২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

বই কেনার নেশা

-

ছোটবেলা থেকেই বই কেনার প্রতি একটা নেশা ছিল। ছোটবেলায় দেখতাম, বিভিন্ন ওয়াজ-মাহফিলে কিংবা মেলায় বইয়ের দোকান বসত। সেখানে নবী-রাসূলের জীবন কাহিনী, মনীষীদের কাহিনী, সফল ব্যক্তিদের কাহিনীর বই পাওয়া যেত। এসব বই কিনে পড়তাম তখন। সে সময় থেকে বই কেনা, বই পড়ার প্রতি আগ্রহটা জন্মায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর সেটা প্রকট আকার ধারণ করে। ঢাকায় অবস্থানের পর থেকে বই কেনার নেশাটা আরো তীব্র হতে থাকে। একসময় কাঁটাবন, মগবাজার, নীলক্ষেত, পল্টন, পাঠক সমাবেশ, বাতিঘর Ñ এসব এলাকায় কোনো কাজে এলেই কমপক্ষে দু-একটি বই কিনা হতো। তখনকার সময়ে আমার নিত্যদিনের সঙ্গী ছিলেন ইয়াসিন মাহমুদ। সেও বই পাগল মানুষ। আমরা নাশতার টাকা বা রিকশা ভাড়ার টাকা বাঁচিয়ে বই কিনতাম। আমাদের সাথে যারা থাকতেন তারা দামি দামি ব্যান্ডের জামা-কাপড় পরতেন, আর আমরা ফুটপাথ থেকে কম দামি জামা-কাপড় নিয়েই তৃপ্ত থাকতাম। কারণ, আমাদের টার্গেট থাকত বই কেনা। ইয়াসিন ভাই বলতেন, দামি জামা-কাপড় দিয়ে কী হবে? বইগুলো একসময় আমাদের সম্বল হবে। একবার বাসা চেঞ্জ করার পর আরেক বই পাগল কবি আহমেদ ইউসুফের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে। সেও দেখি জামা-কাপড় না কিনে অন্য কাজে টাকা খরচ না করে খালি বই কিনে। গ্রাফিক্স ডিজাইন করে যা কয় টাকা পায় তা বই কেনার পেছনেই সব ব্যয় করেন। কোথাও বইয়ের কোনো নিউজ পেলে বা কোথাও নতুন কিংবা পুরনো ভালো কোনো বইয়ের সংবাদ পেলেই আমার ইনবক্সে সেই ম্যাসেজটি হাজির। তার সাথে হাঁটতে বের হলে বই না কিনে বাসায় ফেরা মুশকিল। করোনাকালেও বাড়ি থেকে ফোনকলে বা ম্যাসেজে প্রায় সময় বইকেনার নিউজ দিতো সে। বলে, ভাই নীলক্ষেতের দিকে যান নাকি, গেলে (নাম উল্লেখসহ) এই বইগুলো একটু নিয়ে নিয়েন, আমি বিকাশে টাকা পাঠাব।
বছর দুয়েক আগের একটি ঘটনা, দু-এক দিন অসুস্থ থাকার পর ডাক্তার দেখালাম। ডাক্তার কিছু ওষুধ দিলো, ভাবলাম আসার পথে ওষুধগুলো নিয়েই বাসায় ফিরব। নিউ মার্কেট পার হতেই নীলক্ষেতে একটু-ঢু মারি, আর এমনিতেই কতগুলো বই পছন্দ হয়ে গেল। কিসের ওষুধ কেনা, ওষুধের টাকা দিয়ে বই কিনে বাসায় ফিরলাম। আরেকটি ঘটনা, ছয়-সাত বছর আগে একবার দৈনিক বাংলা থেকে মতিঝিলের দিকে যাচ্ছিলাম। কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটির অফিসের সামনে আসতেই দেখি তাদের এজিএম উপলক্ষে বইমেলা চলছে। ওদের সমিতির সদস্যরা ৫০ শতাংশ কমিশনে বই কিনছে। আমি তো আর সদস্য না, কি করা যায় ভাবলাম। উপরে গিয়ে দেখি অনুষ্ঠানে কবি আল মুজাহিদী বসা, তিনি আমাকে খুব স্নেহ করেন। যাক ফন্দি মিলে গেল, তার সদস্য নম্বর নিয়ে অনেকগুলো বই পছন্দ করে ফেললাম। পকেটে কিন্তু টাকা নেই। বইগুলো কাউন্টারে বিক্রয় প্রতিনিধির কাছে রেখে এক বন্ধুকে ফোন করে বিকাশে টাকা ধার নিয়ে তারপর বইগুলো নিয়ে আসি। এখনো পল্টনে বই দোকানের বিক্রেতারা পকেটে টাকা না থাকলেও বই দিয়ে দেয় আর বলেন, মামা টাকা পরে দিয়েন, বই নিয়ে যান। কোন ধরনের বই পছন্দ করি তাও বিক্রেতা মামারা আন্দাজ করতে পারেন এবং সেই ধরনের বই প্যাকেট করে রেখে দেন। আর ওইদিকে গেলেই বলে, মামা আপনার জন্য এই বইটা রেখেছি।
বই কিনতে কিনতে এখন আর জায়গা হয় না বাসায় বা গ্রামের বাড়িতে। আমাদের সাথে যারা থাকতেন তারা অনেক সময় বিরক্ত হতেন, বাসায় বইয়ের বস্তা বা কাটুন দেখে। বাসা চেঞ্জ করতে গেলেও ভ্যান গাড়ি দিয়ে মালামাল সঙ্কুলান হতো না পিকআপ ভাড়া করতে হতো। গত দুই তিন বছর ধরে বাড়ি যাওয়ার সময় দুই চার কাটুন করে বই বাড়িতে নিয়ে যেতাম। বাবা-মাও বিরক্ত হন অনেক সময়। বলেন, এত বই দিয়ে কী করবি? আমি বলি, মা এই বইগুলো আমার সম্পদ। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কিছু দিতে পারি আর না পারি, বইগুলো তো রেখে যেতে পারব। এলাকায় একটি পাঠাগার গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছি। এই স্বপ্নটা অনেক দিন থেকে লালন করে আসছি। আমার গড়ে তোলা পাঠাগার দ্বারা কেউ যদি একটুখানি আলোর মুখ দেখে তাহলেই আমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে। মনে প্রশান্তি আসবে। মরণের আগে আর কোনো তেমন আকাক্সক্ষা নেই। এই কাজে মহান আল্লাহর সহযোগিতা কামনা করছি। আমীন।


আরো সংবাদ



premium cement