২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

এআই ম্যারাথনে চীন কি যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে যেতে পারবে?

এআই প্রযুক্তিতে চীনকে আটকাতে আমেরিকা তৎপর হয়ে উঠেছে - ছবি : বিবিসি

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই-এর ক্ষতিকারক প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ যেমন বাড়ছে, তেমনি একইসাথে যুক্তরাষ্ট্র জোর চেষ্টা শুরু করেছে যেন কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রযুক্তিতে চীনের অগ্রগতি যতটা সম্ভব খর্ব করা যায়।

এখন পর্যন্ত এআই-এর প্রযুক্তির প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চীনের কাছে সেমিকন্ডাক্টর রফতানিতে বিধিনিষেধ জারি করার পর চীনের প্রযুক্তিগত উন্নতির প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

কিন্তু চীন এই বাধা দূর করতে পারবে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। কারণ এই আই প্রযুক্তিকে নিখুঁত এবং লাগসই করতে এখনও অনেক বছর লেগে যেতে পারে।

গবেষণা সংস্থা ট্রিভিয়াম চায়নার প্রযুক্তিবিষয়ক গবেষণা বিভাগের প্রধান কেনড্রা শেফার বলেন, চীনা ইন্টারনেট কোম্পানিগুলো ‘সম্ভবত আমেরিকার কোম্পানিগুলোর চেয়ে অনেক অগ্রসর। তবে কিভাবে এই অগ্রসরতা আপনি পরিমাপ করবেন, তার ওপর এই তুলনা নির্ভর করছে।’

কিন্তু তিনি বলেন, ‘অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি নির্মাণের ক্ষমতার বিচারে চীন এখনও অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে সবচেয়ে অগ্রসর দেশগুলোর তুলনায় ১০ থেকে ১৫ বছর পিছিয়ে রয়েছে।’

সিলিকন ভ্যালি ফ্যাক্টর
যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো সিলিকন ভ্যালি, যেটিকে মনে করা হয়, বিশ্বে প্রযুক্তি উদ্যোক্তা এবং উদ্ভাবকদের এক নম্বর জায়গা। গুগল, অ্যাপল এবং ইনটেলের মতো যেসব প্রযুক্তি মানুষের আধুনিক জীবনযাপনকে মৌলিকভাবে বদলে দিয়েছে, সেগুলোর জন্ম সিলিকন ভ্যালিতে।

হংকং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এবং টেকনোলজির আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক পাসকাল ফুং বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে উদ্ভাবকরা এতটা বিকশিত হতে পারেন, তার কারণ ওই দেশের ‘অনন্য গবেষণা সংস্কৃতি’।

তিনি বলেন, আমেরিকায় গবেষকরা কোনো পণ্য উদ্ভাবনের কথা মাথায় না রেখেই বছরের পর বছর ধরে গবেষণা করে যান।

উদাহরণ হিসেবে ওপেন-এআইয়ের কথা বলা যায়। এটি অনেক বছর ধরে একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে গেছে। ওই সময় তারা ট্রান্সফরমার মেশিন লার্নিং মডেল নিয়ে গবেষণা করেছে, যা কালক্রমে চ্যাট-জিপিটির জন্ম দিয়েছে।

তিনি বলেন, ‘সিংহভাগ চীনা কোম্পানিতে কখনই এ ধরণের সংস্কৃতি ছিল না। ভোক্তার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে এবং বাজার পাবে, তা নিশ্চিত হওয়ার পরপরই শুধু তারা এআই নিয়ে গবেষণা শুরু করে। এটা চীনা এআই প্রযুক্তির সামনে সবচেয়ে বড় এবং মৌলিক চ্যালেঞ্জ।’

যুক্তরাষ্ট্রে এসব গবেষণায় ওই দেশের বিনিয়োগকারীরা অনেক অবদান রাখছেন। ২০১৯ সালে মাইক্রোসফট ওপেন-এআইতে ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়।

মাইক্রোসফটের প্রধান নির্বাহী সত্য নাদেলা বলেছেন, ‘এআই এমন একটি প্রযুক্তি, যেটি আগামীতে সারা বিশ্বের বিভিন্ন পরিবর্তনে সবচেয়ে বড় প্রভাব রাখবে। বিশ্বের বড় বড় অনেক সঙ্কট সমাধানের পথ খুলে দেয়ার সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে এই প্রযুক্তি।

চীনের বাড়তি সুবিধা
চীনের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো তাদের রয়েছে বিশাল সংখ্যক ক্রেতা বা ব্যবহারকারী। জনসংখ্যার দিকে দিয়ে চীন বিশ্বের দ্বিতীয়। ওই দেশের জনসংখ্যা কম-বেশি ১৪০ কোটি।

বিনিয়োগ সংস্থা রেস ক্যাপিটালের অংশীদার এডিথ ইয়ুং বলেন, চীনের ইন্টারনেট খাতও অনেক বড় এবং অত্যাধুনিক। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, চীনে প্রায় সব মানুষই উইচ্যাট অ্যাপ ব্যবহার করে। টেক্সট বার্তা পাঠানো থেকে শুরু করে ডাক্তারের সাথে সময় ঠিক করা, এমনকি ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল করার জন্যও উইচ্যাট ব্যবহার করা হয়।

মিজ ইয়ুং বলেন, ফলে পণ্যের মান বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় ডেটা বা তথ্যের বিপুল সরবরাহ রয়েছে চীনে। যত ডেটা কোনো এআই মডেল ব্যবহার করতে পারবে, সেটি ততই নিখুঁত হবে।’

তিনি বলেন, ‘ভালো বা মন্দ যাই হোক, যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় চীনে প্রাইভেসি বা গোপনীয়তার অধিকারবিষয়ক বিধিনিষেধ অনেক কম। যেমন ওই দেশে চেহারা সনাক্ত করতে সর্বত্র সিসিটিভি ব্যবহার করা হচ্ছে। তাহলে বুঝুন, এআই দিয়ে ছবি বানানো কত সহজ সেখানে।’

মনে হতে পারে, চীনের প্রযুক্তি কম্যুনিটি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে পিছিয়ে, কিন্তু চীনা প্রযুক্তিবিদদের কিছু বাড়তি সুবিধা রয়েছে বলে মনে করেন প্রখ্যাত প্রযুক্তিবিষয়ক লেখক লি কাই-ফু।

তার ‘এআই সুপার-পাওয়ার : চীন, সিলিকন ভ্যালি এবং নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা’ শীর্ষক বইতে লি এই ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন।

গুগল চায়নার প্রধান লি বলেন, তারা (চীনারা) এমন একটি দেশে বসবাস করে, যেখানে দ্রুত কাজ সম্পন্ন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, নকল সেখানে গ্রহণযোগ্য এবং কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব এতটাই প্রবল যে তারা নতুন একটি বাজার ধরতে কোনো চেষ্টা বাদ রাখবে না।

তিনি আরো বলেন, চীনের এই কঠোর প্রতিযোগিতা-পূর্ণ পরিবেশ সিলিকন ভ্যালির পরিবেশ থেকে অনেকটাই আলাদা, যেখানে কোনো ধরণের নকল করাকে খুবই ছোট চোখে দেখা হয়। অনেক কোম্পানিকে সেখানে শুধু একটি মৌলিক বিষয় নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করার সুযোগ দেয়া হয় এমন আশায় হয়তো হঠাৎ করে ফল মিলবে।’

তবে চীনের নকল করার এই প্রবণতার কিছু সমস্যা রয়েছে। প্রায়ই মেধাসত্ত্ব নিয়ে বড় ধরণের ঝামেলা তৈরি হয়। লি লিখেছেন, এসব ঝামেলা-বিপত্তির পরিণতিতে চীনে অত্যন্ত কষ্ট সহিষ্ণু এবং চতুর একটি উদ্যোক্তা প্রজন্ম তৈরি হয়েছে, যারা যেকোনো প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত।

১৯৮০-এর দশক থেকে চীনে অব্যাহত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। মিজ ফুংয়ের মতে, এক সময় এই প্রবৃদ্ধির মূল ভিত্তি ছিল শিল্প-পণ্য উৎপাদন, যা এখন ধীরে ধীরে প্রযুক্তি-নির্ভর হয়ে উঠছে। গত এক দশকে আমরা চীনে ইন্টারনেট খাতের ব্যাপক প্রসার দেখছি এবং অত্যাধুনিক চীনা ডিজাইনের উদ্ভাবন দেখছি।

চীন যুক্তরাষ্ট্রকে টপকাতে পারবে?
এটা ঠিক যে চীনা প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর বাড়তি কিছু সুবিধা রয়েছে, কিন্তু চীনা সরকারের কর্তৃত্ববাদী নীতির প্রভাব তাদের ওপর কিভাবে পড়বে, তা এখনো পরিষ্কার নয়।

যেমন প্রশ্ন রয়েছে বিভিন্ন বিধিনিষেধ চীনা এআই চ্যাটবট তৈরির ওপর নেতিবাচক প্রভাব রাখবে। যেমন কোনো এআই চ্যাটবট কি প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের ব্যাপারে স্পর্শকাতর প্রশ্নের জবাব দেবে?

মিজ ইয়ুং বলেন, ‘আমি মনে করি না যে চীনে কেউ বাইদু বা আর্নি প্লাটফর্মে এ ধরণের স্পর্শকাতর প্রশ্ন করবে। কারণ তারা জানে, কিছু প্রশ্নের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে স্পর্শকাতর বিভিন্ন বিষয় এআই চ্যাটবট ব্যবহারের ক্ষুদ্র একটি অংশ। শুধু মিডিয়া এগুলোতে নজর দেয়।’

তবে চীনা এআই খাতের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে বিশেষ কিছু প্রযুক্তি থেকে চীনকে দূরে রাখার চেষ্টা করছে তা নিয়ে। উদ্বেগ রয়েছে এর ফলে চীনা এআই খাতের অগ্রগতি শ্লথ হয়ে যাবে কিনা।

উচ্চ ক্ষমতার কম্পিউটার চিপ বা সেমিকন্ডাক্টর নিয়ে এখন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। ল্যাপটপ বা স্মার্টফোন থেকে শুরু করে আধুনিক বা সব প্রযুক্তিতে এই চিপ ব্যবহৃত হয়। এর সরবরাহ বিঘ্নিত হলে সামরিক খাতেও প্রভাব পড়তে পারে। তাছাড়া এআইভিত্তিক শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রের জন্যও সেমিকন্ডাক্টর দরকার।

মিজ ফুং বলেন, এনভিডিয়ার মতো আমেরিকার কোম্পানি এখন বিশ্বের শীর্ষ এআই চিপ নির্মাতা। এসব চিপ চীনের কাছে রফতানি করার ওপর বিধিনিষেধ দেয়ার পর চ্যাট জিপিটির সাথে প্রতিযোগিতা করার মতো চীনা কোম্পানি তেমন নেই বললেই চলে।

মিজ শেফার বলেন, তবে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত এসব রফতানি বিধিনিষেধের ফলে চীনে অত্যাধুনিক এআই খাত হয়তো এখন বেশ অসুবিধায় পড়বে। কিন্তু চীনা মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপের মতো ভোগ্যপণ্যকে তেমন ক্ষতি করতে পারবে না। কারণ, চীনে রফতানির বিধিনিষেধের মূল টার্গেট হচ্ছে চীনকে সামরিক খাতে এআই ব্যবহার থেকে আটকে রাখা।

মিজ ফুং বলেন, এই বিপত্তি রুখতে চীনের এখন প্রয়োজন নিজস্ব একটি সিলিকন ভ্যালির মতো একটি গবেষণা সংস্কৃতি, যা সারা বিশ্ব থেকে মেধাবী লোকজনকে আকর্ষণ করতে সক্ষম হবে। এখন পর্যন্ত তারা দেশের ভেতরের প্রতিভা এবং বিদেশে বসবাসরত চীনা বংশোদ্ভূতদের ওপর নির্ভর করছে। তবে একই সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের ধারকদের চিন্তা-চেতনা-মেধার একটি সীমাবদ্ধতা থাকে।

চীনা সরকার এখন চিপ তৈরির শিল্পগুলোকে ব্যাপকভাবে তহবিল যোগাচ্ছে। তবে একইসাথে সরকার এই খাতের ওপর নিয়ন্ত্রণও শক্ত করছে।

মার্চে প্রযুক্তি খাতের শীর্ষস্থানীয় একজন ব্যক্তিত্ব ঝাও উইগোর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে। এর আগেও বেশ ক’জন শীর্ষ স্তরের প্রযুক্তি উদ্যোক্তা সরকারের রোষানলে পড়েছেন।

প্রযুক্তি খাত প্রচুর মুনাফার পাশাপাশি লাল ফিতার দৌরাত্ব কমায়। কিন্তু এর ফলে সরকারের মধ্যেও নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয় ঢুকছে।

মিজ শেফার বলেন, ‘ঝাওকে গ্রেফতার করে অন্য কোম্পানিগুলোকে বার্তা দেয়া হচ্ছে : চিপ তৈরিতে দেয়া সরকারি অর্থ নয়-ছয় করা চলবে না।’

তবে এই বার্তার প্রভাব চীনের এআই শিল্পের ওপর কী হয়, তা দেখতে আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement