২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

বৃষ্টিদিনের গান

-

বৃষ্টি এল কাশবনে,
জাগল সাড়া ঘাসবনে,
বকের সারি কোথা রে,
লুকিয়ে গেল বাঁশবনে।
কবি ফররুখের এই কথা থেকে দারুণ এক র্বষার চিত্র ভেসে ওঠে। সে সাথে আশ্চর্য হই- বকেরা লুকিয়ে যায়! এটা তো জানতাম না! ও- যাবে না কেন? তারা তো মানবশিশু না! মানবশিশুই বৃষ্টি দেখলে মাতোয়ারা হয়। দলবেঁধে নেমে যায় বৃষ্টিতে। ফুটবল নিয়ে নেমে যায় বাবা-মার চোখ ফাঁকি দিয়ে। দূর্বাভরা মাঠের ওপর চিকচিক পানি। বল গিয়ে পড়লেই, আহা দারুণ দৃশ্য। এই দৃশ্য এখনো বৃষ্টি এসে মনে করে দেয়। কত খেলেছি! স্মৃতির চোখও তৃপ্তি পায়।
ছোট্ট মেয়েরাও বসে থাকে না। তারা চাড়া দিয়ে এক্কাদুক্কা খেলতে থাকে। কখনো দু’জন তিনজন, কখনো দলবেঁধে। বাইরে রিমঝিম বৃষ্টি, কখনো মুষলধারায়। এ সময় একসাথে খেলার মজাই আলাদা। এ তো গেল দুয়েকটা খেলার নাম। আরো কত্ত খেলা আছে!
ছোট্ট মেয়েরাও বৃষ্টিতে ভেজে। ভেজে মা বাবাকে না জানিয়ে। ভেজে ওঠে মনের আনন্দে। সানন্দে আম জাম সংগ্রহ করে। কোরছা ভর্তি জাম নিয়ে ঘরে ফেরে। আমার স্নেহের ছোট বোন। কয়ছিলি! বলার আগেই যেন বলত, ভাইয়া নেন জাম। আহা! কী দারুণ বিষয়। এই জাম কত যে টাটকা সুস্বাদু- বলে শেষ করা যাবে না। কখনো ফুল সংগ্রহ করে আনন্দ পায় মেয়েরা। কখনো মা-চাচির সাথে নকশি কাঁথা সেলাই দেখে। এইগুলো প্রত্যন্ত অঞ্চল বা হাওরের গ্রামের বর্ষরা চিত্র। এখনো আছে!
বৃষ্টি শেষ হলে ক্ষেতে মাঠে পানি জমে থাকে। সে পানি আল কেটে ছেড়ে দিলে ছোট ছোট মাছ উজাইয়া ওঠে। এই মাছ ধরার জন্যও গাঁয়ের শিশুরা ওঠেপড়ে লাগে। নেমে পড়ে ছোট্ট মেয়েরাও। এসব মাছ ধরা খুবই আনন্দের। আমিও কত ধরেছি! সে কথা এভাবেই বলতে হয়Ñ
সত্য বলি মুখ দিয়া
বিষ্টি গেলো সুখ দিয়া
হাঁটু পানি খাল দিয়া
পুঁটি ছুটে ফাল দিয়া
গ্রামের বৃষ্টি সুখ দিলেও শহর এর সম্পূর্ণ বিপরীত। শিশুরা বের হতে পারে না রাস্তায়। নামবেইবা কিভাবে! কোমর বা বুক পানি হয়ে যায়। মেনহোল থাকে খোলা। হঠাৎ সেখানে পড়ে অতলে হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা বেশি। সেই সাথে বিভিন্ন ময়লাযুক্ত পানি খলবল করে। শহুরে বাবা-মা সারাক্ষণ শিশুদের চোখে চোখে রাখে। উন্মুক্ত জায়গাও নেই। ফলে বাসাতেই বন্দী। চার দেয়ালে বন্ধিত্বই শহুরে শিশুর জীবন। কখনো গ্রামের দাদু নানু বাড়িতে গেলে আনন্দ পায়। আর যদি বৃষ্টি পায় তা হলে তো কথাই নেই। সে কথা মনে করে জানালা দিয়ে একটু হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছোঁয়। কখনো জানালা বা বেলকনিতে গিয়ে বৃষ্টি দেখে। এভাবে বৃষ্টিকে দেখা ছাড়া কোনো গতি নেই। এ কথাই কবি জাকির আবু জাফর বলেছেন এভাবেÑ
বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থেকে বৃষ্টি দেখি
হঠাৎ স্মৃতি আনল তুলে গাঁয়ের কথা
শীতল পানির ঝর্ণা ঝরে বন বাদাড়ে
বৃষ্টি ভারে নুইয়ে পড়ে স্বর্ণলতা।
হ্যাঁ, গায়ের কথা মনে হলেই দৃষ্টি বৃষ্টিমুখর গাঁয়ে চলে যায়! রিমঝিম বৃষ্টির মিষ্টিমাখা সুর শুনতে কার না ভালো লাগে। বর্ষার দিনে টিনের চালে ঝাপুর ঝুপুর, গাছের ডালে টাপুর টুপুর, পুকুর জলে রিনিঝিনি বৃষ্টির ছন্দে উদাস হয় মন। বৃষ্টি ঝরে হাটে-মাঠে-নদী ও পাহাড়ে। প্রাণ ফিরে পায় প্রকৃতি। হেসে ওঠে সবুজরঙা গাছপালা, ডেকে ওঠে কোলাব্যাঙ, পুকুর জলে টুপ টুপ ডুব দিয়ে আনন্দে খেলা করে হাঁসের ছানা। মাছেরা ছুটে বেড়ায় বৃষ্টির নতুন পানিতে। জেলেরা জাল ফেলে নদীতে হাওরে। জাল ভরে উঠে আসে রূপালি মাছ। পুকুর পাড়ে কদম গাছে ফুটে থাকে কদম ফুল। টইটম্বুর পানিতে ঢেউ ওঠে ছলাৎ ছলাৎ। চারিদিকে থইথই পানি। যেন নতুন সমুদ্র! দুষ্টু ছেলেরা কলাগাছ কেটে ভেলা বানায়। কলার ভেলায় চড়ে আনন্দে মেতে ওঠে। ঝাঁপ দেয় পানিতে, ডুব সাঁতারে হার মানায় পানকৌড়িকেও। আহা, কলার ভেলা কত চড়েছি! কেউ কেউ গাছে চড়ে লাফ দেয় দীঘির পানিতে। বড়দের শাসানি পেয়ে বাড়ি ফেরে অবশেষে। রাস্তাঘাট কাদায় স্যাঁতসেঁতে হওয়ায় অকারণে বাড়ির বাইরে যাওয়া হয় না কখনো। ঘরের দাওয়ায় বসে বৃষ্টির ঝরে পড়া দেখতে বেশ ভালোই লাগে। এ সময় দাদিরা গল্পের ঝুলি খোলেন। বিকেলে চায়ের গরম ভাপের সাথে চালভাজা ও মুড়ি-মুড়কির প্রচলন আছে গ্রামাঞ্চলে। গ্রামের মতো শহরে বর্ষার সৌন্দর্য খুব একটা ফুটে ওঠে না। তবুও ইট-পাথরে ঘেরা শহুরে ছাদে উঠে বৃষ্টির ছোঁয়ায় আনন্দ পায় শিশু। শহর শিশু ঠাডা বা বজ্রের সময় দৌড়ে বাসায় চলে আসে। গ্রামের শিশুও এখন এই বিষয়টা যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। সাদাকালো মেঘের ঘনত্ব দেখলেই একে অপরকে বলে- চল বাড়ি যায়! তখন এক দৌড়ে বাড়ি ফিরে আসে।


আরো সংবাদ



premium cement