২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

স্বাধীনতা দিবসের অঙ্গীকার হোক করোনা মোকাবেলা করব, সবাই মিলে বাঁচব

-

লেখালেখির মন নেই মোটেও। করোনা আতঙ্কে উদ্বিগ্ন দিনাতিপাত করছি সবাই। কখন কোন দিক দিয়ে বিপদ ধেয়ে আসবে আমরা কেউই জানি না। অদৃশ্য শত্রুর সাথে লড়াই করছি প্রতিনিয়ত। জনজীবন বিপন্ন, নিজের পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের কথা ভাবছি প্রতিনিয়ত। ভাবছি যাদের চিনি না, জানি না তাদের কথাও। দেশের কথা, অন্য দেশের মানুষের কথা। গোটা মানবজাতির ওপর আঘাত এসেছে। অনেক বড় আঘাত। জানি না কিভাবে মুক্তি হবে, কখন মুক্তি হবে। পরম করুণাময়ই জানেন।
এই যখ ন অবস্থা, আসছে ২৬ মার্চ, মহান স্বাধীনতা দিবস। এই দিনটিকে ঘিরে বাঙালির বড়ই আবেগ। আবেগ মহান মুক্তিযুদ্ধ, অগুনতি শহীদান, সম্ভ্রম হারনো মা-বোন আর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়েও। ওরা না থাকলে আজো পরাধীনতার গ্লানি গায়ে মেখে প্রতিপদে বৈষম্যের শিকার হয়ে বাঁচতে হতো আমাদের। যেমন বেঁচে ছিলাম ’৪৭ থেকে ’৭১ এই ২৪ বছর।
‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়!’ আসলে কেউই বাঁচতে চায় না। তাই তো মরণপণ যুদ্ধ, আত্মবলীদান, বিজয়।
বড় আশা ছিল এবারের স্বাধীনতা দিবস হবে অনেক বর্ণাঢ্য, মনে রাখার মতো। জাতির জনকের জন্মের শততম বার্ষিকী এ বছর। ১৭ মার্চ ছিল শততম জন্মদিন। দিনটিকে ঘিরে সরকার এবং দেশবাসীর ছিল অনেক পরিকল্পনা, অনেক স্বপ্ন। কিন্তু মরণব্যাধি করোনার আগ্রাসনে কেটে ছেঁটে ছোট করা হয়েছে পরিকল্পনা। চলছে মুজিববর্ষ। আগামী বছর ২৬ মার্চ পর্যন্ত চলবে এই বর্ষগণনা। পূর্তি হবে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছর। বছরটিকে ঘিরে অনেক স্বপ্ন, অনেক পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের, দেশবাসীর। তৃণমূল পর্যায় অবধি ব্যাপ্ত সেই পরিকল্পনা। জানি না তার কতটুকু বাস্তবায়িত হবে। সবই নির্ভর করছে এই ঘাতক ব্যাধি কবে নির্মূল হবে সেটার ওপর।
সত্তরের নির্বাচনে বিপুল বিজয় পেয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। কিন্তু ক্ষমতা পেল না। অ্যাসেম্বলি ডেকে স্থগিত করা হলো। ক্ষমতা ধরে রাখার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো পাকিস্তানিরা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগের ডাক দিলেন। স্কুল-কলেজ কল-কারখানা বন্ধ হয়ে গেল। শুধু চালু রইল জরুরি ব্যবস্থাগুলো। পাকিস্তানিরা তখন এ দেশের শাসনে থেকেও নেই। তাদের কথা কেউ শুনছে না। দেশ চলছে বঙ্গবন্ধুর কথায়। বঙ্গবন্ধুর কথাই তখন আইন।
১৯৭১-এর ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন না ঠিকই, কার্যত দিলেনও। ওই ভাষণে তিনি বাঙালিকে বলে দিলেন রণকৌশল, ইঙ্গিত দিলেন গেরিলা যুদ্ধের। স্বাধীনতার ঘোষণা সরাসরি দিলেন না কারণ ওদিন সোহরাওয়াদী উদ্যানের দিকে তাক করা ছিল অসংখ্য কামান, বন্দুক। তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে সাথে সাথে ঝাঁক ঝাঁক বুলেট শেষ করে দিতো জনসভায় সমবেত লাখ লাখ জনতাকে। রক্তগঙ্গা বয়ে যেত দেশব্যাপী।
এই আক্রমণের আভাস পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ৭ মার্চের আগে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানান চাপ ছিল তার ওপর। বিভিন্ন ভাবে জানানো হয়েছিল ওদিন স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে কী ভয়াবহ পরিণতি হবে! তাই কৌশলী হতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে। নিজের প্রাণের মায়া তিনি করেননি। বাঁচাতে চেয়েছিলেন লাখ লাখ বাঙালির প্রাণ। মার্চের শুরুতেই আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব তাকে সতর্ক করেছিলেন। বলেছিলেন আত্মগোপনে যেতে। যাননি। নিজের জীবন বাঁচিয়ে নিরীহ জনগণকে বিপদে ফেলতে চাননি তিনি ।
৭ মার্চ তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা সরাসরি দেননি, কিন্তু ওই ভাষণের প্রতিটি পঙ্ক্তিতে আছে স্বাধীনতার কথা, মুক্তির কথা। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বললে স্বাধীনতার ঘোষণার আর কী বাকি থাকে!
বাঙালিদের হেফাজতে রাখতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। চেয়েছিলেন নিয়মতান্ত্রিকভাবে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ক্ষমতা নিতে। কিন্তু হলো না। ২৫ মার্চ আচমকা নিরীহ বাঙালির ওপর পাকিস্তানিরা চালাল ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শ্মশানে পরিণত হলো। আর ওই রাতেই গ্রেফতার করা হলো বঙ্গবন্ধুকে। নিয়ে যাওয়া হলো পাকিস্তানে। বন্দী করা হলো করাগারে। গ্রেফতারের আগে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেলেন।
এরপর আর বাঙালিকে কিছু বলতে হয়নি, কিছু শেখাতেও হয়নি। মানুষ ঢাকা ছাড়তে শুরু করল। জাতীয় নেতারা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে কাজ করতে লাগলেন। এক কোটি শরণার্থী আশ্রয় নিলো ভারতে। শুরু হলো জনযুদ্ধ। একটি আধুনিক প্রশিক্ষিত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামলো লুঙ্গি গেঞ্জি পরা লাঠিসোটা হাতে বাঙালি। প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারাও যোগ দিলো মরণপণ যুদ্ধে। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলো। ৯ মাসের রক্ষক্ষয়ী সংগ্রামের পথ বেয়ে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ অর্জিত হলো স্বাধীনতা। এই ৯ মাসে এ দেশের ওপর দিয়ে বয়ে গেল রক্তস্রোত। ৩০ লাখ শহীদ, ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জত, অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার পঙ্গুত্ব, আর লাখ লাখ মানুষের সম্পদহানির মধ্য দিয়ে অর্জিত হলো স্বাধীনতা। আমরা পেলাম নতুন পতাকা, নতুন মানচিত্র, নতুন দেশ। যে দেশ আমাদের নিজের অথচ এতদিন নিজ দেশেই আমরা ছিলাম পরাধীন।

১০ জানুয়ারি ১৯৭২ পাকিস্তান থেকে লন্ডন, তার পর ভারত হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করলেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীনতার পর মাত্র একটি ২৬ মার্চ পালন করার সুযোগ পেয়েছিলেন এই মহান নেতা। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের রাজকোষ তখন শূন্য। কিছুই রেখে যায়নি পাকিস্তানিরা। সমস্ত অবকাঠামো গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। রাস্তাঘাট ব্রিজ কালভার্ট কিছুই নেই। দেশে খাদ্যসঙ্কট চলছে। বঙ্গবন্ধুর সাথে আছে শুধু মানুষ। সেই মানুষকে হাতিয়ার করে তিনি দেশ পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করলেন। বললেন স্বেচ্ছাশ্রমের কথা, বাধ্যতামূলক সমবায়ের কথা।
বঙ্গবন্ধুর জীবনের একমাত্র চাওয়া ছিল এ দেশের মানুষের সার্বিক মুক্তি। অসহায় অবহেলিত মানুষের প্রতি ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রবল পক্ষপাতিত্ব। তিনি চাইতেন মানুষের সমানাধিকার, বৈষম্যহীন সমাজ। এ দেশের খেটেখাওয়া শ্রমজীবী মানুষদের তিনি বলতেন, ‘আমার দুঃখী মানুষ।’ কৃষক শ্রমিক মেহনতী মানুষের প্রতি তার ছিল মমতার দৃষ্টি। কারণ তারাই সচল রাখে অর্থনীতির চাকা। অথচ তারাই পদে পদে বঞ্চিত হয়। তিনি বিভিন্ন ভাষণে বারবার বলেছেন কৃষক শ্রমিককে সম্মান দেয়ার কথা, মর্যাদা দেয়ার কথা। পাকিস্তানের ২২ পরিবারের প্রতি তিনি যেমন বিতশ্রদ্ধ ছিলেন তেমনি বিতশ্রদ্ধ ছিলেন স্বাধীনতার পর হঠাৎ গজিয়ে ওঠা এ দেশের ধনিক শ্রেণীর প্রতি। ঘুষখোর, মজুদদার, আড়তদার, মুনাফাখোরদের প্রতি। তিনি তাদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন। দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানিরা সব নিয়ে গেছে। খালি চোরগুলোকে রেখে গেছে।’
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট কিছু সেনাসদস্যের আচম্বিত আক্রমণে পুরো পরিবারসহ শহীদ হন বঙ্গবন্ধু। শিশু রাসেলও রেহাই পায়নি ঘাতকের বুলেট থেকে। বিদেশে থাকায় বেঁচে যান বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ছোট বোন শেখ রেহানা।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পূরণের পথে পা রেখেছি আমরা। এই সময় পৃথিবীব্যাপী থাবা বসিয়েছে করোনাভাইরাসের আগ্রাসন। সর্বশক্তি নিয়োগ করেও টালমাটাল অবস্থা পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় স্কুলের ছাত্রী ছিলাম। পঁয়ষট্টিতে পাক-ভারত যুদ্ধ দেখেছি। সত্তরের টর্নেডো দেখেছি। একাত্তরে উদ্বাস্তু হয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছি। ভাই শহীদ হয়েছে। যুদ্ধোত্তর দেশে সৃষ্ট কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ দেখেছি। সপরিবারের বঙ্গবন্ধুকে শহীদ হতে দেখেছি। দেখেছি জিয়ার মৃত্যু। ২০০৯-এর পরিবর্তিত প্রেক্ষাপট দেখেছি। ইতিহাসের অনেক বাঁকবদলের সাক্ষী আমি। কিন্তু কখনই ভাবিনি মহামারির মতো এত বড় দুর্যোগ আমাকে দেখতে হবে। এত বড় দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
আমরা এখন সেই অভাবিত অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। পল-অনুপল পার করছি উদ্বেগে। এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সচেতনতা। প্রয়োজন করোনা প্রতিরোধে করণীয় কাজগুলো নিয়ম করে করা। শুধু নিজের কথা না ভেবে সবার কথা ভাবা। কিন্তু আমরা বেশির ভাগ মানুষ নিজের কথাই ভাবছি। পাগলের মতো মজুদ করছি খাদ্যদ্রব্য। পরিণতিতে ইতোমধ্যে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়ে গরিবের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। এমন চলতে থাকলে করোনার আক্রমণে শুধু নয়, খাদ্যাভাবেও মানুষ মারা যাবে।
তাই এবারের স্বাধীনতা দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক, করোনা মোকাবেলা করব। সবাই মিলে বাঁচব। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement