২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

তবুও উঠবে ঈদের চাঁদ

-

আমরা জানুয়ারি ২০২০ থেকে অত্যন্ত কঠিন, সঙ্কটময়, অনিশ্চিত, ভীতিকর সময় অতিক্রম করছি। করোনাভাইরাসের অভিশাপ শুধু আমাদের প্রিয় দেশটিকে নয়, সমগ্র বিশ্বকে বিপন্ন, অসহায় ও বিপর্যস্ত করে তুলেছে। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে অসংখ্য আদম সন্তান। চীন, ইতালি, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্র প্রমুখ উন্নত রাষ্ট্রসমূহও এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের তাণ্ডবে ছন্নছাড়া। ২০২০ সালের ২০ মে পর্যন্ত বিশ্বের ১৮৮টি দেশ ও অঞ্চলে মোট ৫০ লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন তিন লাখ ২৮ হাজার ৯৫ জন। বাংলাদেশেও বেশ কিছু ব্যক্তি আক্রান্ত হয়েছেন এবং প্রাণ হারিয়েছেন ৩৮৬ জন। ২০ মে পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছেন সর্বমোট ২৬ হাজার ৭৩৮ জন। নিজ বাড়িতে সংক্রমণ প্রতিহত করতে হোম কোয়ারেন্টিনে (ঐড়সব ছঁধৎধহঃরহব) রয়েছেন হাজার হাজার লোক। এদের বেশির ভাগই ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি ও অন্যান্য ইউরোপিয়ান দেশ ও মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত ছিলেন। রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য শহরেও নাগরিকদের হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সামাজিক সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য। পরিস্থিতির তেমন উন্নতি এখনও দেখা যাচ্ছে না। এই অবস্থায় বাংলাদেশে মাহে রামাদান তার অপূর্ব স্বর্গীয় উপহারসহ প্রায় উপাগত। পবিত্র রামাদান সমাপ্তি ঘোষণার জন্য ঈদের চাঁদও উঠবে। কিন্তু এবারের ঈদের চাঁদও অত্যন্ত ম্রিয়মাণ, বিষণœ, নিষ্প্র্রাণ। চাঁদের আলোয় নেই প্রত্যাশিত ঔজ্জ্বল্য। ঈদের কাক্সিক্ষত জামায়াতে যাওয়াও এক ধরনের অনিশ্চয়তায় ঘেরা। কী হবে আল্লাহ তায়ালা জানেন। তারপরও আমাদের ঐকান্তিক কামনাÑ সবার ঘরে আসুক ঈদের আনন্দ। সবার মুখে ফুটুক হাসি, অন্তত ওই দিনে। সব জ্বালা-যন্ত্রণা ভুলে, সব ব্যথা-বেদনা এড়িয়ে সবাই সবার সাথে বুক মিলাক। স্বজন-প্রিয়জনের কলকাকলিতে ভরে উঠুক ঘর-সংসার। ঈদের আনন্দে বিভোর হোক এ দেশের সবাই। সবার ঘরে ঈদ আসুক, আসুক বিনম্র পদভারে, অনাবিল খুশির ডালা সাজিয়ে। এটি আমার প্রত্যাশা। এবারের ঈদ আসছে, খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের বড়দিন অথবা বাংলা নববর্ষ বৈশাখীর পর। কিন্তু বড়দিন অথবা নববর্ষের মেজাজ থেকে ঈদের আনন্দ সবসময় স্বতন্ত্র। নববর্ষ শুধু উৎসবের, শুধু আনন্দের। পেলে পরিতৃপ্তির, কিন্তু না পেলে পরবর্তীতে পাওয়ার আকাক্সক্ষার। ঈদের দিন, এ অর্থে শুধু উৎসবের দিন নয়, তাৎপর্যপূর্ণ অনুষ্ঠানের দিনও এবং অনুষ্ঠানে ব্যক্তিকে ছাপিয়ে সমষ্টি প্রধান হয়ে ওঠে। ব্যক্তিগত আশা-আকাক্সক্ষার ঊর্ধ্বে উঠে আসে সামষ্টিক সন্তুষ্টি। ঈদের আনন্দে তাই রয়েছে সবার ভাগ। সবার অংশীদারিত্ব। ধনী-দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত সবাই অংশীদার ঈদের আনন্দে। এই সমষ্টিগত বৈশিষ্ট্যই ঈদের আনন্দকে বিশিষ্ট করে তুলেছে। করে তুলেছে বিশ্বজনীন। বিশ্বজনীন বলছি এ জন্য যে, ব্যক্তির ঊর্ধ্বে যে সমাজ, এমন কী সমাজের সঙ্কীর্ণ সীমানা ছাড়িয়ে যে বিশ্বসমাজÑ যে মুসলিম উম্মাহ তার সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনাকে ধারণ করে ঈদ আসে। ঈদের আনন্দের আর একটি বৈশিষ্ট্য হলোÑ এর সংযত প্রকৃতি। আত্মশুদ্ধির পথ ধরে ঈদ আসে, এক মাস সিয়াম সাধনার পর। তাই ঈদের আনন্দে বৈচিত্র্য থাকলেও নেই কোনো উদ্দামতা। নেই কোনো বাঁধনহারা অসংযত আধিক্য। থাকে না কোনো অসংলগ্ন ছন্দ। তাই বলা হয়, ঈদের আনন্দে যেমন রয়েছে উৎসবের আমেজ, তেমনি রয়েছে অনুষ্ঠানের মহিমা। কোনো উৎসবে থাকে শুধু প্রাপ্তি অথবা প্রাপ্তির আশা। অনুষ্ঠানে কিন্তু প্রাপ্তির সাথে সাথে কর্তব্যের ডালাও সাজাতে হয়। প্রাপ্তির সাথে সাথে কর্তব্যের ডালাও সাজাতে হয়। প্রাপ্তির সাথে সাথে সৌম্য প্রশান্তিও ঈদের অবদান। সবার ওপরে রয়েছে পরম করুণাময়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা জড়িত বিনয়াবনত আত্মসমর্পণের এক মননও।
বাংলাদেশে ঈদ আসছে। এসেছে বড়দিনের পরে। নববর্ষের পরে। দুই এর মধ্যে তফাতটা সুস্পষ্ট সবার কাছে, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার কাছে। বাংলাদেশে এবারের ঈদের চাঁদ উঠেছে, কিন্তু নেই তার মনোলোভা সেই প্রভা। নেই তার হৃদয়ে কাঁপন সৃষ্টিকারী ঔজ্জ্বল্য। সেই মন কেড়ে নেয়া দ্যুতি নেই। ব্যক্তিভেদে পার্থক্য রয়েছে বটে, কিন্তু সামষ্টিক দৃষ্টিতে এবারের ঈদ বিষাদের ছটায় মলিন। ঈদের দিনে সবাই সবাইকে খুশি করতে চায়। স্বামী স্ত্রীকে। ভাই বোনকে। এককথায় প্রত্যেকে প্রত্যেককে কিছু না কিছু দিয়ে এক সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায় ঈদের দিনে। তা ছাড়া, প্রত্যেকেই আপনজনের কাছাকাছি থাকতে চায়। বিদেশ থেকে তাই দেশে ছুটে আসে মানুষ। শহর-বন্দর থেকে গ্রামে ছুটে আসে। ছেলেমেয়েরা বাবা-মাকে
সালাম করতে চায় এদিন গভীর শ্রদ্ধার সাথে। বাবা-মা সন্তানদের বুকে জড়িয়ে ধরতে চান। ভাইবোন পরস্পরের সান্নিধ্যে আসে গভীর উষ্ণতায়। ঘর সজ্জিত হয় নতুনভাবে। বাড়ির যে অন্তরঙ্গ সুর তার প্রতিফলন ঘটে। চারদিকে উষ্ণ আন্তরিকতার প্রকাশ প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু দেখুন তো দেশের বর্তমান অবস্থা। দেশে প্রথম করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চে। গত ২১ মে পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০ মে পর্যন্ত দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা হলো ২৬ হাজার ৭৩৮ জন এবং মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩৮৬ জন। করোনা ভাইরাসের বৃদ্ধি যেভাবে পাচ্ছে এই হারে বৃদ্ধি পেতে থাকলে, বিশেষজ্ঞদের অভিমত, চলতি মে মাসের শেষ নাগাদ অথবা জুনের প্রথম সপ্তাহে এর চূড়ান্ত রূপ আমরা দেখতে পারি। এর অর্থ অত্যন্ত সুস্পষ্ট। এখনও দেশে জুমার নামাজ স্বল্পসংখ্যক মুসল্লিসহযোগে সংক্ষিপ্ত আকারে সমাপ্ত হচ্ছে। মৃত ব্যক্তির জানাজা অত্যন্ত অল্পসংখ্যক মুসলমানের উপস্থিতিতে সম্পন্ন হচ্ছে। রমজান মাসের তারাবিহ নামাজ মসজিদে না পড়ে বাড়িতেই পড়ার নির্দেশনা এসেছে। পরিস্থিতি এভাবে গড়ালে যে ঈদের জামাতে আবালবৃদ্ধবনিতার অংশগ্রহণ কাক্সিক্ষত, তার অবস্থা কেমন হবে তা অনুধাবনে এতটুকু অসুবিধা হচ্ছে না। ঈদের দিনে বাড়ি বাড়ি যেভাবে অতিথি সেবার রেওয়াজ তা কল্পনা করুন; যদি তখনও হোম কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা চালু থাকে অথবা সামাজিক দূরত্বের প্রথা কার্যকর থাকে অথবা ঢিলেঢালা হলেও লকডাউন চালু থাকে অথবা আক্রান্তদের নিরিবিলি থাকা বাধ্যতামূলক অব্যাহত থাকে। সুতরাং বিশ্বব্যাপী সমগ্র মানবজাতির ওপর যখন করোনাভাইরাসের এমন অভিশাপ, তখন একমাত্র বিশ্বপিতার কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া আর কী আছে? মক্কার বায়তুল হারাম এবং মদিনার মসজিদে নববীতেও যখন নিয়ন্ত্রিত চলাফেরা, তখন কী করার আছে? পত্রপত্রিকায় দেখলাম বিশ্বের ১২টি দেশে বেশ কিছু বাংলাদেশী প্রাণ হারিয়েছেন, আত্মীয়স্বজনদের সামান্যতম সেবা ছাড়া। তাদেররূহের মাগফিরাত কামনা করি আমরা সবাই। হ


আরো সংবাদ



premium cement