২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

এই শহরে কোরবানি ঈদ

-

ছোটবেলায় ঈদ আসছে, ঈদ আসছে। চার দিকে উৎসবের আমেজে সবাই। কবে যাবো গরু কিনতে? গরুটা শান্ত হবে নাকি পাগলাটে? কী রঙের হবে, সাদা-কালো নাকি মিশ্র? এতসব জল্পনা-কল্পনা চলত আমাদের ছোটদের মাঝে। বড়দের ব্যাপার ছিল অন্য। গরু কোথায় রাখা হবে? কারা গরু কাটবে কারা পাহারা দেবে? কোরবানির পর গরুর রক্ত-গোবর-বর্জ্য কোথায় কিভাবে ফেলা হবে, এসব নিয়ে প্রতি সন্ধ্যার পর অফিস ফেরত মুরুব্বিদের আলোচনা চলত রাস্তার মোড়ে, ড্রইংরুমে গলির মাথায় চেয়ার পেতে চা খেতে খেতে। প্রতিদিন আলোচনা প্রতিদিন সুরাহা হলেও আবারো আলোচনা হাসিঠাট্টা আড্ডা আর খুনসুুটি চলত অনবরত। এলাকার বিশিষ্ট বিত্তশালী গোলা মিয়ার (গোলাম আহমেদ) গরু ততদিনে কেনা হয়ে যেত। একটা-দুইটা না সাত-আটটা। ইয়া বড় বড়, তাগড়া তাগড়া। ঈদের কমছে কম এক সপ্তাহ আগে কেনা সেই গরু দেখতে আশপাশের এলাকা থেকে কাঁধে পিঠে শিশুদের নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসত বহু লোকজন। দেখতে দেখতে আমাদের গরু কেনার সময় চলে আসত। ঈদের দুই দিন আগে এলাকার প্রায় সবাই গরুর হাটমুখী হতো। দারুণ উত্তেজনা নিয়ে দল বেঁধে গরুর হাটে যাওয়া, গরু দেখা, দরদাম করা। মুখের ভেতরে বুট-বাদামের কটর মটর আওয়াজের সাথে আমরা ছোটরা সেসব দেখি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গরুর হাটের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত চষে বেড়াই, ক্লান্তি আসে না। হাটের ভেতরে বাপ-চাচারা, ভাইয়েরা মিলে দারুণ আনন্দ-উত্তেজনায় থাকি। তার পর একসময় গরু কিনে হাঁটতে হাঁটতে গরুর সাথে শহুরে রাখাল হয়ে যাই। রাস্তায় রাস্তায় একে অপরের গরুর দরদাম বলাবলি করতে করতে কখন যেন নিজেদের অজান্তেই বাড়ি ফিরে আসি। বাড়ি ফিরে আমাদের উত্তেজনার পারদ বাড়তে থাকে গরুকে খাওয়ানোর তাগিদে। খৈল, ভুসি, ভাতের মাড়, খড় জোগাড় করা। তার পর গুলিয়ে খাওয়ানো, যেন কতকালের গরুর রাখাল। তার পর একসাথে সব বন্ধুরা মিলে দল বেঁধে এলাকার সব গরু দেখা। আর ঘরের ভেতরে তখন মা বোন ফুফু চাচীদের রান্নার আয়োজনের চিন্তা। আদা রসুন, পেঁয়াজ, গরম মসলার গন্ধে শহরের বাতাস তখন জানান দিয়ে ফেলেছে গোশত রান্নার বিশাল আয়োজনের খবর। সাথে মেহেদি গাছ থেকে মেহেদি তোলা, মেহেদি বাঁটা, আর মেহেদি লাগানোর ধুম ঘরে ঘরে। হাতে হাতে ঘুরে বেড়ায় মেহেদির কাঁচা ঘ্রাণের আল্পনা। নিজেদের উদ্ভাবনী ডিজাইনে মেহেদির রঙে একে অন্যের হাত রাঙিয়ে দিত। বহু দিনের সযতনে রাখা ইয়া বড় বড় পাতিল, সসপেন ধুয়ে মুছে রেডি করা। পাটা পুঁতায় ধার দেয়া, দা বঁটি ছুরি চাক্কু ধার দেয়ার সময় গোল হয়ে জমে দেখা আগুনের ফুলকির ছটা কিভাবে ঘর্ষণে ঘর্ষণে ফেটে ফেটে ছোটে। আর তার সাথে ধাতব গন্ধের মিশ্রণ আওয়াজ চার দিকে ঈদের আমেজকে আর উত্তেজনাময় করে তুলত। ঘরে ঘরে তখন কাজের সাথে গল্পের ফুলঝুরি ছুটত, হাসিঠাট্টায় একাকার থাকত মা, ফুফু, দাদুরা। মসজিদে মসজিদে তখন কোরবানির মাসলা মাসায়েল নিয়ে হুজুররা বয়ান করে চলতেন।
ঈদের আগের দিন সকালে আমরা এলাকার ছোট-বড় ভাইয়েরা সবাই একসাথে সবার গরু-ছাগল নিয়ে নব্য শহুরে রাখালের দল সেজে চলে যাই, আমাদের এলাকার সাথে লাগোয়া বিখ্যাত কমলাপুর রেলস্টেশনে। সেখানে রেলইঞ্জিন ধুয়ে মুছে ঘুরানোর জায়গার পাশে বিশাল মাঠে চকচকে সবুজ ঘাসের সমারোহ দেখে গরু ছাগলের চোখ লকলক করে উঠত। ওরা যখন ঘাস খওয়ায় মগ্ন আমরা তখন চাদা তুলে দোকান থেকে মুড়ি কিনি, সাথে বাড়ি থেকে বয়ে আনা কাঁচামরিচ পেঁয়াজ আর সরষের তেল কলাপাতার ওপর বিছিয়ে বিশাল আয়োজনে কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় ছোটখাটো পিকনিক সেরে ফেলি। ঝালে ঝালে একাকার। যে যত সহ্য করবে সে তত বড় হবে। ঝাল খেয়ে হতচ্ছাড়া হয়ে যাই বড় হওয়ার সাধ ভুলে ইঞ্জিন ধোঁয়ার তীব্র গতির সেই পানির কলে হইহুল্লোড়ের সাথে গোসল করি। হঠাৎ শুনতে পাই, জুয়েলের ছাগল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই ভেজা জামাকাপড় নিয়েই খুঁজতে ছুটি কালো রঙের ছাগলটাকে। ওয়ার্কশপ, ইঞ্জিনঘর, ট্রেনের ভাঙা বগিগুলো তন্ন তন্ন করে খুঁজে না পেয়ে জুয়েলের কান্নার সাথে আমাদের মনও আর্দ্র হয়। সবাই মিলে জুয়েলকে সান্ত্ব—না দেই। আমরা সবাই মিলোমাদের গরু ছাগলের গোশত থেকে জুয়েলের বাসায় বেশি করে পাঠাব। এ সান্ত¡¡নায় জুয়েলের কান্নার পানি শুকায় না। গাঢ় হয় চোখের লাল রঙ। বাড়ি ফিরি মন খারাপ করা ক্লান্ত অবসন্ন দুপুরে। এলাকার ঘরে ঘরে রটে যায় সে খবর। মা-খালারা ছুটে যায় দল বেঁধে জুয়েলে মা-বোনদের সান্ত্বনা দিতে। এলাকার ময় মুরুব্বিরা এ বিষয়ের সহজ সুন্দর সমাধানের জন্য আলোচনায় বসে। তখন এলাকার একজনের কষ্টে সবার মধ্যে যে কাতরতা দেখেছি, আহা আজ কোথায় সেই অন্যের দুঃখে দুঃখী হওয়া, কাতর হওয়া। এরই মধ্যে জুয়েলদের বাসা থেকে খবর আসে জুয়েলের বোনের পরীক্ষার সাজেশন পাওয়া যাচ্ছে না। এ নিয়ে জুয়েলের বোনের সেকি কান্না। এ কে ছাগল হারানোর বেদনা তার ওপর সাজেশন হারানোর কষ্ট দুইয়ে মিলে হাহাকার একটা পরিবেশ। সাজেশন টেবিলের ওপর থেকে এক মুহূর্তে উধাও হওয়ার খবরে আশ্চর্য হয়ে আমরা ছোটরা ওদের ঘরের ভেতরে ঢুকলাম। দল ভাগ হয়ে সারা ঘরময় খুঁজতে খুঁজতে খাটের তলার একেবারে কোণায় দেখি কি যেন জ্বলজ্বল করছে, কালো কুচকুচে। সাথে সাথে তিন ব্যাটারির টর্চলাইট মারতেই আমরা ছোটরা আনন্দে আত্মহারা। হই হই, পাওয়া গেছে, পাওয়া গেছে, ছাগল পাওয়া গেছে। সিলেবাসটার কিছু অংশ খেয়েছে কিন্তু বেশির ভাগ অংশই অক্ষত আছে। সেই প্রথম জানতে পারলাম ছাগলে কি না খায়, এই কথার মর্মার্থ। পুরো এলাকায় শোরগোল ওঠে। বড়-ছোট ভাইবোন খালাম্মা-খালু, ময় মুরুব্বিরা ভিড় জমায় জুয়েলদের বাড়িতে। সবার চোখে মুখে জয়ের আনন্দ, প্রাপ্তির আনন্দ। ঈদের আনন্দ কয়েক গুণ বেড়ে যায়। পুরো এলাকার লোকজন গাছপালা রাস্তাঘাট মনে হয় হাসছে, আনন্দে ভাসছে। জুয়েলদের ছাগল ও জুয়েলের বোনের সিলেবাস হারানোর গল্প আমাদের ঈদের আনন্দকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। স্টেশন থেকে বড় রাস্তা পার হয়ে সবুজবাগ ঢোকার মুখের প্রথম বাড়িটাই জুয়েলদের। পথ সামান্য হলেও ছাগলটা কিভাবে যে এই অল্প সময়ের মধ্যে বাড়ির খাটের তলায় এসে সাজেশন খাচ্ছিল তা নিয়ে মুখোরোচক অনেক গল্প তৈরি হয়। ডালপালা বিস্তার করে সেই গল্প দিগি¦দিক ছড়াতে দেরি হয় না। ঈদের সেই গল্প আজো আমাদের অনেকেরই মনের দরজায় কড়া নাড়ে। মনে আছে, ছাগল ফিরে পাওয়ার আনন্দে এলাকার বড় ভাইয়েরা এলাকার ভেতরের মোড়ে চিনি লেবুর শরবত বানাতে বসে যায়। ঈদের আগের দিন বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সবাইকে বিনা পয়সায় নিজেদের হাতে বানানো শরবত খাওয়ায়। গরমে ঘেমে সেই শরবত সবাই একটু পরপর গিলতে যাই। আরেকবার ঈদের আগের রাতে গরু ছুটে গিয়েছিল। বিশাল পাগলা ষাঁড়। দৌড় সে কীদৌড়। ষাঁড়ের পেছন পেছন অনেকে। আমাদের কেউ কেউ সাইকেল নিয়ে। রাস্তাঘাটে মানুষ পাগলা ষাঁড়কে ছুটতে দেখে নিজেরাও ভয়ে দিগি¦দিক। সেই ষাঁড় শেষ পর্যন্ত ধরা খেল খিলগাঁও রেলগেটের কাছে। ধড়া পড়ল ঠিক না। আসলে ট্রেনের হুঁইসেলে সেটা কি মনে করে ঘাবড়ে দাঁড়িয়ে গেল। ভাগ্য ভালো, সে সময় একটা ট্রেন আসছিল বলে রক্ষা। এরকম অজস্র কাহিনী-উপকাহিনীর হাসি-আনন্দের মধ্য দিয়ে আমাদের গরু রাখার শহুরে রাখালি গল্প তৈরি হয়ে আছে।
ঈদের আনন্দে ঘুম আসে না সহজে খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যায়। ঈদের সকালে দল বেঁধে মসজিদে ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়া। নামাজ শেষে কোলাকুলি করার মধ্য দিয়ে সব ভেদাভেদ ভুলে যাই। ঘরে ফিরে জামাকাপড় বদলে সবাই এক দিনের কসাই হয়ে যাই। কোরবানিতে অংশগ্রহণ করি। আমরা ছোটরা যাদের গরুর কাছে তখনো যাওয়া নিষেধ, বিশেষ করে জবাই করার সময়। সবাই যখন গরুকে ধরে কোরবানি করতে গরুকে শুইয়ে প্রস্তুত, আমরা তখন তাদের ফাঁকফোকর গলে গরুর গায়ে হাত ছুঁয়ে রাখি, যাতে মনে হয় আমরাও সরাসরি গরু কোরবানিতে আছি। কোরবানি হয়ে গেলে পারি বা না পারি গোশত কাটতে নেমে পড়ি। গোশত যা কাটি তার চেয়ে বেশি জামাকাপড়ে গোশতের ছিটেফোঁটা রক্ত মেখে একটা কসাই কসাই ভাব আনি। তার পর আমরা ছোট ছোট কসাইরা গল্প করি কার গরু ফেলতে কত কষ্ট হয়েছে। কোনটার তেজ বেশি ছিল, কোনটা শান্ত ছিল। এভাবেই গরু কোরবানি শেষে গোশত খাওয়ার গল্প চলে আসে। এলাকার গরিবদের মাঝে গোশত বিলানোর ধুম পড়ে যায়। দুপুর গড়িয়ে বিকেলে নতুন জামাকাপড়ে রঙিন হয়ে ঈদের বকশিশ হাতড়ে বেড়াই। নতুন চকচকে এক টাকার নোট পাই একটা করে চাচা-ফুফু দাদা-দাদুর কাছ থেকে। নতুন টাকার ঘ্রাণ নিয়ে বেরিয়ে পড়ি ঘর থেকে। মোড়ে মোড়ে আড্ডা জমে ওঠে। দল বেঁধে একেক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে তাদের গরু-ছাগলের গোশত খেয়ে তারিফ করতে করতে সময় বয়ে যায়। পরদিন দল বেঁধে হাঁটি শহরের বিভিন্ন রাস্তায়। হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই শিশুপার্ক, সেখান থেকে বাসে করে চিড়িয়াখানা। এভাবে সারা শহর দাপিয়ে ফিরি এলাকায়। এলাকায় তখন ঘরে ঘরে গোশতের বিভিন্ন আইটেমের রান্না, ভুনা গোশত, আচার গোশত, কাঁচামরিচের গোশত, তেহারি, কলিজা ভুনা, নেহারি দিয়ে চালের রুটি, ভুনা গোশতের ঝোল দিয়ে মুড়ি মাখা আরো কত কী? কোরবানি ঈদ চলে যায়। কিন্তু এর রেশ গোশত খাওয়ার মাঝে অনেক দিন থেকে যায়।
সেই ঈদগুলো এখন ঢুকে গেছে টেলিভিশনের মতো একটা বোকা বাক্সের ভেতর, হাতের মুঠোয় থাকা মোবাইল ফোনের ভেতর। ভাবতেই কষ্ট হয়, ঈদের মতো একটা উৎসব কি অদ্ভুতভাবে বন্দী হয়ে গেল। নাকি বন্দী করে ফেললাম। যেভাবে আমরা আমাদের ক্রমেই বন্দী করে ফেলছি চার দেয়ালের মাঝে, সেখান থেকে নিজের ভেতর। অনেকে মিলেমিশে একাকার নয়। এখন আমরা একক। আজ ঈদ মানেই বোকা বাক্সে বিনোদনের নামে কতগুলো নষ্ট উপস্থাপনা। ঈদ মানেই বাজার গরম করে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয়া। মানুষের এই বন্দিদশা থেকে মুক্তি কাম্য। ঈদের আনন্দের পরিচ্ছন্নতা আবার মানুষের মনকে নষ্ট সংস্কৃতি থেকে সুস্থ সংস্কৃতিতে ফিরিয়ে আনবে।
এখন করোনা আর বন্যায় কবলিত চারিধার। পৃথিবীর ঘোর অন্ধকারকালেই শ্রেষ্ঠ মানুষদের আগমন ঘটেছে। এখনো তাই রাতের অন্ধকার কেটে আজানের সুর সুন্দরের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে মানুষকে ডেকে তোলে। সেভাবেই সব অসুন্দর আর অশান্তির কবল থেকে নিশ্চই মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষকে পথ দেখাবেন। মনে প্রশ্ন জাগে, তখনো কি মানুষ সেই পথে হেঁটে আল্লাহর গুণগান করবে নাকি, নিজেদের অহঙ্কারী ভেবে মহান আল্লাহর সাহায্যকে নিজেদের গৌরবগাঁথা বানিয়ে আরো অহঙ্কারী হয়ে যাবে? যেভাবে মুসা আ: তার কওমকে নিয়ে সমুদ্রপথে আল্লাহর সাহায্যে রাস্তা বানিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়েছিলেন আর অহঙ্কারী ফেরাউন সে পথকে নিজের তৈরি পথ বলে পাড়ি দিতে গিয়ে সমুদ্রবক্ষে তার বিশাল সৈন্যসামন্ত নিয়ে ডুবে মরল। এ শিক্ষা থেকে কে কিভাবে শিক্ষা নেবে এটিই দেখার বিষয়। তবুও মহান আল্লাহ যেন বন্যা ও করোনার মতো দুটো দুর্যোগ থেকে আমাদের সবাইকে ঈদের উসিলায় হেফাজত করে বিশ্বাসকে আরো সুদৃঢ় করে দেন। অবিশ্বাসীদেরও বিশ্বাসের ছায়াতলে আসার সৌভাগ্য দান করেন। আবার যেন আমরা আমাদের রোজার ঈদ কোরবানির ঈদসহ সব আমল ও আনন্দ নির্মলভাবে উপভোগ করতে পারি। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement

সকল