১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কবুতরের ডাক

-

যশোর থেকে ঢাকায় বদলি হয়ে এসেছে সবুজের বাবা। মোহাম্মদপুর এলাকায় বাসা নিয়েছে। বাসাগুলো গায়ে গায়ে লাগা, ঠাসাঠাসি। এ বাসায় প্রথম যেদিন সকালে কবুতরের ডাক শুনল, সবুজ অবাক হয়ে এ দিক ও দিক খুঁজতে লাগল। পেল না। অনেক পরে ও বুঝেছিল জানালার ঠিক নিচে একটা কার্নিশ আছে। সেখানে দুটো কবুতর থাকে। ওরা কি বাসা বেঁধেছে না মাঝে মাঝে আসে বোঝার কোনো উপায় নেই। নিচে গিয়ে তাকিয়ে অত উঁচুতে কিছুই দেখতে পায়নি। আবার অনেক চেষ্টা করেও কার্নিসটা দেখতে পায়নি। তবে ওখানে দুটো কবুতর আছে, সকালে ডাকে এটাতেই ওর আনন্দ। একদিন জানালা দিয়ে দুটো কবুতরকে উড়ে যেতে দেখেছিল তাতেই বুঝেছে ওরা জোড়। 

যশোরের বাসাটা ছিল একতলা, বড় উঠোন। সবুজের এক বাক্স কবুতর ছিল। ও সকালে উঠোনে দানা ছড়াত। কবুতরগুলো ঘুরে ঘুরে খেত। কখনো ওর হাতে, ঘাড়ে এসে বসত। সে যে কী আনন্দ! ঢাকায় আসার আগে বাবা বললেন, কবুতরগুলো বিলিয়ে দিতে। ঢাকায় ছোট্ট বাসা। কবুতর পালার জায়গা নেই। তা ছাড়া প্রতিবেশীরা বিরক্ত হবে। প্রিয় কবুতরগুলো বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়দের দিয়ে এলো। সে দিন সবুজ ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কেঁদেছিল। মা-বাবার চোখও ছলছল করছিল। মা-বাবাকে ফিসফিস করে বলেছিল,

: দেখো না কোনোভাবে কবুতরগুলো নেয়া যায় কি না! অন্তত কিছু কবুতর। 

বাবা জবাব দেননি। তাতেই যা বোঝার বুঝেছিল সবুজ। তা ছাড়া কিছু কবুতর সাথে নেয়াতে তার আপত্তি ছিল। সে সব কবুতরকে সমানভাবে ভালোবাসে, সবাই তার বন্ধু। কাকে রেখে কাকে নেবে সে! কে কারো মনে ব্যথা দিতে পারবে না। বরং এই ভালো সবাই থাকুক বন্ধুদের কাছে। যাবার আগে শুধু একটাই অনুরোধ করেছিলÑ

: কবুতরগুলোকে দেখে রাখিস, আর জবাই করে খাস না। 

ওদের যশোরের বাসার উঠোনে একটা আমগাছ ছিল। সেখানে মাঝে মাঝে পাখি এসে বসত। কাক বসত ইলেকট্রিকের তারে। প্রায়ই বারান্দা থেকে ছোঁ মেরে সাবান নিয়ে যতে। সে সাবান ফেলত অনেক দূরে। কতদিন সবুজকে দূর থেকে সাবান খুঁজে আনতে হয়েছে। ততক্ষণে সাবানের অর্ধেকটাই খেয়ে ফেলেছে কাক। যশোরের বাসার উঠোনের একপাশে পাতকুয়ো, টিউবঅয়েল, দূরে বাথরুম। স্বচ্ছন্দে কবুতররা ঘুরত, ফিরত। ঢাকায় সব আটোসাঁটো। ফাঁকফোকর নেই। গাছ নেই, পাখি নেই। আছে শুধু দুটো কবুতর। 

একদিন বাবার সাথে বেরিয়েছিল সবুজ। রিকশা থেকে দেখেছিল রাস্তার পাশে দোকানে অনেক মাছ, অনেক পাখি, খরগোশ। ও অবাক হয়ে বলেছিল, 

: তুমি যে বললে ঢাকার মানুষ পাখি পাললে বিরক্ত হয়। তা এসব পাখি মাছ কারা কেনে?

: এখানেও বড় বড় জমিদারদের মতো বিশাল বিশাল বাড়ি আছে বাবা। সেসব বাড়িতে অনেক জায়গা, অনেক চাকরবাকর। তারা শুধু পাখি কেন, হরিণও পালে। কিন্তু আমাদের সে সুযোগ কোথায়!

সবুজ বাবার কথা বোঝে। বোঝে এক শ্রেণীর মানুষ পাখি পালতে পারবে আর ওরা পারবে না, এটাই বাস্তবতা। ও যশোরে ফেলা আসা কবুতরগুলোকে মনে করে। রাতে ওদের স্বপ্ন দেখে। আর সকালে ঘুম ভেঙে ঢাকার কবুতরের ডাক শোনে। 

 সেদিন ঘুম ভাঙার পর তড়িঘড়ি স্কুলে গেল সবুজ। স্কুল শেষ করে বাড়ি ফেরার পথে ওর মনে হলো, তাই তো আজ তো সকালে পাখির ডাক শুনিনি! কবুতরগুলো কি আজ আসেনি, নাকি ওদের কিছু হয়েছে! 

বাড়ি ফিরে জানালা দিয়ে নিচু হয়ে কার্নিশ দেখার চেষ্টা করে, পারে না। ওর মন বিষণœ হয়ে থাকে। মা টেবিলে দুধ রেখে যান। ও খায় না। 

 

দুই.

 

বিকেলে মনমরা হয়ে বারান্দায় দাঁড়ায় সবুজ। কিছুক্ষণ পর ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে একটা কবুতর এসে গ্রিলে ধাক্কা খায়। ও দ্রুত ধরে ফেলে কবুতরটাকে। না ধরলে নিচে পড়ে নির্ঘাত মারা যেত। সন্তর্পণে গ্রিলের ভেতর দিয়ে বারান্দায় ঢুকায়। দ্রুত পানি এনে ঠোঁটের কাছে ধরে। কবুতরটা ব্যথাতুর চোখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়। এবার আস্তে ওর পালক সরিয়ে দেখে বাম পাখনার নিচে গভীর একটা ক্ষত। সবুজ জানে কিভাবে ক্ষতের পরিচর্যা করতে হয়। ও পরিচর্যা করে। ততক্ষণে জোড়ের কবুতরটা এসে বসেছে গ্রিলে। এক দিন দুই দিন তিন দিন। তৃতীয় দিন উঠে দাঁড়ায় কবুতরটা। ও উড়াল দিতে যায়। সবুজ হাসে। কবুতরটার গায়ে হাত বুলিয়ে বলে, 

: যা, উড়ে যা, তবে চলে যাস না। কার্নিশে থাকিস। সকালে ডাকিস।

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement