১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যর্থতা

-

অদ্ভুত উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ। রাজনীতিকদের বিষয়ে যখন লেখার কথা ভাবলাম সাথে সাথে উঠে এলো এ বাক্যটি। এই শিরোনাম কবি শামসুর রাহমানের একটি কবিতা বইয়ের। তার কল্পনায় ছিল সেই অদ্ভুত উটের ছবি, যা রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিচিত্র হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। সেই সময়ের রাজনৈতিক বাস্তবতা আমাদের সৃষ্টিশীলতার গহনে যে দুঃখ ও বেদনার পাহাড় জমিয়েছিল, তার রূপকল্প ওই নামটি। তার মানে আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনের সৃষ্টিশীলতা আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের নগ্ন-সুন্দর ও বেদনাকেই স্পষ্ট করে। কবিরা সেই কাজটিই করেন, যা প্রতিবাস্তব। এ বাস্তবের নির্মাতা ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক শক্তিগুলো।
কারণ আমাদের রাজনীতি জনগণহীন, কেবল ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনীতি, যাকে কোনো ভাবেই দেশের জনগণের রাজনীতি বা গণতান্ত্রিক রাজনীতি বলা যায়ই না। ঠিক এ কারণেই পশ্চিমা গণতন্ত্রের মিনিমাম স্ট্রাকচারও আমাদের রাজনৈতিক সরকার(গুলো)র রাজনৈতিক শিক্ষায়, আচার-আচরণে, কথায়-বার্তায় নেই। ক্ষমতার বাইরে যারা আছেন, তারা সরকারি বাহিনীর নগ্ন-নিষ্ঠুর পুলিশি নির্যাতনের মুখে থাকে। যখন যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, আমরা গত ৫০ বছরের রাজনৈতিক পরম্পরায় এ দৃশ্যই দেখে আসছি। সরকারের দোষত্রুটি ও তাদের অগণতান্ত্রিক আচরণের সমালোচনা করলেই নেমে আসে পুলিশি-র‌্যাবের খড়গ। এর কোনো হেরফের নেই। যখন যে রাজনৈতিক সরকারই ক্ষমতার মসনদে থাকুক না কেন, বিরোধী দলগুলোকে দমনে একই রকম নীতি-আদর্শ অবলম্বন করতে দেখেছি আমরা। রাজনৈতিক চরিত্রের এই স্ট্যাটিক পরিণতি যে একটি উন্নয়নকামী দেশের রাজনৈতিক চরিত্র হতে পারে না, সেই বোধটুকুও ক্ষমতাসীনদের মধ্যে দেখা যায় না। আমার এই বিশ্লেষণে দেশের সব রাজনৈতিক দলই নাখোশ হবেন, সন্দেহ নেই, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এটিই।
এর কারণ একটিই, জনগণ নয়, রাজনীতির মৌলিক লক্ষ্য ক্ষমতার মসনদ। আর ক্ষমতায় যেতে হলে সেই ১৯৭৩ সাল থেকেই দেখে আসছি, ভোট নয়, ভোটার জনগণ নয়, পেশিশক্তির ওপরই নির্ভর করছে তারা। চিন্তায় যখন পেশিশক্তির দৈত্য ভর করে, তখন বিদ্যমান আইন নয়, কোনো বিষয়ই রাজনৈতিক শাসকের চিন্তায় পাত্তা পায় না। এটিই এখন দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বাস্তবতা।

২.
টাইরান্ট বা কর্তৃত্ববাদী সরকার তার সমালোচনা কখনোই সহ্য করে না। রাজনৈতিক বিরোধীদের বক্তব্য কমবেশি পাশ কাটাতে দেয় নানা কারণে। জনগণকে দেখাতে চায় তারা গণতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাসী, গণতান্ত্রিক আচরণকে তাদের অধিকার বলে মনে করে। কিন্তু রাতের অন্ধকারে বিরোধী রাজনীতিকদের অগণন মধ্যম ও তৃণমূল স্তরের নেতাকর্মী আটক করে জেলে পুরে রাখাই তার স্বভাব। ওপরের স্তরের নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ আর শ্লেষ নিক্ষেপ করা ছাড়া তেমন একটা অ্যাকশনে যায় না। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে যে ভাষায় বিষোদগার করে তা সভ্য সমাজে, শিক্ষিত সমাজে ও সাংস্কৃতিক গণতান্ত্রিক সমাজে ‘কহতব্য’ নয়। সাধারণ মানুষ রেডিও-টিভিতে এসব কথা শোনে না। তারা লোকমুখে এসব শুনে হাসে; কারণ তাদের কিছু করার নেই।

৩.
আগামী নির্বাচনের একটি গুণগুণ শব্দ বাতাসে ভাসছে। শব্দটি উঠেছে বিএনপির রাজনৈতিক সিরিজ-সভাকে কেন্দ্র করে। বিএনপি নেতৃত্ব তিন দিন ধরে সভা করল তৃণমূলের নেতাদের সাথে। মাঠপর্যায়ের নেতারা (শত শত নেতাকর্মীকে আটক করে রেখেছে আওয়ামী সরকার নানান অপরাধের কথা বলে) যেসব মত দিচ্ছে দল পুনর্গঠনে, নেতৃত্ব দানে, সেসব সংবাদমাধ্যমগুলোয় বিভিন্ন নেতার বরাতে রিপোর্ট হয়েছে। সেই রিপোর্টে পড়ে জানা যাচ্ছে আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিতে পারে, যদি নিরপেক্ষ-নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দেয়া হয়। তারা দলীয়, আওয়ামী সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবেন না।
তাদের সেসব কথিত দাবি পত্রিকায় পড়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকারের মন্ত্রীরা বললেন আগামী নির্বাচন হবে দলীয় সরকারের অধীনে। কোনো রকম তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ দেশে আর আসবে না। তাদের দাবি বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার আমলের সব নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে।
‘নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ নির্বাচনের জন্য কায়েমের আন্দোলন করেছিল ‘আওয়ামী-জামায়াত’ বিরোধী দল ১৯৯৩/৪/৫ সালে, খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামলে। তখন ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। তারা আওয়ামী-জামায়াত ধারণার এ তত্ত্বটিকে উড়িয়ে দিয়েছিল এই বলে যে একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারকে বিশ্বাস না করে তারা অনির্বাচিত সরকারকে বিশ্বাসের কথা বলছে, যাদের কোনো দায় ও জবাবদিহিতার কোনো ব্যবস্থা নেই, বালাইও নেই। শোনা যায়, ওই নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সিস্টেমের তত্ত্বটি জামায়াত করেছিল। তাদের সেই তত্ত্বটি আওয়ামী লীগ গিলেছিল এ কারণে যে এ থেকে তারা লাভবান হতে পারবে। কারণ তারাও সেই সময়কার নির্বাচন কমিশন দলীয় বলেই বিশ্বাস করত। বিএনপি কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করতে পারেনি। ঠিক এ দাবিটি আজ করছে বিএনপি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। তার বহু কারণই ছিল, আজো তা বর্তমান। আজ যখন বিএনপি বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে আওয়ামী কমিশন বলছে, তখনো সেই কমিশনকে বিএনপি কমিশন বলে চিহ্নিত ও চিত্রিত করেছিল আওয়ামী লীগ-জামায়াত ও অন্যান্য বিরোধী দল। পাল্টাপাল্টির এই রাজনীতি এবং পরিণামে দেশে রাজনৈতিক মিছিল-মিটিংসহ যত রকম এজিটেশন আছে, তা হবে। এবং সেসব ঠেকাতে পুলিশ-র‌্যাব রাবার বুলেট ও আসল বুলেট ছোড়তে কসুর করবে না। রক্তপাত হবে, মৃত্যু হবে সাধারণ প্রতিবাদী মিছিলকারীর, লাভবান হবে নেতারা। কর্মী মারা গেলে লাভবান হয় নেতারা। তারা ক্ষমতার মসনদে গিয়ে আরাম পান।
রাজনৈতিক বিভাজন ও বিভেদের প্যাটার্ন পয়সার দুই পিঠের মতোই দুই নামের, কিন্তু কাজটি একই। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও আচরণ একই, নামে শুধু পার্থক্য। এ রাজনীতি আমাদের স্বাধীন দেশের রাজনৈতিক পরিণতির মূল চেহারা। এই রাজনৈতিক চেহারা আমরা দেখতে চাই না।
টিভিতে টকশোতে দেখলাম কমিউনিস্ট পার্টির একজন নেতা নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে বললেন এবং এই কমিশনের অধীনে নির্বাচনে যাবে না তার দল জানালেন। নির্বাচন কমিশন রিফর্ম করার দাবি তুললেন তিনি। সংখ্যানুপাতিক হারে সংসদ নির্বাচনের কথা বললেন। নির্বাচন বিষয়ে টোটাল একটি রিফর্ম তিনি ও তার দল চায়। বেশ কয়েক দিন আগে জাতীয় পার্টির প্রধান জি এম কাদেরও এই নির্বাচন কমিশনের তীব্র সমালোচনা করলেন। তিনিও চান কমিশনের পরিবর্তন। কারণ তিনিও মনে করেন, এই কমিশন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত নয়। তারা যে আওয়ামী লীগের বিরোধী, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সে কথাটাই বললেন তিনি।

৪.
বিএনপির তৃণমূলের নেতারা বলছেন বেগম খালেদা জিয়াকেই আগামী নির্বাচনে নেতৃত্বে দেখতে চান। তিনি যদি আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন তা হলে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তারেক রহমান নেতৃত্ব দেবেন। জোট ও সম্ভাব্য জোট সম্পর্কে তাদের বক্তব্য হচ্ছে, বিএনপি থাকবে নেতৃত্বে (গত নির্বাচনে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বের ‘ঐক্যফ্রন্ট’-এর ব্যানারে) তৃণমূলের নেতারা জামায়াতকে জোট থেকে বাদ দিতে পরামর্শ দিয়েছে। জিয়া, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের রাজনৈতিক ইমেজ নষ্ট হওয়ার পেছনে রয়েছে মৌলবাদী জামায়াতকে জোটভুক্ত করাÑ এই মত তাদের। বিএনপি একটি জনগণকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দল, যার ইমেজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে উঠেছে।
এখন চলছে (সেপ্টেম্বরের ২০.২১.২২) বিএনপির নির্বাহী কমিটি ও জেলার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের নিয়ে তিন দিনব্যাপী সভা, যা তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে গতি দিতে বিশেষ ভূমিকা নেবে। সরকারবিরোধী আন্দোলনটি কী হবে, তা কি হবে অব্যাহত গণবিক্ষোভ নাকি সরকার পতনের ‘গণ-অভ্যুত্থান’ তা নির্ধারণের জন্যই তারা বসেছেন। কোন পথে এগিয়ে যাবে বিএনপি সেটি তাদেরই রাজনৈতিক রোডম্যাপ বলে দেবে আমাদের। তবে বর্তমান সরকার, যেহেতু ভোটের ফসল নয়, তাই বিএনপিকে সেই বিষয়টি মনে রেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এবারো সেই পথেই এগোবে তারা। নির্বাচন যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়, তা হলে তারা ‘গো-হারা’ হারবে। সে কারণেই তারা ‘খুট্টি ধরেছে’ তাদের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। এই একগুঁয়েমি রাজনীতিতে চলে না, বিশেষত গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে তো নয়ই। যদি গণতন্ত্রে বিশ্বাস থাকে আওয়ামী লীগের, যদিও তাদের চেতনা সামন্ত মনন-মানসিকতায় পূর্ণ, সেখানে ছলে-বলে-কলে-কৌশলে ক্ষমতার মসনদই মধুর বলে মনে হয়। দলে যেমন গণতান্ত্রিক রীতিনীতি আদর্শ ও তার প্র্যাকটিস নেই, তা হলে সরকারের কাজকর্ম ও আদর্শে সেই গণতান্ত্রিক ধারা থাকবে কেমন করে?

৫.
রাজনীতি ও তার কালচার বা সংস্কৃতি আমাদের রাজনৈতিক সমাজে কেমনতর অবস্থায় বিদ্যমান, তা পরখ করার কোনো ব্যারোমিটার আছে কি না, তা আমার জানা নেই। তবে আমরা জানি, এখন যে শিশুটি ভূমিষ্ঠ হচ্ছে বা হয়েছে, সে একটি সাংস্কৃতিক ভূমিতে বা আবহে বা প্রচলিত ধারার আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনাচারের মধ্যে জন্মলাভ করেছে। কিন্তু সেই জীবনাচারে দেশের সাধারণ মানুষের অবস্থান কোন স্তরে, তারা সামাজিক কাঠামোর কোথায় বাস করে, তা তারা জানে না, বোঝে না। এবং এই বোঝা না বোঝার ধারণার মধ্যে সেঁধিয়ে থাকা একধরনের কালচারাল হেজেমনি বা সাংস্কৃতিক ধোঁয়াশার জালে বন্দী হওয়ার ফলে ঘটছে। ফলে প্রকৃত সত্য বা জাতিরাষ্ট্রের ধারণায় সংস্কৃতির স্বরূপ কী এবং তার প্রধান প্রবাহ সম্পর্কে কোনো বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞান পায় না। আবার তারা এটাও বোঝে না যে, যারা এখন ক্ষমতার মসনদে বসে আছে এবং কষায় ফেনা তুলে বলছে, তারা গণতান্ত্রিক সরকার, নির্বাচিত সরকার, তাদের সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে, সেখানে বিরোধী দল আছে, ‘বহুদলীয় গণতন্ত্রের’ প্রবক্তা তারা, অতএব বোদ্ধা জনগণ বোঝে টাইরান্ট শাসকই আসলে গণতন্ত্রের প্রতিরূপ। বাংলাদেশে ওই রাজনৈতিক গণতন্ত্রের টাইরান্ট শাখার বা কর্তৃত্ববাদী সরকারের গণতান্ত্রিক শাখার শাসন চলছে। আমরা যারা টিভিতে কার্টুন ছবি ‘টম অ্যান্ড জেরি’ দেখেছি, এই রাজনৈতিক গণতন্ত্রের মাঠ স্তরে, মধ্যম ও কেন্দ্রের রাজনীতিতে সেটাই চলছে। আমাদের দেশে যেন এর কোনো শেষ নেই। তবে কি আমাদের রাজনীতি শিরদাঁড়ায় ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতি’র কোনো সমৃদ্ধ সুশীলসমাজ বা সিভিল সোসাইটির মনন অনুসরণ করে গড়ে ওঠেনি?
সিভিল সোসাইটি, আমাদের রাজনৈতিক সমাজে সুশীলসমাজ নামেই খ্যাত। যারা জ্ঞান-গরিমায়, আচার-আচরণে, নৈতিক বিচারে মানবতা ও মানসিক পর্যায়ে ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা দেয়, তিনি বা তারাই সুশীল; অর্থাৎ বিশেষভাবে শীল বা ‘সংস্কৃত’ জনই হলেন সুশীল।
‘হেগেল বলেন, পারিবারিকবৃত্তে নয়, নাগরিক সমাজেই মানুষ তার সামাজিকতাকে উপলব্ধি করে। যেহেতু ব্যক্তি মানুষের উন্নতি নির্ভর করে অন্য মানুষের উন্নতির ওপর, তাই সিভিল সোসাইটি মানুষকে সহযোগিতা, শ্রেষ্ঠত্ব, ভদ্রতা, সহনশীলতা, এসবের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে।’
হেগেল তিনটি সম্প্রদায়কে চিহ্নিত করেছেন এই সিভিল সোসাইটির কাঠামোয়। ১. ভারার্থক (ভূস্বামীÑ অভিজাত ও কৃষক) ২. শিল্পগত (কলওয়ালা, ব্যবসায়ী, কারিগর) ৩. সাধারণ (রাজপুরুষ)।
আর ইতালির তাত্ত্বিক গ্রামসি বলেন, অর্থনৈতিক সংগঠন এবং দমনমূলক রাষ্ট্রের মধ্যবর্তী স্থানে আছে সিভিল সোসাইটি। ফলে অর্থনীতি ও রাষ্ট্র দুই-ই সিভিল সোসাইটিকে গঠন করে।
‘সরকার, বাজার ও সিভিল সোসাইটি’Ñ এ তিনের সম্মিলিত কাজ হচ্ছে ঔপনিবেশিক শক্তির পুঁজির সাম্রাজ্য চালু রাখা। একে আমি বলব, সাম্রাজ্যবাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতিরই অন্তরে বাস করে পুঁজির সাম্রাজ্য বা পুঁজির প্রবাহ ও সমৃদ্ধি। আর ওই সাম্রাজ্যের চালিকাশক্তি বহিরাবরণে পুঁজি আর সরকারকে দেখা গেলেও অন্তরে তার ক্রিয়াশীল সিভিল সোসাইটি, যারা সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে গতি-প্রকৃতির বর্ণনা ও জনগণের চেতনায় বাহবা তৈরি করে, তাদের ওয়াদা জোগায়। আর ওই সব পুঁজির ব্যবসার ভালো দিকটিকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তোলে সিভিল সোসাইটির সরকারি অনুগ্রাহক সদস্যরা। এসব জ্ঞানী সরকার ও পুঁজির রাজনৈতিক তল্পিবাহক। তারা সিভিল সোসাইটির নামকরা ব্যক্তি ও সংগঠন। আর এদের জ্ঞান বিস্তারের বাহক হচ্ছে দেশের সংবাদপত্রগুলো বা মিডিয়াগুলো, যারা সরকারের ডাণ্ডাবাজির ভয়ে কিংবা পারিতোষকের জোরে ‘জি হুজুরি সেবা’ দেয়।
আমার এ কথার সমর্থনে মিশেল ফোকোকে উপস্থাপন করা যায়। তিনি বিশ্লেষণ করে বলেছেন, সিভিল সোসাইটি রাষ্ট্রক্ষমতাকে প্রতিরোধ বা সীমিত করার বদলে এরা রাষ্ট্রক্ষমতাকেই সমর্থন ও সহায়তা দেয়।
[সিভিল সোসাইটি, তত্ত্ব প্রয়োগ ও বিচার/ফকরুল চৌধুরী সম্পাদিত/ভূমিকা]
আমি এ কথা বলেছি যে আমাদের বর্তমান সমাজে বা সিভিল বা সুশীলসমাজের রাষ্ট্রনৈতিক কর্মের ন্যায়ভিত্তিক সমালোচনা নেই কেন, প্রতিবাদী ভূমিকাও অবশিষ্ট নেই আজ। নেই কেন তার কিছু নমুনা। কেন একটি গণতান্ত্রিক সমাজে গণতন্ত্র নেই। সামাজিক ন্যায়, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত নয়, সাধারণ মানুষের সাংবিধানিক অধিকার নেই, মতপ্রকাশের অধিকারে তালা মেরে রাখা হয়েছে, বৃদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণীকে দলীয় চিন্তা আর ভাবনার সহযোগী করে চিন্তাশীলতার দুয়ার রোধ করা হয়েছে।
একটি স্বাধীন, উপনিবেশ-উত্তর সমাজের মানুষের চিন্তার প্রবাহে রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তার ন্যায়সঙ্গত চর্চা হবে না, এটি কেমন করে মেনে নেয়া যায়। যেহেতু রাষ্ট্রের নিয়ন্তাশক্তি রাজনীতিকরা, তাই তাদেরই প্রধান দায়-দায়িত্ব রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রবাহ সৃজন করা। আর তাদেরই সহায়কশক্তি হচ্ছে সুশীলসমাজ, যারা এই প্রবাহে শক্তি যোগ করে থাকে। তারা পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের লেজুড় হিসেবেই কাজ করে বটে, তার পরও তাদের দায়িত্ব বলে কিছু থাকে, যা ঢেকে দেবে জনগণের দৃষ্টি ও সামাজিক চেতনা। আমরা আজকে তাদের দেখছি কেবল দলবৃত্তি করতে, তাদের প্রকৃত উদ্ভাবনা বা রাজনৈতিক সংস্কৃতির গতিপ্রকৃতি লালন করে তাকে জণগণমুখী করার কাজটি করতে হবে। এটা তাদের ভেতরে যে নেই তা নয়, আছে, কিন্তু তা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে না ব্যক্তিগত ও সুশীলসমাজের গোষ্ঠীগত স্বার্থ হাসিলের কারণে।
দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে এই পাঠ দিতে হবে যে, দলে ও সরকারের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কাজে পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের ধ্যান-ধারণাগুলোকে পোক্ত করে তুলতে হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতিচর্চায় দেশের মানুষের মনে গণতন্ত্রকাঠামো জনমনে প্রশান্তি এনে দেবে। কেননা দেশটি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে দশকের পর দশক ব্যয় করেছে, জীবন দিয়েছে, তার পর রক্তাক্ত প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের আন্দোলনের ভেতর দিয়ে স্বাধীন হয়েছে। ভূরাজনৈতিক স্বাধীনতা আমরা লাভ করলেও মননগত দিক থেকে, সিভিল সোসাইটির মনন-মানসিকতায় রয়ে গেছে ঔপনিবেশিক শাসনজাত প্রক্রিয়ার উপজাত আইনকাঠামো ও তার অপচ্ছায়া। ক্ষমতাসীন মহল এটা বুঝতে পারছে না বা বোঝার চেষ্টাও করে না। যেহেতু পুঁজির সাম্রাজ্য অব্যাহত রাখার অলিখিত চুক্তিতে জড়িয়ে আছে আমাদের মেধা ও মনন এবং তার উপজাত শিক্ষাব্যবস্থা, তাই এর অবসান কবে হবে বা হতে পারে, তা কেবল ভবিতব্যই বলতে পারে।
আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সিভিল সোসাইটির কর্ম-উপযোগিতা লক্ষ করার বিষয়টি মনে রাখতে হবে। ঔপনিবেশিক শক্তির হাত ধরে যে গণতান্ত্রিক শাসন ধারা চালু হয়েছে, এই ধারাস্রোত আমাদের উৎপাদকশক্তি কৃষকের উপকারে আসে না। কৃষক উৎপাদন করে বটে, নাগরিক সমাজকে সরবরাহ করে, কিন্তু মূল্য পায় না। কারণ ওই বুর্জোয়া পুঁজির লোভের ফলে তারা বঞ্চিত হয় এবং হচ্ছে। মূলত এই বুর্জোয়া পুঁজির সাম্রাজ্যবাদী শাসনের প্যাটার্নকে উল্টো পথে চালিত করতে হবে; অর্থাৎ জনগণের শাসন ও জনগণের সুশীল সোসাইটি গড়ে তোলা। অ্যান্তোনিও গ্রামসি বলেছেন ‘কাউন্টার হেজেমনি’ সৃষ্টি করে বুর্জোয়া সোসাইটির লোভী ধারাকে থামাতে হবে। কাজটি করা দুরূহ। কারণ এটি করতে পারে সেই সোসাইটি, যাদের বুর্জোয়া পুঁজি বিকশিত হয়েছে এবং সেই পুঁজি ও সরকারের মধ্যবর্তী অবস্থানে থেকে সিভিল সোসাইটি নির্মাণ করবে নতুন সাংস্কৃতিক চেতনার অবকাঠামো। সেই অবকাঠামোর স্রোতই উৎপাদক শ্রেণীকে দেবে নতুন প্রণোদনা।
দুর্ভাগ্য এটাই যে আমাদের দেশে পুঁজিরই বিকাশ ঘটেনি। এ কারণে রাষ্ট্রযন্ত্র, শিল্প সেক্টর ও সিভিল সোসাইটির ভেতরে পারস্পরিক আদান-প্রদান বিষয়টি গণমানুষের প্রতি দায়বদ্ধ নয়। আর তাই গ্রামোন্নয়নের মাধ্যমে, গ্রামের মানুষের অধিকারের পক্ষেও ওয়াদাবদ্ধ নয়। সিভিল সোসাইটির চিন্তাগত ক্ষেত্রে গ্রাম ও গ্রামীণ মানুষ যদি কেন্দ্রবিন্দু হতো, তা হলে আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র ও পুঁজির স্রোত সেই পথেই চলতে শেখাতো সুশীলসমাজ। আজকে আমাদের সমাজ নৈতিকভাবে দুর্দশা-আক্রান্ত হতো না। রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যর্থতাও এখানেই নিহিত।


আরো সংবাদ



premium cement