২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

রকেট আকাশে ওড়ার সময় কেন দুর্ঘটনা ঘটে

রকেট আকাশে ওড়ার সময় কেন দুর্ঘটনা ঘটে। - ছবি : সংগৃহীত

রকেট উৎক্ষেপণের সময় অনেক ধরনের সমস্যা তৈরি হতে পারে, তবে গত কয়েক দশক ধরে ব্যর্থতার ঘটনাগুলোর মধ্যে আশ্চর্যজনকভাবে অনেকগুলো জায়গায় মিল রয়েছে। তবে যখন সমস্যা দেখা দেয়, তখন রকেট লঞ্চ খবরের সবচেয়ে বড় শিরোনামে পরিণত হয়।

স্টারশিপ ওয়ান ছিল বাণিজ্যিক মহাকাশ সংস্থা স্পেসএক্সের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় রকেট উৎক্ষেপণ। বিশাল সুপার হেভি রকেটের ওপর বসানো স্টারশিপ মহাকাশযানের একটি পরীক্ষামূলক মডেলের প্রথম উৎক্ষেপণ নিয়ে বিশ্বব্যাপী আশাবাদ তৈরি হয়েছিল।

চলতি বছরের ২০ এপ্রিল টেক্সাসের বোকা চিকার লঞ্চপ্যাড থেকে ধোঁয়া ও ধুলার বিশাল মেঘ উড়িয়ে যখন রকেটটি আকাশে উড়ে, তখন মহাকাশ অনুসন্ধানের একটি নতুন যুগের সূচনা হয়। কিন্তু তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি।

স্টারশিপের প্রথম উৎক্ষেপণে রকেটটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে নিয়ন্ত্রিত পুনঃপ্রবেশ এবং মেক্সিকো উপসাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে একবার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করার কথা ছিল।

কিন্তু লঞ্চ করার সময় সুপার হেভি বুস্টারের ৩৩টি ইঞ্জিনের মধ্যে তিনটি চালু হয়নি এবং আকাশে উড়ে যাওয়ার সময় আরো কয়েকটি ইঞ্জিন বিকল হয়ে পড়ে।

প্রাথমিক লঞ্চের প্রায় চার মিনিট পর রকেটটি গড়াতে শুরু করে এবং তখন উপসাগরের ওপরে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সেটিকে ধ্বংস করা হয়।

স্টারশিপ ওয়ানের উদ্বোধনী ফ্লাইটের ব্যর্থতা ছিল মহাকাশ জয়ের জন্য একবিংশ শতাব্দীর নতুন প্রতিযোগিতায় খুবই বড় ধরনের দুর্ঘটনা।

স্পেসএক্স বলছে, এ ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে রকেট উৎক্ষেপণের জন্য অনেক শিক্ষা অর্জন করা গেছে।

ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বোকা চিকা লঞ্চ সাইটটি কয়েক সপ্তাহ ধরে পরিষ্কার করার পর আবার নতুনে করে রকেট লঞ্চ করা হবে।

স্পেসএক্স মনে করে, ওই দুর্ঘটনা কোনো ধরনের ব্যর্থতা নয়। তারা বলছে, এ ঘটনা পরে রকেট লঞ্চের আগে ত্রুটিগুলো কাটিয়ে ওঠার একটি উপায় মাত্র।

রকেট দুর্ঘটনার সংখ্যা কি আসলেই খুব বেশি?
মানুষ মহাকাশে রকেট পাঠাতে শুরু করেছে ৭৫ বছরেরও বেশি সময় আগে, ওই বিবেচনায় রকেট উৎক্ষেপণের ক্ষেত্রে সাফল্যের সম্ভাবনা আসলে কতটা থাকে?

এসব কাজে কী ধরনের ঝুঁকি থাকতে পারে তা অনুমান করতে পারে যেসব মানুষ, ডেভিড ওয়েড তাদের একজন। এট্রিয়াম স্পেস ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে তিনি একজন আন্ডাররাইটার। ওই সংস্থা বাণিজ্যিক স্পেস লঞ্চের বীমা করিয়ে থাকে।

তিনি বলেন, গত বছর ২০২২ সালে, ১৮৬টি রকেট লঞ্চ হয়। সেগুলো দুই হাজার ৫০৯টি স্যাটেলাইট কক্ষপথে নিয়ে যায়। যার বেশিরভাগই ছিল স্টারলিংক, স্পেসএক্সের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট যোগাযোগ ব্যবস্থা।

তিনি জানান, স্পেসএক্স ফ্যালকন ৯-এ একেকবারে ৬০টি পর্যন্ত উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করা হয়। কিন্তু ১৮৬টি লঞ্চের মধ্যে ব্যর্থ হয়েছে মাত্র আটটি।

তার মানে, ব্যর্থতার হার মাত্র চার ভাগ, প্রতি ২৫টি লঞ্চের মধ্যে একটি।

কিন্তু ডেভিড ওয়েড বলছেন, ২০২২ সালে এ হিসেবে কিছুটা অসঙ্গতি দেখা দিয়েছিল।

গত বছর রকেট উৎক্ষেপণের সংখ্যা আগের বছরগুলোর তুলনায় নতুন রেকর্ড তৈরি করে।

২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে রকেট লঞ্চের সংখ্যা ছিল ৪০টি বেশি এবং পাঁচ বছর আগে ২০১৭ সালের তুলনায় সংখ্যাটি ছিল দ্বিগুণ। কিন্তু বেশি সংখ্যায় রকেট উৎক্ষেপণের সাথে সাথে বেড়েছে তার ঝুঁকিও।

তিনি বলেন, ‘অন্য সময়ের চেয়ে গত বছর আমরা অনেক বেশি ব্যর্থতার ঘটনা দেখেছি। এর কারণ, আমরা এমন একটি পর্যায়ে যেতে শুরু করছি যেখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে বেশ কয়কটি নতুন লঞ্চ ভেহিকেল চালু হচ্ছে। যেকোনো রকেট লঞ্চে প্রথম দিকের ফ্লাইটগুলোতেই সবসময় বেশি সমস্যা থাকে।’

স্টারশিপ ওয়ান এবং নাসার আর্টেমিস প্রোগ্রাম প্রথমবারের মতো ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে সফলভাবে চালু হয়। এসব নতুন লঞ্চ ভেহিকেলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয়। কিন্তু এরা সমস্যার ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। নতুন নতুন লঞ্চ ভেহিকেল চালুর সাথে আসে আরো বেশি অনিশ্চয়তা, বিশেষ করে প্রথম দিকের কয়েকটি ফ্লাইটের সাথে।

উৎক্ষেপণে ব্যর্থতার কারণ বের করা ‘খুব কঠিন’

স্পেসএক্সের স্টারশিপ লঞ্চপ্যাড থেকে ঠিকই আকাশ উড়েছে। কিন্তু তার উদ্বোধনী ফ্লাইটটি কয়েক মিনিটের মধ্যে বিস্ফোরিত হয়েছে।

ডেভিড ওয়েড বলেন, ‘সাধারণত, প্রথম বা দ্বিতীয়বার লঞ্চের সময় আপনি আশা করতে পারেন যে এদের মধ্যে ব্যর্থতার হার হবে ৩০ভাগ। এরপর থেকে পরিস্থিতি আরো ভালো হতে শুরু করে। আপনি যখন লঞ্চ ভেহিকেলের ১০তম ফ্লাইটে উঠবেন, তখন দেখবেন ব্যর্থতার হার পাঁচ ভাগেও কম।’

তিনি বলেন, ‘কিছু ফ্লাইট ব্যর্থ হওয়ার কারণ সঠিকভাবে চিহ্নিত করা খুব কঠিন। আপনি দেখবেন প্রথম দুই বা তিনটিতে অনেক প্রচেষ্টা যোগ হয়, প্রচুর পরিমাণে গবেষণা, প্রচুর পরিমাণে মান-নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করে যে সবকিছু ঠিক আছে। এরপরো আমরা ব্যর্থতার মুখোমুখি হই। এর কারণ, সাধারণত প্রথম কয়েকটি ফ্লাইটের সময় অনেক অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে থাকে।’

মহাকাশ শিল্পবিষয়ক বিশ্লেষক ডেভিড টড বলছেন, ‘মানববাহী/মানব বহনকারী মিশনের জন্য উৎক্ষেপণের সময় ব্যর্থতার হার (সর্বকাল তুলনায়) বেশ কম, প্রায় দুই ভাগ এবং কক্ষপথ পরিভ্রমণের ক্ষেত্রে এই ব্যর্থতা মাত্র এক ভাগ।’

তিনি আরো বলেন, ‘ব্যর্থতার এই নিচু হারের কারণ রাশিয়ান সয়ুজ রকেট অনেকগুলো মানুষবাহী ফ্লাইটে উড়েছে। এটি বেশ কয়েক দশক ধরে ব্যবহার করা হয়েছে এবং এটি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য লঞ্চ ভেহিকেল। এছাড়াও মানুষবাহী স্পেসফ্লাইটের সময় অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করা হয়।’

তিনি বলেন, ‘মানববাহী মহাকাশযান লঞ্চ স্কেপ সিস্টেম বহন করে, যা বিপদের সময় ক্রুর প্রাণ বাঁচাতে পারে। ১৯৭৫ সালে সয়ুজ ১৮-এ ফ্লাইটটি এর একটি উদাহরণ।’

গত বছর পুরোটা জুড়ে স্পেসএক্স প্রতি ছয় দিনে একটি করে ফ্যালকন-৯ রকেট উৎক্ষেপণ করেছে। এক্ষেত্রে চীনও তার নিজস্ব রেকর্ড ভেঙেছে। তারা মোট ৬৪টি রকেট উৎক্ষেপণ করেছে, যার মধ্যে ব্যর্থ হয়েছে মাত্র দু’টি।

মহাকাশ উৎক্ষেপণের ক্ষেত্রে নিউজিল্যান্ডের নামই কেউ জানে না। তারাও তাদের একটি নতুন স্পেসপোর্ট থেকে নয়টি রকেট উৎক্ষেপণ করতে সক্ষম হয়েছে।

মহাকাশ বীমার অপেক্ষাকৃত নতুন ব্যবসার ক্ষেত্রে এসব ক্রিয়াকলাপ আকর্ষণীয় সব চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। এক্ষেত্রে ডেভিড ওয়েড ইউরোপিয় স্পেস অ্যাজেন্সির রকেট আরিয়ান-৬ এর উদাহরণ দেন।

তিনি বলেন, ‘যদি আরিয়ান-৬ থেকে এখন আমাদের সাথে যোগাযোগ করা হয় এবং বলা হয় যে তৃতীয় ফ্লাইট থেকে রকেটটি স্যাটেলাইট বহন শুরু করবে। তাহলে সেটি বীমা করার সময় আমরা সম্ভবত জিজ্ঞেস করবো, রকেটটির প্রথম দু’টি ফ্লাইট কি সফল হয়েছে? এবং সেটাকে আমরা শর্ত হিসেবেও দিব। যদি দু’টির মধ্যে একটি ফ্লাইট ব্যর্থ হয়, তাহলে আর বিমার অর্থ আমাদের শোধ করতে হবে না।’

এমন কিছু ব্যক্তি আছেন যারা গত আট দশকে মহাকাশ উৎক্ষেপণ সংখ্যার সব হিসেব রেখেছে এবং তারাও ব্যর্থতার কারণ সম্পর্কে একটি ধারণা দিতে পারেন।

প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন রকেট লঞ্চের সব উপাত্ত সেরাডাটা নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ডেটাবেজে ঢোকানো হয়, যা পরে ডেভিড ওয়েডের মতো বীমা কোম্পানিগুলোর গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়।

ব্যর্থতার প্রশ্নে সেরাডাটা রকেটের পে-লোডের কাঙ্ক্ষিত কক্ষপথে না পৌঁছানো কিংবা উৎক্ষেপণের সময় এর কোনো উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি যার কারণে এটি কক্ষপথ পর্যন্ত পৌঁছুতে ব্যর্থ হয় তা বিবেচনা করে।

মহাকাশ দৌড়ের শুরুর দিকে ১৯৫০ সালের উৎক্ষেপণগুলোর দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায়, ওই সময় ব্যর্থতার হার ছিল আশ্চর্যজনকভাবে ভিন্ন, ৭০ ভাগেরও বেশি।

ওই সংখ্যা কমতে শুরু করে ১৯৬০-এর দশকের শুরুতে। এবং তখন থেকে ব্যর্থতার হার একই রকম রয়েছে।

মহাকাশ শিল্প বিশ্লেষক ডেভিড টড বলেন, ‘শুরুর দিকে আপনি সবসময়ই বড় ব্যর্থতার সম্মুখীন হবেন। শুধুমাত্র এরপরই পাশ্চাত্যের দেশগুলোর রকেট লঞ্চ ভেহিকেলগুলো আমাদের ভাষায় নির্বাণ প্রাপ্ত হয়।’

রাশিয়ার মতো দেশগুলোর তৈরি রকেটের ক্ষেত্রে একই কথা বলা যায় না। প্রোটন লঞ্চ সিস্টেম- স্পেস শাটলের অবসর গ্রহণ ও স্পেসএক্সের ড্রাগন মহাকাশযান উৎক্ষেপণের মধ্য সময়ে আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রের জন্য সয়ুজ রকেট মডিউল ব্যবহার করেছিল, তা ওই প্রবণতাকে কিছুটা বাধাগ্রস্ত করেছে।

ডেভিড ওয়েড বলেন, ‘প্রোটন লঞ্চ ভেহিকেল, যা ১৯৬৫ সাল থেকে মহাকাশে উড়েছে, তার রেকর্ড ছিল হতবাক করার মতো।

প্রোটনের সাফল্যের হারকে তিনি ইউরোপিয় আরিয়ান-৪ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ডেল্টা-২ রকেটের সাথে তুলনা করেন। যেগুলো পরপর ১০০টিরও বেশি সফল উৎক্ষেপণ করেছে।

তিনি বলেন, ‘প্রোটনের ক্ষেত্রে আপনি দেখবেন যে প্রতি ১০ থেকে ২৫টি ফ্লাইটে একটি করে ব্যর্থতার হয়। আমার মনে হয়, রাশিয়ায় ১৯৬০-এর দশকে মহাকাশ প্রতিযোগিতার কারণে এ শিল্পে প্রচুর লোক এসেছিল। সেরা ও মেধাবী ব্যক্তিরা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা স্নাতকরা যোগদান করেছিল।’

ডেভিড ওয়েড বলছেন, মহাকাশ প্রতিযোগিতার সমাপ্তি এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন রুশ মহাকাশ শিল্পকে ব্যাপকভাবে খর্ব করেছে, এ শিল্পে অর্থের প্রবল সঙ্কট রয়েছে।

ডেভিড টড বলেন, নতুন রকেটের প্রথমবার লঞ্চের প্রসঙ্গ উঠলে স্টারশিপ ওয়ানের ব্যর্থতাকে এখন আর অসম্ভব ঘটনা বলে মনে হয় না। এমনকি, রকেট যুগ শুরু হওয়ার আট দশক পরও একটি নতুন রকেট সিরিজের প্রথম উৎক্ষেপণের সময় ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা প্রতি দু’টির মধ্যে একটি এবং দ্রুত বিকাশমান মহাকাশ শিল্প একের পর এক নতুন রকেট তৈরি করে চলছে।

ডেভিড ওয়েড রকেট লঞ্চের উপাত্তের মধ্যে লুকোনো আরেকটি ইন্টারেস্টিং প্যাটার্ন আবিষ্কার করেছেন। তা হলো ষষ্ঠবার লঞ্চে ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা হঠাৎ বেড়ে যায়।

ডেভিড ওয়েড, ‘আমরা সাধারণত দেখি প্রথম ১০টি ফ্লাইটের মধ্যে দু’টি ব্যর্থ হয় এবং প্রথম ও দ্বিতীয়টির ব্যর্থতার হার সাধারণত ৩০ ভাগের মতো। তারপর এটি সুন্দরভাবে কমে আসে। ষষ্ঠ ফ্লাইটটি ব্যর্থ হওয়ার একটি বিশেষ প্রবণতা রয়েছে এবং তবে এর সঠিক কারণ জানা কঠিন। হয়ত ওই পর্যায়ে নির্মাণকাজ দৈনন্দিন বিষয়ে পরিণত হয়। হয়ত মান নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি বজায় থাকে না এবং অতিরিক্ত প্রচেষ্টার মানসিকতাও বদলে যায়।’

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement