২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

খেজুরের রস খেজুরের গুড়

-

শীত এলে খেজুরের রস ও গুড়ের কথা মনে পড়ে। অগ্রহায়ণ মাস থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত খেজুরের রস থেকে নির্গত সুস্বাদু রস থেকে ঘন ও শক্ত পাটালি গুড় তৈরি হয়। এক সময় খেজুরের রস থেকে চিনি তৈরি করা হতো। বৃহত্তর যশোর ও ফরিদপুর, নদীয়া জেলার কিছু অংশ, বশিরহাট ও সাতক্ষীরা মহকুমায়, চব্বিশ পরগনায় ব্যাপকভাবে খেজুর গাছের চাষ হতো। এখনও হয়। এসব এলাকাতেই খেজুরের গুড় বেশি উৎপাদিত হয়। তবে দেশের প্রায় সব জেলাতেই কিছু কিছু খেজুরের গুড় পাওয়া যায়।
বসত বাড়ির আশপাশে, রাস্তার পাশে, জমির চার পাশে, জমির ভেতর সারিবদ্ধভাবে খেজুর গাছ লাগানো হয়। এক বিঘা জমিতে ১০০টি গাছ লাগানো হয়। সাত বছরের মধ্যে গাছগুলো ফল ও রস সংগ্রহের উপযোগী হয়ে থাকে। ত্রিশ-চল্লিশ বছর পর্যন্ত ফলন দেয়। রস সংগ্রহের আগে কিছু প্রস্তুতিমূলক কাজ করতে হয়। গাছের কাণ্ডের একেবারে উপরের অংশে পাতাসংবলিত বাঁকলগুলো ধারাল দা দিয়ে চেঁছে পরিষ্কার করা। সাত-আট দিন পর আবার পরিষ্কার করে আরো সাত-আট দিন পর চাঁছা অংশে বাঁশের নল ও খিল লাগিয়ে এবং তার সম্মুখ ভাগের নিচে হাঁড়ি ঝুলিয়ে দিয়ে রস সংগ্রহ করা হয়। একটি মাঝারি মাপের সুস্থ খেজুরগাছ প্রতিদিন গড়ে ছয় লিটারের মতো রস দিয়ে থাকে। আবহাওয়া যত শীতার্ত ও পরিচ্ছন্ন থাকে, রস ততই পরিষ্কার ও মিষ্টি হয়। প্রথম রাতের রসকে বলা হয় জিড়ান, দ্বিতীয় রাতের রসকে বলা হয় দোকাট, তৃতীয় রাতের রসকে বলা হয় ঝরা। বাংলাদেশে তিন রকমের রস থেকে গুড় তৈরি হয়Ñ আখের রস, খেজুরের রস, তালের রস। যে কেউ গুড় তৈরি করতে পারে না। গুড় তৈরির জন্য লাগে পাকা হাত। রস জ্বালের সাথে ঘনত্বের ভারসাম্য রাখার প্রক্রিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৮৬১ সালে মিস্টার নিউ হাউজ চৌগাছার কপোতাক্ষ নদের পাড়ে তাহেরপুরে প্রথম খেজুরের গুড় উৎপাদনের যান্ত্রিক কারখানা গড়ে তোলেন। ওই কারখানার উৎপাদিত গুড় ইউরোপে রফতানি হয়েছে। পরবর্তী সময়ে যশোরের বিভিন্ন গ্রামে ১১৭টি কারখানা গড়ে ওঠে।
গুড় উচ্চ ক্যালরিযুক্ত। শরীরের জন্য শীতে এর প্রয়োজন রয়েছে। গুড় শরীরে তাপমাত্রা উৎপাদন করে সেটা ধরে রাখতে সহায়তা করে। গুড়ে ক্যালরির পরিমাণ চিনির চেয়ে কম। গুড় আবার অ্যান্টিফ্যাট। আছে আয়রন, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম, কপার, জিঙ্ক, ভিটামিন বি ও সি। জ্বর, সর্দি-কাশি প্রতিরোধ করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। শ্বাসনালী, খাদ্যনালী, পাকস্থলী, অন্ত্র, ফুসফুসে অবাঞ্ছিত রোগের আক্রমণ প্রতিহত করে। রক্তনালী প্রসারিত করে রক্তের প্রবাহ স্বাভাবিক রাখে, পাশাপাশি হিমোগ্লোবিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। প্রতিদিন একটু করে গুড় খেলে হজম ভালো হয়। গুড়ের চেয়ে চিনির ক্যালরি কম। গুড় হতে পারে চিনির বিকল্প। রস সেদ্ধ না করলে গাজন প্রক্রিয়ার তাড়াতাড়ি মজে গিয়ে নষ্ট হয়ে যায়। কিছু এলাকায় তা স্বাস্থ্যবর্ধক হিসেবে গরু মহিষকে খাওয়ানো হয়। আর গুড়কে বেশি জ্বাল দিয়ে ঘন করলে চিংড়িতে পরিণত হয়। এ চিংড়ি গুড় এক সময় গ্রাম এলাকায় চকলেট হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
বর্তমানে নিকাহ ভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে এখন অনেকেই কাঁচা রস খেতে ভয় পান। বাজারে ভেজাল গুড়ে সয়লাব। রসে চিনি মিশিয়ে পাটালি তৈরি করা হয় পরিমাণ বাড়ানোর জন্য। চিনির জায়গা নিয়েছে হাইড্রোজ। রস ছাড়া নানা রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে তৈরি হচ্ছে গুড়। খেজুরগাছ ঘরের আড়া, খুঁটিরূপে ব্যবহৃত হয় এবং জ্বালানি হিসেবে ইটের ভাটাতেও ব্যবহার ব্যাপক হওয়ায় বিস্তীর্ণ এলাকায় খেজুরগাছ প্রায় উজাড় হওয়ার পথে। তাছাড়া তরুণ প্রজন্ম রস থেকে গুড় তৈরিতে আগ্রহ নেই বললেই চলে। নানা কারণে খেজুর গুড়ের উৎপাদন বহুলাংশে কমে গেছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement