বিভিন্ন ধর্মে পাপকে কিভাবে দেখা হয়?

পাপ কাকে বলে? এই প্রশ্ন সম্ভবত সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষকে ভাবিয়েছে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টীয় এবং ইসলামিক সংস্কৃতিতে পাপ বার বার আলোচিত।

পাপের শাস্তিগুলো ধর্মগ্রন্থে বা পুরাণগুলোতে উল্লিখিত। জীবনানন্দ তার এক কবিতায় লিখেছিলেন ‘সৃষ্টির মনের কথা মনে হয়-দ্বেষ’। মানুষ কি কেবল মাত্র বিদ্বেষ থেকেই পাপ করে?

১-নাকি ‘পাপ’ হিসেবে চিহ্নিত বিষয়গুলোর পেছনে রয়েছে আরো কিছু ইন্দ্রীয়-তাড়না? বিভিন্ন ধর্মে উল্লিখিত প্রধান পাপগুলোকে এক বার ফিরে দেখা যেতে পারে এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে।

২-নীতিশাস্ত্র অনুসারে সমাজের কোনও নিয়ম ভঙ্গকে ‘অপরাধ’ হিসেবে ধরা যায়। কিন্তু ‘পাপ’ আর ‘অপরাধ’ এক জিনিস নয়। ‘পাপ’-এর সাথে ধর্মের অঙ্গাঙ্গী যোগ রয়েছে। একেকটি ধর্ম পাপকে তার নিজস্ব সামাজিক প্রেক্ষিত থেকে দেখেছে। অপরাধ যদি সামাজিক নীতিভঙ্গ হয়ে থাকে, পাপ তবে ব্যক্তিগত নীতিবোধ লঙ্ঘন। এই বোধটিও অবশ্য সমাজেরই সৃষ্টি। এখানে একে একে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টীয় এবং ইসলামে বর্ণিত পাপগুলোর কথা আলোচিত হল।

৩-সনাতন হিন্দু ধর্মে কোন কাজগুলো ‘পাপ’, তার বিধান দেয় স্মৃতিশাস্ত্রগুলো। মূলত ‘মনুস্মৃতি’-ই এ বিষয়ে প্রধান ভূমিকা নেয়। তবে, অন্য স্মৃতিগুলোতেও পাপ সংক্রান্ত বিধান রয়েছে। এই বিধান অনুসারে পাপের তিনটি শ্রেণি রয়েছে। প্রথমটি, কর্ম সম্পর্কিত। দ্বিতীয়টি, বাক্য সংক্রান্ত। এবং তৃতীয়টি, চিন্তা সংক্রান্ত।

৪-কর্ম সংক্রান্ত পাপের আওতায় প্রথমেই পড়ে চুরি। মজার ব্যাপার, বেশ কিছু প্রাচীন সাহিত্যে চৌর্যবৃত্তিকে ‘কলা’ বা ‘আর্ট’ হিসেবে বর্ণনা করা হলেও, তাকে শেষ পর্যন্ত পাপ বলেই গণ্য করা হয়।

৫-কর্ম সংক্রান্ত দ্বিতীয় পাপটি হল হিংসাত্মক কাজে ইন্ধন দেয়া। সম্ভবত প্রাচীন ভারতীয় সমাজে গণহিংসা রোধ করতে এই বিধান দেয়া হয়েছিল। কারণ, পরবর্তী বৈদিক যুগে আর্যরা বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভাজিত হয়ে প্রায়শই দাঙ্গায় লিপ্ত হতে শুরু করে।

৬-ধর্ষণকে কর্ম সংক্রান্ত পাপের মধ্য অন্যতম বলে ধরা হয়। এই বিধানের ব্যত্যয় ঘটেনি আজও।

৭-সনাতন ধর্মে বাক্য সংক্রান্ত পাপগুলো এই প্রকার-কুবাক্য কথন, মিথ্যাভাষণ এবং অযথা কথা বলা।

৮-চিন্তা সংক্রান্ত পাপ হিসেবে সনাতন ধর্ম যেগুলোকে চিহ্নিত করে, সেগুলো এই-চুরি সংক্রান্ত চিন্তা, কারও স্ত্রী বা সম্পত্তি হরণের চিন্তা, অন্যের ক্ষতিসাধনের চিন্তা ইত্যাদি।

৯-পরবর্তী সময়ে ব্রহ্মহত্যা, গোহত্যা, গুরুপত্নীর প্রতি কাম ভাব প্রদর্শন ইত্যাদিও সনাতন সমাজে পাপ বলে গণ্য হতে থাকে। সেই সাথে উপরোক্ত পাপে দুষ্ট ব্যক্তিদের সাথে সম্পর্ক রক্ষাকেও পাপ বলে গণ্য করা হতে থাকে।

১০-বৌদ্ধদ্ধর্মে ‘পাপ’-কে ‘অনান্তরিক কর্ম’ বলে বর্ণনা করে থেরবাদ (পরবর্তী কালে যা ‘হীনযান’ নামে পরিচিত হয়)। সেই অনুসারে পাপের সংখ্যা এখানে পাঁচটি।

১১-বৌদ্ধধর্ম অনুসারে কোনও বুদ্ধমূর্তিতে আঘাত হানা পাপ বলে পরিগণিত হয়।

১২-কোনো অর্হৎ বা ভিক্ষুকে হত্যা করা এই ধর্মের চোখে ক্ষমাহীন অপরাধ।

১৩-সঙ্ঘের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টিও পাপ। বুদ্ধের জীবদ্দশায় দেবদত্ত তেমন কাজ করতে চেয়েছিলেন বলে জানা যায়।

১৪-এ ছাড়া মাতৃহত্যা ও পিতৃহত্যাকেও বৌদ্ধধর্ম গুরুতর পাপ হিসেবে চিহ্নিত করে।

১৫-খ্রিস্টধর্মে গুরুতর পাপের সংখ্যা সাত। ক্যাথলিক এবং প্রোটেস্ট্যান্ট, উভয় সম্প্রদায়ই এই সাতটি পাপের বিষয়ে একমত।

১৬ -খ্রিস্টীয় মতে সাতটি পাপের প্রথমটি হল ‘লালসা’। তা যৌন লালসাও হতে পারে, অর্থ বা ক্ষমতালিপ্সাও হতে পারে। (সাথের ছবিটি ১৫-১৬ শতকের ওলন্দাজ চিত্রকর হ্বেরোনিমাস বোশ অঙ্কিত ‘লাস্ট’ বা ‘লালসা’)

১৭-খ্রিস্টীয় ধারণায় দ্বিতীয় পাপটির নাম ‘গ্লুটনি’। বাংলায় একে ‘লোভ’ বলা যেতে পারে। এটি কিন্তু ‘লাস্ট’-এর থেকে চরিত্রগত ভাবে পৃথক। মূলত খাদ্য-পানীয় ও সম্পদের প্রতি অতিমত্রায় আসক্তিকেই এর দ্বারা বোঝানো হয়েছে। (সাথের ছবিটি জার্মানির বোহেমিয়ার শিল্পী গিয়র্গ ইমানুয়েল ওপিজের (১৭৭৫-১৮৪১) আঁকা ‘দ্য গ্লুটন’)

১৮-খ্রিস্টীয় মতে তৃতীয় পাপটি হল ‘গ্রিড’। এরও বঙ্গার্থ, ‘লোভ’। তবে এর চরিত্র ‘লাস্ট; বা ‘গ্লুটনি’-র চাইতে আলাদা। মূলত কোনো পার্থিব লাভের আশায় করা দুষ্কর্মকেই এর দ্বারা বোঝানো হয়। খাদ্য থেকে ভূ-সম্পত্তি, সামাজিক ক্ষমতা থেকে মর্যাদা লাভের উদগ্র বাসনাকেই ‘গ্রিড’ বলে ধরা হয়। (সাথের ছবিটি ফরাসি ছাপাই চিত্রকর জাক কালোর (১৫৯২-১৬৩৫) আঁকা ‘গ্রিড’)

১৯-খ্রিস্টীয় মতে চতুর্থ পাপটি হল ‘স্লথ’। এর অর্থ ঈশ্বরের দিক থেকে উৎসৃত প্রেমের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন। পরে এই শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় ‘আলস্য’। গির্জা নির্ধারিত কর্মে ফাঁকি দেয়াকেও এর দ্বারা বোঝানো হতে থাকে। (সাথের ছবিটি হ্বেরোনিমাস বোশ অঙ্কিত ‘স্লথ’-এর)

২০-খ্রিস্টধর্মে পঞ্চম পাপাটি হল ‘ক্রোধ’ বা ‘অ্যাঙ্গার’। একে ‘রথ’ বলেও বর্ণনা করা হয়। (সাথের ছবিটি ফ্লেমিশ চিত্রকর জাক দে লা’আঞ্জের (১৬২১-১৬৫০) আঁকা ‘রথ’)

২১-এই মতানুসারে ষষ্ঠ পাপ হল ‘ঈর্ষা’। (সাথের ছবিটি হ্বেরোনিমাস বোশের আঁকা ‘এনভি’)
২২-খ্রিস্টীয় ধারণায় সপ্তম পাপটি হল ‘গর্ব’। (সাথের ছবিটি হ্বেরোনিমাস বোশের আঁকা ‘প্রাইড’)

২৩-ইসলাম মতেও প্রধান পাপ হিসেবে সাতটি কাজের উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে প্রথমটি হল ‘শির্ক’। অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তার সমকক্ষতা দাবি করা বা তাঁর সমান্তরাল কোনও শক্তিকে কল্পনা করা।

২৪-ইসলামে হত্যাকাণ্ডকেও গুরুতর পাপ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
২৫-কালো জাদু বা ডাকিনীবিদ্যার চর্চা ইসলাম মতে পাপ।

২৬-দৈনিক পাঁচ বার নমাজ না আদায় করাকে ইসলামে পাপ হিসেবে গণ্য করা হয়।

২৭-নিরপরাধ নারীকে মিথ্যা অপবাদ দেয়াও পাপ বলে ইসলামে পরিগণিত।

২৮-অনাথের সম্পত্তি গ্রাস করা ইসলাম মতে গুরুতর পাপ।

২৯-সুদ গ্রহণ ইসলাম মতে অতি গর্হিত কর্ম।

তাই একজন প্রকৃত মানুষের উচিৎ যে কোনো মূল্যে পাপ থেকে বিরত থাকা।

সূত্র : আনন্দবাজার