১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

নয়া দিগন্ত ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা

-

নয়া দিগন্তের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে নয়া দিগন্ত কর্তৃপক্ষ, সাংবাদিকসহ পত্রিকার সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে হৃদয়ের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
নয়া দিগন্ত সরকারের বহু ধরনের প্রচারণা ও পরিকল্পিত নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে এবং প্রচণ্ড প্রতিকূলতা ও হুমকি মোকাবেলা করে সাংবাদিকতার কর্তব্য সম্পাদন করে এগিয়ে যাচ্ছে, যা অভিনন্দনযোগ্য। বিদ্যমান সামাজিক বাস্তবতায় একটি দৈনিক পত্রিকার ১৮ বছরে পদার্পণ করা আসলেই একটা উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত।
নয়া দিগন্তের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী যখন পালিত হচ্ছে, তখন সারা বিশ্বে কর্তৃত্ববাদী শাসনকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে দুই সাংবাদিক শান্তিতে নোবেল অর্জন করেছেন। সাংবাদিকদের নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা গণমাধ্যমকর্মীদের আরো অনুসন্ধানী এবং আরো উদ্যমশীল করার ক্ষেত্রে উচ্চমাত্রার প্রণোদনা জোগাবে।
শান্তির অন্যতম পূর্বশর্ত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা গণতন্ত্র ও টেকসই শান্তির অন্যতম পূর্বশর্ত। আর এই মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে লড়াইয়ে সাহসী ভূমিকার জন্য সাংবাদিক সমাজের এই বিরল সম্মান অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। বিশ্বব্যাপী যখন গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সঙ্কুচিত হচ্ছে এবং সাংবাদিকরা ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে কাজ করছেন, তখন এ ধরনের পুরস্কার সংবাদপত্রের জন্য দারুণ অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। সংবাদপত্রকে নিয়ন্ত্রণ বা দমনের বিরুদ্ধে এ পুরস্কার একটি উচিত জবাব।
নোবেল কমিটি বলেছে, মুক্ত-স্বাধীন বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা হলো ক্ষমতার অপব্যবহার মিথ্যা অপপ্রচারের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ।
আমাদের মতো সংবিধানভিত্তিক রাষ্ট্রগুলোতে বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতাসহ মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর সরকার অপরিহার্যভাবে নিয়ন্ত্রণের খড়গ নিয়ে আসে এবং ভয়ভীতির সংস্কৃতি চালু করে।
যেহেতু আমাদের দেশে গণমাধ্যমের অসীম প্রভাব রয়েছে সেই জন্যই গণমাধ্যমের সাথে সব সময় একটা বিপদ জড়িয়ে থাকে।
মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে গণমাধ্যমকে অবশ্যই জনগণের অধিকার নিয়ত রক্ষা করতে হবে, জীবনের মর্যাদা সুরক্ষায় সংবাদ পরিবেশন করতে হবে। গণতন্ত্র ও মানুষের মর্যাদার স্বীকৃতি হচ্ছে অপরিহার্য। সংবাদপত্রকে রাজনীতি, অর্থনীতি, মতাদর্শিক ও ভূরাজনৈতিক প্রতিটি প্রশ্নে সঠিক তথ্য উপস্থাপন করে জনগণকে অবহিত রাখতে হবে।
ফিলিপাইনের মারিয়া রেসা ক্ষমতার অপব্যবহার ঊর্ধ্বমুখী সহিংসতা ও ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্বপরায়ণতার খবর প্রকাশ করে তিনি যেভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার আদর্শ সমুন্নত রেখেছেন আমাদের গণমাধ্যমের সাংবাদিকদেরকে এভাবে নৈতিক দায়িত্ব পালন করতে হবে।
বাকস্বাধীনতা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ছাড়া প্রগতিশীল মানবিক সমাজ গঠন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তথ্যবিহীন একটি সমাজকে ক্রমাগত সত্য থেকে বিচ্ছিন্ন এবং রাষ্ট্রকে একটা আস্থাবিহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে।
সরকার কর্তৃত্ববাদী শাসন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নামে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সঙ্কুচিত করার লক্ষ্যে দীর্ঘ দিন ধরে সাংবাদিকদের গ্রেফতার, তাদের ওপর হামলা নজরদারি ও নির্যাতন নিপীড়ন চালাচ্ছে। সাংবাদিক সংগঠনগুলোর নেতাদের ব্যাংক হিসাব তলব ছিল সেই চক্রান্তেরই অংশ। সাময়িক গুম, বিনা বিচারে বন্দিত্ব, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হয়রানি ক্রমাগত বেড়েই চলছে।
বাংলাদেশে সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ এর সাধারণভাবে স্বীকৃত কতগুলো ক্ষেত্র হচ্ছে, রাষ্ট্রের ভাবমর্যাদা, রাষ্ট্রের গোপনীয়তা প্রকাশ এবং দুর্নীতিবাজ প্রভাবশালীদের মর্যাদা ক্ষুণœ।
আমাদের বাকস্বাধীনতার ওপর আরোপিত বাধানিষেধ খুবই অস্পষ্ট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। রাষ্ট্রের ভাবমর্যাদা নিয়ে সরকার একেকবার একেক রকম মনগড়া বক্তব্য দিয়ে থাকেন।
সংবিধানিক নির্দেশনা উপেক্ষা করে, বলপ্রয়োগ বা কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের সাংবাদিক গ্রেফতার ও হাতকড়া পরিয়ে ভয়ের সংস্কৃতি বিরুদ্ধে আমাদের গণমাধ্যমকেও যুগান্তকারী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।
সব পেশাকে নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে হবে, জ্ঞান-বিজ্ঞান সাহিত্য-সংস্কৃতিসহ সব ক্ষেত্রে বিকশিত হওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। সংবাদপত্রবিহীন গণতন্ত্রবিহীন সমাজ ক্রমাগত ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ সব কালো আইনের বিলোপ সাধন করতে হবে।
গণমাধ্যম সাংবাদিকদের অবশ্যই রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভের প্রতি অবিচল থাকতে হবে, একান্তভাবে নিয়োজিত থাকতে হবে এবং সঙ্কট মোকাবেলায় সাহসী হতে হবে। সরকারি নকশায় অনুগত গণমাধ্যম গড়ে তোলার বিরুদ্ধে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকসহ সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। প্রচলিত অপশাসন, বিধিনিষেধকে উপেক্ষা করে, ক্ষমতা বলয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অধিকারহীনদের অধিকারের কথা বলতে হবে, ব্যক্তিগত হুমকি উপেক্ষা করে সব ধরনের নিয়ন্ত্রণের শিকল ছিঁড়ে ফেলে সত্যের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। রাষ্ট্রকে অবশ্যই জনস্বার্থের সংস্থা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
আইন প্রণয়ন ও নীতিনির্ধারণী সংস্থায় গণমাধ্যমের প্রতিনিধিত্ব সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত করতে হবে।
সত্য ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে ও বাঙালির তৃতীয় জাগরণে গণমাধ্যম আরো তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখুক এ প্রত্যাশা করছি।


আরো সংবাদ



premium cement