২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

নজরুল কবিতায় কোরবানি

-

কবি কাজী নজরুল ইসলাম অনেক বিশেষণে বিশেষিত। তিনি ‘বিদ্রোহী কবি’ খ্যাতিতে বহুল পরিচিত। মুসলিম বা ইসলাম জাগরণের কবি বলেও অনেক আলোচক তাকে নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে নজরুলকে যে অভিধায় অভিহিত করা হোক না কেন, সবখানেই রয়েছে তার বিদ্রোহিতা। তার বিদ্রোহিতা কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধেÑ ন্যায়ের পক্ষে। সত্যপথের মানুষের কাছে তিনি প্রিয় এবং অসৎ মানুষের কাছে তিনি অপ্রিয়। অপ্রিয় মানুষের কাছে তিনি অপ্রিয়। অপ্রিয় মানুষরাই বাংলা সাহিত্যে জন্ম দিয়েছিল ‘শনিবারের চিঠি’। শনিবারের চিঠি সপ্তাহে শনিবারে বের হতো শুধু নজরুলকে এবং নজরুলের সাহিত্যকর্মকে ব্যঙ্গ করার জন্য।
নজরুল, নজরুল-ই। তাকে নিয়ে লেখার অসংখ্য দিক আছে। এই লেখাটি তুলে ধরতে চাচ্ছি কোরবানির ঈদকে নিয়ে। নজরুল সাহিত্যে কোরবানির ঈদ। ১০ জিলহজ ঈদুল আজহা অনুষ্ঠিত হয়। ঈদুল আজহাকে ঈদুজ্জোহাও বলা হয়। সাধারণ মানুষ কোরবানির ঈদও বলে। আবার কেউ কেউ বকরি ঈদও বলে। ঈদের দিনে মহান রাব্বুল আলামিন আল্লøাহর সন্তুষ্টির জন্য দুই রাকাত সালাত আদায়ের পর পশু কোরবানি করা হয়। আল্লøাহর রাহে এ মহান ত্যাগকেই ঈদুল আজহা বলে।
নজরুলের কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণায় ‘কোরবানি’ শিরোনামে কবিতা আছে। কোরবানি নজরুলের বিখ্যাত কবিতার একটি কবিতা। কবিতার শুরুতেই কবি বলেছেনÑ ‘ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যগ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন। কোরবানির ঈদকে অনেকে অহেতুক হত্যাযজ্ঞ মনে করে। ইসলামবিরোধী অনেকে ঈদের পশু কোরবানিকে কেন্দ্র করে অনেক আপত্তিকর লেখার অবতারণা করেছেন। একটি উদাহরণও দেয়া যেতে পারে। তৎকালে তরিকুল আলম ডেপুটি ম্যাজিস্ট্র্রেট ছিলেন। তিনি ১৩২৭ শ্রাবণের ‘সবুজপত্র’ পত্রিকায় ‘আজ ঈদ’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেন। সেই প্রবন্ধে তিনি বলেছিলেনÑ ‘আজ এই আনন্দ উৎসবে আনন্দের চেয়ে বিষাদের ভাগই মনের ওপর চাপ দিচ্ছে বেশি করে। যেদিকে তাকাচ্ছি, সেদিকে কেবল নিষ্ঠুরতার অভিনয়। অতীত ও বর্তমানের ইতিহাস চোখের সামনে অগণিত জীবের রক্তে ভিজে লাল হয়ে দেখা দিচ্ছে। এই লাল রঙ আকাশে-বাতাসে চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছেÑ যেন সমস্ত প্রকৃতি তার রক্ত নেত্রের ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে পৃথিবী বিভীষিকা করে তুলেছে। প্রাণ একেবারে হাঁপিয়ে উঠছে।’
অধ্যক্ষ ইব্রাহীম খান বলেন, ‘তরিকুল আলম বলে একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্র্রেট কোরবানির বর্বর যুগের চিহ্ন বলে একটি প্রবন্ধ লিখেন। এ প্রবন্ধ পড়ে নজরুলের কলম গর্জে উঠল। নব্য তুর্কিরা তখন স্বাধীনতার জন্য অকাতরে জান কোরবান করছিল। সে ব্যাপারের সাথে মিলিয়ে তিনি লিখলেনÑ ‘ওরে হত্যা নয়, আজ সত্যগ্রহ শক্তির উদ্বোধন’। নজরুলের উল্লিøখিত কাব্য লাইনটি তরিকুল আলমসহ এ ধরনের সব মানুষের উপযুক্ত জবাব’।
হজরত ইবরাহিম আ:কে আল্লøাহ প্রিয় বস্তু কোরবানি করার হুকুম দিয়েছিলেন। আল্লøাহর হুকুম মোতাবেক হজরত ইবরাহিম আ: তার প্রিয় বস্তু শিশুপুত্র হজরত ইসমাইল আ:কে কোরবানি করার জন্য স্থির করেন। কবি আল্লøাহর হুকুমকে ‘কোরবানি’ কবিতায় নি¤েœাক্তভাবে ব্যক্ত করেছেনÑ ‘এয় ইবরাহিম আজ কোরবানি করো শ্রেষ্ঠ পুত্রধন’। অন্য জায়গায় তিনি লিখেছেনÑ এই দিনই ‘মীনা’-ময়দানে/পুত্র ¯েœহের গর্দানে/ছুরি হেনে খুন ক্ষরিয়ে নে,/রেখেছে আব্বা ইবরাহিম সে আপনা রুদ্র পণ।/ছি ছি! কেঁপো না ক্ষুদ্র মন।/আজ জল্লøাদ নয়, প্রহলাদ-সম মোল্লøা খুন-বদন’।
‘কোরবানি’ একটি সার্থক কবিতা। কবিতাটি ঈদুল আজহাকে মহিমান্বিত করেছে। ৭৪ লাইনের কবিতা কোরবানি ১৩২৭ ভাদ্রের ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় প্রকাশ পায়। ‘ভাঙার গান’ গ্রন্থের ‘শহীদি-ঈদ’ কোরাশ গানে কবি লিখেছেনÑ ‘কোরবানি দিলি গরু-ছাগল/তাদেরই জীবন হলো সফল/পেয়েছে তাহারা বেহেশত লোক!’ আবার বলেছেনÑ ‘দাও কোরবানি জান ও মাল,/বেহেশত তোমার হালাল।/স্বার্থপরের বেহেশত নাই’। একই কোরাশ গানের অন্য জায়গায় লিখেছেনÑ ‘মনের পশুরে কর জবাই/ পশুরাও বাঁচে, বাঁচে সবাই।/কশাইয়ের আবার কোরবানি!’ অন্যখানে বলেছেনÑ ‘পশু কোরবানি দিস কখন/ আজাদ মুক্ত হবি যখন/ জুলুম মুক্ত হবে রে দ্বীন’।
‘শহীদি ঈদ’ কবিতার প্রতিটি পঙ্ক্তি কোরবানির চিন্তা- চেতনাকে পাঠকসমাজের মানসিকতায় কবি এমনভাবে প্রদীপ্ত করেছেন তা ভাবা যায় না। এ কবিতা পাঠেই পাঠক সমাজ জেনে নিয়েছেÑ কোরবানি শুধু পশু জবাই নয়, বড় ত্যাগের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের মননশীল একটি পথ। আর এ পথে চলতে হলে প্রথমেই নিজকে সালাতে ডুবাতে হবে এবং দেহের মনের সমস্ত আবর্জনা ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করতে হবে। ‘জিঞ্জির’ কাব্যগ্রন্থের নজরুলের অনবদ্য সৃষ্টি আরেকটি বিখ্যাত কবিতা ‘ঈদ মোবারক’। কবিতাটি জিঞ্জিরে গ্রন্থিত হওয়ার আগে ১৩৩৪ বৈশাখ ১৩-১৪ সংখ্যা ‘সওগাত’ পত্রিকায় প্রকাশ পায়। কবি শুরতেই বলেছেন, ‘শত যোজনের কত মরুভূমি পারায়ে গো,/কত বালুচরে কত আঁখি-ধারা ঝরায়ে গো,/বরষের পরে আসিলে ঈদ!’ অন্যত্র তিনি লিখেছেনÑ ‘ইসলাম বলে, সকলের তরে মোরা সবাই,/সুখ-দুখ সমভাগ করে নেব সকলে ভাই/নাই অধিকার সঞ্চয়ের।’
‘ঈদ মোবারক’ কবিতাটি মূলত ঈদুল ফিতরকে নিয়ে লেখা। উদ্বৃত পঙ্ক্তিগুলো দুই ঈদের জন্য আবশ্যিক বলে প্রবন্ধভুক্ত করেছি। মর্মোপলব্ধি করলে অবশ্যই পাঠকদের ভালো লাগবে।
ঈদুল আজহা নিয়ে নজরুলের লেখা কবিতা ‘বকরীদ’। বকরীদ কবিতা দিয়ে নজরুল ঈদুল আজহাকে সম্মানিত করেছেন। কবিতার শুরুতে তিনি স্পষ্টতই বলেছেনÑ ‘শহীদানদের ঈদ এল বকরীদ।/অন্তরে চির নৌ-জোয়ান যে, তারি তরে এই ঈদ।/ আল্লার রাহে দিতে পারে যারা আপনারে কোরবান,/নির্লোভ নিরহঙ্কার যারা, যাহারা নিরভিমান,/দানব-দৈত্যে কতল করিতে আসে তলোয়ার লয়ে,/ফিরদৌস হতে এসেছে যাহারা ধরায় মানুষ হয়ে/অসুন্দর ও অত্যাচারীর বিনাশ করিতে যারা/জন্ম লয়েছে চির-নির্ভীক যৌবন মাতোয়ারা-/তাহাদেরী শুধু আছে অধিকার ঈদগাহে ময়দানে/তাহারাই শুধু বকরীদ করে জান মাল কোরবানে।’
৫৪ লাইনের কবিতা ‘বকরীদ’ প্রথম কোনো পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিল তা জানা যায়নি। কবিতাটি ঠাই পেয়েছে কবির ‘শেষ সওগাত’ কাব্যগ্রন্থে। কবিতায় ঈদুল আজহার মাহাত্ম্য গেয়ে কবি ইসলামী সাহিত্যসম্ভারকে সমৃদ্ধ করেছেন।
নজরুলের কবিতায় যেমন কোরবানির ঈদ এসেছে তেমনি তার গানেও ঝংকৃত হয়েছে কোরবানির ঈদের বাণী। তার গানের বই ‘গুল বাগিচা’র ইসলামী গানের অধ্যায়ের ৭৭ নং গানের কিছু অংশ তুলে ধরা হলো। কবির এ গানটি অবিভক্ত ভারতের বাংলাঞ্চলের কোরবানি ঈদে বহুল গীতও গান। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের সন্তানদের এ গানটির সাথেই শুধু নয়, নজরুল- সাহিত্য সম্বন্ধে কোনোই ধারণা নেই। কোনো এক অপশক্তির বিষণœ হাত ক্ষেপণের কারণে নজরুল চেতনা থেকে বাঙালিরা দূরে সরে যাচ্ছে। নজরুলকে মুছে দেয়ার চেষ্টা চলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে। এই অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এখনই সময়। ৭৭ নং গানের প্রথম চার চরণ- ‘ঈদজ্জোহার চাঁদ হাসে ঐ/এল আবার দুসরা ঈদ।/ কোরবানি দে কোরবানি দে,/ শোন খোদার ফরমান তাগিদ’ গানটির আরো চারটি লাইনÑ ‘মনের মাঝে পশু যে তার/আজকে তারে কর জবেহ,/ পুল সরাতের পুল হতে পার/ নিয়ে রাখ আগাম রশিদ’।
গানটি ১৩৪০ বৈশাখ মোহাম্মাদীতে প্রকাশ পায় এবং আবুল কাশেম মল্লিøকের কণ্ঠে হিজ মাস্টার ভয়েজে রেকর্ড হয়।
নজরুলের আরেকটি গানের বই জুলফিকার দ্বিতীয় খণ্ড। বইটি মূলত ইসলামী গানের সমষ্টি। এ গ্রন্থে ঈদুজ্জোহার একটি গান আছে। গানটি হিজ মাস্টার ভয়েজে মানিক মালা ও মহম্মদ কাশেমের কণ্ঠে রেকর্ড হয়। রেকর্ড নং এন-১৭০৪৬। গানটির প্রথম অংশÑ ঈদজ্জোহার তকবির শোন ঈদগাহে।/(তোর) কোরবানির সামান নিয়ে চল বাহে ॥/ কোরবানিরই রঙে রঙিন পর লেবাস/ পিরহানে মাখরে ত্যাগের গুল-সুবাস,/ হিংসা ভুলে প্রেমে মেতে ঈদুগাহেরি পথে যেতে/ দে মোবারকবাদ দ্বীনের বাদশাহে ॥
ইসলাম জাগরণের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ইসলামকে প্রতিটি মানুষের মাঝে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বাংলা সাহিত্যকে যেভাবে ঈমানে আহকামে সাজাতে হয় তাই তিনি করেছেন। মুসলমানকে খাঁটি মুসলমান বানাতে যা করার দরকার তিনি তাই করেছেন। তাই তো তিনি সব মানুষের কাছে একজন গ্রহণযোগ্য মানব।
নজরুল ইসলাম আল্লাহ, রাসূল সা:, মক্কা, মদিনা, হজ, জাকাত ইত্যাদি আরো যত আছে সব বিষয়ের ওপর একাধিক লেখা লিখে বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। বলা হয়Ñ বাংলা সাহিত্যে ইসলামকে কবি নজরুল যত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন, অন্য কোনো মুসলিম কবি তা পারেননি। ‘ইসলাম জাগরণের কবি/বিশ্বে রয়েছে অপ্রতুল/বাংলা সাহিত্যে ইসলামকে/ফুটিয়ে তুলেছে নজরুল।’ হ


আরো সংবাদ



premium cement
জাতিসঙ্ঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থাকে আবার অর্থায়ন শুরু করবে জাপান শেখ হাসিনার অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি বিএনপিকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে : ওবায়দুল কাদের রাশিয়া সমুদ্র তীরবর্তী রিসোর্টে ১৬.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে সিরিয়ায় ইসরাইলি হামলায় নিহত ৩৬ সেনা সদস্য দৌলতদিয়া ঘাটে পন্টুন থেকে নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু অ্যানেসথেসিয়ার পুরনো ওষুধ বাতিল করে কেন নতুনের জন্য বিজ্ঞপ্তি! বাইডেনের মেয়াদে রুশ-মার্কিন সম্পর্কের উন্নতির কোনো আশা নেই : রুশ রাষ্ট্রদূত ডিএমপির অভিযানে গ্রেফতার ৪০ নিউইয়র্কে মঙ্গোলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ফ্ল্যাট জব্দ করবে যুক্তরাষ্ট্র! টাঙ্গাইলে লরি-কাভার্ডভ্যান সংঘর্ষে নিহত ১ জিম্বাবুয়ে সিরিজে অনিশ্চিত সৌম্য

সকল