১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে

-

বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ, বাংলাদেশ আমার ধ্যান। বাংলাদেশ আমার জ্ঞান। এ দেশ আমার অনুধ্যান। বাংলাদেশ আমার বিশ^াস, প্রতিতি এবং প্রত্যয়। বাংলাদেশ আমার সাধনা, সংযম এবং আশ্রয়। এ দেশের সূর্যালোক আমার হৃদ-কন্দরকে করে আলোকিত। এ দেশের বাতাস শরীর জুড়ায়, মনকে করে প্রশান্ত। এ দেশের জলরাশি আমার মানস সরোবর। এ দেশের সমতল আমার বুকের পাঠাতন। এ দেশের সবুজ-শ্যামল আমার নয়নের দীপ্তি। এ দেশের মাথার উপরের নীলাকাশ আমার ভালোবাসার অনুপম প্রাপ্তি। এ দেশের হাওরে-বাঁওড়ে স্নাত হয় জীবনের আনন্দ। এ দেশের রোদ্দুরে উষ্ণিষ হয় ভালোবাসার ছন্দ। এ দেশের গ্রামীণ মেঠোপথ আমার সরলতা। এ দেশের শহুরে পিচঢালা পথ আমার দৃঢ়তা। এ দেশের কৃষক, শ্রমিক আমার অর্থ স্বাস্থ্য। এ দেশের প্রবাসীরা আমার উন্নয়নের উৎস। এ দেশের গ্রাম্য ন্যাংটা শিশু-বালকদের ছোটাছুটি কিংবা সাঁতার আমার সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের অনুপ্রেরণা। এ দেশের শহুরে পার্ক কিংবা বাঁধে কিশোরদের উচ্ছলতা আমার আনন্দ স্মারক। এ দেশের নদীজলের তরঙ্গ-ঢেউ এগিয়ে যাওয়ার সোপান চিহ্ন। এ দেশের মাঝিদের অবিরাম হাল মারা, বৈঠা চালানো সুন্দর আগামীর গন্তব্যাভিসারী।
ঝড়-ঝঞ্ঝা সাথে নিয়ে এগিয়ে যায় মাঝি। ভয়ঙ্কর ঢেউ তাকে পৌঁছে দেয় কাক্সিক্ষত গন্তব্যে। দেশের মাটিতে সোনা ফলানোর জন্য কৃষকের অবিশ্রান্ত পরিশ্রম দেশকে করে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত। সবুজ বৃক্ষের নির্মল অক্সিজেন দেশকে করে প্রাণবন্ত সজীব। শ্রমিকের হাড় ভাঙা পরিশ্রমে প্রবৃদ্ধি ও প্রসার আমাদের করে আশাবাদী। জনশক্তির দক্ষতা আমাদের উজ্জীবনকে করে আশা সঞ্চারী। ছাত্রের পাঠ অভিনিবেশ, শিক্ষকের আন্তরিকতা, শ্রমিকের দক্ষতা, কৃষকের অবিরত প্রচেষ্টা, আমলার সূক্ষ্মদর্শিতা, পেশাজীবীর কর্মতৎপরতা, চিকিৎসকের সেবা মানসিকতা, প্রকৌশলীর উৎকর্ষ ভাবনা, মজুরের সততা, জনতার সরলতা এগিয়ে নিবেই নিবে আমার এ দেশকে। এমন গুণবান ও গুণার্নব জাতি পশ্চাৎপদ থাকতে পারে না। ইতিহাস ও প্রকৃতি অন্তত আমাদের তাই শেখায়। আমাদের প্রত্যয় এগিয়ে যাবার। অদম্য, বিক্রমী, সাহসী গতিতে এগিয়ে যাবার প্রত্যয় আমাদের সর্বদার। বাধা, বিপদ, বিপত্তি, চরাই-উৎরাই, প্রতিবন্ধকতা, ঝঞ্ঝাট-ঝামেলা থাকবে তবে অপ্রতিরোধ্য হবে না। এ বাংলাদেশের উদ্যোগী জনতা সব বাধা পায়ে দলে এগিয়ে যাবে সামনের পানে। কেবলই সামনের পানে। এ প্রত্যয় আমাদের আজীবনের এ প্রত্যয় আমাদের আমৃত্যুর।
আমাদের এ ভূখণ্ড সর্বদাই সবুজাভ। শ্যামলিময় ভরপুর। রকমারি শস্যের বিপুল উৎপাদনের জোগানদাতা। আমাদের সমতল ভূমির উর্বরতা ও উৎপাদন সক্ষমতার কারণেই বাইরের শক্তি নজর দিয়েছে এ দেশের ভূখণ্ডের দিকে। এ দেশের জনশক্তির উদ্যম ও কষ্ট-সহিষ্ণুতার দিকে শকুনের দৃষ্টি ছিল ঔপনিবেশ শক্তিগুলোর। দেশের আম-জনতার সরলতা, সহিষ্ণুতা, উদারতা ও ক্ষমা প্রবণতার খেসারত গুনতে হয়েছে বারবার। উপনিবেশবাদী কিংবা শক্তিশালী রাষ্ট্রের খড়গে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে তাদের শরীর, মন ও মানস।
পরম সত্য কথা হচ্ছে, এ দেশের জনগণ সহজ তবে সুলভ নয়। এ দেশবাসী ত্যাগ তথা ছাড় দিতে সদা প্রস্তুত তবে কাউকে তারা ছেড়ে দেয়নি। তাদের ইজ্জত, সম্ভ্রম, সম্মানকে এগিয়ে নিতে তারা অকুণ্ঠ। তারা ঘাম, রক্ত কিংবা মাথা দিতে প্রস্তুত। কিন্তু মর্যাদা, ঐতিহ্য, সভ্যতা খোয়াতে এতটুকু সম্মতি তাদের থাকে না। এ দেশের জনগণ তাদের মর্যাদাকে আগলে রাখে রক্তমূল্যে। তাদের সাংস্কৃতিকে লালন করে জীবন দিয়ে। যুদ্ধ, লড়াই, সংগ্রাম আর দৃঢ়তা দিয়েই তারা সর্বদা এগিয়ে গেছে সমৃদ্ধির লক্ষ্যপানে। তাদের চেতনার শক্ত ভিত রচনা করেছে উত্তুঙ্গ সত্যতার স্মারক।
প্রাকৃতিক কিংবা কৃত্রিম দুর্যোগ বারবার আঘাত হেনেছে এ দেশবাসীর ওপর। তবুও এগিয়ে গেছে বীর বাঙালিরা। কারণ উদ্দীপনায় তারা অদম্য, পথচলায় নির্ভীক, আস্থা ও বিশ^াসে সৃদৃঢ়। চরম নির্যাতন, নিপীড়ন, নিষ্পেষণের প্রতিবাদে ব্রিটিশ বেনিয়াদের এ দেশ থেকে তাড়াতে বাঙালিদের ভূমিকা ছিল অগ্রণী। আর্থ-রাজনৈতিক-সংস্কৃতিক স্বাধীনতার জন্য তা অপরিহার্য ছিল। স্বীয় সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষার প্রয়োজনে আপন জাতিসত্তাকে এগিয়ে নেয়ার প্রত্যয়ে বাঙালিরা সেদিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তাতে তারা সফলও হয়েছিল। তাদের এগিয়ে যাবার প্রত্যয়কে রুখতে পারেনি কেউ।
ঔপনিবেশিক শাসনের যাঁতাকল থেকে মুক্তি পেলেও এবার জাতিগত দাঙ্গা ও শক্তিমানের প্রভুত্ব থেকে বাঁচতে ও নিজেদের ইমান বাঁচাতে স্বতন্ত্র ভূখণ্ডের দাবিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এ দেশের মানুষ। যৌক্তিক প্রয়োজনের যৌক্তিক আন্দোলনে এবারো তারা সফল হয়। তাদের এগিয়ে যাবার প্রত্যয় এবার মজবুত ভিত্তির স্পর্শ পায়।
ইতিহাস বলে- স্বতন্ত্র ভূখণ্ড পেলেও এ দেশবাসীর সৌভাগ্যের দুয়ার উন্মুক্ত হয়নি। কারণে-অকারণে শাসকগোষ্ঠী আমাদের ওপর চালিয়েছে নির্যাতনের স্টিম রোলার। নির্যাতনের মাত্রা ছড়িয়ে গেলে এ দেশের জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। স্বাধীনতার প্রত্যাশায় এগিয়ে যাবার প্রত্যয়ে এক মহান আন্দোলন গড়ে তোলে। বাকস্বাধীনতা, কর্মের স্বাধীনতা, আর্থিক স্বাধীনতার বৈধ দাবিতে এগিয়ে চলে বাঙালি। তাদের ভাটাহীন প্রত্যয়ে তারা পায় অমলিন স্বাধীনতার স্বাদ।
এত দিনে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতার স্বাদ। নির্বিঘেœ কথা বলার অধিকার। মতামত প্রকাশের সব সুযোগ-সুবিধা। এক যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের মালিক হয়েছি আমরা।
যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করতে গভীর অভিনিবেশ দিয়ে কাজ করেছে এ দেশের মানুষ। উত্তর প্রজন্মের মুখে হাসি ফুটাতে একযোগে কাজ করেছে কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি জনতা। দান-দয়া-দাক্ষিণ্য নয় স্ব-সক্ষমতায় মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে প্রয়াস পেয়েছে প্রতিটি অভিঘাত, প্রতিঘাত কিংবা মুসিবতে। দুর্বিপাক কিংবা দৈবপাক তাদের জীবনকে এলোমেলো করেছে ঠিক। কিন্তু আশাহত করতে পারেনি। দুঃখ দিনের নয়নাশ্রু শুকাতে না শুকাতেই তারা নতুন শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে জীবন সংগ্রামে। সংগ্রাম কখনো সুমধুর হয় না। তাদেরও হয়নি। তবে তারা ব্যর্থ হয়নি। বেলা শেষে দেখা মিলেছে সফলতার। স্বাচ্ছন্দ্যের কিঞ্চিত স্পর্শে হলেও তারা হয়েছে উদ্বেলিত। সফলতা তো কেবলই সংগ্রামীদেরই।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্নস্মারক চূড়ান্তরূপ পায়। যুদ্ধকর্ম শেষ হয়। কিন্তু তার প্রভাব শেষ হয় না। পরিবার সমাজ-পাড়া-মহল্লা-গ্রাম-গঞ্জ-শহর-নগর সর্বত্র তখনো শোকের মাতম। তবে এ শোকেও ছিল স্বাধীনতার সুখানুভূতি। সন্তানহারা বাবা-মা কিংবা বাবা-মা হারা সন্তান, ভাই হারা বোন কিংবা বোনহারা ভাই, বন্ধু হারা বন্ধু সবাই একসাথে, একযোগে সম্মিলিত প্রয়াসে শুরু দেন গড়ার কাজ। জীবনকে সাজাতে, জীবনকে বাঁচাতে, মাতৃভূমির শ্রীবৃদ্ধিতে সবাই ভেদাভেদ ভুলে কাজ করতে থাকে। ফলে সহজেই শিল্প উন্নয়ন, কৃষির উত্তরণ হতে থাকে।
১৯৭৪ সালে দেশে হানা দেয় দুর্ভিক্ষ, সর্বত্র শুরু হয় খাদ্যাভাব। অনাকাক্সিক্ষত মনন্তরের করাল গ্রাসে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে জমে ওঠে কালো মেঘ। এ যেন স্বাধীনতা যুদ্ধের চেয়েও বড় অশনি। থমকে যায় জীবন চলার ছন্দ, নিভে যায় সমাজ-সামাজিকতার সব আনন্দ রশ্মি। বিশে^র মানবিক দৃষ্টি প্রক্ষেপ সর্বোপরি আল্লাহর অপার অনুগ্রহে কেটে যায় দুর্যোগের ঘনঘটা। গাঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায় স্বপ্নাতুর বীর বাঙালি।
দেশে শুরু হয় কৃষি বিপ্লবের নতুন মাত্রা। সবুজ বিপ্লবের নেশায় জেগে ওঠে বাঙলার মানুষ। কৃষি বিপ্লবের নেশায় বিভোর বাঙালিরা এবারো সফল হয়। বাঙলার প্রতিটি ভূখণ্ডের স্বর্ণমৃত্তিকায় তারা সোনা ফলাতে থাকে। বাঙালিদের ছোট ছোট স্বপ্নগুলো ক্রমশ বড় হতে থাকে। এক বিশাল মহীরুহে রূপ নেয়। আজ আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। খাদ্যাভাবের হতাশায় আর কুরে কুরে মরে না বাঙালিরা। বাঙালিদের এগিয়ে যাবার প্রত্যয় সত্যিই দুর্নিবার। এ অদম্য প্রত্যয় রুখে দেয়ার শক্তি নেই কারো।
বারবার রাজনৈতিক অস্থিরতা, নানামুখী ষড়যন্ত্রের ডামাডোল প্রকম্পিত করেছে এ দেশকে, এ দেশবাসীকে। উত্তরণ কিংবা উন্নয়ন থমকে দিয়েছে। কিন্তু থামাতে পারেনি আমাদের অগ্রযাত্রা। দমাতে পারেনি আমাদের এগিয়ে যাবার অমিত বিক্রম। প্রতিটি অশুভ ও অশনিতে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বীর বাঙালিরা। তাদের এগিয়ে যাবার প্রত্যয় অপ্রতিরোধ্য।
আশির দশকে দেশকে বিব্রত অর্থনীতির মুখে ফেলেছে বন্যার ভয়ঙ্কর ছোবল। কয়েকবার ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখি হয়েছে দেশের মানুষ। রাষ্ট্রের দান কিংবা বহির্বিশ্বের দাক্ষিণ্য নয় আপন স্বকীয়তা ও অদম্য প্রত্যয়ে বন্যার সমূহ ক্ষতি পুষিয়ে নিয়েছে এ দেশের বন্যাকবলিত আম-জনতা। ভয়ভীতি-শঙ্কাকে পশ্চাতে ফেলে সামনে এগিয়েছে অসম গতীতে। বন্যা অভিশাপ নয়। বন্যা শিখিয়েছে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার শপথ নিতে হয় কী করে?
গত শতকের নব্বইয়ের দশকে শুরুতেই ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়ে এ দেশ। লাখ লাখ প্রাণহানি ঘটে সে জলোচ্ছ্বাসে। প্রাকৃতিক এ দুর্যোগও বাঙালিরা কাটিয়ে উঠেছে অল্প সময়েই। দেশ গড়ার তীব্র প্রত্যয় ব্যতিরেকে এ অসম্ভব। বাঙালিরাই পারে অসম্ভবকে সীমিত সাধ্যের মধ্যে থেকে জয় করতে। বাঙালির সহিষ্ণুতা ও প্রত্যয় প্রকৃতই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ এ দেশের পিছু ছাড়েনি কখনো। একের পর এক বিপদ, সমস্যা, সঙ্কট লেগেই থেকেছে এ দেশের জনগণের সাথে। আইলা, সিডর, সুনামির মতো ভয়াবহ দুর্যোগ দংশন করেছে এ দেশকে। আইলা ও সিডর এলাকায় গিয়েছিÑ দেখেছি ওই জনপদের মানুষদের দুরবস্থা। উপদ্রুত হওয়ার এক দশক হয়ে এলেও জমিনগুলো এখনো ফিরে পায়নি তার পূর্ব উর্বরতা। সেখানে দেখেছি জীবনের দুর্বিষহতা, জীবনের অসহনীয় যন্ত্রণা। এ যেন মানবতার ওপর সাক্ষাৎ প্রতিশোধ। এই বিপদগ্রস্ত মানবতা স্রষ্টার আস্থায় উদ্যমী হয়েছে আবারো। ফিরে এসেছে তাদের জীবনের নবস্পন্দন। এ যেন নতুন জীবনের স্বাদ। বিপদকে সাথে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া এই বাঙালি সত্যিই অদুর্দমনীয়।
দুর্যোগের ঘনঘটা, দুর্ভোগের প্রকোপ, প্রকৃতির ছোবল বাঙালিদের হতবিহ্বল করলেও স্থবির করে না। জীবনের প্রয়োজনে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, জীবনকে চলমান রাখবার শপথ নিয়েছে। এটিই জীবনের বাধ্যকতাও বটে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো- জীবনের ন্যূনতম প্রয়োজন মিটিয়েই তারা ক্ষান্ত হয়নি। তারা জীবনকে রাঙিয়েছে নতুন ছাঁচে। উন্নয়নের নব মোড়কে।
যুগে যুগে মহামারী বিশ^কে দিয়েছে অশনি বার্তা। এক ভয়াবহ মহামারী হানা দিয়েছে বর্তমান বিশে^। যা চলমান রয়েছে এখনো। এ মহামারীতে মৃত্যুর হার কম হলেও মোট সংখ্যা বিবেচনায় তা প্রায় অর্ধকোটি ছাড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম। সংক্রমণ বিবেচনায় এ সংখ্যা প্রায় ৫০ কোটি। পৃথিবীর প্রায় সব দেশে হানা দিয়েছে এ মহামারীর প্রকোপ। বিভিন্ন জাতিকে নাস্তানাবুদ করেছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। প্রাণহানির শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যেই মৃতের সংখ্যা সিকি লাখ ছাড়িয়েছে সব থেকে বড় কথা হলো এ মহামারীর আতঙ্কে ভুগছে সবাই। এ মহামারীর ভয়াবহ প্রভাব হলো পারস্পরিক সম্পর্ক বিনষ্ট, অন্যকে দোষারোপ প্রবণতা, জীবন হানির আশঙ্কা ইত্যাদি মানুষকে অমানুষের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। অনেক দেশের অর্থনীতির চাকা থমকে গেছে। অনেক বড় বড় মোড়লদের মাথায় হাত পড়েছে। চিন্তাক্লিষ্টতায় তারা বিষণœতর হয়েছে।
বাংলাদেশ বিশে^র খুবই ছোট একটি দেশ। নানা অস্থিরতা অশান্তি লেগেই আছে এ দেশের ললাটে। তবুও অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে দেশের নীতি-নির্ধারকরা যথেষ্ট ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
বাংলাদেশ সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষাখাতে। প্রায় আঠারো মাস পূর্ণ বন্ধ থাকার পর সীমিতভাবে চালু হয়েছে সশরীরে শিক্ষা ব্যবস্থাপনা। ক্রমেই তা পূর্ণতার রূপ পেতে যাচ্ছে। আমরাও সেটির প্রত্যাশী। শিক্ষা খাতের এত বড় ক্ষতি খুব কম দেশেরই হয়েছে। ক্ষতি যত বেশিই হোক তা পুষিয়ে নেয়ার সক্ষমতা এই বাঙালির রয়েছে। নিশ্চয়ই রয়েছে।
শিক্ষক সমাজের আন্তরিকতা, ছাত্রসমাজের নবউদ্দীপনা ও অধ্যবসায়। শিক্ষা কর্মকর্তাদের বাড়তি কর্মোদ্যোগ, অভিভাবকদের যথাযথ সতর্কতা ও সচেতনতা, শিক্ষা সহযোগী সব প্রতিষ্ঠানের ইতিবাচক মনোভাব এই ক্ষতি পুষিয়ে দিতে ও নিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। আমি বিশ্বাস করি খুবই দ্রুত ও স্বল্প সময়ে তা পুষিয়ে যাবে। জনমনে শিক্ষা দুর্বলতার নানা প্রশ্নের তথা আশঙ্কার বিলোপ হবে তাও বিশ্বাস করি মনে প্রাণে।
সম্প্রতি কোভিড-১৯ গোটা দুনিয়ায় ভয়াবহ আক্রমণ চালিয়েছে। সবাইকে তটস্থ করেছে। প্রায় সব দেশই এর জন্য খেসারত গুনেছে। বাংলাদেশও এই ক্ষতিগ্রস্ত তালিকায় রয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, রাজনীতি সব ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ এর ছোবল লক্ষ করার মতো। কোভিডের ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার জন্য আর্থিক, বৌদ্ধিক ও সাংগঠনিক সক্ষমতা অনেক দেশের চেয়ে আমাদের কম ছিল। দরিদ্র বলেই হয়তো এই অক্ষমতা বাংলাদেশকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলতে চেয়েছে বারবার। কিন্তু দেশের সীমিত স্বার্থের মধ্যেও আন্তরিকতা, একযোগে কাজ করবার মানসিকতা, কর্মদক্ষতা তাদেরকে নানাবিধ ক্ষতি কমিয়ে আনতে সাহায্য করেছে। কোভিড সংক্রমণ ও মৃত্যুহার কমাতে দেশের কর্ণধারদের অনেক সিদ্ধান্তই ছিল সময় উপযোগী। দেশের সবাই সাধ্যমতো এ জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করেছে। কোভিডের টিকা আবিষ্কার ও প্রস্তুতকরণের অংশীদার হয়েছে এই বাংলাদেশ। তাই আমরা মনে করি দলবাজি, রাজনৈতিক বিদ্বেষ, ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি থেকে মুক্ত থাকতে পারলে দেশের যে সক্ষমতা অর্জিত হবে তা যেকোনো মহামারীর চেয়ে শক্তিমান হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। অবশ্য এখানে আমি মহান স্রষ্টার প্রতি ঐকান্তিক আস্থা, তার কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ ও তার নির্দেশের অনুবর্তী হওয়া একান্ত আবশ্যক বলে মনে করি। এ অবস্থায় আত্মবিশ্বাসী বাঙালিরা আরোহণ করবে সাফল্যের উত্তুঙ্গ চূড়ায়। এ কথা বলা যায় চোখ বন্ধ করেই। কারণ আমরা আমরা এগিয়ে গেছি সর্বদা আপন প্রত্যয়ে।
বিশ্বে চলছে আরো বড় এক মহামারী। তা হলো ইন্টারনেট। ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টেলিগ্রাম, হোয়াটস অ্যাপ, মেসেঞ্জার, ইউটিউবসহ আরো বেশ কিছু প্রোগ্রাম। আর নেটভিত্তিক খেলাধুলার প্রাদুর্ভাব তো আছেই। এসব কর্মসূচি আমাদের শিশু-বালক-কিশোরদের মাথা নষ্ট করে ফেলছে। সময়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশটাই খেয়ে ফেলছে। সন্তানদের বিপথে-কুপথে নিয়ে যেতে মুখ্য খলনায়কের ভূমিকা পালন করছে। বিষয়টি খুবই আশঙ্কার। অনেক দেশ এসব কর্মসূচি বন্ধ বা সীমিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। আমাদেরও সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখনই।
আমাদের দেশের যুব শক্তির সংখ্যা খুবই আশাব্যঞ্জক। এগিয়ে যাওয়ার ও দেশকে এগিয়ে নেয়ার উপযুক্ত সময়। সঠিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এসবের ব্যবহারে পরিমিতিবোধ আনতে হবে। তবেই দেশের জন্য সূচিত হবে উন্নয়নের স্মারকস্তম্ভ। দেশের বিদ্বতজন ও বিদগ্ধগোষ্ঠী এ সিদ্ধান্তে আসতে যত কম দেরি করবে, দেশের মঙ্গল ততই ত্বরান্বিত হবে। এগিয়ে যাবো আমরা দৃঢ় প্রত্যয়ে।
সভ্যতা, সংস্কৃতির মহামারীও কম যায় না। চমকপ্রদ ও চটকদার নানা শিরোনামে প্রলুব্ধ করে আমাদের প্রায়ই। বিদেশী সংস্কৃতি, বিজাতীয় সভ্যতার হিংস্র থাবা আমরা বুঝতে না পেরে তার সাথে তাল মিলাতে চাই। গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেই। এর থেকে বেশি ক্ষতিকর আর কিছু হতে পারে না। দেখতে ভালো মনে হলেও কখনই তা শুভকর হতে পারে না। শুভঙ্করের মতো আমাদের তা ফাঁকিতে নিক্ষেপ করে অনায়াসেই। ময়ূরের পেখম কাকের পশ্চাতে জুড়ে দিলেই কাক তা ধারণ করতে পারবে না। নিঃসন্দেহে কাকের জন্য তা হবে বিব্রতকর; বরং তা হবে আপন অস্তিত্ব বিকিয়ে দেয়ার নামান্তর। তাই কবিও বলেছেনÑ
বিদেশের ঠাকুর ফেলি
স্বদেশের কুকুর ধরি ॥
প্রচণ্ড অভিজ্ঞতালব্ধ ও বঞ্চনাক্লিষ্ট অভিব্যক্তি এটি। দেশকে না বিকিয়ে, আপন অস্তিত্বকে না ভুলে গিয়ে, আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হলে আর কোনো শক্তি তার এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় রুখে দিতে পারবে না।
ইতিহাসের পাঠ আমাদেরকে জানায়; প্রতিটি জাতির এগিয়ে যাওয়ার পশ্চাতে রয়েছে আপন কীর্তির ধ্বজা উড্ডীন করে রাখা। অনুসরণ, অনুকরণ বাদ দিয়ে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান থাকা। আমার উন্নয়নের দায়িত্ব নিতে হবে আমাকেই।
ঝড়ঝঞ্ঝা, বিক্ষুব্ধতা, অস্থিরতা, ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত, দুর্যোগ, উদ্বেগ সব কিছুকে পায়ে দলে এগিয়ে যেতে চাই আমরা। দেশকেও নিতে চাই সফলতার সুউচ্চ স্মারকে। বিশ্বসভায় উড্ডীন করতে চাই মর্যাদার পতাকা।
প্রগতির নামে অন্যের অনুসরণ নয়, পরের ধনে পোদ্দারি নয়, আমার যা আছে তাই নিয়ে এগিয়ে যাবো আমি নিজে। এগিয়ে নেবো আমার দেশকে।
আত্মবিশ্বাসী, আত্মমর্যদাসম্পন্ন জাতিকে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। আমাদেরও পারবে না। এগিয়ে যাওয়ার শপথ নিতে চাই দৃঢ় প্রত্যয়ে।
শপথ যদি সত্য হয় আমাদের রুখবে কে?
প্রত্যয় যদি নিত্য হয় আমাদের রুখবে কে?
প্রতীতি যদি প্রদীপ্ত হয় আমাদের রুখবে কে?
বিজ্ঞজনদের সুপরামর্শে, বয়স্কজনদের সঠিক নির্দেশনায়, দেশের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশকে এগিয়ে নেয়ার এ প্রত্যয়কে আঞ্জাম দেবে দেশের যুবসমাজ। আমাদের এ প্রত্যয় হোকÑ শিশু-বালক-কিশোর-যুবক-পরিণত-মুরুব্বিজন সবার। দেশের জন্য যারাই কাজ করছেন, দেশের উন্নয়ন ভাবনায় যারাই অবদান রাখছেন সবার জন্য অন্তর উজাড় করা একডালি নিখাঁদ ভালোবাসা।
প্রত্যেকে আমরা দেশের তরে।


আরো সংবাদ



premium cement