২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

সেলিমের পক্ষীশালায় কিছুক্ষণ

-

শীতের সকাল। কনকনে ঠণ্ডা। লেপ থেকে বেরোতেই মন চায় না। কিন্তু অর্ধাঙ্গিনীর ডাকে উঠতে হলো। আজকে না তুমি নারায়ণগঞ্জ যাবে। ওহ, ভুলেই গিয়েছিলাম। আড়মোড়া ভেঙে রেডি হয়ে উঠে বাসে যখন উঠলাম, তখন ভোরের আকাশ বেশ পরিষ্কার। মিরপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ দূরত্ব বেশি নয়। সকাল সকালই নারায়ণগঞ্জ পৌঁছে গেলাম। উদ্দেশ্য সারুমা এভেয়ারি দেখা। এভেয়ারির কর্ণধার বজলুর রশীদ সেলিম। ফোন দিলেও অপর প্রান্তে কোনো সাড়া নেই। এত সকালে তিনি ঘুম থেকে উঠেন না। দারোয়ানের কাছে শুনলাম। কী আর করা। অগত্যা শহরটা ঘুরে দেখতে বের হলাম। কিছুটা পথ যেতেই চোখে পড়ল বোস কেবিন। শত বছরের ঐতিহ্যবাহী। নাশতাটা সেখানেই সেরে নিলাম। নাশতা সেরে এসে সেলিম সাহেবকে পাওয়া গেল।
বজলুল রশিদ সেলিম। একজন সফল ব্যবসায়ী। তবে তার বড় পরিচয় তিনি একজন পাখিপ্রেমিক। বিদেশী পাখির বিপুল সংগ্রহ তার। রীতিমতো ছোটখাটো একটা চিড়িয়াখানা। এত বেশিসংখ্যক বিদেশী প্রজাতির পোষা পাখি বাংলাদেশে খুব বেশি মানুষের কাছে নেই। তার এই পক্ষীর সংগ্রহশালা দেখতেই নারায়ণগঞ্জ আসা। আলাপ-পরিচয় হলো। তার পীড়াপীড়িতে দ্বিতীয়বার নাশতা খেতে হলো। পাখির জগতে সেলিমের আতিথেয়তার জুড়ি নেই। যত দর্শনার্থীই আসুক না কেন। তিনি কিছু না খাইয়ে তাদের যেতে দেন না। তার ভাষায়Ñ অতিথি হলো আল্লাহর মেহমান। খালি মুখে যাবে কেন? তার পিছু পিছু ছাদে গেলাম। দুটি বাসার পাঁচতলা ও ছয়তলার ছাদে তার পাখির বৈচিত্র্যময় জগত। কিছু পাখি খোলা জায়গায় উড়ে বেড়াচ্ছে। শুরুতেই চোখ পড়ল ম্যান্ডারিন ডার্কের ওপর। পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছে। অসম্ভব সুন্দর একটি পাখি। চোখ ফেরানো যাচ্ছিল না। পানির জলাধার করা হয়েছে। আবার রেস্ট নেয়ার জন্যও ঘর আছে। সেলিমের কাছে জানা গেল, বাংলাদেশে প্রথম এবং একাধিকবার ম্যান্ডারিন ডার্ক ব্রিড করাতে সফল হয়েছেন তিনি। খাঁচা ও কলোনি দু’ভাবে পাখি পালা যায়। সেলিম দু’ভাবেই সফল। ছাদের বাম পাশে তার ময়ূরের বিপুল সংগ্রহ। শীত, তাতে কী? মনের আনন্দে ময়ূর ঘুরে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ পেখম মেলে ধরছে। সৌন্দর্যের কমতি নেই। চোখ জুড়িয়ে মনে অন্যরকম প্রশান্তি এনে দিলো। একটি-দুটি নয়, ১২টির মতো ময়ূরের দেখা মিলল। জানা গেল, ব্যক্তিগত সংগ্রহে এত ময়ূর দেশে আর কারো নেই বললেই চলে। তার কাছে জানলাম, ময়ূর ৯টির মতো ডিম পাড়ে। ৩০ দিন লাগে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে। কথায় কথায় জানতে চাইলাম। কিভাবে পাখি পালা শুরু হলোÑ সেলিম বলেন, পশু-পাখির প্রতি প্রেম ছোটবেলা থেকেই। মা ময়না পাখি পুষতেন। অবাক বিস্ময়ে তা দেখতাম। বনের শালিক পুষেছি। বেজি, বিড়াল, কুকুর, বানর, সাপও ছিল।
তবে ২০১১ সালে বাইপাশ সার্জারি হয়। ডাক্তার টেনশনমুক্ত থাকতে বলেন। তখন খাঁচায় পাখি পালার বুদ্ধি আসে। ভাবলাম এতে টেনশন ফ্রি থাকা যাবে। শখের বসে কিনে নিয়ে আসি ৫০ জোড়া বাজরিগার পাখি। খাঁচার বিদেশী পাখি। তখন তিনি আমি গার্মেন্টস ব্যবসায়ী। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে পাখির ঘর তৈরি করি। এভাবেই একসময় বাড়তে থাকে পাখির সংখ্যা।

তার সংগ্রহে এখন ৫০ প্রজাতির প্রায় ১০০ মিজটেশনের পাখি আছে। সংখ্যায় তা কয়েক শ’ এর মতো। নারায়ণগঞ্জের থানাপুকুড় পাড়ে তার পক্ষীশালা।
প্যারাকেট প্রজাতির প্রায় সব রকম পাখি দেখা হলো। মলক্কান কাকাতুয়া ধবধপে সাদা রঙয়ের পাখি। মাথায় আবার ঝুটিও আছে। বড্ড শান্ত স্বভাবের। হাতে নিলেও কিছু বলে না। সেলিম হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ আদর করলেন। এরই মধ্যে কিছু লরি পাখি তিনি আমার হাতে দিলেন। পোষ মানানো পাখি। উড়ে যাবে না। শিহরিত হলাম কিছুটা। এভাবে এত সুন্দর পাখি হাতের ওপর। এটা কম আনন্দের নয়। এরপর ঘুরে ঘুরে দেখা হলো মলুক্কান কাকাতুয়া, আফ্রিকান গ্রে প্যারট, ইলেকটাস প্যারট, ব্লু অ্যান্ড গোল্ড ম্যাকাও, ক্যাটাগনিয়ান কনুর, গালা কাকাতুয়া, চ্যাটারিং লরি, ইয়োলো বিপ লরি, রেড লরি, মলক্কান রেড লরি, ব্লু মাউন্টেন লরি, রেইনবো রেড কালার লরি, পারফেক্ট লরি, কার্ডিনাল লরি, সান কনুর, গোল্ডেন হেড কনুর, ইয়োলো সাইডেড কনুর, পাইনআপেল কনুর, ব্লু কনুর, লুটিনো রিংনেক, এলবিনো রিংনেক, ক্লিয়ার হেড/টেল রিং নেক, অস্ট্রেলিয়ান কিং প্যারট, ব্যারাবেন/সুপার প্যারাকিট, ক্রিমসন বেলি কনুর, প্রিন্সেস অব ওয়েলস, ককাটেল, ইংলিস বাজরিগার, অস্ট্রেলিয়ান বাজরিগার, জাপানিজ ক্রিস্টেট বাজরিগার, টারকুইজিন, ময়ূর (ইন্ডিয়ান, আফ্রিকান), ম্যান্ডারিন ডার্ক, উট ডার্ক, ডায়মন্ড ডোভ, লাভবার্ড, গ্রিন চিক কনুর, এলবিনো ক্রিস্টেট বেঙ্গলি ফিঞ্চ, প্যারাডাইজ ওয়েদা, জেব্রা ফিঞ্চ, পাইড বেঙ্গলি, ক্যালিফোর্নিয়ান কোয়েল ইত্যাদি। বেশির ভাগ পাখিই দুর্লভ প্রজাতির।
প্রচণ্ড শীত। এর মধ্যে দেখলাম লাল রঙের একটি পাখি খাবার পানিতে গোসল করছে। ঠাণ্ডা লাগবে না? বলতেই সেলিম হেসে বলেন না। এরা গোসল করতে পছন্দ করে। পশম শীত থেকে ওদের সুরক্ষা দেয়। পাখিটির নাম লরি। বাংলাদেশে লরি পাখির গুরু বলা হয় সেলিমকে। পাখি তো আছেই। আবার ফল-ফুলের গাছও আছে। প্রাকৃতিক পরিবেশে পাখি দেখা যাবে এখানে। আপেল, মাল্টা, লেবু, টমেটো, শসা, কাঁচামরিচ, বাগানবিলাস, গোলাপ, কী নেই। সব ধরনের ফুল-ফল, সবজির গাছের বিপুল সমারোহ তার বাসার ছাদে চোখে পড়ল। দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত সারুমা এভেয়ারি বিডি। সারুমা এভেয়ারিতে যে কেউ পাখি দেখতে আসতে পারেন। এত সুন্দর, গোছানো পাখি চিড়িয়াখানায়ও নেই। সেলিম জানালেন, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে স্কুল-কলেজ, মাদরাসার ছাত্রছাত্রী, সরকারি কর্মকর্তা, ব্যাংক কর্মকর্তা, বেসরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, সব শ্রেণীর মানুষ তার এভেয়ারিতে আসে। সময় নিয়ে পাখিদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন তিনি। যান্ত্রিক জীবনে অনেকেই হাঁপিয়ে উঠেছেন। এক দিনের মধ্যে পুরো পরিবার নিয়ে সারুমা এভেয়ারি বিডি ঘুরে আসা সম্ভব। বিদেশী পাখির বর্ণিল মনকাড়া উপস্থিতিতে মুগ্ধ করবে। খনিকের জন্য হলেও মনে প্রশান্তির সুবাতাস বইয়ে দেবে। এ কথা জোর দিয়েই বলা যায়। শেষ বিকেল। দিনের আলো ফুরিয়ে এসেছে। ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। ঢাকার পথে পা বাড়াতে হলো আমাকে। এক পৃথিবী ভালোলাগার মিষ্টি অনুভূতিকে সঙ্গী করে।

যেভাবে যাবেন
ঢাকার মিরপুর, ফার্মগেট, উত্তরা, গুলিস্তানসহ বিভিন্ন স্থান থেকে নারায়াণগঞ্জ যাওয়ার বাস পাওয়া যাবে। সকাল থেকে রাত অবধি বাস চলে। নারায়ণগঞ্জের চাষাড়া মোড় নেমে থানাপুকুড় পাড়ে গেলেই দেখা মিলবে সারুমা এভেয়ারি বিডির। আগে থেকে ফোন করে যেতে হবে। সারুমা এভেয়ারি বিডির ফোন নম্বর-০১৭১১ ৫২৩৫৫৬।

ছবি: লেখক


আরো সংবাদ



premium cement