১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মানুষের অধিকার অনধিকার সামাজিক দায়বদ্ধতা

-

মহাবিশ্বের সব কিছুই মানুষের প্রয়োজনে সৃষ্টি করা হয়েছে। স্রষ্টার বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষের জয়যাত্রা উন্মোচিত। মানুষ শ্রেষ্ঠ হলেও তাকে শ্রেষ্ঠতম হতে হয়। জন্মের পরপরই নানামাত্রিক সমন্বয় সমবায়ের মাধ্যমে মানবিক গুণাবলি অর্জিত হয়ে থাকে। এর জন্য অভিভাবক, শিক্ষাদীক্ষা, পরিবেশ, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যকার উপাদানের সুষম সমন্বয় প্রয়োজন। এর উপর ভিত্তি করেই সমাজে প্রকৃত মানুষের অবস্থান অবয়ব নির্ণীত।
অনুরূপ উপাদানগুলোর মধ্যে শিক্ষা অন্যতম নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করে। পৃথিবীর প্রায় যাবতীয় শাস্ত্রসংহিতার মধ্যে শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে শিক্ষাই সবচেয়ে বেশি মর্যাদার সাথে বর্ণিত। শিক্ষার জন্যই একজন মানুষ প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে। শিক্ষা গ্রহণ মানুষকে আত্মবোধসমন্বিত মানবিক গুণাবলিতে বিভূষিত করে তোলে। শিক্ষা একটা জাতির মেরুদণ্ড হিসেবেও কীর্তিত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের দেশে শিক্ষার অবয়ব অবস্থান কি রকম? ভারতবর্ষের ইতিহাসে যুগে যুগে শিক্ষা নিয়েই সবচেয়ে বেশি রাজনীতি ও ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তৃত হয়েছে। সেই প্রাচীন রামায়ণ মহাভারতের যুগ থেকে প্রাচীন মধ্য, আধুনিক যুগ পর্যন্ত তা অব্যাহত রয়েছে। যুগে যুগে বিভিন্ন শাসকবর্গ শিক্ষাকে একটা বিশেষ শ্রেণীর মধ্যে আবদ্ধ করে রাখে। বৃহত্তর গণমানুষকে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত রাখা হয়। এর ফলে কখনো সুষম সামাজিক কাঠামো গড়ে ওঠার সুযোগ পায়নি। ভারসাম্যহীন শাসন ত্রাসন বৃহত্তম মানবমুক্তির পথে অন্তরায় হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এর জন্য সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যপ্রবণ রাজনীতিই মূলত দায়ী। ফলে মানুষের কাক্সিক্ষত স্বপ্নকাক্সক্ষা বারবার ভূলুণ্ঠিত হয়ে পড়ে। এক দিকে ক্ষমতার অপরিসীম লালসা অন্য দিকে সাধারণ মানুষের বঞ্চনা সমানতালে বয়ে চলে। শাসকের ক্ষমতালিপ্সার সীমাহীন খায়েস কখনো চরিতার্থ হওয়ার মতো নয়। এ যেন কর্ণঢাকা মত্তহস্তির মতো কেবলই ছুটে চলে। সেখানে বৃহত্তর গণমানুষ পদপিষ্ট হয়ে দলিত মথিত। এহেন বৃত্তাবদ্ধ চক্রাকার বেদিতলে মানুষকে যুগে যুগে আত্মাহূতি দিতে হয়েছে। সেই আর্য-অনার্য, ব্রাহ্মণ্য বৌদ্ধ, ইংরেজ মোগল, বাঙালি পাঞ্জাবি মিলিয়ে একই অবস্থা আমরা প্রত্যক্ষ করে চলেছি।
তবুও অনেক স্বপ্নকথার আশাজাগানিয়া রাজনীতির ভেলায় চড়ে স্বাধীন বাংলাদেশের উদ্ভব ঘটে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর পঞ্চাশ বছর এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত এ দেশে একটি অভিন্ন জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। শুধু ক্ষমতা ও আত্মগত স্বার্থসিদ্ধির বলয়বিবরে তা বারবার পদদলিত হয়েছে। ফলে একই দেশে শিক্ষা আজ সরকারি-বেসরকারি মাদরাসা কিন্ডারগার্টেন। এ লেবেল ও লেবেল এবং ক্যাডেট শিক্ষাসহ অজস্র ধারায় বিভক্ত। এ অবস্থায় একটি জাতিগোষ্ঠীর প্রকৃত শিক্ষাব্যবস্থা কখনো গড়ে উঠতে পারে না। ফলে শিক্ষার উদ্দেশ্য অন্বেষা অনেকাংশেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত। সেখানে সুযোগ্য ও সুষম সুন্দর নাগরিক গড়ে ওঠার স্বপ্নটি স্বপ্নই থেকে যায়। আর মানুষের এ দৈন্যদশা সেখানে আর সব কিছুই অসুন্দর ও কুৎসিত হতে বাধ্য। বারবার আন্দোলন-সংগ্রাম, সংবিধান সংশোধন, রকমারি আয়োজন করেও কোনো লাভ নেই। রাজনীতি কথা ফুলঝুরি অচিরেই দুঃস্বপ্নের হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। চার দিকে বাহ্যিক জৌলুসের আড়ম্বর সত্ত্বেও মানুষের চারিত্রিক অধঃপতন প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে। এতে মূল্যবোধের অবক্ষয়, পারিবারিক বিপর্যয়, মাদকাসক্তি, জঙ্গিবাদ, ইত্যকার সমস্যা আমাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্রমাগত মানবিকতার বদলে পাশবিকতা এসে সব কিছু গ্রাস করছে। ক্রমাগত এ অবস্থা যেন ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। এর অশুভ প্রাদুর্ভাব সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। সামাজিক ও পারিবারিক শৃঙ্খলা ভূলুণ্ঠিত। দুর্বৃত্ত দুর্বৃত্তায়নের ঘেরাটোপে সমাজজীবন অবরুদ্ধ।
এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য পুরো শিক্ষাব্যবস্থা একেবার খোলনলচে পাল্টে ফেলতে হবে। একটি অভিন্ন জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে। এর মধ্যে জনগণমন সর্বাধিক গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় আনা জরুরি; যাতে পুরো জাতিসত্তা শিক্ষার আলোয় আলোকিত হওয়ার সুযোগ পায়। শিক্ষা কখনো বিশেষ কিছু শ্রেণীর জন্য নয়। পুরো জাতি অন্ধকারে রেখে দু-চারজন শিক্ষিত হলে তা হবে আত্মঘাতী প্রয়াস। গণশিক্ষার সর্বপ্লাবী বিস্তার ঘটিয়ে একটা সুষম সুন্দর সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। অংশবিশেষের শিক্ষা বরাবরই ঋণ ও আগুনের শেষাংশের মতোই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। সর্বসাধারণের উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থাই একটি জাতিকে মুক্তির পথ প্রদান করতে সক্ষম; যা জাতির ইতিহাস ঐতিহ্য, কৃষ্টি সংস্কৃতি ও মৃত্তিকা অবস্থিতি অঙ্গীকার করে প্রণীত হবে। এ ছাড়া আমাদের কোনো গত্যন্তর নেই, থাকাও সম্ভব নয়।
আমরা বরাবরই জানি মানুষ সামাজিক জীব। অথচ সম্প্রতি মানুষ অধিকতর রাজনৈতিক জীব হিসেবে প্রতিভাত। মানুষের সব কিছুই এখন রাজনীতির দখলে চলে গেছে। স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, পাড়া মহল্লা, পরিবার সমাজ সব কিছুতেই রাজনীতির একচ্ছত্র অধিপত্য বিস্তৃত হয়ে আছে। বিশ্বায়নের যুগে মোবাইল, ইন্টারনেট, যোগাযোগ, গণতন্ত্র, পুঁজিবাদ ইত্যকার ব্যবস্থাপনায় রাজনীতি একেবারে পুরোমাত্রায় জেঁকে বসেছে। এর বাইরে আর এখন আমাদের সামাজিক জীবনের কোনো অস্তিত্ব নেই। রাজনীতির এই সর্বপ্লাবী বিস্তার মোটেই দোষের কিছু নয়, বরং এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই রাজনীতির ধারক বাহক বা নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠছে কারা? রাজনীতির ধর্মই হচ্ছে তা আদর্শভিত্তিক হয়ে জনজমিনের সর্বাত্মক সেবায় নিবেদিত। অপেক্ষাকৃত সমাজের শিক্ষিত সজ্জন, অভিজাত মার্জিত, মানবিক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে নির্ধারিত হতো। তারা মানুষের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে সারা জীবন নিজেকে উৎসর্গ করেছে। দেশমাতৃকার প্রতি নিবেদিত এসব মহাত্মা রাজনীতিক মানবমুক্তির লক্ষ্যে উৎসর্গকৃতপ্রাণ। এ পর্যায়ে আমরা মহাত্মা গান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হাজী শরীয়তুল্লাহ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের নাম উল্লেখ করতে পারি। তুল্যমূল্য হিসেবে বর্তমান রাজনীতিবিদদের অবস্থান কোথায় তা খুব সহজেই অনুমেয়। রাজনীতি এখন ব্যবসা ও স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে; যা কেবলই দুর্বৃত্ত ও দুর্বৃত্তায়নের কুৎসিত বলয়ে ঘুরপাক খায়। এহেন বাস্তবতার নিরিখে কখনো সুস্থ ও সুষম সুন্দর সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। সুতরাং রাজনীতিকে এই রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত করতে হবে। তবেই আমাদের কাক্সিক্ষত সোনার বাংলা রচনা করা সম্ভব।
সর্বোপরি শিক্ষা ও রাজনীতির এই পুনর্বিন্যাস খুবই জরুরি হিসেবে দেখা দিয়েছে। আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনেই অনুরূপ পদক্ষেপ এখন সময়ের দাবি, যা সংশোধিত হলে আমাদের মানবিক সমাজকাঠামো আরো বেশি সুসংহত হয়ে উঠতে পারে।


আরো সংবাদ



premium cement