২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ঈদ ও ঈদের সৌন্দর্য

-

মহান রাব্বুল আলামিনের সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ প্রতিটি মানুষের অন্তরিন্দ্রীয় বা হৃদয় নামক একটি রাজ্য আছে। যাকে মনোরাজ্যও বলা যায়। আর এই মনোরাজ্যের দুয়ারগুলো সর্বক্ষণ থাকে উন্মুক্ত। ফলে বিচিত্রধর্মী ভাবনা কিংবা চিন্তাগুলো মনোরাজ্যের অভ্যন্তরে অবাধে যাতায়াত করতে পারে। বিস্মৃতির অন্ধকার থেকে ভাবনা কিংবা চিন্তাগুলো চেতনার আলোকে, আবার চেতনার আলোক থেকে বিস্মৃতির অন্ধকারে বিরামহীনভাবে চলাচল করে মনোরাজ্যের সর্বত্র। আর এ জন্য মনোরাজ্যকে রঙ্গমঞ্চের সঙ্গেও তুলনা করা যায়। রঙ্গমঞ্চে অভিনেতা অভিনেত্রীরা যেমন আসা-যাওয়া করে ঠিক তেমনি ভাবনা কিংবা চিন্তাগুলো আসা-যাওয়া করে। তবে একে ভাব ও ভাবনার কিংবা চিন্তার রঙ্গমঞ্চ ভাবাই শ্রেয়। ভাব রাজ্যের এই রঙ্গমঞ্চে ভাবনা-চিন্তার আসা-যাওয়ার শেষ নেই। অবিরাম আসা-যাওয়ায় রত ভাব, ভাবনা ও চিন্তার রয়েছে বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক দিক। যার একটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অর্থাৎ যাকে বলা যায় প্রকাশ্য। আর অপরটি হচ্ছে অপ্রকাশ্য বা অইন্দ্রিয়জ। জাগতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ভাবনাগুলোই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা প্রকাশ্য। আর জাগতিক কর্মকাণ্ডের বাইরের আধ্যাত্মিক জগতের সঙ্গে জড়িত ভাবনা কিংবা ভাবগুলো অইন্দ্রিয়জ বা অপ্রকাশ্য। জাগতিক ও আধ্যাত্মিক উভয় জগতেই মানুষের যে বিচরণ তার সঙ্গে আল্লাহর আদেশ-নির্দেশ পালনের একটি সম্পর্ক রয়েছে। যারা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী তাদের বেশির ভাগই এই আদেশ-নির্দেশ মেনে জাগতিক ও আধ্যাত্মিক কাজকর্ম করে থাকেন। তারা আল্লাহকে ভয় করেন বলেই এভাবে কাজকর্ম করেন। আর এই ভয়ের অর্থই হলো জাহান্নামের ভয়। আল্লাহ বলেছেনÑ ‘জাহান্নাম সেই ব্যক্তিকে ডাকিবে যে সত্য হইতে পলায়ন করিয়াছিল ও মুখ ফিরাইয়া লইয়াছিল। যে সম্পদ পুঞ্জীভূত করিত এবং উহা আঁকড়াইয়া ধরিয়া রাখিত। তবে তাহারা নয়, যাহারা সালাত আদায় করে, যাহারা তাহাদিগের সালাতে নিষ্ঠাবান, যাহারা তাহাদিগের প্রতিপালকের শাস্তি সম্পর্কে ভীতসন্ত্রস্ত’ (সূরা মা’আরিজ, আয়াত-১৭, ১৮, ২২, ২৩ ও ২৭)। সহিহ তিরমিজিতে (৪১৩) বলা হয়েছেÑ কিয়ামতের দিন বান্দাসমূহের মধ্যে সর্বপ্রথম নামাজের হিসাব নেয়া হবে। কুরআন ও হাদিসে এরূপ ভয়ের কথা বহুবার বহুভাবে উচ্চারিত হয়েছে। আর এসব জয়ের কথা ভেবেই ইসলামী জগতের মানুষ আল্লাহর আদেশ-নির্দেশ পালন করে থাকেন। যার কিছু দৃশ্যমান, কিছু অদৃশ্যমান অর্থাৎ আধ্যাত্মিক।
অদৃশ্যমান আধ্যাত্মিক জগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মাহে রমজান ও ঈদ। রমজান ও ঈদের গুরুত্বপূর্ণ অংশ আধ্যাত্মিক হলেও এর রয়েছে দৃষ্টিগ্রাহ্য দিকও। অর্থাৎ দর্শনীয় পবিত্র সৌন্দর্যের দিক। যেমন ভাবগম্ভীর পরিবেশে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে মসজিদে গমন, সালাত বা নামাজ আদায়, রোজা শেষে ইফতার করা, রাত জেগে তারাবিহ নামাজসহ নানাবিধ ইবাদত করা, গরিবের মাঝে জাকাত প্রদান করা ইত্যাদি। ছোটবেলায় মা-বাবা ও আত্মীয়স্বজনদের রমজানের এই অধ্যাত্ম সাধনায় অংশগ্রহণ করতে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। বড়দের রোজা রাখতে দেখে আমিও মাঝে মাঝে রোজা রেখেছি মা-বাবার নিষেধ সত্ত্বেও। বলতেন এত ছোট বয়সে রোজা রাখতে পারবে না। কিন্তু তার পরও রেখেছি। সে এক মহা আনন্দের বিষয়। রোজা রাখার বয়স নয়, তবুও রেখেছি। কেন রেখেছি, কোন ভাবনা চিন্তা মগ্ন হয়ে রেখেছি তার বিনাশ না হলেও আজ আর খুঁটিনাটি বিষয়গুলো স্পষ্ট নয়। সব কিছু মনোরাজ্যের বিস্মৃতির অন্ধকারে থাকলেও সেগুলোকে চেতনার আলোকে আনতে অতীত স্মৃতির রোমন্থনের ওপর নির্ভর করতে হবে। অতীত স্মৃতির অন্ধকারে কিংবা বলা যায় অন্তজ্ঞানিক প্রদেশের অলক্ষ্যে কত কর্ম, কত ভাবনা যে লুকিয়ে আছে তার হিসাব দেয়া আজ আর সম্ভব নয়। শৈশবের সোনালি দিনগুলোতে মা-বাবার আদর স্নেহে যা ভেবেছি কিংবা যা যা করেছি তার সব কিছু স্মরণ করা সম্ভব না হলেও মাহে রমজান, রোজা, নামাজ, তারাবিহ ও ঈদের কথা স্মরণে আছে। কারণ এখনো সেগুলো পালন করতে হয়।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে (নাটোরের চকবড়াইগ্রামে) আটকা পড়ে যাই। সে সময় আমি বিএফএ চূড়ান্ত পরীক্ষার পরীক্ষার্থী। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের কারণে পরীক্ষা বন্ধ। ফলে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাটিক মাধ্যমে বাংলাদেশের পতাকা তৈরিতে মনোনিবেশ করলাম। বৃহৎ সবুজ ভূমিতে লাল সূর্যের মাঝে বাংলাদেশের চিত্র হলুদ রঙে রাঙিয়ে তুললাম। হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের ভয়ে সে পতাকা প্রকাশ্যে নিয়ে আসা সম্ভব হলো না। দেশ স্বাধীন হলে সেই পতাকা ওড়ানো হলো বাড়ির আঙ্গিনায়। এ ছাড়া প্রতি বছর ঈদের দিনে ওড়ানো হতো ঈদগাহ ময়দানে। আমাদের বাড়ির অনতি দূরেই ঈদগাহ ময়দান। রমজানের রোজা শেষে ঈদের খুশির দিনটির জন্য ছোটবেলায় পাড়ার সবাই আমরা অপেক্ষা করতাম। ঈদের দিন সকালে নানা রঙের রঙিন কাগজের ঝালোড় দিয়ে সাজানো হতো ঈদগাহ ময়দানকে। ঈদের দিন সকালবেলা আমাদের বাড়িতে রক্ষিত চটের দীর্ঘ মাদুর ও কাপড় নিয়ে গিয়ে ঈদগাহ ময়দানে বিছানো হতো মুসল্লিদের জন্য। ওড়ানো হতো পতাকা। শুধু ঈদগাহ সাজানো নয়, আমরা পাড়ার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও সাজতাম নতুন পোশাক ও কাগজের তৈরি রঙিন টুপির সাহায্যে। দলবেঁধে হইচই করতাম আনন্দ প্রকাশের উদ্দেশ্যে। নামাজের সময় হলে বাবার হাত ধরে ঈদের জামাতে শামিল হতাম নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে। মাঠে যাওয়ার পূর্বে দুধ-চিনি-সহযোগে মায়ের তৈরি মিষ্টি খেতাম মন ভরে। সেই ছোটবেলার আনন্দের অনুভূতিগুলো আজও মনের চেতনার আলোকে আলোকিত রাজ্যে জ্বলজ্বল করে। আজ সেগুলো শুধুই স্মৃতি। বাবাও নেই মাও নেই, সেই সুন্দর ঈদগাহে যাওয়াও নেই। যা আছে তা শুধুই স্মৃতি। আজ সেই সুন্দর গ্রামীণ স্মৃতিময় পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঢাকায় বসবাস। এখানে দালান কোঠার সুন্দর পরিপাটি পরিবেশে নেই সেই খোলামেলা গ্রামীণ পরিবেশের সৌন্দর্য। নেই ঈদগাহ ময়দানে শত শত মানুষের জমায়েত হয়ে আল্লাহর উদ্দেশ্যে নামাজ আদায় ও হাত তুলে মুনাজাতের সৌন্দর্য। এখানে আছে নিত্যদিনের নামাজ আদায়ের মতো মসজিদে ঈদের নামাজ আদায়ের রুটিন-চিত্র।
আমরা যে ঈদের উৎসবের কথা বলি সেই উৎসবের সঙ্গে সুন্দরের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সুন্দর এ উৎসব এক এক দেশে একেকভাবে পালিত হয়। অনেক দেশ আছে যে সব দেশে প্রকৃত অর্থেই ঈদকে উৎসবে রূপান্তর করা হয়। ঈদকে করা হয় সৌন্দর্যের প্রতীক। অনেক দেশ আছে সে সব দেশে পুরুষদের পাশাপাশি মেয়েরাও সুসজ্জিত হয়ে ঈদের জামাতে শামিল হন। ঈদ উপলক্ষে মেলারও আয়োজন করা হয় কোনো কোনো দেশে। মেলার পাশাপাশি নানা ধরনের খেলাধুলা ও চিত্রাঙ্কনের ব্যবস্থাও করতে দেখা যায়। দিনব্যাপী চলে এসব অনুষ্ঠান। ফলে ঈদের পুরো আনন্দ উপভোগ করেন সকলে। ঈদ উপলক্ষে ইন্দোনেশিয়ায় নানা বয়সের মেয়েরা বাহারি সাজে সজ্জিত হয়ে জীবজন্তুর চিত্রসংবলিত নানা রঙের অসংখ্য বেলুন আকাশে উড়িয়ে থাকেন। আমেরিকার লং আইল্যান্ড, ম্যানিলা, চায়না, ফালুজা, গাজা স্ট্রিপ, কায়রো ও তিউনিসিয়াসহ অসংখ্য দেশে নানাভাবে ঈদকে উপভোগ্য উৎসবে রূপ দেয়া হয়।
মুঘল ইন্ডিয়ার মুসলিম সম্রাটগণও ঈদকে ব্যাপক উৎসবে পরিণত করতেন। ঈদের আনন্দকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ঈদের শোভাযাত্রার আয়োজন করতেন সম্রাটগণ। সেই শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করতেন সর্বস্তরের মানুষ। অতি দরিদ্র মানুষদেরকেও উৎসাহ প্রদানের জন্য শোভাযাত্রায় শামিল করা হতো। শোভাযাত্রায় নেতৃত্ব দিতেন স্বয়ং সম্রাট, সম্রাটের পরিবারের সদস্যবৃন্দ, সভাসদবৃন্দসহ কর্মচারী-কর্মকর্তারা। সুসজ্জিত হাতি ও ঘোড়ার পিঠে তাদের অনেককেই দেখা গেছে নেতৃত্ব দিতে। মুঘল যুগের প্রথম থেকেই এই প্রক্রিয়ার শুরু। এসব বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার চিত্রও আঁকা হতো সে সময়। এমনই একটি চিত্রে প্রথম মুঘল সম্রাট বাবরকে ঈদুল ফিতর উপলক্ষে তার কোটের সভাসদকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে দেখা যাচ্ছে। প্রায় সব সম্রাটই এ পথ অনুসরণ করছেন। সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর ছিলেন শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি উদার হৃদয় মানুষ। তিনি ইসলামী সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দিয়ে নানা ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন তার ইংরেজ অফিসার টমাস মেটকাফেকে দিয়ে। সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের এসব কর্মকাণ্ডের কথা ইতিহাসের পাতায় স্পষ্টাক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে। শুধু তা-ই নয়, এসব কর্মকাণ্ডের অসংখ্য চিত্রও ছাপা আছে বিভিন্ন গ্রন্থে। যেগুলো সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর টমাস মেটকাফেকে দায়িত্ব দিয়ে আঁকিয়ে নিয়েছিলেন। এসব চিত্র ‘দ্য গোল্ডেন কাম’ নামক একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থে ছাপা রয়েছে। গ্রন্থটি লিখেছেন স্যার টমাস মেটকাফের মেয়ে এমিলি। র্৮´ীর্৯র্ আকারের এই গ্রন্থের ২১০ পৃষ্ঠার সর্বত্র রয়েছে এসব চিত্রসহ অসংখ্য ইসলামী সংস্কৃতির নিদর্শন। আধ্যাত্মিক সাধনা পবিত্র তারাবির নামাজ সম্পর্কেও রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। ঈদ ও তারাবির জামাতের শৃঙ্খলা লেখিকা এমিলিকে অভিভূত করেছে।
মুঘল আমলে সম্রাটগণ দিল্লিতে যেমন ঈদের শোভাযাত্রার আয়োজন করেছেন তেমনি ঢাকাতেও শোভাযাত্রার আয়োজন করেছেন নওয়াবরা। এসব শোভাযাত্রার অঙ্কিত চিত্র আজো ঢাকার জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। আনন্দধারা ও ধর্মীয় অনুভূতির তরঙ্গমালা সৃষ্টিকারী, ঐশ্বরিক ও স্বর্গীয় অনুভূতি প্রদানকারী ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের মাঝে সাম্যের বাণী প্রচারকারী এবং সব মানুষের হৃদয়ে শান্তির বাণী বহনকারী এসব ঈদের শোভাযাত্রার চিত্রসমূহ মুসলমানদের ঈমানি শক্তি ও সামাজিক শান্তিশৃঙ্খলার প্রতীক। হ


আরো সংবাদ



premium cement