২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মেজর জেনারেল (অব:) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক

-

জাতীয় নিরাপত্তা পৃথিবীর যেকোনো দেশের জন্যই খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার, যিনি সেই থেকে এখন পর্যন্ত একজন বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তি এবং অনেকাংশেই একজন বিতর্কিত ব্যক্তি। এ মুহূর্তেও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের একজন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা আছেন। তবে জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত চমকপ্রদ কোনো ঘটনা ঘটছে না বলে তার নামটি মিডিয়ায় তেমন একটা আসছে না। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মেয়াদকালে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ পদেই ঘন ঘন পরিবর্তন হয়েছে; সে রকমই একটি পদ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বা ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার। যিনি বর্তমানে এই পদে আছেন, তার আগেরজন ছিলেন জনাব জন বোলটন। জন বোলটন ১৮ মাস দায়িত্ব পালনের পর, পদত্যাগ করেছিলেন। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে, জন বোলটনের লেখা একটি আত্মজীবনীমূলক বই প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে তার মতপার্থক্যের বিষয়গুলো বা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সিদ্ধান্তগুলোর সমালোচনা করেছেন। জন বোলটনের বই প্রকাশের মাধ্যমে, আমেরিকার ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজারের নাম ও পদবি আবার আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে যায়, অর্থাৎ কিছু ঘটলে তখন এই নাম এসব পদবি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক ব্যক্তিরা মনে করেছিলেন যে, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি যদি যেমন আছে তেমনই থাকে (অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক নতুন দেশ না হয়) তা হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্য ভালো। তাই ১৯৭১ সালে মার্কিন সরকার পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল এবং পাকিস্তান সামরিক বাহিনী কর্তৃক তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের মানুষের ওপর পরিচালিত গণহত্যা ও অমানবিক নির্যাতনগুলোর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করেনি। অথচ আজ ২০২০ সালে, পাকিস্তান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সম্পর্ক কোনো মতেই উজ্জ্বল নয়। বরং পাকিস্তান এবং চায়নার সম্পর্ক অতি উজ্জ্বল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে, ভারত সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল এবং সার্বিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছিল। এ কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের প্রতি অবন্ধুসুলভ ছিল। অথচ আজ ২০২০ সালে ভারত এবং আমেরিকা অত্যন্ত বন্ধুসুলভ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে এবং ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যেটাকে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি বলা হয় সেটাতে উভয়ে পরস্পরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তখনকার আমলের গণচীন নামক বিশাল রাষ্ট্রটি তথা চীন সরকার, তাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু পাকিস্তানের স্বার্থের পর সমর্থন দিয়েছিল এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন দেয়নি। কিন্তু আজ ২০২০ সালে চীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে একজন বড় রকমের সহযোগী। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা দিয়েছিল, শুধু আমাদের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে নয়, তাদের নিজেদের স্বার্থের দিকেও অবশ্যই তাকিয়ে সহযোগিতা দিয়েছিল। আমি এ কথাগুলোর মাধ্যমে বোঝাতে চাচ্ছি যে, জাতিরাষ্ট্রের অবশ্যই নিরাপত্তার সাথে সম্পর্কিত কিছু স্বার্থ জড়িত থাকে এবং সেই স্বার্থের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী উপাত্তগুলো পরিবর্তনশীল। যেকোনো একটি দেশের সরকারে, ওই দেশের নিরাপত্তার স্বার্থ দেখাশোনা করার জন্য অভিজ্ঞ বিশেষায়িত ব্যক্তিবর্গ বা সংস্থা নিয়োজিত থাকে। আবার অনেক দেশ আছে যেখানে এ রকম নেই।
আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতেও একজন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা আছেন। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। ভারতে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে যিনি মনোনয়ন পান, তিনি দুই বা তিন বছরের জন্য দায়িত্ব পালন করে থাকেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে কেউ নেই। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পরিষদ অথবা জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ এরূপ নামেও কোনো সংস্থা বাংলাদেশে সক্রিয় নেই। বাংলাদেশে আছেন প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা। যেমন কি না বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপদেষ্টা আছেন একজন, অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা আছেন একজন বা জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা আছেন একজন। বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ বা জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পরিষদ এরূপ নামের একটি সংস্থা গঠনের তাগাদা অনেকদিন যাবতই অনুভূত কিন্তু বিভিন্ন স্পর্শকাতর কারণে, এইরূপ সংস্থা সৃষ্টি থেকে বাংলাদেশের সরকারগুলো দূরত্ব বজায় রেখেছে।
জাতীয় নিরাপত্তার অনেক দিক আছে। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা আধুনিক রাষ্ট্র নিরাপত্তা ব্যবস্থার ভাষায় এগুলো হলো, ভৌগোলিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, রাষ্ট্রব্যবস্থার নিরাপত্তা, খাদ্য নিরাপত্তা, মানবসম্পদ নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্বের নিরাপত্তা ইত্যাদি। বিশ্বের অন্যতম মোড়ল যুক্তরাষ্ট্র বলে বেড়ায়, পৃথিবীর অনেক স্থানেই তাদের স্বার্থ নিহিত আছে। সেই স্বার্থের ওপর আঘাত এলে তারা মনে করে তাদের নিরাপত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং হুমকিতে পড়েছে। এটি বিশ্বের সব দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যেমনÑ বাংলাদেশের ভূখণ্ডের বাইরেও দেশের স্বার্থ জড়িত থাকতে পারে। ওই স্বার্থের ওপর যদি কোনো ধরনের হামলা আসে তা হলে আমাদের বলতে হবে, বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা হুমকিতে পড়েছে। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শক্তিশালী দেশ চীন, অথবা অর্থনৈতিকভাবে অন্যতম শক্তিশালী দেশ জাপান, উভয় দেশের জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও এ ধরনের একাধিক বিষয় বিবেচনায় নেয়া হয়। জাপান ও চীনের অল্প দূরে অবস্থিত জনমানবশূন্য দু’টি দ্বীপের মালিকানা নিয়ে অনেক দিন ধরে উভয় দেশ ঝগড়ায় লিপ্ত। ওই দ্বীপগুলোয় কোনো কিছু ঘটলে জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে বলে তারা মনে করে। অথচ দ্বীপ দু’টির আয়তন জাপানের মূল ভূখণ্ডের আয়তন থেকে ১০০ ভাগের এক ভাগ এবং চীনের মূল ভূখণ্ডের আয়তন থেকে ৪০০ ভাগের এক ভাগেরও কম। বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে পার্বত্য বান্দরবান জেলার নাখ্যৈংছড়িতে এবং কক্সবাজারের সর্ব দক্ষিণ উপজেলা উখিয়ার কিছু গ্রামে অনেক কিছুই ঘটছে বা ঘটে। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের পর বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশ তথা কক্সবাজার জেলা এবং সেই জেলার সাথে আন্তর্জাতিক সীমানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ২৫ আগস্ট ২০১৭ তারিখে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত মিয়ানমার নামক রাষ্ট্রের রাখাইন প্রদেশে, মিয়ানমার সামরিক বাহিনী গণহত্যা পরিচালনা শুরু করে। এই অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে ২৫ আগস্টের পরে দু-তিন মাস সময় নিয়ে আট লাখের অধিক মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষ, সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। একান্তই মানবিক কারণে, বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদেরকে আশ্রয় দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত কক্সবাজার জেলায় জনসংখ্যার ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। যেই আট বা নয় বা দশ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছে, তাদেরকে নিরাপত্তা দেয়া বা তাদেরকে খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা দেয়া ও তারা যেন আইনশৃঙ্খলাবিরোধী বা বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কোনো কর্মে অংশগ্রহণ না করে, এরূপ ব্যবস্থা জারি রাখা একটি কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল ও স্পর্শকাতর বিষয়। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে ভৌগোলিক নিরাপত্তা ব্যাহত হচ্ছে রোহিঙ্গাদের কারণে। বাংলাদেশের তাৎক্ষণিক প্রতিবেশী মিয়ানমারের সাথে নাজুক সম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছে রোহিঙ্গাদের কারণে। বাংলাদেশের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান দেশগুলোর সম্পর্ক স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে রোহিঙ্গাদের গমনাগমন ও বাংলাদেশী পাসপোর্ট গ্রহণ করা বা না করার কারণে। আমি এই অনুচ্ছেদে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এটিই উপস্থাপন করতে চাচ্ছি যে, ২০১৭ সালের আগস্টের পরপর, বাংলাদেশ যদি রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দিত, তা হলেও বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তায় সমস্যা দেখা দিত, আবার আশ্রয় দেয়ার কারণেও বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তায় সমস্যা দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশের অধিবাসীরা পৃথিবীর যেখানেই থাকুন, তারা বাংলাদেশেরই অংশ। তদ্রƒপ আমেরিকানরা পৃথিবীর যেখানেই থাকুন, তারা আমেরিকারই অংশ। বাংলাদেশী দূতাবাসগুলো পৃথিবীর যে স্থানে রয়েছে সেটিও বাংলাদেশেরই অংশ। আবার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের যেসব দূতাবাস বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রয়েছে, সেগুলোও মূল দেশগুলোরই অংশ। সুতরাং বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশী দূতাবাসে বা দূতাবাসে অবস্থানরত কোনো বিদেশী নাগরিকের ওপর যদি কোনো ধরনের আক্রমণ আসে, তা হলে মেনে নিতে হবে সেই আক্রমণটি তাদের দেশের স্বার্থের ওপরই করা হয়েছে। যেমন প্রায় পাঁচ বছর আগে আততায়ীর গুলিতে (ঢাকা মহানগরীতে) ইতালীয় নাগরিক সিজারি তাভেল্লা নিহত হওয়ার ঘটনায় ইতালির স্বার্থ আক্রান্ত হয়েছিল, অথবা ইতালির নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছিল। সেই সময় রাজধানী ঢাকায় ইতালীয় নাগরিক হত্যাকাণ্ডের মাত্র পাঁচ দিন পরই রংপুরে জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি একই ধরনের হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন। এখানেও ওই একই কথা প্রযোজ্য। অর্থাৎ জাপানি নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছিল অথবা জাপানি স্বার্থ আক্রান্ত হয়েছিল। প্রশ্ন হলো, এ হত্যাকাণ্ডগুলোর কারণে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হয়েছিল কি না বা বাংলাদেশের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছিল কি না? জবাবে বলতেই হবে, হ্যাঁ, বাংলাদেশেরও জাতীয় নিরাপত্তার ওপর একটি আঘাত এসেছিল। আবার যদি এমন ঘটনা ঘটে তা হলে আবারো সেটা নিরাপত্তার ওপর আঘাত হিসেবেই গণ্য হবে। কারণ বাংলাদেশে বসবাসরত জনগণ যদি নিরাপদ না থাকেন, তা হলে বুঝতে হবে দেশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নাজুক অবস্থায় রয়েছে। উপরের একটি অনুচ্ছেদে জাতীয় নিরাপত্তার বিভিন্ন আঙ্গিকের উদাহরণ দিয়ে গিয়ে আমরা মানবসম্পদের নিরাপত্তার কথা বলেছি। বাংলাদেশের বর্তমানে (২০২০) নাগরিকরা অনিরাপত্তায় ভুগছেন। অনিরাপত্তার উদাহরণ হলোÑ ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, খুন, গুম প্রভৃতি। এবং মিডিয়ায় প্রকাশিত রিপোর্টগুলো মোতাবেক এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে যেহেতু বাংলাদেশ শাসনকারী ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা জড়িত, সেহেতু এটা বলাই যায় যে, বর্তমান রাজনৈতিক সরকার বাংলাদেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। বাংলাদেশের সীমান্তে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর গুলিতে বাংলাদেশী নাগরিকরা প্রায়ই নিহত হন; এটাও বাংলাদেশী নাগরিকগণের নিরাপত্তাহীনতার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যখন নাগরিকরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন, তখন নাগরিকরা সরকার ও রাষ্ট্রের ওপর আস্থাহীন হয়ে পড়েন। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে যদি নাগরিকরা উদাসীন হয়ে ওঠেন, তখন রাষ্ট্রই অনিরাপদ হয়ে পড়ে।
একটি রাষ্ট্রের যে চারটি অনস্বীকার্য মূল উপাদান প্রয়োজন তার একটি হচ্ছে সীমানা দ্বারা চিহ্নিত ভূখণ্ড, দ্বিতীয়টি হচ্ছে ওই ভূখণ্ডে বসবাসরত জনগোষ্ঠী, তৃতীয়টি হচ্ছে সরকার তথা ওই জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ, পরিচালনা ও ভূখণ্ডের নিরাপত্তার জন্য একটি বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান, আর চতুর্থ উপাদানটি হচ্ছে সার্বভৌমত্ব। অর্থাৎ নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমার মধ্যে বসবাসরত জনগণ স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করবে, বাইরের কোনো শক্তি এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
আমি এই প্রসঙ্গে বিষয়টির একটি ভিন্নতর প্রেক্ষাপট উল্লেখ করছি। গত দুই-তিন বছর নয়, তার আগের চার বা পাঁচ বা ছয় বছর ধরে সরকারের গোয়েন্দা বাহিনীগুলো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো এবং সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্ব অহরহ বলে আসছিল যে, বাংলাদেশে জঙ্গি উত্থান কিছুতেই হতে দেয়া হবে না; জঙ্গিরা দেশের যেখানেই থাকুক না কেন এবং যত বড় শক্তিশালীই হোক না কেন তাদের ধরা হবে এবং আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, বিভিন্ন অপরাধীকে ধরার পর, বিশেষ করে দলবদ্ধ বা সুপরিচিত কোনো গোষ্ঠীর সাথে দূরবর্তী কোনো সম্পর্ক আছে এমন কাউকে ধরার পর তাদের মিডিয়ার সামনে হাজির করা হতো জঙ্গি সংগঠনের তকমা লাগিয়ে। মিডিয়ায় প্রচুর প্রচারণা চালানো হতো। এমন প্রচারণার একটি ইতিবাচক দিক হচ্ছে, দেশে-বিদেশে লোকজন বলতেন, বাংলাদেশে জঙ্গিরা সুবিধা করতে পারছে না, ধরা পড়ছে; বাংলাদেশ সরকার খুবই তৎপর। আর নেতিবাচক দিক হচ্ছে, দেশে-বিদেশে অনেকেই মনে করতেন যে, কয়েকজন মাত্র ধরা পড়েছে, এর বাইরে আরো না-জানি কতজন লুকিয়ে আছে, ধরা পড়ছে না। আমি মনে করি, এভাবে বারবার প্রচারের কারণে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিল। পৃথিবীতে উগ্রবাদী, চরমপন্থী ও জঙ্গিরা রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই তিন পন্থীর কোনো পন্থী বাংলাদেশে রয়েছে কি না বা এখনো আছে কি না? সেই সময় বিশ্বব্যাপী বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে জঙ্গি তৎপরতা বহুল আলোচিত ছিল।
১৯৭২-৭৪ সালে আমাদের সোনালি আঁশ পাট ও পাটের গুদাম একের পর এক জ্বলেছিল হিংসার আগুনে। গত ১৫-১৬ বছরের খতিয়ান যাচাই করলে দেখব, দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানেও পরপর আগুন লাগিয়ে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়েছে। অনেক দেশই বর্তমান সরকারকে আনুষ্ঠানিকতার খাতিরে উপরে উপরে সদ্ভাব দেখায় অর্থাৎ সম্পর্ক বহাল রাখে। কিন্তু তারা অন্তর থেকে বর্তমান সরকারকে পছন্দ করছে না। কারণ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন করে তারা ক্ষমতায় এসেছিল। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের কথাও কারো অজানা নেই। তারা যেভাবেই ক্ষমতায় আসুক, কূটনৈতিক সম্পর্কের নিয়মানুযায়ী বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে তাদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সম্পর্ক রয়েছে। এর মানে এই নয় যে, বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সাথে পৃথিবীর সব দেশই ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি করবে বা করতে পেরেছে। বরং উল্টোটা হয়েছে। অনেক দেশ, সরকার ও জনগোষ্ঠী বর্তমান সরকারের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করতেই পারে। অতএব সরকার জোর করে ক্ষমতা ধরে রাখার মাধ্যমে নিজেদের শত্রু সংখ্যা বাড়াচ্ছে বলে আমি করি। এতে বিশ্বে দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ হচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কে এর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আমি আরো মনে করি, বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা এখন আংশিকভাবে হুমকির সম্মুখীন।
জাতীয় নিরাপত্তার জন্য শুধু সামরিক বাহিনীই যথেষ্ট নয়। জাতীয় নিরাপত্তার অঙ্গনে যেকোনো একটি দেশের সামরিক বাহিনী বিশেষত বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের সামরিক বাহিনী অন্তত দু’টি নিয়মে অবদান রাখে। প্রথম নিয়মটি হলো, সীমান্ত রক্ষায় তথা বৈদেশিক শত্রু কর্তৃক সম্ভাব্য আক্রমণের মোকাবেলা করা। দ্বিতীয় নিয়ম হলো, নিজেদের শক্ত ও সামর্থ্যবান চেহারা ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমে, নিজ দেশের জনগণের মনে শক্তি ও সাহস জোগানো। যুগে যুগে ও দেশে দেশে সামরিক বাহিনীগুলো, নিজ দেশের জনগণের স্বার্থ রক্ষায় এবং জনগণের অধিকার রক্ষায় উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে। যেমন কি না উপরের একটি অনুচ্ছেদে আমরা বলেছি যে, জাতীয় নিরাপত্তার অনেকগুলো আঙ্গিক আছে, তেমনই জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা করার ক্ষেত্রেও অনেকগুলো উপাত্ত বা আঙ্গিক আছে; তার মধ্যে একটি উপাত্ত বা আঙ্গিক হলো, জনগণের মনোবল সুউচ্চ রাখা এবং জগনণের মানসপটে জাতীয়তাবাদী চিন্তা উজ্জ্বল রাখা।
নয়া দিগন্ত পত্রিকার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত আমার এই কলামের মাধ্যমে, আমিও কামনা করি যে, বাংলাদেশের জনগণের মনোবল সুউচ্চ থাকবে এবং জাতীয়তাবাদী চিন্তা উজ্জ্বল থাকবে। হ
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক। চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
িি.িমবহবৎধষরনৎধযরস.পড়স.নফ

 


আরো সংবাদ



premium cement
রংপুরে মহানবী সা:-কে নিয়ে কটূক্তি করায় ছাত্রলীগ কর্মী গ্রেফতার বাড়ছে না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি, অনলাইনে ক্লাস চালুর চিন্তা বিশ্বের অন্যতম স্মার্ট হজ ব্যবস্থাপনা হবে বাংলাদেশে : ধর্মমন্ত্রী সিলেটে ৪৪ লাখ টাকার ভারতীয় চিনিসহ গ্রেফতার ৪ অবৈধ সম্পদ : এস কে সিনহার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন ২৬ জুন টি-টোয়েন্টি র‌্যাংকিংয়ে চাপম্যান-আফ্রিদির উন্নতি থানচিতে ট্রাকে দুর্বৃত্তদের গুলি চীনের আনহুই প্রদেশের সাথে ডিএনসিসি’র সমঝোতা স্মারক সই আ’লীগের ২ গ্রুপের সংঘর্ষ : ২ শতাধিক ককটেল বিষ্ফোরণ, আহত ৫ রাঙ্গামাটিতে ডাম্প ট্রাক খাদে পড়ে নিহত ৬, আহত ৮ প্রতিবাদ সমাবেশকারীদের গ্রেফতারের নিন্দা জামায়াতের

সকল