২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

বোয়ালের বড়শি

-

মাসুদা বিলের পানিতে বড়শি ফেলে এক দৃষ্টে ফতনার দিকে তাকিয়ে আছে। বোয়াল মাছ ধরার খুব ইচ্ছে তার। গত সাত দিনে পুঁটি আর টেংরা মাছ ছাড়া কিছুই ধরতে পারেনি সে। তাই তার মন ভীষণ খারাপ। আজো বেশ কয়েকটা পুঁটি ও টেংরা মাছ ধরেছে সে। অনেকক্ষণ পার হয়ে যায়। এক সময় বড়শি গুটিয়ে নেয়। কেঁচোগুলো পানিতে ছুড়ে ফেলে দেয়। তারপর বড়শি আর খালুই নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হয়।
দিগন্তজুড়ে বর্ষায় চোখে পড়ে শুধু পানি আর পানি। খাল বিল, নদী নালা, হাওয়া- বাঁওড় মিশে একাকার হয়ে যায়। ঝোপঝাড় বাড়ির আঙ্গিনায় পানি থই থই করে। গতকাল টানা কযেক ঘণ্টা বৃষ্টির পর বিলের পানি হু হু করে বেড়ে গেছে। আজ বৃষ্টি নেই। ঝলমলে রোদ। হঠাৎ মাসুদার পথ আগলে দাঁড়ায় মায়া। মায়া মুচকি হেসে বলল,‘বোয়াল মাছ বড়শিতে ধরা এত সহজ না। বোয়াল মাছ ধরতে হলে বড় বড়শি লাগে, বুঝলি?
মায়া তার ক্লাসমেট। দু’জনেই কনকাপৈত হাইস্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়ে। মাসুদা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘ বুঝলাম। এখন সরে দাঁড়া।’
মায়া সরে দাঁড়ায়। মাসুদা সামনে এগোতে থাকে। রাস্তায় কাদা। বিলের মুখে মোহন লাল জেলে জাল ফেলেছে। সেখানে ছোট ছেলেমেয়েদের উপচে পড়া ভিড়। বাড়ির সামনে কাচারি ঘর পর্যন্ত আসার পর কুঁজো বুড়ি শূন্য মাড়ি দেখিয়ে এক গাল হেসে বলল, ‘ কী নাতীন বোয়াল মাছ ধরছো কয়টা?
‘হাজার খানিক ধরছি দাদী। তোমার কয়টা লাগবে বল? মাসুদাও হাসে। হাসতে হাসতে চোখে পানি এসে যায় তার।
‘তোমার খালুইতে দেখি পুঁটি আর টেংরা। যাও বাড়িতে যাও।’ বুড়ি বিলের দিকে যায়। মাসুদা সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বাড়িতে ঢুকে দেখে বাবা গোয়াল ঘরে গাভীর দুধ ধুইছে। তার দিকে এক নজর চেয়ে মুচকি হাসে। সে বড়শি আর খলুই ঘরের আলসের সাথে রেখে কলপাড়ে গিয়ে হাত মুখ ধোয়। পরদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে বাজার থেকে একটা বড় বড়শি কিনে সে। বিকেল বেলা বাঁশের লগির মাথায় নাইলন দড়ি বেঁধে বড় বড়শি লাগিয়ে নেয়। এবং বিলপাড়ে গিয়ে প্রথমে ছোট বড়শি দিয়ে একটা পুঁটি মাছ ধরে। বাুুঁশের লগি বিলপাড়ে কাৎ করে গেড়ে পুঁটি মাছ বড় বড়শিতে গেঁথে দেয়। পুঁটি মাছ বিলের পানিতে খেলা করে। বিলপাড়ে বসে এ দৃশ্য দেখে খুব আনন্দ পায় মাসুদা।
তারও কিছুক্ষণ পর কোত্থেকে যেন কুঁজো বুড়ি এসে হাজির হয়। বুড়ি মাসুদার পাশে বসে বলল,‘ এবার ঠিক আছে। বোয়াল মাছ ধরতে আর সমস্যা হবে না।’
‘দোয়া কর দাদী। যেন একটা বোয়াল মাছ ধরতে পারি।’
‘দোয়া করি যেন দুইটা বোয়াল মাছ ধরতে পারো। একটা আমাকে দিবা আর একটা তুমি নিবা।
‘ঠিক আছে। তাই হবে।’ একটা ট্রলার ছুটে যায় দক্ষিণে। ট্রলারের উপর একদল কিশোর ছেলে উচ্চস্বরে গান বাজিয়ে নাচছে। বালুবোঝাই করে স্টিমার ছুটে চলছে দক্ষিণে। পানির স্রোতের সাথে কচুরিপানাও ছুটে চলছে অজনায়।
এ সময় এক গাধা হাঁড়ি পাতিল নিয়ে হাজির হয় মায়া। মায়া বিলপাড়ে বসে হাঁড়ি পাতিল মাজতে মাজতে বলল, ‘বোয়াল মাছ কুটা একদম সহজ।’
‘জীবনে কয়টা বোয়াল মাছ কুটছস ?’ মাসুদা বড়শির দিকে তাকিয়ে বলল।
‘একটা ও না। না কটুলে কী হয়েছে ? বোয়াল মাছ কটুতে তো দেখছি।’
‘তাই না?’
‘হুঁ।’ মায়া পাতিল মাজে আর আড় চোখে তাকায়। এ সময় একটা কাণ্ড ঘটে। বড়শিতে আটকানো পুঁটি মাছ পানিতে তলিয়ে যায়। তা দেখে বুড়ি চিৎকার করে ওঠে, ‘ মনে হয় বোয়াল মাছ আটকা পড়ছে!’
মাসুদা ছুটে গিয়ে লগি ধরে টান মারে। বিলপাড়ে বড়শি তুলে সে হকচকিয়ে যায়। কুঁজো বুড়ি আর মায়া শব্দ করে হাসে। মাসুদা রাগে গজ গজ করতে করতে বলল, ‘হাসো কেন দাদী ? মায়া তুই হাসছস কেন?’
বড়শিতে একটা কচ্ছপ ধরা পড়েছে। এটা ভাবতে তার কষ্ট হয়। সে কচ্ছপের মুখ থেকে বড়শি বের করার ব্যর্থ চেষ্টা করে। মায়ার হাঁড়ি পাতিল মাজা শেষ হয়। কুঁজো বুড়ি মায়া চলে যায়। সেও বড়শি ফেলে বাড়ির দিকে রওনা হয়। বোয়াল মাছ ধরার ইচ্ছে আর নেই তার। পুঁটি আর টেংরা মাছ পেলেই খুশি সে। তার বড়শিতে যে কচ্ছপ ধরা পড়েছে, এটা ভেবে তার নিজেরও হাসি পায়।
বাড়ি এসে দেখে বাবা বাজার থেকে মস্ত বড় একটা বোয়াল মাছ নিয়ে এসেছে। মা পাকের ঘরের মেঝেতে বসে বোয়াল মাছ কুটছে। মাসুদা মায়ের সামনে পিঁড়িতে বসে। বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। অনেক দিন পর বোয়াল মাছ দিয়ে ভাত খাবে। এটা ভেবে খুশিতে ভরে ওঠে তার মন।


আরো সংবাদ



premium cement