২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

জীবনের বাকি কথা

-

পুরনো লোকদের কথা হঠাৎ হঠাৎ মনে আসছে। শিল্পী কামরুল হাসানের অফিসে গিয়ে হাজির। অদ্ভুত তার অফিসটি। এক দিকে কাজ করছেন আর অন্য দিকে ছবি আঁকছেন। আমাকে দেখে খুব খুশি। বললেন, এসো গল্প করি। আমি বললাম, মীর্ণাকে এত সুন্দর ছবি দিয়েছেন ওর বিয়ে উপলক্ষে। আর আমার ভাগ্যে কিছুই জুটল না। তিনি চট করে একটি ছবি এঁকে আমার সামনে তুলে ধরলেন। বললেন, এইটি তুমি। আমি বললাম, আমি এতই কদাকার দেখতে? আমি তখন খুবই রোগা ছিলাম। আমাকে খুবই শীর্ণকায় একজন উ™£ান্ত কবি হিসেবে তিনি চিত্রিত করেছেন। ছবিটি নেই। উনি বললেন, আমার মুখের বৈশিষ্ট্য আমার নাক। যারা আমাকে চেনে তারা আমার নাকটিকে আরো চ্যাপ্টা করে দেয়, যাতে বোঝা যায় এই নাকটি কামরুল ছাড়া আর কারো নয়। নজরুলের ‘খাঁদু দাদু’ কয়েকটি লাইন আবৃত্তি করে শোনালাম। ‘ও মা, তোমার দাদার নাকে কে মেরেছে ল্যাঙ, খ্যাঁদা নাকে নাচছে ন্যাদা নাকড্যাঙা ড্যাঙ ড্যাঙ’। জিজ্ঞেস করলেন, এমন আবৃত্তি কে শেখাল? নিশ্চয়ই বদরুল?
বললাম, ঠিক তাই। বদরুল হাসান তার ছোট ভাই। তার মতো আবৃত্তি কেউ করতে পারত না। আমাকে ভীষণ ভালোবাসত। বামপন্থী রাজনৈতিক পাল্লায় পড়ে জেল খাটে এবং শেষের দিকে উ™£ান্তের মতো প্রেস ক্লাবে এসে বসে থাকত। বলত, এই তুলু চা খাওয়াবি? বলতাম, শুধু চা না, সিঙ্গারাও খাওয়াব। মনে আছে তার আবৃত্তি। ‘নজরুলের বক’ দেখেছ? কামরুল ভাইয়ের আরেক ভাই হাসান জানও আমাকে ও মীর্ণাকে খুব আদর করত। এ রকম আদর আর কারো কাছে পাইনি। ভাবতে অবাক লাগে যে, আমাদের সবচেয়ে আদরের এ তিনটি ভাইকে ছেড়ে কিভাবে আমরা বেঁচে আছি? তিনজনেরই আমাদের বাড়িতে ছিল অবাধ প্রবেশ।
আব্বার সাথে কামরুল ভাই গল্প করতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আমি ও মীর্ণা তার কাছে ব্রতচারী গান ও নৃত্য শিখি। মুকুল ফৌজের সর্বাধিনায়ক কামরুল হাসান। এদের সাথে হাজির হতেন মোহাম্মদ মোদাব্বের, যিনি ছিলেন ‘মুকুলের মাহফিল’-এর বাগবান। তার মাথায় চুল বলে কোনো পদার্থ ছিল না। পুরোটাই গড়ের মাঠের মতো মসৃণ। অর্ধ সাপ্তাহিক পাকিস্তান পত্রিকার তিনি ছিলেন সম্পাদক। এত হাসাতে পারতেন, যা বলার নয়। জান ভাই কয়েকবার চেষ্টা করেছিলেন তার দেশের বাড়িতে আমাদের নিয়ে যেতে। সেখানে ছিল তার পুকুরঘাট এবং তার পাশে কলাগাছের সারি। যাওয়া হয়নি।
পুরনো লোক তো আর আসবে না। বায়তুল মোকাররমে গেলেই ওই সব মানুষ আমাকে তাড়া করে। একজন শামসুর রাহমান। তাকে দেখলেই আমি আমার বাসায় ঢুকিয়ে নিয়ে আসতাম। আমার ভাই ছিল তার বন্ধু। তাতে কী? ভাই ব্যস্ত আর আমি শামসুর রাহমানের কবিতার একক শ্রোতা। তাকে নাশতা খাওয়াতাম। মা এসে বসতেন, যেন একই পরিবার। শামসুর রাহমান মীর্ণার জন্য কয়েকটি গান লিখে দেন। আবদুল আহাদ সন্ধ্যাবেলায় এসে সেগুলোতে সুর দিতেন। একদিন শামসুর রাহমান আমার আবৃত্তি শোনে অবাক হয়ে যান। বলেনÑ তুলু, আমার কবিতার আবৃত্তি তুমি ছাড়া আর কেউ করতে পারেনি। তুমি কার কাছে শিখেছ? বড় ভাইয়ের নাম বললাম। কই দুলু তো কোনো দিন আমাকে আমার কবিতা আবৃত্তি করে শোনায়নি।
একদিন শামসুদ্দিন আবুল কালাম (কাশবনের কন্যা খ্যাত) বললেনÑ তুলু, তুমি কি খবর পড়তে চাও, ইংরেজিতে? আমি শুনে অবাক। উনি বললেন, পাশের ঘরে তুমি খবর পড়ো ইংরেজিতে, তা কয়েকবার শুনেছি। আমি নিশ্চিত যে এরিক ক্যাটাপিয়ার, যিনি ইংরেজিতে খবর পড়তেন, তুমি তার চেয়ে কোনো অংশে কম নও। এরপর আমার বন্ধু রাশিদুল হাসান ও আমি ইংরেজিতে খবর পাঠক হিসেবে অডিশন দিতে যাই। সে প্রথম হয়, আমি দ্বিতীয়। তাই চাকরি পাইনি। একদিন রেডিওতে গিয়ে হাজির, তখন রাশিদুল হাসান খবর পড়ছিল। আমাকে গ্লাসের এপারে দেখেই সে অবাক। আমার ইচ্ছা করছিল ঘরে ঢুকতে। অবশ্যই এরপর বিভিন্ন অভিনয়ে আমি পারদর্শিতা অর্জন করতে পেরেছি। যারা আমাদের সাথে অভিনয় করতেন তাদের কাউকে ভুলিনি। যেমনÑ রনেন কুশারি, মাধুরী চ্যাটার্জি, ইনাম আহমেদ, কাফে খান, শরফুল আলম। অনেকের নাম ভুলে গেছি। কিন্তু চেহারা স্পষ্ট মনে আছে।
অনেকের কথা লিখেছি যখন অপেক্ষাকৃত তরুণ। আত্মজীবনী : ‘জীবন নদীর উজানে’। কুড়ি বছর পর আবার লিখলে হবে নতুন লেখা, নতুন রসে সঞ্জিবিত। অনেকের কথা লিখতে পারব। যারা হয়তো সাধারণ মানুষ, কিন্তু আমার চোখে অসাধারণ। জানি আমার লেখা এ মুহূর্তে কেউ পড়বে না। কিন্তু এক শ’ বছর পরে এসব লেখার মূল্য হবে। যেমনÑ জসীমউদ্দীনের ‘জারি গান’ (৫০০ পৃষ্ঠা) ও ‘মুর্শিদা গান’ (৫০০ পৃষ্ঠা) বইতে লেখা ২০০ শিল্পীর কথা, যাদের নাম কেউ জানে না, অথচ ওরা লোকবাংলার শ্রেষ্ঠ শিল্পী। জীবনে যাদের সাথে দেখা হয়েছে, তারা অনেক বড় মাপের মানুষ। তুলনায় আমি কিছুই নই। তবুও আমার লেখনীতে সেসব মানুষ হয়তো অক্ষয় হয়ে থাকতেন। তাই পত্রিকার সম্পাদকদের কাছে অনুনয় জানাই, আমার লেখা ফালতু কাগজের বাক্সে ফেলে দেবেন না। এ-ও জানবেন, আজকের পত্রিকা আগামীকালের ফালতু বাক্সে। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement