১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কোরবানি : মহান রবের প্রতি আত্মসমর্পণ

-

ঈদ ঈদ ঈদ! ঈদের খুশি, ঈদের আনন্দ নানা আয়োজনে উঁকি দেয় মনের আঙিনায়। ছোট থেকে বড় সকলেই আনন্দ হিল্লোলে জেগে ওঠে উৎসবের খুশিতে। এ যেন স্বর্গীয় পুলক হৃদয়ে ঝলক দেয়ার চিত্রকল্প। ঈদ যদি হয় কোরবানির তা নিয়ে আসে ভিন্ন আমেজ। ভিন্ন অনুভব। ত্যাগের মহিমায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। বছর ঘুরে কোরবানিতে অংশ নেয়ার অনাবিল আনন্দ যেন বিশাল প্রাপ্তির ঔদার্যের। মনোলোকে ঝর্ণাধারার মতো প্রবহমান। এ গতির তীব্রতার ছোঁয়া মনের মধ্যে খুশির আনন্দধারা বইয়ে দেয়। বানহীন এ ফল্গুধারা মানুষকে আপন করে তোলে। ঈদ মিশে আছে আমাদের জীবনের সাথে। হৃদয়ের গভীরে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গ্রামাভিমুখে চলে মানবসমুদ্রের ঢল। বাস ট্রাক লঞ্চ ট্রেনের ছাদে থাকে না তিল ধারণের ঠাঁই। লক্ষ্য একটাই প্রিয়জনের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করা। নাড়ির টানে এগিয়ে চলে সবাই। কষ্টের মহাসমুদ্রের মুখোমুখি হতে হবে জেনেও থেমে থাকে না গতিপথ। এই আনন্দ অনুভব পৃথিবীময় খুঁজে পাওয়া ভার। আপনজনের সান্নিধ্যে উৎসবের আনন্দই ঈদকে সার্থক করে তোলে।
বছর ঘুরে আসে কোরবানির ঈদ আনন্দ। মুসলমানদের নানান আয়োজনে সাজানো হয় ঈদের দিনটিকে। কেউ বা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কোরবানির অর্থ জমিয়ে রাখেন। কেউবা তার একমাত্র পোষা প্রাণীটি চোখের জলে সিক্ত হয়ে কোরবানির প্রস্তুতি নেন। ঈদের আগের বাজারগুলোতে দেখা যায় কোরবানির পশু কেনার হিড়িক। বাজারে নানান রঙের নানান আকৃতির পশুর বাহার। কোথাও বা পশুর গলায় ঝুলছে রঙবেরঙের মালা। পশু কেনার কাজটিও সহজ নয়; অনেকটা কষ্টকর। মাঝে মাঝে দালালের খপ্পরেও পড়তে হয়। পশু কেনা হয়ে গেলে হৃদয়ে আনন্দের ঝিলিক খেলে ওঠে। কোরবানির পশু কেনায় নেই কোনো অর্থের প্রতিযোগিতা। প্রদর্শনীর সুযোগ তো নেই-ই। বেশি দামি গরু কিনে মানুষকে দেখানোতে কোরবানির প্রকৃত উদ্দেশ্য ম্লান হয়ে যায়। সাধ্যের সর্বোচ্চ উৎসর্গের মানসিকতাই মহান রবের সন্তুষ্টি লাভের একমাত্র উপায়।
আবার কোনো কোনো মানুষের কাছে প্রদর্শনী হয়ে ওঠে মুখ্য। কার গরু কত বেশি দামি এ যেন এক প্রতিযোগিতার মওসুম। পশু কেনার টাকা কতটা সঠিক পথে উপার্জিত সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আবার কেউ কেউ পশুর দাম কম দেখিয়ে কোরবানির হাটের চাঁদা বা রওনা কম দেয়ার চেষ্টা করেন। যা কিছুতেই কাম্য হতে পারে না। কখনও বা কসাইয়ের প্রাপ্য পারিশ্রমিক দিতে দেখা যায় কার্পণ্য। কোরবানির গোশত দিয়েও অনেকে পারিশ্রমিক শোধ করে থাকেন,যা নিঃসন্দেহে অসুন্দর একটি কাজ। অর্থের প্রতিযোগিতার সঙ্গে সঙ্গে গোশত সংরক্ষণেরও চলে ব্যাপক প্রস্তুতি। ফ্রিজ খালি করা, কোরবানি উপলক্ষে ফ্রিজ ক্রয়-বিক্রয়ের বিশেষ অফার আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। গরিব অসহায় মানুষ যারা সারা বছর অনাহারে অর্ধাহারে কাটায়। কোরবানির গোশত থেকে তাদের প্রাপ্য অংশটুকু দেওয়ার থাকে না কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা। সারা বছর যারা গোশত কিনে খাওয়ার সামর্থ্য রাখেন তারাই তা সংরক্ষণে বেশি তৎপর। অথচ মানবতার বন্ধু মহানবী সা: অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর শিক্ষা দিয়ে গেছেন বিশ্বময়। কোনো প্রতিবেশী অভুক্ত বা কষ্টে থাকলে তিনি প্রকৃত মুমিন হতে পারেন না। ধনীরা তা অনেকাংশে ভুলে যান। মানুষ মানুষের জন্য। অসহায় অভাবীর সেবা যে ¯্রষ্টারই সেবা। এতটুকু দৃষ্টিভঙ্গিই পারে আমাদের জীবন সমাজকে নবরূপে সাজাতে। সমাজের উন্নতি সমৃদ্ধি একা একা নয়। সবাই মিলে মিশেই সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিতে হয়। ত্যাগেই পরমানন্দ ভোগে নয়। আমাদের হৃদয়ে সে অনভূতিই জাগিয়ে তোলে কোরবানি ফি বছর।
করোনায় কোরবানি আমাদের ঘরে এলো এক নতুন মাত্রায়। সচ্ছল ব্যক্তিরাও আজ আর্থিক সঙ্কটের মুখোমুখি। কোরবানির গোশত যারা বিলিয়ে দিতেই অভ্যস্ত তাদের জন্য কোরবানির ঈদ হয়ে ওঠে পরীক্ষার। মানুষের কাছে হাত পাতার কথা ভাবতে গিয়ে তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত।
অন্য দিকে সন্তানের ভরণপোষণের সামর্থ্য হারিয়ে গৃহবন্দী। এ-জাতীয় মানুষের সন্ধানে এগিয়ে আসা সময়ের অপরিহার্য দাবি। তাদের প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়ানোর মর্যাদা সর্বাধিক। এ মহান দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে আমাদের আনন্দও হবে সুদূরপরাহত। কোরবানির উদ্দেশ্যও হবে ম্লান। অনাবিল প্রশান্তির ছায়া থেকে আমরা হবো বঞ্চিত। করোনার দুর্যোগে ভালোবাসার পরশে এগিয়ে আসার সূবর্ণ সুযোগ আমাদের হাতের নাগালে। কোরবানির এ শুভলগ্নে অসহায়ের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টাই হোক আমাদের দৃঢ় প্রত্যয়।
শৈশবের বেড়ে ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে কোরবানির স্মৃতি আজো হৃদয়ে অম্লান। প্রতিযোগিতা চলে কার আগে কে যাবে গরু নিয়ে মাঠে। ইমাম সাহেব সিরিয়াল ঠিক করতে হিমশিম খেয়ে যান। দলবেঁধে সবাই একসাথে ধরে গরু শুইয়ে দেয় মাটিতে। কখনো বা জবাই শেষ হওয়ার আগেই এক লাফে পালায় গরু। সবাইকে ছাড়িয়ে জীবন বাঁচাতে দেয় দৌড়।
ভীতিকর এক অবস্থা। কে যাবে গরু ধরতে সবাই তো আনাড়ি। সাহস যার বেশি এগিয়ে যান তিনি। তাতেই ঘটে বিপদ। জবাইয়ের সময় ভয়ে গরু ছেড়ে দিলেই ঘটে বিপত্তি। আহত হয়ে হাসপাতালেও যেতে দেখা যায়। তবুও থেমে থাকে না নির্মল আনন্দের এ গতিধারা।
কোরবানির মাঠে সবাই একসাথে সহযোগিতার হাত বাড়ায়। চামড়া ছোলা থেকে গোশত কাটার কাজে ছোট-বড় সবাই অংশ নেয়। সারা বছর যারা শহরে থাকেন তারাও স্বাচ্ছন্দ্যে গোশত কাটার কাজে যোগ দেন। অপূর্ব অভাবনীয় আনন্দময় এক পরিবেশ বিরাজ করে কোরবানির মাঠে মাঠে। গোশত তিন ভাগ করে এক ভাগ রাখা হয় সামাজিক বণ্টনের অংশ হিসেবে। পড়ন্ত বিকেলে ধনী-গরিব সবাই একাকার হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন সামাজিক বণ্টনে অংশ নিতে। সামর্থ্য অসামর্থ্যরে কোনো পার্থক্য থাকে না সেখানে। সবচেয়ে দামি গরু কোরবানি করা ব্যক্তির ছেলে আর সমাজের অসহায় গরিব ছেলেটি একই কাতারে। কী এক অনুপম সাম্য সম্প্রীতির দৃশ্য! হৃদয় মন আন্দোলিত হয় এভাবেই। শত বছরের ঐতিহ্য সাম্যের নিদর্শন।
ঈদে কোরবানির গোশত খাওয়া এক ভিন্ন সংস্কৃতি। নানান স্বাদ, ঘ্রাণে মুখরিত পরিবেশে থাকে নানান রকমের রান্নার আয়োজন। এ-বাড়ি সে-বাড়ি ঘুরে ঘুরে খাওয়ায় এক পরম আনন্দ। পরিমাণের দিকে কোনো খেয়াল নেই। খুশির অনুভূতিই মুখ্য। কারো বাড়িতে না খেলে বেজায় মন খারাপ। খাওয়া আর খাওয়ানোর চলে প্রতিযোগিতা। যাদের গরুর গোশত খাওয়া নিষেধ তারাও বেমালুম ভুলে যান সব কিছু। কোরবানির গোশত খাওয়ায় কোনো ক্ষতি নেই। এ ভাবনা যেন চাউর হয়ে ওঠে। ডায়াবেটিসের রোগীরও সে দিকে খেয়াল থাকে না। বিশ্বাসে ভর করেই চলতে থাকে জীবন তরী।
কোরবানির ঈদের পড়ন্ত বিকেলে দীর্ঘ প্রতীক্ষা এক পশলা বৃষ্টির। রক্তময় মাঠঘাট ধুয়ে মুছে নির্মল করে তোলে বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা। প্রবল বর্ষণে প্রকৃতি ফিরে পায় সজীবতা। মানুষের মনে ফিরে আসে স্বস্তির নিঃশ্বাস।
কোরবানি যেমন হৃদয়কে কলুষমুক্ত করে তেমনি বৃষ্টির প্রবলধারায় প্রকৃতিও প্রাণান্ত রূপে ধরা দেয়। কিশোর যুবারা দলবেঁধে খেলায় মেতে ওঠে। বিবাহিত ও অবিবাহিত দু’ভাবে ভাগ হয়ে ফুটবল, ক্রিকেট খেলতে দেখা যায়। উন্মুক্ত মাঠে খেলা হয়ে ওঠে সবার উপভোগ্য। টান টান উত্তেজনা। মনের অজান্তেই সবাই কারো না কারো সমর্থক হয়ে যায়। হারজিত খেলার চিরায়ত রীতি হলেও মাঠে চলে বিজয়ের লড়াই। সবশেষে হয় পুরস্কার বিতরণের আয়োজন। ঈদে যোগ হয় ভিন্ন রকম আনন্দ-উৎসবের। ভাববিনিময়ের এ এক মিলনমেলা।
কোরবানি ইতিহাস প্রায় চার হাজার বছর পুরনো। ইবরাহিম আ:-এর হৃদয় গভীর ভালোবাসা ত্যাগের মহিমায় দীপ্যমান। বৃদ্ধ বয়সে নিরাশার অন্ধকারে আলোর বিচ্ছুরণ। শিশুপুত্র ইসমাইলের আবির্ভাব। হাজেরার মাতৃক্রোড় আলোকিত।
মা-বাবার আদর-সোহাগে বেড়ে ওঠে শিশু। হঠাৎ নির্দেশ আসে মা ও দুই বছরের শিশুকে নির্জন তপ্ত মরুভূমিতে রেখে আসার। স্রষ্টার প্রতি গভীর ভালোবাসায় তাদের রেখে দেয়া হয় খাবার-পানিবিহীন মরুপ্রান্তরে। হাজেরা পিপাসার্ত শিশুর তৃষ্ণা নিবারণে ছুটে বেড়ান সাফা ও মারওয়ার পাদদেশে। এক ফোঁটা পানির খোঁজে। মাতৃহৃদয় পাগলের মতো ছটফট করতে থাকে। একপর্যায়ে শিশুর পদচিহ্নে প্রবহমান ঝরনাধারা দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়েন। জমজম কূপের সেই স্মৃতিময় ঝরনাধারা আজো মুসলিম বিশ্বের কাক্সিক্ষত পবিত্র পানীয়।
কালের পরিক্রমায় পিতাপুত্র মহান আল্লাহর ইবাদতে মশগুল। আবারো পরীক্ষার পালা। এলো শিশুপুত্রকে কোরবানির নির্দেশ। একমাত্র কলিজার টুকরো সন্তানকে কোরবানির আদেশে হৃদয় কেঁপে ওঠে। স্রষ্টার কী অপার মহিমা! যেমন পিতা তেমন পুত্র। একবাক্যে রাজি হয়ে যান মাত্র ৮-১০ বছরের শিশু ইসমাইল। বলে ওঠেন, আল্লাহ যদি সন্তুষ্ট হন তা হলে আমার জীবন সার্থক। নেই কোনো ভাবনা চিন্তা। মিনার প্রান্তরে পুত্রকে নিজ হাতে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোরবানি দিতে প্রস্তুত পিতা। পৃথিবীতে বোধহয় এর চেয়ে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটেনি। জীবন যার দান সবই তার হাতে নিবেদিত সমর্পিত। পিতা চোখ বেঁধে চালালেন ধারালো ছুরি। জবাই শেষ করলেন মহান রবের তরে। চোখ খুলে পাশে তাকিয়ে দেখেন শিশুপুত্র হাসছে আনন্দের হাসি। কবুল হয়ে গেল কোরবানি। মানবেতিহাসে এক নতুন ধারায় প্রচলন হয় কোরবানির। তা না হলে পৃথিবীতে কোরবানির ইতিহাস কী হতো, ভাবতে গেলে অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে।
কোরবানি মহান সত্তার ভালোবাসা লাভে ধন্য হওয়ার উপায়। নৈকট্য লাভের সুবর্ণ সুযোগ। পশু কোরবানির প্রতীকে হৃদয়ের সব পঙ্কিলতা লোভ লালসা ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়। অপার্থিব এক আনন্দময় অনুভূতির সঞ্চার হয়। কোরবানির গোশত আমরা নিজেরাই খেয়ে থাকি প্রাণভরে। যাঁর নির্দেশে কোরবানি, তাঁর কাছে পৌঁছে শুধু হৃদয়ের আবেগ আকুতি। আত্মসমর্পণ নিজেকে সঁপে দেয়ার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। মননের ঐকান্তিকতার মাপমাঠিতে নির্ণিত হয় এর প্রতিদানও। কার পশু কত দামি মানদণ্ড তা নয়। অন্তরের সমর্পণ নিবেদন কতটা ত্যাগের তাই প্রকৃত মাপকাঠি। আল কুরআনের ভাষায়, ‘আল্লাহ তায়ালার কাছে কখনো কোরবানির গোশত ও রক্ত পৌঁছায় না। বরং তাঁর কাছে তোমাদের তাকওয়াটুকুই পৌঁছায়। (সূরা আল হাজ্জ, আয়াত ৩৭)
কোরবানি মহান রবের প্রতি আত্মসমর্পণের এক অনুপম নিদর্শন। আমাদের নামাজ-কোরবানি জীবন-মরণ সবই তাঁর উদ্দেশ্যে নিবেদিত। মানুষের চূড়ান্ত ঠিকানা তাঁরই কাছে। অসহায় মানুষের মধ্যে গোশত বিতরণের আনন্দ মননের শিরা উপশিরায় সঞ্চারিত হয়। হৃদয় মন নেচে ওঠে। পার্থিব কোনো আনন্দ এর সাথে তুলনীয় নয়। অনুভব স্মৃতি সহমর্মিতা ঔদার্যে এর সৌন্দর্য সর্বোচ্চ শিখরে। আকাশের বিশালতা সাগরের গভীরতা চাঁদের স্নিগ্ধতার মতো হৃদয় মন ভরিয়ে তোলে। প্রতিটি দিন হয়ে উঠুক কোরবানির ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর। তবেই পৃথিবী হবে সুন্দর জীবন হবে আনন্দময়। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement