২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ

-

সমাজভেদে মূল্যবোধ ভিন্ন হলেও মানবিক আবেদনের বিষয়ে সব মানুষের প্রায় একই রকম বাসনা লক্ষ করা গেছে। যে মানুষটি নিজে কাউকে সম্মান করে না সেও চায় অন্য মানুষ তাকে সমীহ করুক। অর্থাৎ প্রতিটি মানুষ তার নিজের মানবতা বিষয়ে আগ্রহী বেশি। আগ্রহী বেশি বলেই মানুষ চায় অন্য মানুষ তাকে সম্মান করুক, স্বাধীনভাবে বাঁচতে সহযোগিতা করুক। অর্থাৎ সম্মান দেয়া-নেয়া, স্বাধীনভাবে বাঁচা, জাতপাত উঁচুনিচু ভুলে মানুষের জয়গান করা ইত্যাদি বিষয়গুলো মানবিক আবেদনের মধ্যে পড়ে। সামাজিকভাবে এসব বিষয়কে গুরুত্ব দেয়ার নাম মানবিক মূল্যবোধ। আবার এভাবেও বলা যেতে পারে যে, মূল্যবোধ হচ্ছে এক প্রকার ধারণা, আদর্শ বা গুণ, যা মানুষের আচরণের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। সমাজবিজ্ঞানী জনাথন হ্যাইট বলেন, ‘ধর্ম, ঐতিহ্য ও মানব আচরণ থেকে নৈতিকতার উদ্ভব।’ অনেকেই মনে করে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ একই। নৈতিকতার ধারণা শিশু-কিশোর গ্রহণ করে অগ্রজদের কাছ থেকে। অগ্রজদের সামাজিক আচরণ অনুজদের মূল্যবোধ সৃষ্টিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। অতএব নীতির প্রতি অবনত থাকতে পারলে সামাজিকভাবে মূল্যবোধকে ধরে রাখা যেতে পারে। কিন্তু আমরা মূল্যবোধকে ধরে রাখতে পারিনি। সম্প্রতি বাংলাদেশের সমাজে মূল্যবোধের পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। মূল্যবোধ পরিবর্তনের কারণে সামাজিক শৃঙ্খলা ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে। সততার সাথে বাঁচা। প্রতারণা না করা। আত্মীয়স্বজনের খোঁজখবর করা। বিপদে-আপদে মানুষের পাশে থাকা; দুস্থ-অভাবী-অনাহারী মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসা। ধারকর্জ দেয়া ও সময়মতো তা পরিশোধ করা। সম্মিলিতভাবে অত্যাচারীকে প্রতিরোধ করা। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থেকে জনমত সৃষ্টি করা ইত্যাদি মানবীয় বিষয়গুলোই মূল্যবোধের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু সমাজে চলতে-ফিরতে আজকাল কানে ভেসে আসছে ‘ভালো থেকে লাভ নেই; সৎ লোকের ভাত নেই। টাকা ছাড়া মানুষের মূল্য নেই। মামুর জোর না থাকলে চাকরি নেই। রাজনীতির ঠিক নেই। আইন আদালতে বিচার নেই। ভোটার হয়ে লাভ নেই এবং সর্বোপরি এমনও শোনা যাচ্ছে যে, নিজে বাঁচলে বাপারে নাম। নেতিবাচক এসব ধারণা সমাজে বিস্তার লাভ করেছে এবং রীতিমতো যা সেøাগানে পরিণত হয়েছে। এই সেøাগানগুলো মানবিক মূল্যবোধ প্রতিরোধে সহায়ক হিসেবে কাজ করছে। ‘সৎ লোকের ভাত নেই’ কথাটা সহজে বলা হলেও এই কথার অর্থ শেষ পর্যন্ত আর সহজ থাকে না; অর্থ গিয়ে দাঁড়ায় অসৎ হতে না পারলে সফলও হওয়া যায় না, সে দিকে ইঙ্গিত করে কিংবা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ করাকে বোঝাবে। অসৎ হতে পারাটা যেন কৃতিত্বের। অসৎ লোকেরই কপালে কোরমা-পোলাও জোটে। এ ভাবনাটা মানুষ অবচেতন মনে নিজেদের মধ্যে লালন করছে। সমাজে দেখাও যাচ্ছে তা-ই; অসৎ লোক রাতারাতি তাদের আর্থিক উন্নতি করে ফেলছে। আরেকটি সেøাগান সমাজে ভয়ঙ্করভাবে প্রভাব ফেলছে তা হলো ‘যার টাকা নেই তার মূল্য নেই’। এই সেøাগানকেও মানুষ অবচেতন মনে নিজেদের মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলেছে, যেহেতু টাকা ছাড়া মানুষের মূল্য বা সম্মান নেই কাজেই টাকা রোজগার করতে হবে যেকোনো ভাবেই। সমাজে দেখাও যাচ্ছে টাকাওয়ালাদের মানুষ বিশেষ কদর করছে। তা সে টাকার উৎস যাই হোক না কেন। সে কারণে টাকার পেছনে মানুষ ছুটছে। টাকা রোজগার করতে গিয়ে নির্মাণকাজে ব্যবহার করা হচ্ছে রডের বদলে বাঁশ। নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহার করে তৈরি করা হচ্ছে রাস্তা। করা হচ্ছে টেন্ডারবাজি, ভাউচারবাজি। খাদ্য ও ওষুধপত্রের মতো জীবনসুস্থকারী দ্রব্যেও মিশানো হচ্ছে ভেজাল। গুদামজাত করে কৃত্রিম সঙ্কটের মাধ্যমে বাড়ানো হচ্ছে নিত্যপণ্যের বাজার দর। ঘুষ, সুদেও কারো আপত্তি থাকছে না। প্রভাব খাটিয়ে রাষ্ট্রয়ত্ত ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে লোনের নামে চলছে টাকা উত্তোলন। রাষ্ট্রয়ত্ত ক্রয়ে করা হচ্ছে পুকুর চুরি। এসবই করা হচ্ছে ‘টাকা ছাড়া মানুষের মূল্য নেই’ এই একটি বোধ থেকে। এই বোধের কারণে মানুষ স্বার্থবাদিতার চরমসীমায়ও পৌঁছে যাচ্ছে। নিজে বাঁচলে বাপের নাম’ এটি আর একটি নেতিবাচক আত্মঘাতী সেøাগান। এই সেøাগানটি স্বার্থবাদিতার মুখপত্র হিসেবে কাজ করে; নেতিবাচক এই সেøাগানের প্রভাবে মানুষ নিজের ভেতর থেকে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। আমরা জানি আত্মকেন্দ্রিক চেতনা ও স্বার্থবাদীতা মানুষকে অন্ধ করে তোলে। এ কারণে আত্মকেন্দ্রিক মানুষের খেয়াল থাকে না বা সে খেয়াল করতে চায় না তার চার পাশে কী ঘটছে। এর ফলে আত্মীয় সম্পর্কের বন্ধনগুলো শিথিল হচ্ছে। প্রবীণ পরমাত্মীয়দের নিবাস হচ্ছে আশ্রমগুলোতে। ভাইবোনরা যার যার মতো দূরে সরে যাচ্ছে। এমনকি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে মানুষ একা নিঃসঙ্গ হয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। অন্য দিকে দুর্বৃৃৃৃৃৃৃৃত্তদের দুর্বিপনা বাড়িয়ে দেয়ার মতো আর একটি সেøাগান হরহামেশা যত্রতত্র শোনা যাচ্ছে। ‘আদালতে বিচার নেই, আইনের শাসন নেই’। আইন-আদালত সম্পর্কিত নেতিবাচক এই সেøাগানের মর্মার্থ উপলব্ধি করে দুর্বৃত্তরা মানুষকে বিবস্ত্র করে পেটাচ্ছে। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করছে। ধর্ষণ করছে। লুট করছে। ভূমি দখল করছে। আদালতের ওপর ভর করে রাজনীতিও গতিপথ বদলিয়েছে। বদলে নেয়া রাজনীতির পথে প্রতিক্ষ দাঁড়াতে পারছে না। দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেই প্রতিনিয়ত মামলা-মোকদ্দমার শিকার হচ্ছে। সেসব মামলার বিচারে নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। আদালতের বিমাতা আচরণ লক্ষ করে মানুষ বিশ্বাস করতে চাইছে, আইনের শাসন আজ পরাহত। আদালতের প্রতি মানুষের এ বিরূপ মন্তব্য মূল্যবোধকে সঙ্কটে ফেলছে। নৈতিক মূল্যবোধের এই যে চরম সঙ্কট লক্ষ করা গেছে, তা এক দিনে তৈরি হয়নি। বহুদিন ধরে এ অবস্থা চলে আসছে। এসব উপলব্ধি করে মানুষ আইন-আদালতের প্রতি আস্থা হারাচ্ছে। এমন অনাস্থা সৃষ্টির পেছনে অনেক প্রভাবশালীদের হাত রয়েছে। এ নজির মূল্যবোধের ওপর সরাসরি আঘাত করেছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement