২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

এরই নাম কোরবানি

-

বারান্দা থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম বড় ভাইজানের বাইর দরজা থেকে ফিরে যাওয়া ভ্যানটিকে। উপরে উপবিষ্ট একজন হুজুর গোছের লোক সাথে ক’টা সাদা বস্তা। বুঝতে আর বাকি থাকেনি এ দৃশ্য গত বছরেও দেখেছি তবে সেবার ভাইজান বিনয়ের সাথে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন প্যাকেটটি তালিকাহীন অন্য আরেকজনের নাম বলে দিয়ে। অন্যের প্রয়োজনটাই ভাইজানের কাছে বেশি বড়। আর এভাবে দেখাটাই ভাইজানের স্বভাব।
জানি না ভাইজান কী করে কোথায় যায়! সারা দিন শুধু ব্যস্ততা আর ব্যস্ততা। কার বাড়িতে খাবার নেই, কার উনুনে আগুন জ্বলেনি, কে বেকার হয়ে ঘরে বসা, কোন বাড়িতে করোনা ঢুকেছে এ নিয়েই অনুসন্ধান-পর্যবেক্ষণ। মাঝে মধ্যে ফুড প্যাকেট বা দৈনন্দিন গৃহসামগ্রী, কাপড়-বস্ত্র, টাকাকড়ি ইত্যাদি সংগ্রহ ও বিতরণÑ এই হলো আমার শিক্ষক ভাইটির ইদানীংকার কাজ। বিশ্ব-অতিমারীতে পৃথিবী থমকে গেছে, যায়নি শুধু আমার ভাইজানের মতো কিছু পাগলপারা মানুষের অনন্ত ব্যস্ততা! এরা নিজের খেয়ে পরের গায়। সারা রাত কুরআন পাঠ আর নামাজে কাটায় আর দিনের বেলায় জনহিতকর কাজে ছুটে বেড়ায়। রমজান আর জিলহজ মাস এলে তো এঁদের অন্য রকম ঈদ শুরু হয়ে যায়। ইবাদতের ঈদ। কোমড় বেঁধে লেগে যায়। রোজা পালনসহ বিভিন্ন দোয়া জিকিরে মশগুল আবার সে সাথে ইত্যাদি জনসেবায় সময় দান। এবার দেখলাম আমার ছেলে দুটোকে নিয়ে ভাইজান তাকবির, তাহলিল, তাহমিদ অর্থাৎ আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, সুবহানাল্লাহ প্রভৃতি শব্দ শেখাচ্ছেন।
ঈদুল আজহা। আরবি জিলহজ মাসের দশম দিন। এ মাসেই হজ করতে হয় আর কোরবানি হজেরই একটি অঙ্গ। এমনি বিশ্বাসে মুসলিম সম্প্রদায়ের এক অন্যতম দিবস এটি। ছোটবেলায় শুনেছিলাম নবী ইবরাহিম আ:-এর জীবনের নানাবিধ পরীক্ষার মধ্যে কোরবানি ছিল অন্যতম এক পরীক্ষা। আল্লাহর হুকুমে সবচেয়ে প্রিয়মুখ বৃদ্ধ বয়সে পাওয়া সন্তান ইসমাইল আ:-কে উৎসর্গ করতে গিয়েই ঘটে যায় এক কাহিনীÑ যা আল্লাহ তায়ালা কবুল করেছেন পশু কোরবানির বিনিময়ে। আর সে থেকেই পালিত হয়ে আসছে কোরবানির এই প্রচলন। এর মূল উদ্দেশ্য প্রচলিত সব শিরককে প্রতিহত করা বা শেরেকি ধারণার মূলোৎপাটন করা। খুব ভালো করে জানতে চাইনি কখনো যদিও ভাইজান বলেছিল কয়েকটি সূরার নাম যেখানে হজ ও কোরবানিসংক্রান্ত আয়াত নাজিল হয়েছে যেমন সূরা আল-বাকারা, আলহজ; সেগুলো একটু পড়ে দেখতে। এমনকি হজ ও কোরবানিসংক্রান্ত দু-একটি বইও হাতে তুলে দিয়েছিলেন নিজ জ্ঞানে বুঝে নিতে। কী হবে অতশত বুঝে? এই তো চলছি বেশ! এমনি দায়িত্বহীন ভাবনা ছিল আমার।
ভ্যানটি উঠে গেল বড় রাস্তায়। মোড় নেয়া থেকেই বোঝা গেল যাচ্ছে দক্ষিণ পাড়ায়। ও পাড়ায় এবার একটি কোরবানিও হয়নি। পুরো গ্রামের মধ্যে আমাদের এ এলাকাতে আগে থেকেই কোরবানি দেয়ার মতো সামর্থ্যবান পরিবার হাতেগোনা ক’টি মাত্র। তবু অনেকেই স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে বছরের একটি ইবাদত মনে করে শরিকি ভাগে অংশ নিয়ে তৃপ্তি পেত; কিন্তু এ দুই বছর কী হয়ে গেল। ভাইজানের মতো মানুষটিও কোরবানি করা থেকে বিরত। যে নাকি পারলে পুরো গোশতটাই বিলিয়ে দিয়ে শান্তি পেত। আমার অবশ্য এসবে অত মাথাব্যথা নেই। কিসের আবার কোরবানি? গোশত খেতে ইচ্ছা করলে বাজার থেকেই তো কিনে আনা যায়! কিন্তু বৌকে তা বুঝতে না দিয়ে বরং খুশিমনে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দিই; সেও খুশি আমিও দায়মুক্ত। কিন্তু এবার লকডাউনে সব বন্ধ! ট্রেন নেই, বাস নেই, বৌ-বাচ্চাদেরও যাওয়া নেই। দেখলাম সকাল থেকেই মুখ গোমড়া করে আছে বৌ। আগের দিনের কেনা মুরগিটা রান্না হয়েছে যদিও এখনো খাওয়া হয়নি। ছেলে দুটো খেয়েছে কি না তাও জানি না। সারা দিন ঘুমিয়েই কাটালাম। আড়মোড়া ভাঙতেই বারান্দায় এসেছিলাম।
গতবারেও ঠিক আসরের এ সময়েই ভ্যানটি এসেছিল। এর কিছুক্ষণ আগেই ভাইজান বাড়ি ফিরেছেন। তার তাকবির ধ্বনি শোনা থেকেই বোঝা যায় কখন বেরিয়েছিলেন আর কখন এলেন। উচ্চৈঃস্বরে তাকবির ধ্বনি দেয়া ভাইজানের অভ্যাস। পুরুষের জন্যই নাকি এমনি বিধান। নামাজের সময় অর্থাৎ ঈদগাহে যেতে যেতে আমাকেও ডেকেছিলেন। শুনলেও ঘুমের ভান করে পড়েছিলাম। কী হবে ওই এক দিন নামাজ পড়ে? আমি তো নামাজে উৎসাহী না! বাবা বেঁচে আছে? মা বেঁচে আছে? কই তাদের নামাজ তো অকাল মৃত্যু ঠেকাতে পারল না!
তার ওপর আবার কোরবানির চিন্তা! ইসলামের এ বিষয়টি যেন একটু বেশিই বাড়াবাড়ি। অহেতুক একই দিনে কতগুলো পশুর জীবন খোয়ানো, রক্তের বন্যায় জমিন ভাসিয়ে ফেলা, পরিবেশ দূষিত করা ছাড়া আর কী! একবার একটি নিউজ রিপোর্ট হলোÑ জনৈক শিশু পশু জবাই দেখে হার্টফেল করেছে। জনৈক কোরবানিদাতা সওয়াবের আশায় নিজ হাতে কোরবানি দিতে গিয়ে গরুর গুঁতোয় নিজেই কোরবানি হয়েছে। এ রকম আরো কত মুখরোচক খবর। আরো শোনা গেছে ঢাকা শহরে ঈদুল আজহায় পথের ভিক্ষুকও বিত্তবান হয়ে ওঠে। ওরা নাকি সারা দিন গোশত সংগ্রহ করে রাজপথে সব বিক্রি করে দেয়। ওদের প্রয়োজন অর্থ। আরে তা হলে কোরবানি না করে বরং ওই টাকাই বিলিয়ে দে সবে ফকির মিসকিনকে। তা হলেই তো পরিবেশটাও বেঁচে যায়, গরিবের লোভও মিটে যায়! পুরনো ভাবনাগুলো এমনিভাবেই মনে পড়ছিল আমার।
এরই মধ্যে ছোট ছেলেটির সাগ্রহ খবর পৌঁছানোর কাজটি হয়ে গেছে। Ñবাবা জানো! জেঠুজির ঘরে একটি লোক এসে এক টোপলা গোশত দিয়ে গেছে। জেঠিমা বলেছে, এটি কোরবানির গোশত। ধরতে নেই। জেঠু এসে যা করার করবে। বাবা আমাদের ঘরে কেন দিয়ে গেল না!
ছেলের কথা ছেলে বলে গেল আমি ভাবছি অন্য বিষয়। ঈদুল আজহা বা রমজান এলেই ভাইজানের ব্যস্ততা বেড়ে যায় দ্বিগুণ-ত্রিগুণ। বেসরকারি স্কুলের বেতন আর কতই। ছাত্র পড়িয়ে কিছুটা সঙ্কুলান করেন। আর ওটিই তার রুজির প্রধান উৎস যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিনা পারিশ্রমিকেই ছাত্রদেরে পড়িয়ে উৎসাহিত করতেন। অথচ এখন এই মহামারীতে সেটিও বন্ধ। তার ওপর আমার বেকারত্ব। আমার চারজনের সংসার টানা। সবই করে যাচ্ছেন নিঃসন্তান ভাই-ভাবী হাসিমুখে। ভাবীটিও যেন পয়মন্ত বৌ এক। কোনো কিছুতেই নেই কোনো চাহিদা, নেই কোনো অভিযোগ। বাবা যখন হঠাৎ অকালে পরপারে চলে যান, আমি তখনো স্কুলের চৌহদ্দি পেরোইনি। এই ভাই-ভাবীই ধরলেন হাল। ছোটবেলাতেই মা হারা আমি নাকি ভাইজানের ১৬ বছর পর জন্মেছিলাম। সময় হওয়ার আগেই শখ করে ভাইজানকে সংসার ধরিয়ে দিয়েছিল বাবা-মা। সেই ভাই-ভাবীই আমাকে সন্তানসম করে গড়ে তোলেন। স্থানীয় কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করতেই জীবিকার খোঁজে বেরিয়ে পড়েছিলাম। রাজধানীতে গিয়ে একটা পত্রিকা অফিসে ছোটখাটো একটি চাকরিও জুটিয়ে নিই। সময়মতো বিয়েও করেছি। আল্লাহ দুটো ছেলেসন্তানও আমাকে দিয়েছেন। কিন্তু দেননি শুধু একটি বিষয়; ভাইজানকে অনুসরণ! ভাইজানের মতো নামাজি হতে পারলাম না। পারলাম না মুত্তাকি হয়ে উঠতে। ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হতেÑ এমনকি সত্যনিষ্ঠ জীবনযাপনও করতে। ওই সততার অভাবেই এক দিন চাকরিটাও গেল। অথচ ওই পত্রিকাতে কাজ করে করেই আমি ধর্মের প্রতি দিন দিন বিতৃষ্ণ হয়ে উঠেছিলাম।
হঠাৎ আমার নামধরে ডাক শুনে ফিরে তাকালাম। আমাদের ভেতর-বারান্দায় দাঁড়ানো ভাইজান। ছেলেরা সমস্বরে চিৎকার করছে : জেঠুজি গোশত নিয়ে এসেছে। তাকিয়ে দেখলাম মুখবাঁধা গোটা প্যাকেটটাই। তার মানে? আমার প্রশ্নবিদ্ধ চাউনিতে ভাইজান নিজেই ব্যাখ্যা করলেন : এই কোভিডে যারা ভুক্তভোগী অর্থাৎ বেকার, রোগাক্রান্ত এমনকি কোরবানি দিতে অসমর্থ হয়ে পড়েছে, তাদের জন্য আমাদের সংগঠনের বিত্তবানরা কোরবানির একটি বড় অংশ বণ্টনের জন্য দিয়ে দিয়েছেন। যেখানে আমার নামের সাথে তোর নামটিও তালিকাভুক্ত করেছিল তারা। কিন্তু আমি আমার প্যাকেটটা অন্য কাউকে দিতে বলে দিয়েছি গতবারের মতোই। এটি তোর প্রাপ্য। নাও বৌমণি রান্না করে নাও তাড়াতাড়ি। বলেই আমার বৌর হাতে তুলে দিলেন প্যাকেটটি।
‘এরই নাম কোরবানি!’ মনে পড়ে গেল এই শিরোনামে একটি লেখা এসেছিল পত্রিকা অফিসে। ত্যাগ-তিতিক্ষার এক অতুলনীয় বর্ণনা। কিন্তু লেখাটি ছাপিনি বরং বিকৃত করে নিজস্ব উষ্মাজনিত মতামত ঢুকিয়ে নতুন বানিয়ে ছদ্মনামে চালিয়ে দিয়েছিলাম। সে লেখাটির জন্য একটি ভালো সম্মানীও পেয়েছিলাম মনে আছে। কারণ ধর্মবিরোধী লেখার কাটতি বেশি!
পাল্টা প্রশ্ন করলাম : সারা দিন কোথায় ছিলে? সহাস্যে ভাই আমার বললেন : আজ আমাদের ‘ফুডপ্যাকেট’ বিতরণ কর্মসূচি ছিল। এ জন্য আমরা ক’জন মিলে এলাকা ভাগ করে নিয়ে কোরবানির গোশত ও আগেই সংগৃহীত তেল, মসলা, পেঁয়াজ-রসুন-আদা প্রভৃতির একটি করে প্যাকেট বানিয়ে তালিকানুযায়ী বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিতরণ করে এসেছি, যাতে সবার ঘরে ঈদের আনন্দ পরিপূর্ণ হয় রে! এ জন্যই এ ক’দিন খুব ব্যস্তও ছিলাম রে! ইদানীং তোর খোঁজখবরও নিতে পারিনি। এখন তোর শরীরটা কেমন আছে। মাত্রই করোনার আক্রমণ থেকে মুক্তি পাওয়া আমার শরীরের দুর্বলতা কাটেনি যদিও তবু নিজের কথা ভুলে গেলাম মুহূর্তে। এ মুহূর্তে আমার পিতৃতুল্য ত্যাগী ভাইটির কথাই হৃদয়ে জাগ্রত।
নিজে না খেয়ে না রেঁধে প্রায় নাস্তিক এ ভাইটির জন্য রেখে গেল সবটা? মনে পড়ে ভাইজানের মুখেই শুনেছিলাম; ‘আল্লাহ তায়ালা রক্ত চান না, গোশত চান না, চান তাকওয়া’। তবে কি এই সেই তাকওয়া? অন্যের কষ্টে দরদি হওয়া, অন্যের জন্য নিজকে বিলিয়ে দেয়া? জীবনের পরতে পরতে শুধু ত্যাগই করে গেলেন তিনি। এটিই তো কোরবানি! ছিঃ এঁদের বিরুদ্ধেই কিনা আমি কলম চালিয়েছি এদ্দিন। লজ্জায় অপমানে মাথাটা নুয়ে এলো। ভাইজান যেতে যেতে তাকবির ধ্বনি দিচ্ছিলেন। ভাইজানের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আমার বিবেক কণ্ঠে বেজে উঠল : আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার ওয়াল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ! হ

 


আরো সংবাদ



premium cement