২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ওমরাহ পালন : কিছু বিষয়ে সতর্কতা

ওমরাহ পালন : কিছু বিষয়ে সতর্কতা - ছবি : সংগৃহীত

ওমরার নিয়তে মীকাতের বাইরে থেকে এহরাম বেধে কাবার চতুর্পাশে তাওয়াফ এবং সাফা-মারওয়ায় সায়ী করে মাথা মুণ্ডন বা চুল খাটো করে হালাল হওয়াকে শরীয়তের পরিভাষায় ওমরাহ বলে। অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাস সম্ভবত ওমরার জন্য সবচে উপযোগী সময়। কারণ এ সময়ে মক্কা-মদিনার আবহাওয়া থাকে নাতিশীতোষ্ণ। যদিও সারা বছরই খোদাপ্রেমী মানুষের ঢল থাকে কাবা চত্বরে। রব্বে কাবার ডাকে সাড়া দিতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লাব্বাইক বলতে বলতে মুমিন বান্দারা খোদার ঘরে এসে হাজিরা দেয়।

মানবজাতির হেদায়েতের লক্ষ্যে পৃথিবীর বুকে সর্বপ্রথম যে বরকতময় ঘর নির্মাণ করা হয়, তা হলো বাইতুল্লাহ তথা কাবা ঘর। আরব উপদ্বীপের বাক্কা নামক স্থানে এর অবস্থান। যা মক্কা নগরীতে অবস্থিত।

কুরআনে কারিমের ইরশাদ, ‘নিশ্চয় মানুষের জন্য ইবাদতের স্থান হিসেবে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্মিত প্রথম ঘর হচ্ছে যা বাক্কা নামক স্থানে নির্মিত। যা জগদ্বাসীর হেদায়েত ও বরকতস্বরূপ নির্মিত হয়েছে। সেখানে রয়েছে আল্লাহর কুদরতের সুস্পষ্ট নিদর্শন মাকামে ইবরাহিম।’ (আলে ইমরান : ৯৬)

কালো গিলাফে আবৃত এই আদি ঘরের ছায়ায় হৃদয় শীতল করতে, ঈমান সতেজ করতে এবং খোদার সান্নিধ্য লাভে নিজেকে ধন্য করতে প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষ কী যে এক আকর্ষণে ছুটে যাচ্ছে মুগ্ধ মনে! খালি মাথায় নগ্নপদে সেলাইবিহীন দুই টুকরা সাদা কাপড় শরীরে জড়িয়ে অনুসন্ধানী মনে প্রদক্ষিণ করছে খোদার ঘরের চতুর্পাশ। আবেগ আর অনুতাপের অশ্রু ঝরাচ্ছে দুই নয়নে।

এটাই কাবার বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘স্মরণ করুন! যখন আমি কাবাকে বানালাম মানুষের জন্য সম্মিলনস্থল বা বারবার ফিরে আসার জায়গা।’ (বাকারা : ১২৫)

ওমরাহ পালন একটি ফজিলতপূর্ণ ইবাদত। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, এক ওমরাহর পর আরেক ওমরাহ উভয়ের মধ্যবর্তী সময়ের (গুনাহের) জন্য কাফফারা। আর জান্নাতই হলো হজ্জে মাবরূরের প্রতিদান।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ১৭৭৩)

ইবাদত হতে হয় শরীয়তের নির্ধারিত তরীকা অনুসারে। শরীয়তে অনুমোদিত নয় এমন কোনো কাজ ইবাদত নয়। আবার অনুমোদিত কাজটি শরীয়তের তরীকা পরিপন্থী হলে সেটি অসম্পূর্ণ হয় অথবা নষ্ট হয়ে যায়। গত কিছুদিন আগে ওমরার সফরে থাকাকালে এরকম কিছু সমস্যাই চোখে পড়েছে। এখানে সংক্ষেপে সেগুলোর বিবরণ তোলে ধরছি-

১. মাহরাম ছাড়া মহিলাদের হজ ওমরার সফর করা। সফরেরব সমপরিমাণ দূরত্ব থেকে হজ ওমরার সফর করতে হলে মহিলাদের জন্য অবশ্যই মাহরামসহ সফর করতে হবে। মাহরাম না থাকলে সামর্থ থাকা সত্ত্বেও মহিলার জন্য হজ বা ওমরায় গমন আবশ্যক থাকে না। বর্তমানে শরীয়তের এ বিধানের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করে এমন লোক খুব কমই পরিলক্ষিত হয়। এ হুকুম লঙ্ঘন করে মাহরাম ছাড়াই হজ ওমরাহ করে নিলে মাকরুহের সাথে সম্পাদন হয়ে গেলেও অনাবশ্যক আমল করতে গিয়ে নিশ্চিত গোনাহে লিপ্ত হওয়াটা স্পষ্ট বোকামি।

২. এহরাম বাধার পরও মহিলারা নেকাব পরে থাকা কিংবা চেহারা পুরোপুরি অনাবৃত রাখা। এ দুই তরীকার কোনোটিই সঠিক নয়। এহরামরত অবস্থায় মহিলাদের জন্য চেহারায় কাপড় লাগানোর যেমন অনুমতি নেই তেমনি চেহারা একেবারে উন্মুক্ত রাখারও অনুমতি নেই। এক্ষেত্রে করণীয় হচ্ছে নিজ দেশ থেকেই ক্যাপ সংগ্রহ করে নেয়া। এর ওপর দিয়ে উড়না বা কাপড়ের পাট্টা ঝুলিয়ে দিলে চেহারায় কাপড়ও লাগবে না আবার পর্দাও লঙ্ঘিত হবে না।

৩. এহরামের কাপড় পরা অবস্থায় পুরুষদের নাভীর নিচ পর্যন্ত উন্মুক্ত হয়ে যাওয়া। হানাফি মাযহাব অনুসারে পুরুষের সতর হল নাভী থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত। অনেককেই নাভীর অনেকটা নিচে ইহরামের কাপড় পরিধান করতে দেখা যায়। ফলে ফরজ সতরের অনেকটা খোলা থাকে, যা কোনো অবস্থাতেই জায়েয নেই। এ ব্যাপারে সবারই সতর্ক হওয়া উচিত।

৪. তাওয়াফের চক্করের সংখ্যায় ভুল করা। ওমরায় এবং হজে তাওয়াফ একটি ফরজ আমল। কাবা ঘরের চতুর্পাশে সাতবার প্রদক্ষিণ করলে এক তাওয়াফ হয়। চক্করের সংখ্যা সাতের কম হলে তাওয়াফের ফরজ আদায় হবে না। চক্করের সূচনা ও শেষ হয় কাবার দরজার বাম পাশের কোণ থেকে। যেখানে হাজরে আসওয়াদ স্থাপিত আছে। তাওয়াফ করতে খানিকটা লম্বা সময় লাগে বিধায় দু-তিন চক্করের পরে অনেকেরই চক্করের সংখ্যায় সন্দেহ সৃষ্টি হয়। ফলে তাওয়াফ সাত চক্করের চেয়ে কম হওয়ার আশঙ্কা থাকে। চক্করের সংখ্যা স্মরণে রাখার জন্য সাতটা দানা বা কংকর রাখা যেতে পারে। প্রত্যেক চক্কর শেষে একটি করে দানা পৃথক করবে।

৫. যে সকল জায়গায় চুম্বন বা ইস্তেলাম স্বীকৃত নয় সেখানেও চুম্বন-ইসতেলাম করা। পুরো হজ এবং ওমরার কার্যাবলির মাঝে কেবল হজরে আসওয়াদে চুম্বন করাটা এবাদত বলে স্বীকৃত। অন্য কোথাও চুম্বন করা অনুমোদিত নয়। অবশ্য ইস্তেলাম তথা সম্ভব হলে হাতের তালু দ্বারা স্পর্শ করা অন্যথায় দূর থেকে ইশারা করার বিষয়টি হাজারে আসওয়াদের রুকন এবং রুকনে ইয়ামানি এই দুই স্তম্ভের ব্যাপারেই প্রমানিত আছে। অনেককে মাকামে ইবরাহিমে, হাতীমে, কাবার অন্যান্য অংশে এমনকি জাবালে রহমতের চূড়ার স্তম্ভে এবং গারে হেরার পাথরে চুম্বন করতে দেখা যায়। এগুলো ইবাদত বলে স্বীকৃত নয়।

৬. রমল ও ইজতেবার কথা মনে না থাকা। আবার তিন চক্করের পরও ইজতেবা অব্যাহত রাখা। ওমরার তাওয়াফে এবং হজের ক্ষেত্রে তাওয়াফে কুদুমে রমল করা তথা তাওয়াফের প্রথম তিন চক্করে উভয় কাঁধ নাড়িয়ে বীরদর্পে হাটা একটি সুন্নত আমল। এ সময় ইজতেবা করতে হয়। অর্থাৎ ইহরামের চাদর ডান বগলের নিচ দিয়ে নিয়ে বাম কাঁধের ওপর দিয়ে ছেড়ে দিতে হয়। ডান কাঁধ খোলা রাখতে হয়। ইজতেবার আমল শুধু রমলের সাথে। যেই তাওয়াফ বা চক্করে রমল নেই সেখানে ইজতেবাও নেই। অনেককেই দেখা যায় রমল বা ইজতেবা কোনোটিই করে না। আবার অনেকে ইজতেবাসহ তাওয়াফ শুরু করে সাত চক্করই ইজতেবা অবস্থায় সম্পন্ন করে। এ দুটি তরীকাই ভুল।

৭. নফল তাওয়াফে কোনো রমল-ইজতেবা নেই। নফল তাওয়াফে ইহরামের কাপড় পরিহিত থাকাও জরুরি নয়।

৮. ইহরামরত অবস্থায় নিজেরা নিজেরা হলক করে ফেলা। হলক তথা মাথার মুন্ডানো বা চুল খাটো করা একটি ওয়াজিব আমল। এর মাধ্যমে একজন মুহরিম হালাল হয়। তবে এরজন্য শর্ত হলো- হারামের সীমার ভেতরে হলক করতে হবে এবং একজন হালাল -এহরামরত নয় এমন- ব্যক্তির মাধ্যমে হলক করাতে হবে। এহরামরত অবস্থায় নিজের চুল নিজে কাটা যেমন জায়েয নেই অন্যেরটা কেটে দেওয়াও জায়েয নেই। অনেককে এহরামরত অবস্থায় একে অপরের মাথা মুণ্ডিয়ে দিতে দেখা যায়। এমনটা করলে দম দিতে হবে।

৯. ওমরার তাওয়াফ চলা অবস্থায়ও তালবিয়া অব্যাহত রাখা। ওমরার ক্ষেত্রে নিয়ম হলো- তাওয়াফ শুরুর প্রাক্কালে হাজারে আসওয়াদে ইসতিলাম করার সাথে সাথে তালবিয়া পাঠ বন্ধ করে দেয়া। অথচ অনেককেই তাওয়াফকালে তালবিয়া পাঠ করতে দেখা যায়।

১০. হারাম এলাকার সম্মানের প্রতি খেয়াল না রাখা। বাইতুল্লার চতুর্পাশে বিস্তৃত নির্দিষ্ট সীমায় বেষ্টিত এলাকাকে হারাম বলে। ইহরামের যেমন কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে যেগুলো একজন মুহরিমকে মেনে চলতে হয়। তদ্রূপ হারাম এলাকারও কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে যেগুলো সেখানে অবস্থানরত মুহরিম গাইরে মুহরিম সবারই মেনে চলা উচিত। এহরামের বিধিনিষেধগুলো সাধারণত সবাই মেনে চললেও হারাম এলাকার সম্মান রক্ষা করে চলে এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম। অথচ এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। হারাম এলাকার শিকার না ধরা, সেগুলোকে উত্ত্যক্ত না করা, সেখানকার মালিকানাহীন সজীব গাছ, ঘাস উপড়ানো বা ছেড়া থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি ওই সীমার ভেতরে অবস্থান করাকে সাওয়াবের মনে করা, ঝগড়াঝাটি, অশালীন বাক্যালাপ, অনর্থক কাজকর্ম এবং যাবতীয় গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকাও হারাম এলাকার সম্মানের অন্তর্ভুক্ত। হারামের সীমায় অবস্থানকালে এ বিষয়গুলোর প্রতিও সচেতনতার সাথে লক্ষ্য রাখা উচিত।

১১. বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনায় বা নিদর্শনে নিজের নাম লিখে রেখে আসা। মক্কা মদীনায় যিয়ারতের বিভিন্ন স্থানে যেমন: গারে হেরার পাথরে, জাবালে রহমতের স্তম্ভে, গারে ছূরের পাথরে, জাবালে উহুদে এবং বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনা ও নিদর্শনে নিজের নাম লিখে রেখে আসা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং কুসংস্কারমূলক একটি কাজ। হজ ওমরার মতো শুভ্রতার ইবাদতে কুসংস্কারের আঁধারকে আলিঙ্গন করা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। এগুলো থেকে বিরত থাকা কাম্য।
আল্লাহ আমাদেরকে সকল ইবাদত বাসীরত ও সতর্কতার সাথে করার তাওফিক দান করুন! আমিন।

লেখক : শিক্ষক, মাদরাসা দারুর রাশাদ

 


আরো সংবাদ



premium cement