২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

কাউনের চালের তৈরি নুডলস নিয়ন্ত্রণ করবে ডায়াবেটিস : শাবিপ্রবির গবেষণা

- ছবি - ইউএনবি

ইনস্ট্যান্ট নুডলস এখন পুরো বিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আমাদের দেশে এই নুডলস উৎপাদনের সাধারণত গম, চাল, আলু, মিষ্টি আলুকেই প্রধান কাঁচামাল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে উপাদানগুলোতে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ বেশি থাকায় ওজন বৃদ্ধি, ডায়াবেটিসসহ নানারকম জটিল রোগের সহায়ক হিসেবে কাজ করে। এজন্য এর বিকল্প হিসেবে এ সকল রোগ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম এবং একই সঙ্গে জলবায়ু অভিযোজন সম্পন্ন শস্যকে কাচাঁমাল হিসেবে ব্যবহার করে সম্প্রতি সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) একটি পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে।

এই গবেষণার গবেষক ছিলেন ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টি টেকনোলজি (এফইটি) বিভাগের পিএইচডি ফেলো মোছা. মেহেরুন্নাহার। তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন একই বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোজাম্মেল হক। এছাড়া সহ-তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) ইন্সটিটিউট অব ফুড সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (আইএফএসটি) সিএসও ড. মো. আব্দুস সাত্তার মিয়া।

শরীরে ওজন বৃদ্ধি, ডায়াবেটিস সহ নানারকম জটিল রোগ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সময়ের চাহিদায় শস্য বৈচিত্র আনা এবং অল্প খরচে স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের কাঁচামাল উৎপাদনের উদ্দেশ্যে এই গবেষণা।

গবেষণার মূল বিষয় ছিল- নতুন প্রজাতির কাউনের চাল, গম, রাইস ব্রান ও মাশরুমের সমন্বয়ে তৈরি কম্পোজিট ফ্লাওয়ার দ্বারা পুষ্টি সমৃদ্ধ একটি নুডলস উৎপাদন করা। যেখানে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ প্রায় ৫০ শতাংশ কমিয়ে এনে প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেলসের পরিমাণকে বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। যেটি সাধারণ নুডলসের চেয়ে অনেক বেশি পুষ্টিকর। এই নুডলস খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের ফলে ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হাইপার অ্যাক্টিভিটিসহ ওভারওয়েট নামক ভয়াবহ রোগ ও শারীরিক সমস্যা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হবে।

এছাড়া নুডলস উৎপাদনের ফলে দেশে কাউনের চাল উৎপাদনের চাহিদাও বৃদ্ধি পাবে। এতে করে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকরা নতুন করে তাদের জীবনের গতি পাবে। কারণ অব্যবহৃত জমি ও চর এলাকায় অনাবৃষ্টির কারণে অন্য ফসল উৎপাদন সম্ভব নয়- এমন জমিতে স্বল্প খরচে এই ধান উৎপাদন সম্ভব।

মূল গবেষণাটি সম্পন্ন হয় আইএফএসটির ল্যাবরেটরিতে। গবেষণায় কাউনের চালকে প্রধান কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি গম, রাইস ব্রান ও মাশরুমও ব্যবহার করা হয়। প্রত্যেকটি কাঁচামালের তিন ধরনের জাত নিয়ে তাদের ভৌত রাসায়নিক, মিনারেলস ও ফাংশনাল প্রোপার্টিস এনালাইসিসের মাধ্যমে কাঁচামালগুলোর গুণগত মান নির্ণয় করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে ভালো জাতের কাঁচামালটি নুডলস উৎপাদনের জন্য বাছাই করা হয়।

গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়, ওজন নিয়ন্ত্রণে কাউনের চাল অসাধারণ ভূমিকা পালন করে। এটি গ্লুটেন ও সুগার ফ্রি। প্রতি ১০০ গ্রাম কাউনের চালে প্রায় ১২ শতাংশ প্রোটিন, ৭০ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট, সাত শতাংশ ফাইবার, তিন শতাংশ ফ্যাট, ৩৯০ কিলোক্যালরি এনার্জি, ৩২ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, আট মিলিগ্রাম আয়রন, ৪০০ মিলিগ্রাম পটাসিয়াম, প্রায় ৭০০ মিলিগ্রাম ফসফরাসসহ অন্যান্য খনিজ লবণ ও ভিটামিন বিদ্যমান।

এ বিষয়ে গবেষক মোছা. মেহেরুন্নাহার বলেন, কাউনের চালে গ্লুটেন নাই এবং ফ্যাটের পরিমাণ কম থাকে। যেটি ডায়াবেটিস রোগীর জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী। কারণ ফাইবার বেশি থাকার কারণে এটি পাকস্থলী পরিষ্কার এবং কোষ্টকাঠিন্য দূর করতে সক্ষম। পর্যাপ্ত পরিমাণে মিনারেলস থাকায় শরীরে লবণের ঘাটতি পূরণ করে বিশেষ করে অন্তঃসত্ত্বা ও শিশুদের। এছাড়া ভিটামিন এবং খনিজ লবণ থাকায় এটি পরিপাকে দীর্ঘ সময় থাকে, শরীরে এনার্জি সরবরাহ করে থাকে। শুধু তাই নয়, মেডিক্যাল সায়েন্সের পরিভাষায় গ্লুটেন জাতীয় খাবার অনেক শিশুদের হাইপার অ্যাক্টিভিটি বাড়িয়ে তোলে। তাই বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের ক্ষেত্রেও চিকিৎসকরা গ্লুটেন (আটা, ময়দা) জাতীয় খাবারের পরিবর্তে কাউনের চালের তৈরি খাবারকেই প্রাধাণ্য দিয়ে থাকেন। স্বাস্থ্যের এই দারুণ উপকারিতায় এবং ডায়েটে অসাধারণ ভূমিকা রাখার কারণে পুষ্টিবিজ্ঞানীরা বর্তমানে ‘সুপার ফুড’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

কাউনের চাল জলবায়ু অভিযোজনে সক্ষম একটি শস্য। জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। তাই দেশে খাদ্য নিরাপত্তা এখন হুমকির সম্মুখীন। এর ফলে ক্ষুধা, অপুষ্টি ও অস্বাস্থ্য দিন দিন বেড়েই চলছে। জলবায়ুর এই বিরূপ পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে বিভিন্ন অভিযোজনের কৌশল সম্পর্কে জানা জরুরি। এই কৌশল প্রয়োগ করে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে শস্য বৈচিত্র অনন্য ভূমিকা পালন করে থাকে। কাউনের চাল জলবায়ু অভিযোজনসম্পন্ন একটি শস্য। এছাড়া অন্যান্য চাল উৎপাদনের চেয়ে কাউনের চাল উৎপাদনের তুলনা করে এর উপকারিতা তুলে ধরা হয় গবেষণাপত্রে।

গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক এফইটি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ মোজাম্মেল হক বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের অসামঞ্জস্যতায় দেশের কৃষিতে বড় ধরনের সমস্যা হতে চলেছে। এসব প্রেক্ষাপট বিবেচনায় শস্য বৈচিত্র আনা অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি দিনে দিনে ডায়াবেটিস, হাইপার অ্যাক্টিভিটিসহ ওভারওয়েট রোগের প্রবণতাও বাড়ছে। এজন্য রোগ নিয়ন্ত্রণ ও একইসঙ্গে জলবায়ু অভিযোজনে সক্ষম শস্য উৎপাদন এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তাই এ ধরনের শস্য নিয়ে আরো অধিকতর গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে এবং এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট গবেষকদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমানে আমাদের খাদ্যাভ্যাসে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ বেশি থাকায় শরীরে ওজন বৃদ্ধি, ডায়াবেটিসহ নানারকম জটিল রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। একইসঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় জলবায়ু অভিযোজনে সক্ষম শস্য উৎপাদন বৃদ্ধির বিষয়টি অধিক গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে। এছাড়া জলবায়ু অভিযোজনে সক্ষম শস্য উৎপাদন এবং এতে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ কম থাকে- এমন শস্য উৎপাদন নিয়ে গবেষণা নিঃসন্দেহে একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।

তিনি বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা গবেষণায় প্রতিনিয়ত ভালো করছে। আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে শিক্ষা ও গবেষণায় আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হওয়া। এজন্য গবেষকদের সব সময় আমরা উৎসাহ ও প্রেরণা দিয়ে থাকি। এ বছর গবেষণায় বরাদ্দ সাত গুণ বাড়িয়েছি। সামনে আরো বাড়বে। গবেষণায় অবকাঠামো উন্নয়নসহ যা যা প্রয়োজন তা আমরা করে যাচ্ছি।

দেখুন:

আরো সংবাদ



premium cement