২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পলাশী ষড়যন্ত্রকারীদের পরিণতি

-

এক.
নানা নবাব আলীবর্দী খান সিরাজকে অস্ত্রবিদ্যার কূটকৌশল শুধু নয়, রাজ্য পরিচালনার বিষয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষাদান করেছিলেন, যাতে সিরাজ তার অনুপস্থিতিতে রাজ্য পরিচালনা করতে পারেন। বর্গী হামলার বিরুদ্ধে নানার সাথে থেকে সিরাজ তাদের আক্রমণ বন্ধ করে রাজ্যের মানুষের জীবনে সুখ-শান্তি এনে দিয়েছিলেন।
বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব আলীবর্দী খান আশা করেছিলেন, সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যুর পর যেমন আকবরকে দেখার দায়িত্ব দিয়েছিলেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু বিশ্বস্ত সহচর বৈরাম খান ওরফে গাজী বাবাকে, তেমনি তার মৃত্যুর পর সিংহাসনের দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে সর্বাধিক সহযোগিতা করবে মীর জাফর।
আলীবর্দি খানের মৃত্যুর পর সিরাজকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার জন্য ইংরেজদের সাথে ষড়যন্ত্র করে সিপাহসালার, আমাত্মবর্গ এবং সিরাজের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন আত্মীয়স্বজন তাদের ব্যক্তিস্বার্থ লাভের আশায়। এমনকি মীর জাফর পুত্র মীরনের বাড়িতে তার দূতিয়ালিতে ১৭৫৭ সালের ৯ জুন একটি চুক্তিনামাও তারা সম্পাদন করেন।
চুক্তিনামায় উল্লেখ করা হয় সিরাজকে হত্যা করে সিংহাসন ছিনিয়ে নেয়া হবে যুদ্ধের মাধ্যমে। সে যুদ্ধে ইংরেজদের বিরুদ্ধে মীর জাফর কোনো যুদ্ধ করবে না। তাদের সৈন্য সামন্ত নিয়ে ইংরেজদের পক্ষে অস্ত্রধারণ করবে। সিরাজের পতনের পর মসনদে নবাব হবে মীর জাফর এবং সিপাহসালার পদ দেয়া হবে রায়দুর্লভকে। জগতশেঠ পাবে অনেক অর্থ এবং উমিচাঁদকে দেয়া হবে বিশ লাখ টাকা। অন্যান্য যারা তাদের মধ্যে ইয়ার লতিফ খাঁ, নন্দকুমারকে দেয়া হবে অন্যান্য সুবিধা আর ক্লাইভ পাবে একটি গ্রামের জমিদারিসহ রাজকোষের কোটি টাকা। ইংরেজ বেনিয়াদের নেতা ওয়াটস, ওয়াটসন, হলওয়েলসহ অন্যরা পাবে নানাজাতীয় সুবিধা। মীর জাফর পুত্র মীরন হবে নবাব পুত্র। ঘসেটি বেগম আপন খালা হয়েও সিরাজের অপসারণ এমনকি শেষ পর্যন্ত হত্যা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।

দুই.
নবাব আলীবর্দি খানের দৌহিত্র ছোট মেয়ে আমিনা বেগম ও জয়নুদ্দীনের ছেলে নওয়াব মনসুর উল মুলক, মির্জা মোহাম্মদ সিরাজউদ্দৌলা ও হজরত জঙ্গ বাহাদুর বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সিংহাসনে বসলেন ১৯ জুন ১৭৫৬ সালে।
সিরাজউদ্দৌলা সিংহাসনে বসার মাত্র এক বছর পর মীর জাফরের নেতৃত্বে তাকে উৎখাত করার জন্য পলাশীর আমবাগানে ২৩ জুন ১৭৫৭ সালে ষড়যন্ত্রের যুদ্ধ সংঘটিত হয়Ñ নবাব বাহিনীর সাথে ইংরেজ বাহিনীর। এ যুদ্ধে সিরাজ বাহিনীর পক্ষে ৫৩ হাজার সৈনিক ও বিপুল অস্ত্রশস্ত্র ছিল আর ইংরেজ বাহিনীর ছিল মাত্র তিন হাজার সিপাহি। মীর জাফরের নির্দেশে সিরাজ বাহিনীর কামান ও বন্দুক থেকে গোলা ও গুলি বের হলো না। মোহনলাল, মীর মদন, বন্দে আলী, সিনফে্রঁসহ মাত্র কয়েকজন নি¤œ পদস্থ সেনাপতি প্রাণপণ যুদ্ধ করে ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে মাত্র দু’দিনের যুদ্ধে সিরাজ বাহিনী মীর জাফর গংদের বেঈমানির ফলে পরাজিত হলো।
১৭৫৭ সালের ২ জুলাই সিরাজকে কারাগারে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এভাবে চলে যায়। তবে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে দুনিয়াতেই প্রায় সময়ই বেঈমানদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। তার প্রতিশোধ হয় বড় নির্মম ও ভয়ঙ্কর।
মীর জাফর সিরাজউদ্দৌলার সিপাহসালার থাকাকালীন বয়স হয়েছিল ৮০ বছরের মতো। সিরাজের হত্যার পর ইংরেজরা তাকে সিংহাসনে বসায় তবে তা ছিল তাদের অধীনস্থ কর্মচারীর মতো। ইতিহাসে তাকে বলা হয় ‘ক্লাইভের গাধা’। চার বছর নবাব পদে রাখা হয়েছিল, আবার দুর্নীতির জন্য দুই বছর বহিষ্কার করা হয়। তার জামাতা মীর কাশিমকে দুই বছরের জন্য নবাবের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু মীর কাশিমের স্বাধীনতাকামী আচরণে দুই বছর সিংহাসনে রাখার পর তাকে বহিষ্কার করে আবার মীর জাফরকে সিংহাসনে বসানো হয়। দুই বছর পর তাকে আবার বহিষ্কার করে সরাসরি ইংরেজ সরকার ক্ষমতা দখল করে নেয়।
মীর জাফরের পতন হয় বড় মর্মান্তিক অবস্থায়। কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয় মীর জাফর। তার শরীরে অসংখ্য ঘা ও ফোড়া হয়ে দূষিত রক্ত ও পুঁজ পড়ে দুর্গন্ধ বের হয়। এ অবস্থায় পরিবারের লোকেরা তাকে লোকালয়হীন জঙ্গলে রেখে আসে। রাজা নন্দকুমার কিরিটেশ্বরী দেবীর পা ধোয়া পানি ওষুধ হিসেবে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে দেয়। এভাবে ঈমান পর্যন্ত নষ্ট করে সে মৃত্যুবরণ করে। বাংলাদেশসহ এ এলাকার মানুষ বেঈমান বলতে মীর জাফর শব্দ যুগ যুগ ধরে ব্যবহার করে আসছে।
মীর জাফর পুত্র মীরন সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা থেকে শুরু করে বহু অপকর্মের নায়ক। ঐতিহাসিকরা বলেন, সে বজ্রাঘাতে মৃত্যুবরণ করেছে, আবার কেউ কেউ বলেন, জনৈক ইংরেজ সেনাপতি তার বাড়াবাড়ি দেখে তাকে গুলি করে হত্যা করে। সিরাজউদ্দৌলার খালা ঘসেটি বেগম যিনি রক্ত সম্পর্কীয় হওয়া সত্ত্বেও ষড়যন্ত্রকারী। তাকে মীরন বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকা ডুবিয়ে হত্যা করে।
মোহাম্মদী বেগ ছিল আমেনাÑজয়েনউদ্দীনের পালিত পুত্র। সিরাজের মা-বাবা সিরাজ জন্মের আগে তাকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনে লালন-পালন করেন। তার বিয়েতে মুর্শিদাবাদ রাজপ্রাসাদে ধুমধামের বন্যা বয়ে যায়। সেই মোহাম্মদী বেগ মাত্র ১০ হাজার টাকার লোভে কারাগারে সিরাজকে নির্মমভাবে হত্যা করে। পরে সে পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে পানিতে ডুবে মারা যায়।

তিন.
মীর জাফরের জামাতা মীর কাশিম সিরাজকে ভগবান গোলা থেকে ধরিয়ে দেয়। সিরাজ-পরবর্তী স্বাধীন নবাব তাকে বলা হয়। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ইংরেজদের চরিত্র। তাকে ইংরেজরা ক্ষমতাচ্যুত করার পর পথে পথে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। একদিন সকাল বেলায় তার লাশ মুঙ্গের দুর্গের সামনে পড়ে থাকতে দেখা যায়।
বায়দুর্লভ ও জগৎ শেঠকে ক্ষমতায় থাকাকালে মীর কাশিম দুর্গশিখর থেকে গঙ্গায় নিক্ষেপ করেন ক্ষমতায় থাকাকালে তাদের বেঈমানির জন্য। রাজা রাজবল্লভকে গলায় বালুর বস্তা বেঁধে গঙ্গা নদীতে ফেলে দেয়া হয় এবং ওই অবস্থায় সে মৃত্যুবরণ করে। ইয়ার লতিফ খাঁ নিরুদ্দেশ হয়। উমিচাঁদ ২০ লাখ টাকা না পেয়ে শোকে পাগল হয়ে যায়। পরে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।
মাত্র ৮০ টাকা বার্ষিক বেতন নিয়ে কেরানি ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানিতে ১৭৪৪ সালে মাদ্রাজে খ্যাতিহীন, বিত্তহীন, ক্লাইভ বিলাত থেকে আসে। ১৭৬০ সালে সেনানায়ক কর্নেল ক্লাইভের জাহাজ যখন পোর্টস মাউথ বন্দরে এসে থামল, তখন ইংল্যান্ডের ম্যানুয়েল রেজিস্টারে তার সম্পর্কে মন্তব্য ছিল ‘এই কর্নেলের কাছে নগদ টাকা আছে প্রায় দুই কোটি টাকা। তার স্ত্রীর গয়নার বাক্সে মণিমুক্তা, হীরা ও জহরত আছে দুই লাখ টাকার। ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডে তার চেয়ে অধিকতর অর্থ নেই আর কারো কাছে।’ (দৃষ্টিপাত/ যাযাবর-৩৪ পৃ:)
ক্লাইভ সিরাজের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণের জন্য মীর জাফর ও মীরনকে প্ররোচিত করেছে। সিরাজের মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞায় সই করতে মীর জাফরকেও প্ররোচিত করে। মোহাম্মদী বেগকে হত্যার জন্য সে মীরনকে টাকা দিতে বলেছে।
ক্লাইভ বাংলা লুণ্ঠনের দায়ে বিলাতে দুর্নীতি মামলায় সাত বছর জেল খেটে কপর্দকহীন হয়ে পড়ে। পরে আত্মহত্যা করে। ডা: হল ওয়েলের স্ত্রী তাকে রেখে অন্য যুবকের সাথে চলে গেলে সে আত্মহত্যা করে।হ


আরো সংবাদ



premium cement