২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

মূল্যবোধহীন সমাজে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড

-

গত প্রায় ১০ মাস ধরে করোনার কঠিন থাবায় আক্রান্ত আমরা। শুধু আমরা নই, আক্রান্ত সমগ্র বিশ্ব। সহজ, স্বাভাবিক, চেনা জীবনের বাইরে এক সম্পূর্ণ অচেনা জীবনযাপন করছি আমরা। নিজেদের লোকজন, আত্মীয়স্বজন থেকে পর্যন্ত আমরা দূরে। প্রতিদিন নতুন নতুন মৃত্যুসংবাদ শুনছি। আপনজন, কাছের লোক অনেক চলে গেছেন, অনেকে ধুঁকছেন। কেউ কারো পাশে দাঁড়াতে পারছেন না। মানুষ মানুষের জন্য এই আপ্তবাক্যটিও এই মহামারী সত্য হতে দিচ্ছে না।
একে তো এই অপরিসীম দুর্যোগ তার মধ্যে লেগেছে আর এক মহামারী। নারীর মর্যাদাহানি, নির্যাতন, ব্যভিচার, ধর্ষণ। দিন রাতে লাগাতার, সারা দেশব্যাপী। এমনতিই সমাজের এক অংশের চোখে নারীরা নিম্নপ্রজাতি, গরু ছাগল সমতুল্য। আর নারীদের এক অংশও গরু ছাগল শুনতে শুনতে একসময় নিজেদের গরু ছাগল ধরে নেন। পুরুষের রায়ে অবলার মতোই আচরণ করেন। পুরুষ যেভাবে চালায় সেভাবেই চলেন। নিজের কোনো ইচ্ছা অনিচ্ছা নেই, চাওয়া পাওয়া বাসনা, কিছুই নেই। পুরুষের চাওয়াই তাদের চাওয়া। সে পুরুষ যদি হয় তার আঙুল সমান বয়সের তাহলেও নারীর চাওয়ার চেয়ে আঙুল সমান ওই পুরুষের চাওয়ার দাম বেশি। আর দুঃখ হলেও সত্যি এই নারীদের মধ্যে শিক্ষিত স্বনির্ভর নারীও আছেন। তারা ডিগ্রি পেয়েছেন, তবে মানসিক বোধ হয়নি তাদের।
সম্প্রতি কক্সবাজারের সীমান্ত চকরিয়ার হারবাং ইউনিয়নের পহরচাঁদা এলাকায় গ্রামের এক মা আর তার দুই মেয়ে এক ছেলে গরু চুরি করেছে এই মামলা দিয়ে তাদের কোমরে গরুর রশি দিয়ে বেঁধে যথেচ্ছ মারধর করা হয়েছে। এলাকার লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সার্কাস দেখেছে। সারা চকরিয়া ঘুরাল তাদের। লোকজন ছিঃ ছিঃ করতে লাগল। মুমূর্ষু অবস্থায় তাদের পুলিশের চৌকিতে নেয়া হলো, তারপর হাসপাতালে। সেখান থেকে জেলে। ওদের বরাত ভালো বেঁচে আছে, এমন পরিস্থিতিতে বাঁচার নজির নেই। নুসরাত বাঁচতে পারেনি, সোহাগী বাঁচতে পারেনি। এখানেও তো দু’জন সোহাগী, দু’জন নুসরাত ছিল।
দাস বেচাকেনার যুগ পার হওয়ার পর কিছু নিষ্ঠুর মানুষের করা গৃহের অভ্যন্তরে ঘটা দু’-চারটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদে মধ্যযুগীয় এমন বর্বরতার কথা আর শুনিনি। শোনা যাচ্ছে এই গরুচুরির কাহিনীর নেপথ্যে একজন জনপ্রতিনিধি আছেন। তার বালাখানায় যাওয়ার প্রস্তাব নাকচ করার কাহিনী আছে। সেই গোস্বা থেকেই চুরির নাটক।
দেশজুড়ে বড় বড় চোর, বড় বড় ডাকাত, বড় বড় লুটেরা। রিলিফের ত্রাণ চুরি করে, মাস্ক গ্লাভস এমনকি করোনার স্যাম্পল নিয়ে চোরামি করে। তাদের কখনো কোমরে রশি পড়েছে বলে শুনিনি। যারা বালিশ পর্দা বাঁশ বক্তৃতা কেলেঙ্কারি করে, টাকার পাহাড় গড়ে তাদের কোমরেও কোনো দিন দড়ি পড়েছে বলে শুনিনি। তারা বহাল তবিয়তে সমাজে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আর আদর্শের বাণী কপচাচ্ছে। হঠাৎ করে একজন শাহেদ, একজন পাপিয়া বা একজন স¤্রাট ধরা পড়েছে। এমন অসংখ্য শাহেদ বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর কথার তুবড়ি ছোটাচ্ছে। আমরা বুঁদ হয়ে শুনছি।
এ দেশে যেখানে নারী আছে সেখানেই অন্যায় অবিচার। নারীকে কেন্দ্র করে কিছু ঘটলেই অবশ্যম্ভাবী উঠবে চরিত্রের প্রশ্ন। বলা হবে নারীর চরিত্র খারাপ। চরিত্র রক্ষার দায়িত্ব যেন একমাত্র নারীর। এ দিকে বলা হচ্ছে নারী স্বাধীন, নারী অনেক এগিয়েছে কিন্তু কাজের প্রয়োজনে কোনো পুরুষের সাথে গেলেই তার চরিত্র খারাপ। এ সমাজ কবে ভাবতে শিখবে দু’জন নারী একসাথে যেভাবে কাজ করে, দু’জন পুরুষ একসাথে যেভাবে কাজ করে, একজন পুরুষ আর একজন নারীও একইভাবে কাজ করতে পারে। তারা সহকর্মী।
নারীবান্ধব সরকার, নারীর জন্য কত আইন কানুন অথচ নারীর প্রতি কেন সুবিচার নেই। এই সেদিন পর্বতারোহী রতœাকে পিষে ফেলল একটা প্রাইভটেকার। কিচ্ছু হলো না। রতœার বাবা রাজনীতিবিদ হলে বা তার টাকা-পয়সা থাকলে হয়তো গাড়ি আর তার চালককে খুঁজে পাওয়া যেত। কিন্তু রতœা মারা যাওয়ার খবরটি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো খবর আজ অবধি পেলাম না।
তবু ভালো, ফেসবুক ছিল বলে নারীর প্রতি অন্যায়-অবিচার সহিংসতার অনেকটাই এখন আমরা জানতে পারি। নারীর প্রতি অন্যায় হয় কিন্তু অধিকাংশ নারী অভিযোগ করে না। যেমন কক্সবাজারের নারীরা করেনি। ওদের অত সাহস কোথায় যে অভিযোগ করবে! অভিযোগ করে কি ওরা ক্ষমতাশালীদের বিরাগভাজন হবে, এলাকা ছাড়া হবে নাকি জীবনছাড়া হবে! জলে বাস করে কুমিরের সাথে যে লড়াই করা যায় না এটা ওরা ভালো করেই জানে।
আসি ধর্ষণ প্রসঙ্গে। ধর্ষণ শব্দটা শুনতে যেমন অশ্লীল, বানান তেমন কঠিন, উচ্চারণও জঘন্য। কিন্তু এই শব্দটিই এখন সমাজজীবনে সবচেয়ে সহজলভ্য শব্দ। এই যে আমি লিখছি এই সময়ের মধ্যেই হয়তো ঘটে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে একাধিক ধর্ষণ।
একটা সময় ছিল যখন ধর্ষণ করার জন্য আড়াল লাগত। অন্ধকার লাগত, নির্জনতা লাগত। মানুষের মনে এই বোধ ছিল যে ধর্ষণ একটা খারাপ কাজ। কিন্তু এখন ধর্ষণ এক মহোৎসবের কাজ। একা একা করলে চলে না, দলবদ্ধ হয়ে উল্লাস করে করতে হয়। যেমন হয়েছে এমসি কলেজে। বেগমগঞ্জের ভিকটিম বলেছেন, তাকে ধর্ষণ করা হয়নি। কিন্তু যেভাবে দলবেঁধে তার সর্বাঙ্গে টর্চ মেরে মেরে দেখা হয়েছে, নানা ধরনের জিনিস ব্যবহার করা হয়েছে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিজাতীয় আনন্দে, আর সেগুলো ভিডিও করা হয়েছে। আমার এক পুরুষ বন্ধু বেগমগঞ্জের ভিডিওটা দেখতে গিয়ে বমি করেছে। তাহলে সহজেই অনুমেয় একজন নারী ও ভিডিও দেখলে তার মনে কী মারাত্মক বিবমিষার উদ্রেগ হবে। কতটা ক্ষতি হবে তার শারীরিক মানসিক!
ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের খসড়া অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। ইতোমধ্যে মহামান্য রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরে অধ্যাদেশ জারি হয়েছে। সংসদ চলমান না থাকায় এবং পরিস্থিতির কারণে বিবেচনায় বিষয়টি জরুরি বিবেচনা করে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের কিছু ধারা সংশোধন করে অধ্যাদেশটি জারি করা হয়েছে। পরবর্তী সংসদে অধ্যাদেশটি আইনে রূপ নেয়ার কথা। আর অধ্যাদেশ জারির পর ভুয়াপুরে অনুষ্ঠিত একটা ধর্ষণ মামলার রায়ও হয়েছে।
কোনো সন্দেহ নেই, সবার জানা, জনদাবির মুখে এই অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। দেশে প্রতিনিয়ত যেভাবে ধর্ষণ হচ্ছে তাতে দাবি ওঠা যৌক্তিক। কিন্তু ‘ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড’ এই অধ্যাদেশ জারি করলেই কি ধর্ষণ কমবে? বা সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড এই রায় দিলেই কি তা কার্যকর হবে?
২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯/১ ধারায় ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ছিল। এই ধারাটি সংশোধন করে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড করা হয়েছে।
ধর্ষণ এবং ধর্ষণের ফলে মৃত্যুর কারণে ইয়াসমিন হত্যাসহ একাধিক মামলায় ধর্ষকের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। তাতে ধর্ষণ মোটেও কমেনি। আমার কথা হচ্ছে আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড রাখা হয়েছে ভালো কথা। কিন্তু আমরা ধর্ষণ ঘটে যাওয়ার পর কী শাস্তি হবে সেটা নিয়ে আগাম চিন্তা করব নাকি ধর্ষণ যাতে না হয় সে চিন্তা করব? একটি মেয়েকে ধর্ষণ করা হলো, তারপর মামলা মোকদ্দমা হলো, ধর্ষকের ফাঁসি হলো। তাতে মেয়েটার লাভ কতটুকু? লাভ এতটুকুই যে তাকে ধর্ষণ করার একটা শাস্তি হলো। কিন্তু ধর্ষণের কারণে তার জীবনটা যে তছনছ হয়ে গেল, সে এই পিছিয়ে থাকা সমাজে সংসারে যে অসম্মানের জীবনযাপন করল তার কি কোনো কিনারা হলো এই শাস্তির কারণে! আমি এই আইনের বিপক্ষে বলছি না। কিন্তু আমি বলছি, এমন কিছু ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন যাতে পুরো দেশ, পুরো সমাজ, পুরো সংসারে ধর্ষকদের বিরুদ্ধে ঘৃণা উচ্চারিত হয়। তাহলেই ধর্ষণ কমা বা বন্ধ হওয়া সম্ভব। এমনিতেই ধর্ষিতার পরিবার ধর্ষণের কথা প্রায়ই চেপে যায় সমাজে জানাজানি হওয়ার ভয়ে।
তারপরও যারা সাহস করে থানা অবধি যায়, থানা তাদের অনেকেরই মামলা নিতে চায় না। কারণ ধর্ষকরা ক্ষমতাশালী হয়। মামলা যদি করতেও পারে ক্রমাগত হুমকি আসতে থাকে মামলা তুলে নেয়ার জন্য, জীবনের হুমকি আসে। এসব কিছু পার করে যারা টিকে থাকে এবার তারা পড়ে মামলার দীর্ঘসূত্রতার কবলে। ভুয়া সাক্ষী দেয়া ভুয়া প্রমাণ জোগাড় করার লোকেরও অভাব হয় না ক্ষমতাশালীদের পক্ষে। কাজেই রায় অবধি পৌঁছার সুযোগ খুব কম ভিকটিমেরই হয়। বেগমগঞ্জের কথাই ধরি। ঘটনাটি ঘটেছিল এক মাস আগে। সমাজ সংসারের ভয়ে মেয়েটি চেপে রেখেছিল। আর এখন যে জানাজানি হয়েছে মেয়েটি রাত কাটাচ্ছে আজ এর কাল ওর বাড়ি। ওই মেয়ের জীবনের নিরাপত্তা কে দেবে! কত দিন দেবে!
মৃত্যুদণ্ড সর্বোচ্চ শাস্তি মানে ধর্ষকের সতর্কতা বেশি হবে। স্বভাব তো তাদের বদলাবে না। তারা ধর্ষণ করবে, তবে প্রমাণ রাখবে না। এখন মেয়েগুলো ধর্ষণের পর বেঁচে যায় এরপর অনেক ক্ষেত্রেই তারা আর বাঁচবে না। মামলা করার জন্য, সাক্ষী দেয়ার জন্য, ধর্ষককে চেনার জন্য ধর্ষিতাকে বাঁচিয়ে রাখা হবে না। তাই যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে এবার শুধু ধর্ষণ নয় ধর্ষকের হাতে হত্যাও বাড়বে। আর যদি সে মেয়ে বাঁচেও আইনের ফাঁকফোকর আগেও ছিল, এখনো আছে। আদালতের ওপরেও আছে আরো বড় আদালত। তাই ফাঁসি পর্যন্ত যাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
আবার অন্য সম্ভাবনাও আছে। যেহেতু সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কিছু ফলস মামলাও সাজানো হতে পারে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য। ধনীদের মধ্যে এক শ্রেণীর নারী আছে তাদের দিয়ে অনেক কিছুই করানো সম্ভব। মাত্র কিছু দিনের মধ্যে এমন অনেক প্রমাণ আমরা পেয়েছি। আর টাকার লোভে দরিদ্র কোনো কোনো নারী এমনটা করবেন না তাও বলা যায় না।
আমাদের ছেলেবেলায় এই ধর্ষণ শব্দটার সাথে কোনোই পরিচয় ছিল না আমাদের। খুব জোর আমরা শুনতাম, গ্রাম এলাকায় মুখ চেপে ধরে পাটক্ষেতে নিয়ে গেছে, তাও বছরে-দু’ বছরে একটা। মফস্বলে কখনো এসব শুনিনি। সভ্যতার বিস্তারের সাথে সাথে ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের রকমফের হয়েছে, বিস্তার হয়েছে। ধর্ষণ যে শুধু অন্য নারীকে করা হচ্ছে তাও তো নয়, ঘরের বউকে ধর্ষণ করা হচ্ছে। এ বউটি কার কাছে বিচার চাইবে? ছোট ছোট পুরুষ শিশুকে বলাৎকার করা হচ্ছে। তারা কোথায় কার কাছে যাবে!
আমাদের দেশে অসংখ্য ভাসমান মানুষ আছে। তাদের এক বিরাট অংশ বস্তিতে ফুটপাথে গ্যারেজে থাকে। অনেক যুবতী মেয়ে আছে তাদের মধ্যে, আছে অল্প বয়সী বউ।রাতে রাস্তায় যারা মাস্তানি করে বেড়ায়, ছাত্ররাজনীতির নামে যারা মামদোবাজি করে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে যারা টহলদারি করে বেড়ায় তাদের এক বড় অংশের শিকার হয় এই নারীরা রাতের পর রাত। দু’ মুঠো ভাত জুটাতে এদের প্রাণান্ত। এরা কোথায় কার কাছে যাবে মামলা দিতে। যে অপ্রকৃতিস্থ রমণী নিঝুম বসে থাকে গ্যারেজের পাশে বা ট্রেনের পরিত্যক্ত বগিতে, যার বোধ অনেকটাই অসাড়, কিন্তু দেহ সতেজ সেও প্রতি রাতে শিকার হয় নির্যাতনের। সে কোথায় যাবে কার কাছে যাবে। আর এসব ঘটনাই বোঝায় আমাদের মূল্যবোধ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে।
কাজেই শাস্তি বাড়ানো বা কমানো তো ধর্ষণ বাড়বে বা কমবে বলে মনে হয় না। শাস্তি বাড়ালেই যে মামলা বাড়বে এমনও নয়। আসল বিষয় হচ্ছে প্রতিরোধ। এই ডিটিজাল যুগে এমনকি কোনো ব্যবস্থা নেয়া যায় না যে, কোথাও এ ধরনের ঘটনা সংঘটিত হলে একটা অ্যালার্মের মতো বাজতে থাকবে। সবাই জেনে যাবে। বুঝতে পারবে কোন স্পটে বিষয়টি ঘটছে। পাড়া মহল্লায় কি প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তোলা যায় না। এক সময় এ দেশের সেরা ছাত্ররা ছাত্ররাজনীতি করত। এদেশ বাহান্নার ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান আর মুক্তিযুদ্ধের পুরোভাগে ছিল ছাত্ররা। আজকাল ছাত্ররাজনীতির কথা শুনলেই সবার নাক কুঁচকে ওঠে। ছাত্ররাজনীতি আজকাল ব্যবসা। দেশে এখন একটাই দল। কারণ ওই দলের নাম বললেই রোজগার করা যায়। আদতে হয়তো আকাম করা ছাত্রটি ওই দলেরই নয়। কিন্তু সেই শনাক্তকরণ বা বাছাইপ্রক্রিয়া কোথায়। এই ছাত্রনেতাদের কি কাজে লাগানো যায় না ধর্ষণ প্রতিরোধে? তাদের দিয়েই কি গঠন করা যায় না ছোট ছোট স্কোয়াড?
পুলিশকে আরো কঠোরভাবে নির্দেশ দেয়া দরকার। মামলা দিতে এলেই যেন তারা মামলা না নিয়ে বিদায় না করে দেয় সেটা দেখা দরকার। পুরো ঘটনা শুনে আলামত দেখে যেন পুলিশ ব্যবস্থা নেয় সেটা দেখা প্রয়োজন। পুলিশ যেন হয় নির্যাতিতের পক্ষে মানবিক পুলিশ, নির্যাতনকারীর পক্ষে নয়।
মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটেছে সমাজে সংসারে। আগে প্রতিটি পরিবারে নারীর আলাদা মর্যাদা ছিল। বাড়ির সদস্যরা শেখাতেন মায়ের পায়ের নিচে বেহেশত, দাদা-দাদী, নানা-নানী গুরুজন, নারীরা মায়ের জাতি। এখন ওসব নেই। এখন সবাই ব্যস্ত। সন্তানদের মূল্যবোধের শিক্ষা দেয়ার সময় বাবা-মায়ের নেই। আর ছেলেমেয়েরও অত সময় বা ধৈর্য নেই বাবা-মায়ের কাছে শিক্ষা নেয়ার। যৌথ পরিবার ভেঙে পড়েছে। একজন না শিখালে আরেকজন শিখাবে সে সুযোগও নেই। এখন একদল দৌড়াচ্ছে ক্যারিয়ারের পেছনে, আর একদল কত সহজে টাকা কামানো যায় গাড়ি বাড়ি স্মার্টফোন কেনা যায় সেসবের পেছনে। তাই নারীকে সম্মান, বড়দের শ্রদ্ধা, প্রতিবেশীর প্রতি দরদ এই মৌলিক মূল্যবোধগুলো যেন এখন সেকেল বস্তু। আর সরকারেরও তেমন কোনো চেষ্টা দেখি না মূল্যবোধের উদ্বোধন ঘটানোর।
ধর্ষকদের বয়কট করা দরকার। প্রথম বয়কট হবে ঘর থেকে। যে ঘরের ছেলে এটি করবে তাকে বাবা-মা খেতে দেবে না, তার সাথে কথা বলবে না, আলটিমেটাম দেবে। তারপর সামাজিকভাবে বয়কটা করা দরকার। যে পরিবারের কেউ ধর্ষক হবে সে পরিবারকে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। তাদের সাথে বিয়ে-শাদি সামাজিক আচার আচরণ বাদ দিতে হবে। বন্ধুরা তাদের সাথে মিশবে না, আত্মীয়স্বজন পরিচয় দেবে না, এমনকি সবাই যদি তাদের সাথে কথা না বলে, দোকানদাররা যদি তাদের কাছে জিনিসপত্র বিক্রি না করে সেটা হবে বিরাট শাস্তি। মানুষের ঘৃণার চেয়ে বড় শাস্তি আর নেই।
ধর্ষকের পক্ষে যেন কোনো উকিল না দাঁড়ায় সেটা দেখা দরকার। প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে কি অপরাধী আইনের সহায়তা পাবে না! এমন কিছু অপরাধ আছে যা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার, অপরাধীরা প্রকাশ্য। সেখানে তো আইনের সহযোগিতা না পাওয়াই উচিত।
সবশেষে একটা কথা বলি, এক শ্রেণীর উৎকট পুরুষ ধর্ষণের জন্য নারীর পোশাককে দায়ী করছেন। তিন বছরের কন্যাশিশু ধর্ষিত হলো কোন পোশাক পরে, আশি বছরের বৃদ্ধা ধর্ষিত হলেন কোন পোশাক পরে? তনু ও নুসরাত হিজাব পরত, তারা কেন ধর্ষিত হলো? দৃষ্টিভঙ্গি বদলান ভাইয়েরা। দেখার চোখটাকে বদলান। তাহলে পোশাক কোনো সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে না।
নারীর প্রতি অন্যায় অবিচার ধর্ষণ ঠেকাতে পারে যুগপৎ সচেতনতা, জাগরণ, প্রতিরোধ ও শাস্তি। আমাদের চেষ্টা করতে হবে যেন আমাদের সন্তানরা মূল্যবোধ নিয়ে বেড়ে ওঠে। তারা যেন ধর্ষক না হয়ে ওঠে। আর চেষ্টার পরও যদি তারা ধর্ষক হয় তাহলে আইনের শাস্তি কার্যকর করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। হ
লেখক : কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

 


আরো সংবাদ



premium cement