২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

স্বাধীনতা দিবসের প্রকৃতি

-

দীর্ঘ দিনের অধীনতা ও অনিশ্চয়তার ঘন অন্ধকারে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ এই জনপদে জ্বলে উঠেছিল স্বাধীনতার ছোট্ট মাটির প্রদীপটি। দীর্ঘ ৯ মাসের জমাটবাঁধা অন্ধকারে এই প্রদীপই এ জনপদের সাত কোটি মানুষের মনে জ্বালিয়ে রেখেছিল আশার ক্ষীণ আলো। এই প্রদীপের ক্ষীণ আলো ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে তাই হয়ে ওঠে দিবালোকের মতো উজ্জ্বল। ২৬ মার্চে সূচিত স্বাধীনতাসংগ্রামের ক্ষীণ ধারাটি ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে জাতীয় জীবনের বিস্তীর্ণ উপত্যকার হাজারো প্রান্তে অসংখ্য রক্তস্রোতের সৃষ্টি করে, চূড়ান্ত পর্যায়ে তার সম্মিলিত প্রবাহ ১৬ ডিসেম্বরে সমাজ জীবনের দুই কূল ছাপিয়ে যে মহাপ্লাবনের সৃষ্টি করে, তার ফলে জন্মলাভ করে স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতার স্বর্ণদ্বীপ বাংলাদেশের। ২৬ মার্চকে তাই এ জাতি স্মরণ করে আত্মশক্তির প্রতীকরূপে। স্মরণ করে আত্মমর্যাদার দিগদর্শন হিসেবে। স্মরণ করে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর দুর্জয় প্রত্যয়রূপে। এ দেশে রয়েছে রোগ-শোক-ব্যাধি-অপুষ্টি। এ দেশে রয়েছে অনগ্রসরতা, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে। রয়েছে অশিক্ষা, অদক্ষতা। কিন্তু ২৬ মার্চের সেই প্রদীপের আলোয় হারিয়ে গেছে পরাধীনতার গ্লানি। নিশ্চিহ্ন হয়েছে আত্মনিবেদনের দাসসুলভ মানসিকতা। এই তো আমাদের ইতিহাস। এটি আমাদের গৌরবময় ঐতিহ্য।
২৬ মার্চে যার সূচনা, ১৬ ডিসেম্বরে তারই পরিপূর্ণতা। দুটিই কিন্তু রক্তাক্ত দিন। রক্তসিক্ত ২৬ মার্চ সবাইকে ডাক দিয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে। নিজেদের যুদ্ধ নিজেরা করে শক্ত হাতে বিজয় ছিনিয়ে আনার দৃঢ় সঙ্কল্পসহ। এ জন্য ২৬ মার্চকে বলা যেতে পারে রক্তদানের আকুতির প্রতীক। আত্মশক্তি উদ্বোধনের নিশানা। আর ১৬ ডিসেম্বর হলো এক জীবন-মরণ সংগ্রামের শেষ অধ্যায়। গৌরবদীপ্ত বিজয়ের স্পর্শধন্য এক রেড লেটার দিবস। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে দু’টিই উজ্জ্বলতম দিন।
২৫ মার্চের রাতকে এই জাতি চিহ্নিত করেছে ইতিহাসের সবচেয়ে তমশাচ্ছন্ন রাত হিসেবে। কালরাত রূপে। এটি কালরাত বলা হয় দু’টি কারণে। এক. এই রাতে এ জনপদের নিরস্ত্র ও নিরীহ সাধারণ মানুষের ওপর পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়। চাপিয়ে দেয়া হয় জনগণের ওপর শতাব্দীর সবচেয়ে অসম যুদ্ধ। এক হিসাবে বলা হয়েছে, সেই কালরাতে শুধু ঢাকা নগরীতেই প্রায় ৫০ হাজার নর-নারীর প্রাণহানি ঘটে এবং তাও এমন এক সময় যখন কর্মক্লান্ত সাধারণ মানুষ ঘুমে অচেতন, মধ্য রাতে। দুই. জাতীয় ইতিহাসের এই দুর্যোগময় মুহূর্তে জাতীয় নেতৃত্ব জনগণকে কোনো দিকনির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হয়ে ব্যস্ত রইলেন আত্মগোপনে। এর আগে তিন সপ্তাহব্যাপী আন্দোলনে গণমনে পাকিস্তানবিরোধী উন্মাদনা চরমে ওঠে। বলদর্পী ইয়াহিয়া খানের ১ মার্চে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণার ফলে সবার অলক্ষ্যে ছয় দফা দাবি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এক দফা দাবিতে রূপান্তরিত হয়েছে। পাকিস্তানের ঘাতক বাহিনী যে প্রতিশোধ গ্রহণে উন্মত্ত হয়ে উঠবে, তা জাতীয় নেতৃত্বের অনুধাবনে আসেনি। ফলে বাংলাদেশের মুুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে প্রথম শিকার হলেন হাজার হাজার সাধারণ মানুষ। নির্মমভাবে নিহত হন তারা। কোনো কিছু বোঝার আগেই। কোনোরূপ সাবধানতা অবলম্বনের আগেই। এই মৃত্যু যে কত করুণ, কত নির্মম, তা এ জনপদের মানুষই জেনেছেন।
সেই মৃত্যু কিন্তু বৃথা যায়নি। তাদের রক্তে বাংলার মাটি শুধু যে উর্বর হলো তাই নয়, তাদের এক এক ফোঁটা রক্ত রক্তবীজের মতো সৃষ্টি করে এক একজন অজেয় সৈনিক। শত্রুকবলিত বাংলাদেশ হানাদারমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তারা লড়ে গেছেন জীবন বাজি রেখে। এ জন্যই তো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সোনালি ফসল যে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ তার জন্মও স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত। প্রতিবেশী ভারত বা পাকিস্তানের জন্ম যেভাবে হয়েছে, তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের সৃষ্টি হলো। কোনো ধরনের দেন-দরবার বা গোলটেবিল বৈঠকের সিদ্ধান্তের ফল বাংলাদেশ নয়। নয় কোনো কূটকৌশলের ফল। নয় কোনো সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দাক্ষিণ্য। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ জন্মলাভ করল মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরে। জনগণের সচেতন উদ্যোগের ফলে। সীমাহীন ত্যাগের বিনিময়ে। ঘন অন্ধকার কাটিয়ে উঠে উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত হলো স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। এ উদ্যোগে নেতৃত্ব দিয়েছেন পূর্ব বাংলার জনগণ (ছাত্র-শিক্ষক, কৃষক-মজুর, অখ্যাত পল্লীর দুরন্ত তরুণ, নগরীর হাজারো বস্তির উদ্ধত যুবক, মহানগরীর যুবশক্তি, মিল-ফ্যাক্টরির কর্মী, বিভিন্ন পেশার প্রশিক্ষিত নাগরিক)। জাতীয় জনসমাজ বলতে যা বোঝায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তারাই। অংশগ্রহণ করেন কোনো দলের সদস্য হিসেবে নয়। নয় কোনো দলের আদর্শে অনুপ্রাণিত কর্মী হিসেবে। কোনো দলের অঙ্গীকারবদ্ধ অনুসারী হিসেবে নয়। শিক্ষার্থীরা শিক্ষায়তন ছেড়ে, কৃষকদের একাংশ চাষাবাদ ছেড়ে, অনেক শ্রমিক মিল-ফ্যাক্টরি ছেড়ে, পেশাজীবীদের অনেকেই নিজ নিজ পেশা ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে শরিক হলেন। অনেকে নিজ নিজ অবস্থানে থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থন জানালেন। শিল্পী-সাহিত্যিকদের শিল্পকর্ম ও রচনাসম্ভার একই উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত হলো। দীর্ঘ দিন পরে জাতীয় পর্যায়ে জনসাধারণের যে সার্বিক উদ্যোগ ও আত্মত্যাগের মহোৎসব, তাই মূর্ত হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধে। বিজয় দিবস তারই বিকশিত রূপ। তারা যেন চিৎকার করে বলে উঠেছিল :
সরে দাঁড়াও। পিছু হটো। আমাদের যুদ্ধ আমাদেরই করতে দাও।
তোমরা আমাদের বিজয় ছিনিয়ে নেবে না।
আমরা মুক্ত হবোই। আমরা স্বাধীন হবো।
সৃষ্টিকর্তা এবং ন্যায়নীতি আমাদের প্রতীক ও পতাকা।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বৈশিষ্ট্যময় প্রকৃতি এটিই। এটি ছিল এক জনযুদ্ধ। সত্যি বটে কিছুসংখ্যক বিপথগামী এই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে। কিন্তু শক্তি বলতে যা বোঝায়, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীদের তেমন শক্তি তখনো ছিল না। পরবর্তী পর্যায়ে সুসংহত হয়ে শক্তির পর্যায়ে কোনো দিন তারা আবির্ভূত হতে পারেনি। বরাবরই জনগণের তীব্র ঘৃণার কুয়াশায় তারা আচ্ছন্ন থেকেছে। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement