সেটিকে পরিবেশ সহনীয় করতে না পারলে বা জমির উপযোগিতা ধরে রাখতে না পারলে পরবর্তী সময়ে সেই জমির গ্রহণযোগ্যতা অনেকটা কমে যায়। আমাদের এখানে আরো গবেষণা করার দরকার আছে, যাতে আমরা কৃষি ও খাদ্যের উন্নয়নকে টেকসই করতে পারি। আপাতত সাফল্য নিয়ে বসে না থেকে এটিকে টেকসই করার জন্য আরো পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
২. আমদানিমুখিতা থেকে রফতানির ও উৎপাদনের দিকে যাওয়ার সফলতার ক্ষেত্রেও আমাদের আরো অনেক কিছু করণীয় আছে। গুটিকয়েক পণ্য বা সেবার ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আমাদের এক্সপোর্ট বাস্কেট আরো বড় করতে হবে। রফতানি আয়কে ঊর্ধ্বমুখী ও টেকসইকরণের ওপর জোর দিতে হবে। শিল্পক্ষেত্রে নানান ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আমরা যে শিল্পকে গড়ে তোলার চেষ্টা করছি সেটি যেন স্থিতিশীল হয়, সে ব্যাপারে দেখা দরকার। আমরা দেখছি ভালো রফতানি হচ্ছে; কিন্তু টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। রফতানি হলেও টাকা দেশে আসছে না। শিল্পক্ষেত্রে নানা অমনোযোগিতা। এসব জায়গায় আরো সতর্ক হতে হবে ও পর্যবেক্ষণ বাড়াতে হবে। দেশের অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে কেন তার কারণ খুঁজতে হবে, বন্ধ করতে ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশে বিনিয়োগের পথ সুগম করতে হবে এবং দুর্নীতিজাত অর্থ (যা সাধারণত পাচার হয়) উপার্জনের উৎসমুখ বন্ধ করতে হবে। অর্থপাচার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে রফতানি খাতে আমাদের উন্নয়ন টেকসই হবে না। এখানে সুশাসন, জবাবদিহিতা ও কড়া নজরদারির প্রয়োজন আছে। কারণ এর সাথে দ্রব্যমূল্য জড়িত। দ্রব্যমূল্য হচ্ছে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম নিয়ামক। কোনো ভুল নীতির জন্য দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে, এর প্রভাব সরাসরি জনগণের ওপর পড়ে।
৩. জনসংখ্যা রফতানির ক্ষেত্রেও টেকসইকরণের ব্যাপারটি রয়েছে। আমরা দক্ষ জনশক্তি পাঠাতে পারলে আরো তিন-চারগুণ বেশি রেমিট্যান্স পেতাম। জনশক্তিকে জনসম্পদে পরিণত করার জন্য আরো উদ্যোগ নিতে হবে। স্কিল ম্যানপাওয়ার পাঠানো এবং তাদের দেখভাল করার প্রয়োজন। এর সঙ্গে শিক্ষার বিষয়টিও জড়িত। আমরা এমন শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারিনি যা আমাদের জনশক্তিকে জনসম্পদে পরিণত করতে পারে। ফলে আনস্কিল ম্যানপাওয়ার বিদেশে যাচ্ছে এবং স্কিল ম্যানপাওয়ার তৈরি না করাতে বিদেশীরা এসে আমাদের দেশ থেকে রেমিট্যান্স নিয়ে যাচ্ছে। প্রতি বছর ৯-১০ বিলিয়ন টাকা আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর স্কিল ম্যানপাওয়াররা এসে নিয়ে যাচ্ছে। ম্যানপাওয়ার সারপ্লাসের দেশ হিসেবেই আমাদের দেশেই দক্ষ কর্মশক্তি উৎপন্ন হতে পারত এবং বিদেশে যে টাকাটা যাচ্ছে সেই টাকা না গিয়ে দেশেই থাকত। দেশের বেকার লোকরা এই অর্থ আয় করতে পারত। শিক্ষায় নজর দেয়ার ব্যাপারে প্রচুর গাফিলতি ও অসফলতা আছে।
৪. আমাদের শিক্ষাকে যুগোপযোগী ও জনশক্তিকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করার মতো শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে আমাদের এখনো অনেক কিছু করণীয় রয়েছে। যদিও এখনো একটি নিরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছি।
৫. শিল্পোদ্যোক্তা শ্রেণীকে উৎসাহিত করার জন্য নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ আসলে এখনো সহজ হয়নি। দিন দিন যাতে কঠিন না হয় সে চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। যে সব সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে সেগুলোর অপব্যবহার রোধ করতে হবে। দেশে এখনো শিল্পবান্ধব পরিবেশ পুরোপুরি গড়ে উঠেনি। এরপরও যে শিল্পোদ্যোক্তা শ্রেণী গড়ে উঠেছে তাদের আমরা ঠিকভাবে প্রণোদনা সুবিধা দিতে পারছি না। একটি জেনারেশন কষ্ট করে শিল্প গড়ে তুলল কিন্তু সেটি যদি টেকসই না হয়, তাহলে তো হবে না। আমাদের বড় বড় শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, বড় বড় শিল্প খাত ঘুরে যাচ্ছে। বড় বড় শিল্প পরিবার শিল্প থেকে সরে যাচ্ছে অনেকের অগ্রগতি নেই বলে। নতুন যারা আসছে তারা আবার নানা ধরনের প্রতারণার শিকার হচ্ছে। যেমনটি আমরা ই-কমার্সের ক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি। বিশে^ আমরা যেসব পণ্য রফতানি করছি সেগুলোর সুনাম ধরে রাখার চেষ্টা করতে হবে। আমাদের শিল্পনীতি যেগুলো নেয়া হয়েছিল সেগুলো বেশ ভালো ছিল কিন্তু আমরা সেগুলো আক্ষরিক অর্থে বাস্তবায়নের পরিবেশ তৈরি হয়নি। আমরা শিল্প নীতিতে অনেকগুলো সুযোগ-সুবিধার কথা বলেছি, শর্তের কথা বলেছি কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়ন করতে সময় নিচ্ছি অথচ ইতোবছরে অনেক সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। আমরা বিদেশীদের জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধার কথা বলেছি কিন্তু সেগুলো তারা পায়নি। আবার অনেকে আমাদের ঘোষিত সুযোগ-সুবিধা অপব্যবহারের কৌশল অবলম্বন করেছে। আমরা দেশের রাজস্ব আহরণে সফলতা অর্জন করলেও এই জায়গায় আরো অনেক কাজ করার আছে। কারণ আমরা কর ও জিডিপি রেশিওকে এখনো উন্নত করতে পারিনি। আমাদের রাজস্ব আহরণের সিস্টেমের ভেতরে এখনো অনেকগুলো গলদ রয়ে গেছে। প্রচুর খাতকে আমরা কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ করে দিয়েছি, অনেক খাতকে উপেক্ষা করেছি। কালো টাকা সাদা করার ব্যাপারে এমন সুযোগ-সুবিধা দিয়েছি যার ফলে দুর্নীতি ও অসৎ উপার্জনকে আরো উৎসাহিত হতে পারে। অপর দিকে, নিয়মিত করদাতারা ও সৎ পথে উপার্জনকারীরা নিরুৎসাহিত হচ্ছে।

৬. আগে খুব সহজ শর্তে বাংলাদেশ বিদেশী ঋণ পেত। যার ফলে আমরা খুব সহজে ঋণ পরিশোধ করতে পারতাম। কঠিন শর্তে বিদেশী ঋণ নেয়ার ফলে তার যে লায়াবিলিটি তৈরি হচ্ছে তা শোধ করার জন্য অর্থনীতিকে যদি স্বয়ম্ভর করতে না পারি তাহলে ডেথ ট্র্যাপে পড়ার সম্ভাবনা স্পষ্ট হচ্ছে। আমরা অবশ্যই প্রত্যাশা করি এই আশঙ্কা যেন সত্যি না নয়। খুব কঠিন শর্তে ঋণ নিয়ে কোনো অবকাঠামো তৈরি করলে সেটি যত তাড়াতাড়ি তৈরি করে তত তাড়াতাড়ি সেখান থেকে যে উপযোগিতা আসবে তা দিয়ে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। কঠিন শর্তে ঋণ নিয়ে দ্রুত কাজ শেষ করতে না পারলে সফলতা পাওয়া যাবে না। আমাদের মাথাপিছু দেশী এবং বিদেশী ঋণ ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। সুদের পরিমাণও এত বেড়ে যাচ্ছে যে, পুরো বাজেটের প্রায় ২০-২২ শতাংশ শুধু সুদ পরিশোধ করতে খরচ হয়। ভবিষ্যতে আমাদের বাজেটের বেশির ভাগ খেয়ে ফেলবে এই ঋণের দায় শোধ করতে। তাহলে উন্নয়ন হবে কখন ও কীভাবে? তখন উন্নয়ন করতে পারব যদি আমরা ঋণ নিয়ে যে অবকাঠামো তৈরি করেছি সেগুলো যদি সত্যি সত্যি সময়মতো পাই তাহলে অর্থনীতিতে যে গতিশীলতা আসবে এতে আমরা কাভারআপ করতে পারব। মানুষ ঋণ নেয় ভবিষ্যতে সক্ষমতা অর্জন করার জন্য। এমন ঋণ নেয় যেটি ভবিষ্যতে শোধ করতে পারবে। কিন্তু সেটি যদি পরিশোধ করতে না পারে তাহলে ডেট ট্র্যাপে পড়ে। অনেক উন্নয়নশীল দেশ, আফ্রিকার বহু দেশে ও আমাদের অনেক প্রতিবেশী দেশ এ ধরনের বিপদে পড়েছে। অতএব, এই আশঙ্কার বিষয়টি আমাদের অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement
কুলাউড়ায় জঙ্গল থেকে তরুণীর লাশ উদ্ধার ঈদগাঁওতে মাদক সম্রাট রেজাউল গ্রেফতার শিক্ষায় ব্যাঘাত : ফেসবুক-টিকটক-ইনস্টাগ্রাম-স্ন্যাপচ্যাটের বিরুদ্ধে ২৯০ কোটি ডলারের মামলা আমতলীতে কিশোরীকে অপহরণ শেষে গণধর্ষণ, গ্রেফতার ৩ মহানবীকে কটূক্তির প্রতিবাদে লালমোহনে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ক্রিমিয়া সাগরে বিধ্বস্ত হলো রুশ সামরিক বিমান জর্ডান আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশী বিচারক এবারের আইপিএলে কমলা ও বেগুনি টুপির লড়াইয়ে কারা সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে সন্ত্রাসনির্ভর হয়ে গেছে : রিজভী রাশিয়ার ৯৯টি ক্ষেপণাস্ত্রের ৮৪টি ভূপাতিত করেছে ইউক্রেন আওয়ামী লীগকে ‘ভারতীয় পণ্য’ বললেন গয়েশ্বর

সকল