১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা : মনে ঘরে দেশে

-

নিরাপত্তা নামক শব্দটির ব্যাপক দ্যোতনা ও তাৎপর্য আছে। নিরাপত্তা নামক শব্দটি সংসারেও আলোচিত হয়। নিজের বাড়ির নিরাপত্তা, নিজের আবাসিক এলাকার নিরাপত্তা, নিজের মহল্লার নিরাপত্তা, নিজের স্কুল-কলেজের নিরাপত্তা, বহুতল বিল্ডিংয়ে অবস্থিত মার্কেটের নিরাপত্তা ইত্যাদি। বাংলাদেশ আঠারো কোটি মানুষের আবাসস্থল বা ঘর। বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে চলাচল করে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে তথা আন্তর্জাতিক সব কর্মকাণ্ডের পরিসরে। বাংলাদেশ নিজেকে নিয়ে এবং অন্যকে নিয়ে চিন্তা করে। অর্থাৎ বাংলাদেশেরও সড়ক নিরাপত্তা চাই, বাংলাদেশের তথা বাংলাদেশীদেরও মনের চিন্তার নিরাপত্তা চাই এবং বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডটির সার্বিক নিরাপত্তা চাই।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বা মহাযুদ্ধ চলেছিল ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সাল। সেই যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর, পৃথিবীর মানচিত্রে পরিবর্তন এসেছিল। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছিল মধ্যপ্রাচ্যে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার বছর অর্থাৎ ১৯১৮ সাল থেকে নিয়ে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। তুরস্ক নামক রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের যে সাম্রাজ্য বিদ্যমান ছিল, সেই সাম্রাজ্যের নাম ছিল অটোমান সাম্রাজ্য। অটোমান সাম্রাজ্যের প্রধান তথা তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের খলিফা ছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিতদের একজন। এই পরাজয়ের শাস্তি স্বরূপ তার সাম্রাজ্য ভেঙে মানচিত্র নতুনভাবে আঁকা হয়েছিল এবং মুসলিম বিশ্বের জন্য খলিফার পদ্ধতিটিও বাতিল করা হয়েছিল। তুরস্ক নামক রাষ্ট্রটির চিন্তাচেতনা বা জীবনব্যবস্থা থেকে ধর্মকে নির্বাসন দেয়া হয়েছিল। মধ্যপ্রাচ্যের খনিজসম্পদ, বিশেষত তেল যেন পাশ্চাত্যের নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং তেলের আন্তর্জাতিক চলাচল পথ যেন পাশ্চাত্যের নিয়ন্ত্রণে থাকে, এই দু’টি ভিত্তিকে মেনেই মানচিত্র নতুন করে আঁকা হয়েছিল। মুসলমানদের দোষে বা আগ্রহে নয়, পাশ্চাত্যের দেশগুলোর পারস্পরিক ক্ষমতার লোভেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হয়েছিল, অটোমান সাম্রাজ্য প্রান্তিক রাজ্য হিসেবে ফেঁসে গিয়েছিল। কালের অতি সংক্ষিপ্ত পরিক্রমায় পৃথিবী আবার যুদ্ধে আক্রান্ত হলো। এবারো পাশ্চাত্যের তথা ইউরোপের দেশগুলোর পারস্পরিক কলহের জন্যই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলল ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পরবর্তী ২৫ বছরে এশিয়ার কোনো কোনো অংশে এবং আফ্রিকার অনেক জায়গায় মানচিত্র পুনরায় টানা হলো। ইংল্যান্ড বা যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং ইতালি ইত্যাদি বড় ও ঔপনিবেশিক শক্তিকে তাদের অনেক উপনিবেশ হারাতে হয়েছে। ওই উপনিবেশগুলো স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ১৯৭০ এর দশকের পর পৃথিবীর মানচিত্রে নতুন নতুন রাষ্ট্র আবির্ভূত হওয়ার গতি (ইংরেজি ভাষায় ফ্রিকোয়েন্সি) অনেক ধীর হয়ে গিয়েছে কিন্তু একদম বন্ধ হয়নি। ১৯৭০ সালের পর যে কয়টি নতুন রাষ্ট্র হয়েছে, তারা যুদ্ধ করে ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন হয়েছে। আরেকটি তথ্য হলো এই যে, কোনো কোনো রাষ্ট্র, নিজেদের অভ্যন্তরীণ জাতিগত সমস্যার কারণে ভেঙে গিয়ে, একাধিক রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। তবে যেই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি আমরা তথা বাংলাদেশের জন্য প্রাসঙ্গিক, সেটা হলো, বড় বড় শক্তি কর্তৃক, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্র বা দেশকে গিলে ফেলার প্রবণতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যেই বছর শেষ হয়েছিল অর্থাৎ ১৯৪৫ সালের পর থেকেই এই প্রবণতা বিদ্যমান। “গিলে ফেলা” শব্দদ্বয় দিয়ে আমি দু’টি কথা বুঝাচ্ছি। একটি কথা হলো এই যে, ছোট রাষ্ট্রকে একটি বড় রাষ্ট্র আক্ষরিক অর্থে দখল করে (ইংরেজিতে অকুপাই বা এনেক্স)। আরেকটি কথা হলো- শারীরিকভাবে বা সাংবিধানিকভাবে দখল করে না; কিন্তু ছোট রাষ্ট্রের ভেতরে ও বাইরে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা হয় যে, ছোট রাষ্ট্র ওই বড় রাষ্ট্রের আজ্ঞাবহ বা তাবেদার হতে বাধ্য।
উপরের দীর্ঘ অনুচ্ছেদটিতে ভৌগোলিক নিরাপত্তার একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছি। বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে ছোট দেশ। জনসংখ্যার দিক হতে বাংলাদেশ বড় দেশ। অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দিক থেকে বাংলাদেশ উজ্জ্বল দেশ। বাংলাদেশের প্রতিবেশীদের সাথে বাংলাদেশের আকার-আকৃতিগত, সামরিক অর্থনৈতিক শক্তিগত এবং আদর্শ সংস্কৃতিগত পার্থক্য আছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও, দশ ভাগের এক ভাগ ভূখণ্ড, অবশিষ্ট নয় ভাগ থেকে একটু আলাদা। বাংলাদেশের জনসংখ্যার মধ্যে, শতকরা আড়াই ভাগ মানুষ, বাকি শতকরা সাড়ে সাতানব্বই ভাগ থেকে আলাদা। ওই আড়াই ভাগ হচ্ছে নৃ-তাত্ত্বিক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী বা উপজাতি। ওই আড়াই শতাংশ ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে দুই শতাংশই একটি সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলে সীমাবদ্ধ, যথা পার্বত্য চট্টগ্রাম। বাকি একের অর্ধেক শতাংশ সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগণের একটি অংশ, কুড়ি-পঁচিশ বছর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। অর্থাৎ অনুরূপ কোনো একটি যুদ্ধ ভবিষ্যতেও হতে পারে এই সম্ভাবনা বা পটেনশিয়ালিটি উড়িয়ে দেয়া যায় না। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরে, উত্তর-পূর্বে, পূর্বে, দক্ষিণ-পূর্বে অন্য বা ভিন্ন দেশের জনগোষ্ঠীর সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক ও মনের ভেতরের আশা-আকাক্সক্ষার মিল আছে। এই মিলের কারণটিই বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। কিন্তু বলে রাখা ভালো, একমাত্র হুমকি নয়।
আমরা কাল্পনিকভাবে বা মনে মনে যদি বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে সরাসরি আকাশে উঠতে থাকি তাহলে আমরা বৃহৎ থেকে বৃহত্তর ভূখণ্ড দেখতে থাকব। মাটির উপরে বা ভূমির উপরে সমান মাটিতে, মানুষের চোখের বা স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তির সীমাবদ্ধতা আছে। এক কিলোমিটার বা দেড় কিলোমিটার দূরে গেলে তখন হুবহু চেনা যায় না, অনুমান করে আকার আকৃতি থেকে বুঝে নিতে হয়। আরো দূরে গেলে, সব কিছু ঝাপসা হয়ে যায়। আকাশে উপরের দিকে উঠার পর নিচের দিকে তাকালে একই কারণে সবকিছু পরিষ্কার দেখা যাবে না। তাছাড়া ধূলিকণা, কুয়াশা, সূর্যের প্রখর তাপ ইত্যাদির কারণে দৃষ্টিশক্তি কমে যায়। তারপরেও আমরা কল্পনা করতে চাই বা অনুমান করতে চাই যে, আমরা বিশ মাইল উপরে উঠেছি এবং আমরা নিচের দিকে সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পারছি। তাহলে আমরা দেখব যে, ভারত এবং বার্মা নামক দু’টি দেশের একটি ‘চিপা’-র মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান। বাংলাদেশের পশ্চিমে ভারত, বাংলাদেশের পূর্বে ভারত; পূর্ব ভারত এবং পশ্চিম ভারতের মধ্যে যোগাযোগ হচ্ছে বাংলাদেশের উত্তর দিয়ে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উত্তর প্রান্তে অবস্থিত ক্ষুুদ্র একটি ভারতীয় ভূখণ্ডের উপর দিয়ে, যাকে বলা হয় শিলিগুড়ি করিডোর। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র যদি না থাকতো তাহলে, উত্তর-পূর্ব ভারত এবং বাংলাদেশের পশ্চিমে অবস্থিত ভারতীয় মূল ভূখণ্ড এক খণ্ড জমি হতো। শুধু খণ্ড নয়, বঙ্গোপসাগর নামক জলরাশির উপকূলের এবং জলরাশির ওপর প্রভাবের নব্বই ভাগ এরই মালিক হতো ভারত নামক রাষ্ট্রটি। অতএব বাংলাদেশের ভৌগোলিক অস্তিত্ব, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের জন্য ভৌগোলিকভাবেই বিব্রতকর। ভৌগোলিক বিব্রতা, কাটিয়ে ওঠার জন্য শারীরিক, কূটনৈতিক বা অর্থনৈতিক অনুকূলীয় পরিবেশ প্রয়োজন। এই পরিবেশ সৃষ্টিতে ভারত এবং বাংলাদেশ উভয়কে ভূমিকা রাখতে হবে। যদি ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে বড় দেশ ভারত, বেশি শক্তিশালী ভূমিকা রাখে তাহলে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
উপরের অনুচ্ছেদগুলোর আলোচনার সূত্র ধরেই আমাদের পরবর্তী দু’টি অনুচ্ছেদের আলোচনা শুরু। এই রচনার প্রথমদিকের কয়েকটি অনুচ্ছেদে আমরা নিরাপত্তার আলোচনা করেছি। এটা একটা সংসারের জন্য প্রযোজ্য, তেমনই একটি রাষ্ট্রের জন্যও প্রযোজ্য। বাংলাদেশের জন্য যেমন প্রযোজ্য, ভারতের জন্যও প্রযোজ্য। অবশ্যই চীন নামক ভীষণ বড় ও শক্তিশালী রাষ্ট্রের জন্যও প্রযোজ্য। বাংলাদেশের পশ্চিক দিয়ে অবস্থিত ভারত এবং পূর্বদিকে অবস্থিত ভারত, এই দু’টি খণ্ডের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করা প্রয়োজন এবং ভৌগোলিকভাবে সংক্ষিপ্ততর করা প্রয়োজন। আমরা একটা ত্রিভুজ কল্পনা করি। ত্রিভুজের নিচে একটি বাহু আছে যেটা হরাইজন্টাল (বাংলায় : দিগন্তের সমান্তরাল বা অনুভূমিক), অপর দু’টি বাহু আড়াআড়িভাবে উপরে গিয়ে পরস্পরের সাথে মিলিত হয়। আড়াআড়ি দু’টি বাহুর দৈর্ঘ্য, সমান্তরাল বাহুটির কমপক্ষে দ্বিগুণ। এই আকৃতিটি বাংলাদেশ ভারত প্রসঙ্গে প্রযোজ্য। বাংলাদেশের পশ্চিমে অবস্থিত ভারতীয় নগরী কলকাতা থেকে, বাংলাদেশের পূর্বে অবস্থিত ভারতীয় নগরী আগরতলায় যেতে ত্রিভুজের দু’টি বাহুর মতো পথ অতিক্রম করতে হবে। কিন্তু এই দু’টি বাহু হতে অর্ধেকেরও অনেক কম দূরত্ব হচ্ছে কলকাতা হতে আগরতলা পর্যন্ত টানা সমান্তরাল বাহুটি। বহু বছর ধরে, ১৯৪৭ সাল থেকেই, এটি ভারতের অন্তরের অন্তস্তÍলে লালিত স্বপ্ন যে, তারা বাংলাদেশের মাটির ওপর দিয়ে এই ত্রিভুজের সমান্তরাল বাহুটি আঁকবে এবং নিজেদের সমস্যা মিটাবে। প্রথম ধাপ হিসেবে ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টিতে তারা অবদান রেখেছে। ফলে বাংলাদেশ একটি বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র। গত বারো বছর ধরে ওই বন্ধুত্বের সীমারেখা ও গভীরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। ভারত এখন আমাদের ভূখণ্ড ব্যবহার করছে। ফলে ভারতের চলাচল যেমন সহজ হয়েছে, তেমন নিরাপত্তার তাগাদা বৃদ্ধি পেয়েছে।
এই নিবন্ধের একাধিক জায়গায়, উপরে আলোচনা করেছি যে, দেশ বা রাষ্ট্রের নিরাপত্তায় অনেকগুলো আঙ্গিক আছে। বাংলাদেশের জন্যও এই আঙ্গিকগুলো প্রযোজ্য। বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত টেকনাফ; তার দক্ষিণের প্রতিবেশী হলো মিয়ানমার নামক রাষ্ট্রের রাখাইন প্রদেশের ভূমি। টেকনাফের পশ্চিম পাশে যেমন বঙ্গোপসাগরের নীল পানি, তেমনই রাখাইনের ভূমির পশ্চিম পাশেও একই বঙ্গোপসাগরের নীল পানি। এই স্থান থেকে যদি বার্মার রাখাইন প্রদেশ এবং বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামসহ উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকে যাওয়া হয়, তাহলে ভারতের ত্রিপুরার অংশ, মিজোরামের অংশ, মনিপুরের অংশ, নাগাল্যান্ডের অংশ ও অরুণাচলের অংশ নিয়ে যাত্রাপথ ঠেকবে হিমালয় পর্বতের পাদদেশে, চীন নামক বৃহৎ দেশের সীমান্তে। এই ধরনের একটি রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক সত্তা গঠনের প্রস্তাব ১৯৩৭ সালে প্রথমবার উপস্থাপন করেছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের, আসাম প্রদেশের লেফটেন্যান্ট গভর্নর মহোদয়। এরূপ দুর্ঘটনা থেকে নিরাপদ থাকার জন্য বাংলাদেশের মানসিক ও বস্তুগত প্রস্তুতি প্রয়োজন। এখন মানসিক ও বস্তুগত প্রস্তুতি নিয়ে দু’টি কথা বলব।
মানসিক প্রস্তুতি হচ্ছে, বিদ্যমান সমস্যা স্বীকার করা, ভবিষ্যতের সমস্যা মূল্যায়ন করা এবং এই মূল্যায়নকে বস্তুগত প্রস্তুতির সাথে সম্পর্কিত করা। মানসিক প্রস্তুতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে দেশের প্রতি ভালোবাসা ও স্বাধীনতা রক্ষার আকাক্সক্ষা। দেশের প্রতি ভালোবাসা তখনই আসে, যখন দেশের জন্মের প্রতি আনুগত্য থাকে, জন্মের কারণগুলোকে স্বীকার করা হয় এবং কারণগুলোর মধ্যে যেগুলো ইতিবাচক সেগুলোকে শক্তিশালী করা হয়। চুলার মধ্যে আগুন যদি নিভে যাওয়ার মতো হয়, তখন মুখের ফু দিয়ে বা চোঙ্গা দিয়ে বাতাস দিলে আগুন আবার শক্তিশালী হয়। গ্রামে কোনো বাড়িতে আগুন লাগলে, যদি বাতাস না থাকে তাহলে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সহজ হয়, অপরপক্ষে যদি বাতাস থাকে তাহলে আগুন দ্রুত চতুর্দিকে ছড়িয়ে যায়। শস্যক্ষেত্রে বা ফুলের বাগানে গাছগুলো যখন দুর্বল দেখা যায় বা তার আগেই সার দিতে হয় যেন, গাছগুলোর স্বাস্থ্য ভালো হয়। দেশের প্রতি ভালোবাসাও এমনই একটি জিনিস। এই ভালোবাসাকে শক্তিশালী করতে হলে, অনেক কিছুই জনসমক্ষে সর্বদাই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে উদ্ভাসিত রাখতে হয়। অন্য দেশের আলোচনা করে প্রতিযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি করতে হয়। অপরপক্ষে, যদি নিজের দেশের ইতিহাস, নিজের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা ইত্যাদিকে অস্বীকার করা হয় বা উপেক্ষা করা হয় তাহলে দেশপ্রেম দুর্বল হতে থাকে।
বস্তুগত প্রস্তুতির আলোচনা অনেক বড় পরিসর দাবি করে। বস্তুগত প্রস্তুতি হলো সামরিক বাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী এবং তাদের সহায়তার উপকরণ। সামরিক বাহিনীসমূহের প্রশিক্ষণ, এর অন্তর্ভুক্ত। প্রশিক্ষণের একটি লক্ষ্যবস্তু থাকে। বাহিনীসমূহের সরঞ্জামের সামঞ্জস্যতা থাকে। আমাদের ক্ষেত্রে গত ৯ বছরে আমরা আমাদের প্রস্তুতি ও লক্ষ্যবস্তুর কাঁটা ঘুরিয়ে দিচ্ছি বলে অনেকেই মনে করেন। তবে এই মনে করাটি সঠিক হতেও পারে, না-ও হতে পারে। ১৯৭৮-৭৯ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তম, একটি তত্ত্ব প্রদান করেছিলেন এবং বাস্তবায়ন শুরু করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন যেকোনো অবস্থাতেই যেন বাংলাদেশে কমপক্ষে এক কোটি যুবক ন্যূনতম সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয় এবং ন্যূনতমভাবে সংগঠিত থাকে। কারণ বাংলাদেশের মতো অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল দেশ অনেক বড় আকৃতির সামরিক বাহিনী বহাল রাখতে পারবে না। অতএব সহায়ক শক্তি প্রয়োজন। ওই রূপ সহায়ক শক্তি হিসেবে, জিয়াউর রহমান বীর উত্তম, দু’টি বাহিনী শনাক্ত করেছিলেন। একটি তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলস এবং আরেকটি নতুনভাবে জন্ম দেয়া আনসার-ভিডিপি বাহিনী। আনসার-ভিডিপি বাহিনীর লক্ষ্য ছিল, নিজেদের গ্রামকে রক্ষা করার মতো দক্ষতা অর্জন করা। নিজেদের গ্রাম থেকে সামরিক বাহিনীতে যাওয়ার জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা। যেকোনো প্রয়োজনের সময় সামরিক বাহিনী যদি গ্রামের আশপাশে আসে বা থাকে, তাহলে সেই সামরিক বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য পরিবেশ-পরিস্থিতি সৃষ্টি করা। সার্বিকভাবে সামরিক বাহিনীর প্রতি, বন্ধুসুলভ মনোভাব জনমনে সৃষ্টি করা।
উপরে যা কিছু আলোচনা করলাম তার প্রেক্ষাপটেই বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর প্রসঙ্গে দু-চারটি কথা উপস্থাপন করা প্রয়োজন। সামরিক বাহিনী শব্দমালা এবং প্রতিরক্ষা বাহিনী শব্দমালা দু’টির মধ্যে ব্যাপক তফাৎ নেই। সামরিক বাহিনীর উদ্দেশ্য, দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় অবদান রাখা। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বড় একটি আঙ্গিক হলো সামরিক বাহিনীসমূহ। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আরো আঙ্গিক আছে যথা জনগণের মধ্যে গণপ্রতিরোধের মানসিকতা সৃষ্টি করা। এই কলামের পাঠক খেয়াল করবেন যে, বাংলাদেশে একটি সংগঠন বা বাহিনী আছে যার নাম হলো ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স। কমপক্ষে সাত দশক আগে এই বাহিনীর নাম এইরূপভাবে করা হয়েছিল। কিন্তু কালের পরিক্রমায় ওই বাহিনীর হাত থেকে সিভিল ডিফেন্সের গুরুত্ব বা দায়িত্ব উভয়টিই প্রত্যাহার করা হয়ে গিয়েছে। সিভিল ডিফেন্স মানে, দেশ যদি শত্রু আক্রান্ত হয়, অথবা দেশে যদি গৃহযুদ্ধ লাগে অথবা দেশে যদি সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে রায়ট লাগে, তাহলে সমাজের তরুণ ও সক্ষম ব্যক্তিরা সেখানে প্রতিরক্ষা গড়ে তুলতে পারবে বা যুদ্ধ নিরসনে ভূমিকা রাখবে। সিভিল ডিফেন্সের মানে এরকমও, শত্রুর আক্রমণের সময়, মানুষ যেন অস্থির না হয়, মানুষ যেন মনোবল না হারায়, তার জন্য তাদের সঙ্ঘবদ্ধ রাখা। বাংলাদেশে বর্তমানে কোনো একক ডিপার্টমেন্ট বা মন্ত্রণালয় নেই যারা দেশের সার্বিক প্রতিরক্ষা নিয়ে চিন্তা করে। আনসার ভিডিপি হলো গণযুদ্ধের প্রস্তুতি বা প্রতিরোধ যুদ্ধের জন্য নির্ধারিত নিকটতম বাহিনী। তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে। বাংলাদেশ পুলিশ ও কোস্টগার্ডের অবস্থা তথৈবচ। বিজিবি-ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে। সামরিক বাহিনীগুলো যুগপৎ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও সশস্ত্রবাহিনী বিভাগের অধীনে।
বাংলাদেশ বহিঃশত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হবেই হবে এমন কথা কেউ বলতে পারবে না। আবার এমন কথাও কেউ বলতে পারবে না যে, কোনোদিন বহিঃশত্রু কর্তৃক বাংলাদেশ আক্রান্ত হবে না। তাই প্রস্তুতি রাখাটাই বুদ্ধিমানের লক্ষণ। এখানে অন্য কোনো দেশের মান-অভিমানের কোনো জায়গা নেই। তবে এটাও সত্য যে, বাংলাদেশের নিজের ভূখণ্ডটি যেন অন্যের যুদ্ধ পদচারণার ক্ষেত্রে পরিণত না হয়, তার দিকে অত্যন্ত কড়া নজর রাখতে হবে। হাজার হাজার মাইল দূর থেকে এসে আমেরিকা আফগানিস্তান এবং ইরাকে যুদ্ধ করেছিল। সব দেশই যদি মনে করত যে, কেউ কোনো দিন আক্রান্ত হবে না, তাহলে কোনো দেশই সামরিক বাহিনী বা প্রতিরক্ষা বাহিনী রাখত না। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীসমূহ, গত কয়েক দশকে ধীরে ধীরে সমৃদ্ধশালী হয়েছে। আকৃতিতে বড় হয়েছে তথা প্রশিক্ষিত জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন বা সমসাময়িক অস্ত্রের সমাহার ঘটেছে। বর্তমান বিশ্বের বড় বড় বা উন্নত দেশগুলোর সামরিক বাহিনীর সাথে ইতিবাচক যোগসাজশে আমাদের উন্নতি হয়েছে। তবে সেই উন্নতি প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের আপেক্ষিক তুলনায় কতটুকু সেটা প্রকাশ্যে আলোচনা না করাই শ্রেয়। ভূগোলের একটি উপমা আলোচনা করছি। সোজা উত্তর থেকে যমুনা নদী নেমে এসে, উত্তর-পশ্চিম থেকে নেমে আসা পদ্মা নদীর সাথে মিলিত হয় গোয়ালন্দ নামক জায়গায়। অতঃপর পদ্মা নাম ধরেই নদীটি প্রবাহিত হয় এবং চাঁদপুরে এসে উত্তর-পূর্ব দিক থেকে আসা মেঘনা নদীর সাথে মিলিত হয়। এরপর মেঘনা নামেই এই বিরাট স্রোতধারা বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে। উপমাটি দিলাম এই জন্য যে, আমাদের সামরিক বাহিনীর বিশেষ করে সেনাবাহিনীর অস্ত্রসম্ভার ও প্রশিক্ষণে আন্তর্জাতিক বহুমাত্রার প্রভাব আছে যথা চীন, ভারত ও আমেরিকা। এগুলোকে (প্রতীকী অর্থে) মেঘনা নামেই প্রয়োগ করতে হবে; আমার বিশ্বাস, এটি সবার জানা। পার্বত্য চট্টগ্রামে যখন জনসংহতি সমিতি নামক রাজনৈতিক গোষ্ঠীর পক্ষে শান্তিবাহিনী নামক সশস্ত্র গ্রুপ বিদ্রোহমূলক যুদ্ধ চালাচ্ছিল, তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সেখানে বিদ্রোহ দমনে তথা যুদ্ধ দমনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিল। সৈনিকের সচেতনতা এবং বৈরী পরিবেশে চলাচলের সক্ষমতা সার্বক্ষণিকভাবে মেইনটেইন হতো। এখন সেই পরিবেশটি নেই। এখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উল্লেখযোগ্য অংশ, শান্তিরক্ষার নিমিত্তে বিভিন্ন মহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়োজিত। সেখানকার সচেতনতা এবং চলাচলের সক্ষমতা ভিন্নতার দাবি রাখে। নীতি নির্ধারকগণ নিশ্চিতভাবেই এই প্রসঙ্গে ওয়াকিফহাল, এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই।

 


আরো সংবাদ



premium cement
নাভালনির মৃত্যু : ৩০ রুশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ইইউর সালাম মুর্শেদীকে গুলশানের বাড়ি ছাড়তে হাইকোর্টের নির্দেশ গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনার জন্যে মিসর ও সৌদি আরব যাচ্ছেন ব্লিঙ্কেন আমাকে অ্যাপ্রোচ করেছিল, আমি গ্রহণ করিনি : মেজর অব. হাফিজ জাতিসঙ্ঘ সংস্থার প্রধানকে গাজায় প্রবেশে বাধা ইসরাইলের মিয়ানমারে বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার খবরে ‘শঙ্কিত’ জাতিসঙ্ঘ প্রধান ডিএমপির অভিযানে গ্রেফতার ২৩ হলমার্ক কেলেঙ্কারি : তানভীর-জেসমিনসহ ৯ জনের যাবজ্জীবন লক্ষ্মীপুরে উপড়ে ফেলা হয়েছে যুবলীগ নেতার চোখ ঝড়-বৃষ্টির আভাস, কমবে তাপমাত্রা ফ্রান্সে কমিউনিটি মসজিদের ইফতার মাহফিল

সকল