২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

প্যানডেমিক : অপ্রকৃতস্থ অস্বাভাবিক মানবজীবন

-

কোভিড নাইন্টিন বা করোনাভাইরাসকে মাহামারী (প্যানডেমিক) হিসেবে আখ্যা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সাথে সাথে মহামারী মোকাবেলা করার জন্য এই সংস্থা থেকে কিছু কৌশলও উল্লেখ করা হয়েছে যেমন, সাবান-পানি দিয়ে বিশ সেকেন্ড সময় নিয়ে ঘন ঘন হাত ধোয়া, মাক্স পরা, নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব রেখে চলাফেরা করা ইত্যাদি। এ ভাইরাস যেভাবে সংক্রামিত করতে পারে তা উল্লেখ করতে গিয়ে বলা হয়েছেÑ আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে এবং তার হাঁচি-কাশির ড্র্রপ্লেটের মাধ্যমে সংক্রমণ ঘটতে পারে। এসব কথা যখন প্রচারিত হলো তখন মানুষে মানুষে সামাজিক দূরত্বের বিস্তার ঘটল আর কার্যত পৃথিবী অচল হয়ে পড়ল এবং বেড়ে গেল মানুষে মানুষে সৌহার্দ্যও সম্প্রীতির দূরত্ব। আক্রান্ত ব্যক্তিকে আইসোলেট করে ফেলা হলো এবং পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল প্যানিক বা আতঙ্ক। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা ও পথ্যসেবা করার পরিবর্তে তাকে নিঃসঙ্গ রেখে নিজেদের জীবন বাঁচানোর জন্য মানুষ তৎপর হয়ে উঠল। পরিস্থিতি এমন একপর্যায়ে ঠেকল যে, কোভিড নাইন্টিনে মৃত্যু তো বটেই সাধারণ স্বাভাবিক মৃতের লাশও দাফন বা সৎকার করা থেকে মানুষ বিরত থাকল। ডাক্তার নার্স আত্মগোপনে গেল, হাসপাতালগুলো বন্ধ হলো এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ল। এ অবস্থাদৃষ্টে বিশ্বনেতৃবৃন্দ ভাবল, এ ছাড়া আর কী-ই বা করার আছে। বিজ্ঞানীরা রাতদিন পরিশ্রম করে ভাইরাস প্রতিরোধে টিকা আবিষ্কার করার জন্য ব্যস্ত হয়ে থাকল। প্রশ্ন হলো পৃথিবী কেন এত নাস্তানাবুদ হলো? কোভিড নাইন্টিনের মতো মহামারী তো পৃথিবীতে নতুন নয়। পৃথিবীর শুরু থেকে যুগে যুগে মহামারী এসেছে, ভবিষ্যতেও আসতে পারে। তবে মানুষ কেন মহামারী মোকাবেলার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে না? এসব প্রশ্নের বিজ্ঞানভিত্তিক সদোত্তর পাওয়া যায় না।
মানুষ মহামারীর সাথে পরিচিত হতে পেরেছে প্রাগৈতিহাসিককালে। ৪৩০ খ্রিষ্টাব্দে এক মহামারী ইথিওপিয়া থেকে ছড়িয়ে মিসর ও গ্রিস পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল। ইতিহাসে এ মহামারীর নাম রাখা হয়েছে ‘অ্যাথেনিয়ন প্লেগ’। দ্রুত ছড়িয়ে পড়া এ ভাইরাসের লক্ষণ ইবোলা ভাইরাসের মতো তীব্র জ্বর ও রক্তবমি এবং কয়েক দিনেই রোগীর মৃত্যু। এ ভাইরাসের প্রভাবে মানুষের মধ্যে নীতি-নৈতিকতা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসার রীতি বিলুপ্ত হয়েছিল। মানুষ মৃত্যু ভয়ে আড়ষ্ট ছিল। এরপর ১৬৫-১৮৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মানবসমাজকে আক্রমণ করে ‘অ্যান্টোনাইন প্লেগ’। এ মহামারী চীন থেকে উৎপত্তি ঘটিয়ে এশিয়ার কিছু দেশ এবং মিসর, গ্রিস, ইতালিসহ রোমান সা¤্রাজ্যের সৈনিকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই মনে করে গুঁটিবসন্তের জীবাণু থেকে এ রোগের উৎপত্তি হয়েছে। সে সময় এই অ্যান্টোনাইন প্লেগে রোমান সাম্রাজ্যের দুই-তৃতীয়াংশ লোক সংক্রমিত হয়েছিল। এ মহামারীতে মানুষের মূল্যবোধ পরিবর্তিত হয়ে খারাপের দিকে যায় এবং রোম সাম্রাজ্যেরও পতন ঘটে।
৫৪১ খ্রিষ্টাব্দে আরেক ভয়াবহ মহামারী ‘জাস্টিনিয়ান প্লেগ’ রোমান সাম্রাজ্যকে আবারো তছনছ করে দেয়। এ মহামারীর নামকরণ করা হয়েছিল রোমান সম্রাট জাস্টিনিয়ানের নামানুসারে। জাস্টিনিয়ান প্লেগের জীবাণু ছিল ‘ইয়েরসিনিয়া প্যাসটিস’ নামক ব্যাকটেরিয়া, যা ইঁদুর ও মাছির মাধ্যমে সমগ্র ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলসহ রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কন্সট্যান্টিনোপলে ছড়ায়। এ ভাইরাসের উপসর্গ ছিল জ্বর, বিষফোঁড়া ও রক্তবমি। মৃতের সংখ্যা এতই ছিল যে মানুষকে কবর দেয়ার মতো জায়গা ছিল না। শহরের চারপাশে লাশের স্তূপ গড়ে ওঠে। রাস্তা-ঘাট জনশূন্য হয়ে যায়, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেলে খাদ্যাবভাবেও অসংখ্য মানুষ মৃত্যুবরণ করে। ৫৪১ খ্রি. থেকে ৭৫০ খ্রি. পর্যন্তু প্রায় ২০০ বছরে আড়াই কোটিরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। মনে করা হয়, এ মহামারীতে ইউরোপের অর্ধেক মানুষ মারা পড়েছিল। মহামারী ‘জাস্টিনিয়ান প্লেগ’ এর ৬০০ বছর পর ১৩৩৪ সালে দেখা দেয় ‘বিউবনিক প্লেগ’ যা ইতিহাসে ‘ব্ল্যাক ডেথ’ নামে পরিচিত। এটি প্রথম চীন দেশে সংক্রমণ শুরু করে। এ রোগের জীবাণু ছিল ‘ইয়েরসিনিয়া প্যাস্টিস’ নামক ব্যাকটেরিয়া যা ইঁদুর ও মাছি বহন করত। এর উপসর্গ ছিল জ্বর, বিষফোঁড়া, রক্তবমি ও নিউমোনিয়া। আক্রান্ত মানুষের প্রায় অর্ধেকই মারা গিয়েছিল। চীনে শুরু হয়ে এ মহামারী এশিয়া, ভারত উপমহাদেশ হয়ে সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। ৫০ বছর ধরে এ মহামারী ১৫০ মিলিয়ন মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। মৃত্যুভয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থা সব কিছু ভেঙে পড়ে। সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়ে এবং ধনীরা সর্বস্বান্ত হয় আর গরিব অসহায় মানুষ বিত্তবান হয়ে ওঠে। এ মাহামারীর ফলে সমাজকাঠামো রদবদল হয়ে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উৎপত্তি ঘটে।
আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মহামারীর নাম ‘স্প্যানিশ ফ্লু’। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের বিশেষজাত অণুজীব দ্বারা মানুষ সংক্রামিত হতে থাকে। শূকর, পাখি ও মানুষ সমগোত্রীয় প্রাণী থেকে উৎপত্তি হয়ে ১৯১৮ সাল থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত দুই বছরে সংক্রামিত করে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মানুষকে। স্প্যানিশ ফ্লুতে ৫০ মিলিয়ন মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এ ভাইরাসের উৎপত্তি কোথায় ঘটে তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ফ্রান্স, স্পেন অথবা অস্ট্রিয়ার যেকোনো অঞ্চল থেকে এর উৎপত্তি হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র বিশ্বে। এ ভাইরাসটি জেনেটিক মিউটেশনের মাধ্যমে বারবার রূপ পরিবর্তন করে তিন ধাপে সংক্রামিত করে। ফলে ভাইরাসটি অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে আর মানুষ মৃত্যুভয়ে হতে থাকে তটস্থ। সার্চ ইবোলাসহ প্রতিটি ভাইরাসের চরিত্র ও প্রভাব কমবেশি একই রকম লক্ষ করা গেছে। কোভিড নাইন্টিনও সেই একই পথে হেঁটেছে। সৃষ্টি করেছে ভীতিকর পরিস্থিতি প্যানিক। কার্যত পৃথিবীকে স্থবির করে দিয়েছে। করোনাসহ এরকম নানান রোগব্যাধি দ্বারা মানবগোষ্ঠী সময়ে সময়ে বিপদে পড়েছে আর সেসব বিপদ থেকে পরিত্রাণের জন্য মানুষ নানান ফন্দিফিকির করেছে। অনুসন্ধান করেছে মহামারী প্রতিরোধের উপায় কী হতে পারে। মহামারী প্রতিরোধের উপায় অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিজ্ঞানীদের ব্যর্থতা ও সফলতা দু’টোই পাওয়া গেছে। সফল যখন হয়েছে তার আগেই এক একটি মহামারী মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়ে পৃথিবীকে অস্বাভাবিক অপ্রকৃতস্থ করে দিয়েছে। তারপর মানুষ আবিষ্কার করতে পেরেছে ভাইরাস প্রতিরোধক টিকা। কিন্তু ১০০ বছর পর আবার এসেছে অন্য একটি মহামারী। নতুন এ মহামারী প্রতিরোধ করতে আগের টিকা আর কাজে লাগানো যায় না। শুরু হয় নতুন মহামারী প্রতিরোধ কল্পে নতুন টিকা আবিষ্কারের জল্পনা-কল্পনা। তত দিনে মহামারী কেড়ে নেয় লাখ লাখ মানুষের প্রাণ, পৃথিবীকে পরিণত করে দেয় মৃত্যুপুরীতে। তাহলে ফল দাঁড়াল, মহামারী প্রতিরোধে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানী উভয়ই ব্যর্থ একথা না বলার উপায় দেখা যায় না।
অণুজীব বিজ্ঞানীদের মতে ১৫ লাখেরও বেশি অণুজীব বায়ুমণ্ডলে অবস্থান করে এবং এদের একেকটির চরিত্র এক এক রকমের। এসব অণুজীবের কিছু ক্ষতিকর আর কিছু উপকারী। এসব এককোষী অণুজীব অন্য কোনো কোষের সংস্পর্শে এসে নিজেকে বিকশিত করে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, ক্ষতিকর অণুজীব যেকোনো কোষের ওপর ভর করে তার বিষক্রিয়া সক্রিয় করে। এই প্রক্রিয়ায় ভাইরাস এক দেহ থেকে আরেক দেহে ছড়িয়ে পড়ে। ছড়িয়ে পড়ার মাত্রা যখন বেড়ে যায় তখন সেটাকে মহামারী হিসেবে গণ্য করা হয়। পৃথিবীতে যত মহামারী এসেছে সবই এই প্রক্রিয়ায় এসেছে। কেন ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে তার উত্তর খুঁজে বিজ্ঞানীরা বলছে, এসব ভাইরাসের ধর্মই হচ্ছে অন্যকোষের সংস্পর্শে এসে বিকশিত হওয়া। কখন এসব ভাইরাস তার কার্যক্রম চালাতে পারে তা নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। তার মানে এসব ভাইরাসকে মানুষ সহজে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। ভাইরাস যখন মনে করে এখন পৃথিবীর মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া দরকার আর তখনই মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এ গেল মহামারী সঙ্ঘটিত হওয়ার ব্যাপারে বিজ্ঞানের ধারণা। এখন আসা যাক মহামারীর উৎপত্তি সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও হাদিস কী বলছে। হজরত ইবনে ওমর ও ইবন আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘যখন কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যভিচার ও অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে তখন সেখানে মহামারী দেখা যায়।’ মহামারী সম্পর্কিত সূরা বাকারর এক আয়াতের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে বলা হয়েছে, বনি ইসরাইলের লোকজন বাজারে পণ্য বিক্রির জন্য সুন্দরী মেয়েদেরকে পাঠাত। আর এ কাজ করতে গিয়ে মেয়েরা ব্যভিচারে লিপ্ত হতো। এই পাপাচারের শাস্তি হিসেবে তাদেরকে মহামারী ঘিরে ফেলেছিল। শুধু ব্যভিচার ও অশ্লীলতাই নয়; পৃথিবীতে মানুষে মানুষে যখন বৈষম্য বেড়ে যায় এবং আল্লাহর প্রতি মানুষের অবজ্ঞা প্রদর্শন তীব্র হয় তখনই আল্লাহ সে জাতির ওপর মহামারী দেয়ার প্রয়োজন মনে করেন। আল্লাহ ঘোষণা করেনÑ ‘অবশেষে আমি তাদের ওপর তুফান পাঠালাম, প্লাবন, পঙ্গপাল ছেড়ে দিলাম, উকুন ছড়ালাম, ব্যাঙ বের করলাম ও রক্তের বৃষ্টি দিলাম। এসব নিদর্শন আলাদা আলাদা করে দেখালাম। কিন্তু তারা বিদ্রোহ করেই চলল। তারা বড়ই অপরাধী সম্প্রদায় ছিল’ [সূরা আ’রাফ- ১৩৩]। সূরা আন’য়ামের ৪২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে ‘হে রাসূল! আপনার পূর্বে বহু সম্প্রদায়ের কাছে আমি রাসূল পাঠিয়েছি এবং তাদেরকে আপদ-বিপদ ও দুঃখ-কষ্টে ফেলেছি যাতে তারা বিনয়ী হয়ে আমার সামনে নত হয়।’ আল্লাহ মানুষকে বড় শখ করে সৃষ্টি করেছেন। সেই মানুষের বেশির ভাগ যখন অল্প কিছু মানুষের দ্বারা জুলুমের শিকার হয় তখন আল্লাহ দুর্বল মানুষদের ওপর করা অপমান-অপদস্ত সহ্য করতে পারেন না। দুর্বল মানুষের মধ্যে আরো বেশি দুর্বল মেয়ে মানুষ। পৃথিবীজুড়ে পুরুষ কর্তৃক মেয়ে মানুষ অকথ্যভাবে নির্যাতিত অপমাণিত হয়ে আসছে। অথচ সব নারী-পুরুষই নারীর উদর থেকে জন্মলাভ করেছে। যার উদর থেকে মানুষ নিজেই জন্মেছে তাকে সম্মান-শ্রদ্ধা করা বাদ দিয়ে উল্টো তাকে অপমাণিত করছে। এ অন্যায় ক্ষমতার শীর্ষে থাকা মহান আল্লাহ মোটেই সহ্য করতে পারেন না। আল্লাহ সহ্য করতে পারেন না মানুষে মানুষে কাটাকাটি, হানাহানি, জুলুম, অত্যাচার নির্যাতন। শুধু তা-ই নয়; সবল মানুষ এখন দুর্বল মানুষদের মুখের গ্রাস কেড়ে খাচ্ছে। অথচ আল্লাহ মানুষকে ন্যায়-অন্যায় বুঝবার মতো যথেষ্ট জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়েছেন। ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য করার ক্ষমতা থাকার পরও মানুষ যখন অন্যায়কে গ্রহণ করে তখনই মানুষকে শায়েস্তা করার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে মহামারী অপরিহার্য হয়ে ওঠে। অথচ বিজ্ঞানীরা মহামারীর কারণ হিসেবে এই বিষয়গুলোকে পাত্তাই দিতে চায় না। আবার মহামারী ঠেকাতেও পারে না। আল্লাহ ঘোষণা করেন, ‘অন্যায় আচরণের কারণে তোমাদের আগে আমি অনেক জাতিকে ধ্বংস করে দিয়েছি। তাদের রাসূল তাদের কাছে সুস্পষ্ট নিদর্শন নিয়ে এসেছিল কিন্তু তারা বিশ্বাস করেনি। এভাবেই আমি অপরাধী জাতিকে অপরাধের বদলা দিয়ে থাকি [সূরা ইউনুস- ১৩]। পৃথিবীতে যে জাতিই সামাজিক শৃঙ্খলা নষ্ট করে অশান্তি তৈরি করেছে তাদেরই আল্লাহ গজব-মহামারী দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। সীমা লঙ্ঘনের চরম পর্যায়ে গিয়েছিল আদ আর সামুদ জাতি। আল্লাহ তাদেরকে যেভাবে ধ্বংস করেছে সে বর্ণনা সূরা ফজরে উল্লেখ করা হয়েছে। সেসব ঘটনা আল্লাহ তার রাসূলকে স্মরণ করে দিয়ে বলেন, ‘হে রাসূল আপনি দেখেননি? আপনার রব কী ব্যবহার করেছে উঁচু
থামওয়ালা ইরাম বংশীয় আদ জাতির সাথে? যাদের মতো জাতি দুনিয়ায় পয়দা করা হয়নি। আর সামুদ জাতির সাথে, যারা পাথর খোদাই করেছিল? আর ফেরাউনের সাথে, আর সেসব লোক যারা দেশে বিদ্রোহ ও সীমালঙ্ঘন করেছিল এবং সেখানে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল, শেষে আপনার রব তাদের ওপর আজাবের চাবুক মেরেছিল’ [সূরা ফজর ৬-১৪]। আদ আর সামুদ জাতির দাম্ভিকতা অপ্রতিরোধ্য হয়ে গিয়েছিল। আল্লাহ তাদেরকে গজব দিয়ে মানুষকে সতর্ক করেছে। আজকের পৃথিবীতে কোভিড নাইন্টিনও এসেছে গজব হিসেবে। পৃথিবীর কিছু মানুষ এতটাই পঙ্কিল হয়ে উঠেছে যে, তারা আদ আর সামুদ জাতিকেও হার মানিয়েছে। সীমালঙ্ঘনকারীদের পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ সূরা আ’রাফে ঘোষণা করেছেন- ‘তারপর যা ঘটল তা হলো এই, এক প্রচণ্ড ভূমিকম্প তাদেরকে পাকড়াও করল, ফলে তারা নিজেদের ঘরেই মুখ থুবড়ে পড়ে রইল [সূরা আ’রাফ-৯১]। কোভিড নাইন্টিনের লক্ষণ দেখে এ কথা বিশ্বাস না করে উপায় নেই যে, এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে গজব বা শাস্তি নয়। এটি গজব এবং যেকোনো মাধ্যমেই পৃথিবীতে তা ছড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
মানুষ যখন বিশ্বাস করবে যে, গজব বা মহামারী কেবল আল্লাহর পক্ষ থেকে এসে থাকে, তখন সেটি কিভাবে মোকাবেলা করা যায় সে পদ্ধতিও কুরআন-হাদিস থেকে গ্রহণ করা যেতে পারে।। মহামারী যখন এসেই যায় তখন সেই মহামারীকে সামাজিকভাবে মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়। আল্লাহ ঘোষণা করেন- ‘তুমি কি জান না সেসব লোকের কথা, যারা মৃত্যুভয়ে হাজার হাজার নিজেদের আবাসভূমি পরিত্যাগ করেছিল, তারপর আল্লাহ তাদের বলেছিল- ‘তোমাদের মৃত্যু হোক। অতঃপর আল্লাহ তাদের জীবিত করেছিলেন, নিশ্চয় আল্লাহ মানুষের প্রতি অনুগ্রহশীল কিন্তু অধিকাংশ লোক কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে না’ [সূরা বাকারা- ২৪৩]। এ আয়াতের ঐতিহাসিক বর্ণনা হলো, বানি ইসরাইলের একটি দলের মধ্যে মহামারী দেখা দিয়েছিল। আল্লাহর নির্দেশ ছিল মৃত্যুর ভয়ে তারা যেন পলায়ন না করে। কিন্তু তারা পালিয়ে নিজেদের দেশ ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়ে দুই পাহাড়ের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিল কিন্তু আল্লাহ তাদের সবাইকে একসাথে মৃত্যু দিয়েছিলেন। এদের সংখ্যা ছিল ৭০ হাজারের বেশি, মতান্তরে ৬ লাখ। এই মানুগুলো মহামারীতে আক্রান্ত সন্তান ও আত্মীয়স্বজনকে ফেলে রেখে পালিয়েছিল। তাদের এ স্বার্থপরতার শাস্তিস্বরূপ আল্লাহ তাদেরই আগে মৃত্যু দিয়েছিলেন। করোনাকালীন এ সময়েও একই দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। মানুষ করোনা আক্রান্ত আত্মীয়স্বজনকে ফেলে রেখে পালিয়ে যাচ্ছে। এটি মুসলিমদের স্বভাববিরুদ্ধ কাজ। নিজেকে মুসলিম হিসেবে দাবি করলে এ দায়িত্ব এড়ানো যায় না। অসুস্থ ব্যক্তিকে সেবা করার নির্দেশ রয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে। কাজেই মহামারীতে আক্রান্ত ব্যক্তিকে স্পর্শ করা যাবে না কিংবা মৃত্যুবরণ করা লাশকে দাফন করা যাবে না এ ধারণা অবিশ্বাসীদের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে, মুসলিমদের জন্য নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে ফতুয়া দিচ্ছে সেটি মুসলিমদের জন্য গ্রহণীয় নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মুসলিম কর্তৃক পরিচালিত হয় না। মুসলিমদের নিজস্ব ফতুয়া রয়েছে। সেই ফতুয়া মোতাবেক রোগীর সেবা করে লাশ দাফন করে প্রমাণ করে দিতে হবে মুসলিমরা পৃথিবীতে উৎকৃষ্ট জাতি এবং আল্লাহ বিধানই কেবল শ্রেষ্ঠ বিধান। এসব কথা মাথায় রেখে মানুষ ধৈর্য, সালাত ও এসতেগফারের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে মহামারী থেকে মুক্তি পেতে পারে। এ ছাড়া দাম্ভিকতা প্রদর্শন করে মহামারী থেকে বাঁচার চেষ্টা করা নিরর্থক। তবুও মানুষ দাম্ভিকতা ছাড়তে পারেনি। দেখা গেছে যারা রাজনীতি করে তাদের অনেকেই মহামারীর সুযোগে কৌশলে রাজনীতির ফায়দা লুটেছে। যারা ব্যবস্যা করে তাদের অনেকেই মহামারীর সুযোগে লাভের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এ প্রতিযোগিতায় স্বাস্থ্য ব্যবস্যায়ীরা রয়েছে এগিয়ে। মহামারীতে ফ্যাসিবাদী শাসকশ্রেণী সুবিধায় আরো একধাপ এগিয়ে গেছে। তারা যেকোনো গণজমায়েত মহামারীর অজুহাতে রুদ্ধ রেখে নিজেদের স্থায়িত্ব সুদৃঢ় করতে চাচ্ছে। মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষার্থীরা। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকলে ছাত্রদের আন্দোলনে ফ্যাসিস্টরা তটস্থ থাকত। কেননা করোনায় মৃত্যুভয়ের চেয়ে ফ্যাসিস্টদের ক্ষমতা হারানোর ভয় বেশি। পৃথিবীর বড় বড় গণ-অভ্যুত্থানের সূত্রপাত হয়েছে ছাত্রদের দিয়ে। সুতরাং, ফ্যাসিস্টরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের নিষ্ক্রিয়তা বেশি আশা করে। এজন্য করে যে, প্রতিপক্ষকে দমিয়ে রাখতে পারলে তাদের স্বার্থসিদ্ধির পথ মসৃণ হতে পারে। ফ্যাসিস্টরা জনসেবা করতে চায় না, তারা চায় সম্পদের পাহাড় তৈরি করতে। এসব দৃষ্টে মনে হয় না মানুষ অনুতপ্ত হতে পেরেছে। মানুষ অনুতপ্ত না হওয়া দাম্ভিকতা। দাম্ভিকরা অপেক্ষায় রয়েছে, কবে টিকা আবিষ্কার হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় টিকা আবিষ্কারের অপেক্ষা করতে করতে পৃথিবীকে সর্বস্বান্ত হতে হবে।
লেখক : গবেষক, সাহিত্য বিশ্লেষক, কলেজ শিক্ষক
সড়লধভভধৎয৪০@মসধরষ.পড়স


আরো সংবাদ



premium cement
গণকবরে প্রিয়জনদের খোঁজ কক্সবাজারে ভুল চিকিৎসায় প্রসূতির মৃত্যু, স্বজনদের হাসপাতাল ঘেরাও বঙ্গোপসাগরে ১২ নাবিকসহ কার্গো জাহাজডুবি ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশকে ‘নেট সিকিউরিটি প্রোভাইডার’ হিসেবে দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র রাজশাহীতে তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৮ ডিগ্রি রাজশাহীতে টানা তাপদাহ থেকে বাঁচতে বৃষ্টির জন্য কাঁদলেন মুসল্লিরা শরীয়তপুরে তৃষ্ণার্ত মানুষের মাঝে পানি ও খাবার স্যালাইন বিতরণ জামায়াতের এক শ্রেণিতে ৫৫ জনের বেশি শিক্ষার্থী নয় : শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী নজিরবিহীন দুর্নীতির মহারাজার আত্মকথা ফতুল্লায় ১০ লাখ টাকা চাঁদার দাবিতে নির্মাণকাজ বন্ধ, মারধরে আহত ২, মামলা পার্বত্যাঞ্চলে সেনাবাহিনী: সাম্প্রতিক ভাবনা

সকল