তবুও এগোতে হবে আমাদের
- আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক
- ২৫ অক্টোবর ২০২০, ০০:০০
বিশ্বব্যাপী মহামারী করোনাকাল অতিক্রম করছি আমরা। এ বছরের মার্চ থেকে দীর্ঘ দিন লকডাউনে ছিলাম। সব কিছু সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল আমাদের। জীবন বন্দী হয়ে গেল চার দেয়ালের মধ্যে। লকডাউন এখন নেই। কিন্তু করোনা রয়ে গেছে। এখনো আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। আক্রান্ত কেউ কেউ প্রাণ হারাচ্ছেন এখনো। এ মহামারীতে অনেক পরিচিতজন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং দেশের অনেক নাগরিক মৃত্যুবরণ করেছেন। আমরা তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। তাদের রূহের মাগফিরাত কামনা করছি। করোনায় ভূমিকা রাখতে গিয়েও প্রাণ হারিয়েছেন অনেকে। এর মধ্যে ডাক্তার রয়েছেন। প্রশাসনের লোকজন রয়েছেন। রয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। বিশেষ করে পুলিশের বেশ ক’জন সিপাহি এবং কর্মকর্তা মারা গেছেন।
করোনার ভয়াল থাবা পড়েছে মিডিয়াতেও। প্রাণ হারিয়েছেন অনেক সাংবাদিক। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তারা আক্রান্ত হয়েছেন করোনায়। এবং করোনাতেই মৃত্যু হয়েছে তাদের। মিডিয়াকর্মীদের এ ত্যাগের প্রতি আমি শ্রদ্ধা জানাই। মানুষকে করোনার ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক করার কাজে নিয়োজিত ছিলেন এসব সাংবাদিক। মিডিয়ার ভূমিকা এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
করোনা সম্পর্কে জানতে হবে আমাদের। জেনে মানতেও হবে। তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে আমরা সবাই অনেক কিছু জানি। জানাটা সহজ হয়ে গেছে। কিন্তু শুধু জানলে তো হবে না। জানার সাথে সাথে মানতেও হবে। জানানোর কাজটি মিডিয়া প্রবলভাবে করছে। একইভাবে মানার কাজে উৎসাহিত করছে তাও মিডিয়া।
এ কথা সত্য, আমরা সব বিষয়ে পরিপূর্ণভাবে জানি না কিন্তু যতটুকু জানি সেটুকু মানতে হবে আমাদের। যেটুকু জানি না সেটুকু জানার চেষ্টা করতে হবে।
আমরা দেখেছি, উন্নত বিশ্বেও মাস্ক পরা নিয়ে মিছিল হয়েছে। লকডাউন নিয়ে প্রতিবাদ হয়েছে। মানুষকে সচেতন করতে নেয়া হয়েছে বিভিন্ন উদ্যোগ। তবুও অনেক মানুষ অসচেতন থেকে যায়। সাবধান হতে পারে না। অথবা বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে পারে না।
কিন্তু এ মহামারীর দুর্যোগ মুহূর্তে আমাদের দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হবে। প্রজ্ঞার সাথে কাজ করতে হবে। অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে হবে। এ ক্ষেত্রেও গণমাধ্যমের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসব বিষয়ে গণমাধ্যম আমাদের জনগণকে সচেতন করতে পারে।
অতীতের মতো এই মহামারীও আমাদের পাঠ্যবইয়ে আসবে। আমাদের আগামী প্রজন্ম পড়বে। জানবে। সেটি ভবিষ্যতের কথা। কিন্তু এ মুহূর্তে গণমাধ্যম, তথ্যমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং দ্রুত যোগাযোগমাধ্যম আমাদের সাহায্য করতে পারে। করছেও। গণমাধ্যমের এ ভূমিকা প্রশংসনীয় বাংলাদেশের গণমাধ্যম প্রায় করোনার প্রথম দিন থেকে যখন চীনে ধরা পড়ল, সেই থেকে প্রচারে সক্রিয় ভূমিকা রেখে চলেছে। এ ভূমিকা রাখছে দক্ষতার সাথে।
আমাদের সরকারও পদক্ষেপ নিয়েছে; যে কারণে আমাদের হাসপাতালগুলো বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে। ব্যবস্থা নিয়েছে প্রশাসনও।
করোনায় সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। সবাই এর আঘাতে ক্ষতবিক্ষত। কিন্তু আমাদের দেশের শ্রমিকশ্রেণী, দিনমজুর যারা দিন এনে দিন খায়, এদের জীবনে দুর্ভোগ নেমে এসেছে। কারণ এসব গরিব ও অসহায় মানুষের নির্ধারিত কোনো আয় নেই। যেটুকু কাজ সেটুকুই তার খাওয়ার আয়োজন। করোনার কারণে এসব লোকের কাজ নেই। বেকার হয়ে গেছে বেশির ভাগ লোক।
অন্য দিকে ব্যবসায় বাণিজ্য বন্ধ প্রায়। শিল্পকারখানায় উৎপাদন নেই। অনেকের প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। স্কুল-কলেজ-মাদরাসাসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। ফলে কাজের ক্ষেত্র খুবই সীমিত হয়ে পড়েছে। ফলে মানুষের জীবনযাত্রা হয়ে পড়েছে ভীষণ কষ্টের।
এমন সঙ্কটেও কিছু দুষ্কৃতকারী লোভ ও লালসা চরিতার্থ করছে। তারা খুন-খারাবি ও ধর্ষণের মতো জঘন্য কাজে লিপ্ত হচ্ছে। নারী নির্যাতন এবং ধর্ষণ এক ধরনের সামাজিক বিস্ফোরণের মতো। এটি খুবই উদ্বেগের। এদের বিচার হওয়া উচিত। অথচ সঙ্কটের সময় নিজেদের সংশোধন করার কথা। বঙ্গবন্ধু এ কথাটিই বলেছিলেনÑ সর্বাবস্থায় গণজীবনকে কলুষমুক্ত রাখতে হবে। বঙ্গবন্ধুর এ কথা মান্য করলে লোকেরা খারাপ হতে পারে না।
করোনার এই মহাসঙ্কটে আত্মশুদ্ধ করতে হবে। নিজেদের পরিশুদ্ধির কাজ করতে হবে। আত্মসচেতন হতে হবে। অপরাধপ্রবণতা লালন করা যাবে না। যারা ধর্ষণ করছে তারা বড় অন্যায় কাজ করছে।
নতুন প্রজন্ম নিয়ে ভাবি। আমাদের কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের কথা ভাবি। তাদের ক্লাস নেই। স্কুল-কলেজ বন্ধ। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে গত ফলাফলের ভিত্তিতে প্রমোশন দেয়ার। এটি একটি ভালো সিদ্ধান্ত। আসলে স্কুল-কলেজ খুলে ঝুঁকি নেয়া যায় না। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশও স্কুল-কলেজ খুলে আবার বাস্তবতার কারণে বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে।
আমাদের বিশ্ব থেকে শিখতে হবে। কিভাবে দুর্যোগ মহামারী মোকাবেলা করতে হয়। এবারের করোনা ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া সুন্দরভাবে মোকাবেলা করেছে। শুধু উন্নত দেশ নয়; উন্নয়নশীল দেশও দক্ষতার সাথে তা মোকাবেলা করেছে। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও সিঙ্গাপুর এসব দেশ থেকে শিখতে হবে আমাদের।
সারা দুনিয়াতে করোনায় মানুষের মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। চার দেয়ালে বন্দিজীবনে মানসিক চাপ-উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তার কারণে এ সমস্যা দেখা দিয়েছে। এখন মানুষের শারীরিক চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক চিকিৎসাও জরুরি। মানসিক এসব সমস্যার কারণেও সামাজিক অপরাধ বাড়ছে। ধর্ষণ, নারী নির্যাতন ও খুন-খারাবি বেড়ে গেছে। চিকিৎসার পাশাপাশি অপরাধীদের যথার্থ শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশ সরকার এরই মধ্যে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেছে। অপরাধ যাতে না হয় তার জন্যও আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে।
এ ক্ষেত্রে সমাজকর্মী ও শিক্ষকদের দায় আছে। শিক্ষকরা ব্যক্তি, পরিবার ও সামাজিক জীবনের সুন্দর ও সুস্থতার পক্ষে কাজ করতে পারেন। করোনাকালে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করা সবার কর্তব্য। আমরা আমাদের পাশের জনকে সাহায্য করতে পারি।
যে হতাশ হচ্ছে তাকে আসার কথা শোনাতে হবে। যে শিক্ষার্থী হতাশ হয়ে যাচ্ছে তাকে শিক্ষার কাজে জড়িয়ে হতাশামুক্ত করতে হবে। প্রত্যেক নাগরিকেরই পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করা কর্তব্য।
মানুষের প্রতি আস্থা রাখতে হবে। মানুষকে বিশ্বাস করতে হবে। একই সাথে কাজও করে যেতে হবে। আমরা অনেক দুর্যোগ মোকাবেলা করেছি। করেছি সম্মিলিতভাবে। এখনো ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ সঙ্কট মোকাবেলা করতে হবে আমাদের।
আসলে দায়িত্ব সবার ওপরই আছে কম-বেশি। সবার চেষ্টা থাকা উচিত সবাইকে নিয়ে ভালো থাকার। একা একা ভালো থাকা যায় না। করোনার এটি একটি বড় শিক্ষা। নিজকে রক্ষা করতে হলে আসে পাশের সবাইকে রক্ষা করতে হবে। এককভাবে সুরক্ষিত থাকা যায় না। একা ভালো থাকার উপায়ও নেই। তাই সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে হবে। সবার কথা ভাবতে হবে। করোনায় সব উলট-পালট হয়ে গেছে। নতুন এ বাস্তবতার সাথে খাপখাইয়ে চলতে হবে সবার।
আমাদের নতুন প্রজন্ম প্রবীণ থেকে অনেক বুদ্ধিদীপ্ত। তাদের জানার পরিধি বেশি। তারা টেকনোলজির সাথে খুব সহজে পরিচিত হচ্ছে। এখন তারা এ কঠিন সময় পার করছে। নিশ্চয় এখান থেকে তারা শিখছে। অভিজ্ঞতা নিচ্ছে এবং প্রযুক্তিকে অতিদ্রুত আত্মস্থ করতে সক্ষম। সারা দুনিয়ায় দেখছে তারা। এসব দেখা ও অভিজ্ঞতা থেকে তারা নিজেদের উপযুক্ত করে গড়ে তুলবে। নিজেদের প্রতি আস্থাশীল হয়ে। আত্মবিশ্বাস নিয়ে চলবে। তথ্যপ্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করবে। তারা সৃষ্টিশীল হবে। টেকনোলজিকে মানুষের উন্নত জীবনের জন্য ব্যবহার করবে। ধ্বংসাত্মক কাজে নয়। আত্মবিশ্বাসই তাদের পথ দেখাবে।
সমাজে সবসময় ষড়যন্ত্রকারী, প্রতারক, ধান্দাবাজ ও আত্মসাৎকারী থাকবে। দুর্নীতিগ্রস্ত লোক থাকবে। এদের মোকাবেলায় আইনের শাসন যেমন দরকার তেমনি দরকার ভালো মানুষদের সঙ্ঘবদ্ধ হওয়া। ভালো মানুষেরা সংগঠিত হলে অপরাধীরা অপরাধ করার সাহস করবে না।
সব মানুষের জন্য কাজ করতে হবে আমাদের। পারস্পরিক সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। এসব কিছুর ভেতর দিয়ে তবুও এগোতে হবে আমাদের। হ
লেখক : সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা