২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

পবিত্র কোরআনে মাক্কি ও মাদানি সুরার পার্থক্য

-

পবিত্র কোরআনে সুরা : পবিত্র কোরআনুল কারিম মহান আল্লাহর কালাম এবং তাঁর তরফ থেকে রাসুল সা.-কে দানকৃত সবচেয়ে বড় মুজেজা ও আশ্চর্যজনক বস্তু। পবিত্র কোরআনে ১১৪টি সুরা রয়েছে। মজবুত মতানুসারে সেগুলোর ৮৬টি মাক্কি ও ২৮টি মাদানি সুরা।

মাক্কি ও মাদানি সুরার সংজ্ঞা
মাক্কি ও মাদানি সুরা নির্ধারণে সালাফ ও পূর্ববর্তী উলামায়ে কেরামের মধ্যে তিনটি সংজ্ঞা প্রচলিত। এক. মাক্কি সুরা মূলত ওইসব সুরা যা হিজরতের আগে মাক্কি জীবনে অবতীর্ণ হয়েছে, যদিও তা মক্কার বাইরে কোথাও থাকা অবস্থায় হোক না কেন। আর মাদানি সুরা বলা হয়, যেসব সুরা হিজরতের পরে অবতীর্ণ হয়েছে, ‍যদিও তা মদিনার বাইরে ভিন্ন কোথাও অবতীর্ণ হয়ে থাকে।
দুই. যেসব সুরা মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে তাকে মাক্কি সুরা এবং যেসব সুরা মদিনায় অবতীর্ণ তাকে মাদানি সুরা বলা হয়- এক্ষেত্রে হিজরতের আগে-পরের কোনো সময়ের শর্ত উল্লেখ নেই।

তিন. যেসব সুরায় মক্কাবাসীদের সম্বোধন করা হয়েছে সেসব মাক্কি এবং যেগুলোর মধ্যে মদিনাবাসীকে সম্বোধন করা হয়েছে তা মাদানি সুরা। সুতরাং উলামায়ে কেরামের সংজ্ঞার এই ভিন্নতার কারণ হলো- মাক্কি ও মাদানি নির্ধারণে একেক দলের মানদণ্ড ভিন্ন ভিন্ন; প্রথম দল মাক্কি-মাদানি সংজ্ঞা নিরূপনে সময়কে মানদণ্ড বানিয়েছেন, দ্বিতীয় দল স্থান এবং তৃতীয় দল মানদণ্ড বানিয়েছেন সম্বোধিত ব্যক্তিকে।

যেভাবে মাক্কি-মাদানি সুরার সৃষ্টি
সুরাগুলো মাক্কি কিংবা মাদানি হওয়ার ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসুল সা. থেকে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য পাওয়া যায় না। আর সাহাবায়ে কেরামও রা. তাঁকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেননি। কেননা, সম্পূর্ণ কোরআনে কারিম তাঁদের সামনেই একেক করে অবতীর্ণ হয়েছে। তাঁদের এ বিষয়ে পূর্ণ জানাশোনা ছিল যে কোনটি মাক্কি আর কোনটি মাদানি? কিন্তু সাহাবা ও তাবেয়ীদের যুগ অতিবাহিত হওয়ার পরে অনারব ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য মাক্কি-মাদানি বিষয়টি জানা জরুরি হয়ে পড়ে। এর ফলেই ওই সময়ের উলামায়ে কেরাম মাক্কি-মাদানি সুরা নির্ধারণে দুটি পদ্ধতি গ্রহণ করেন।

এক. সরাসরি সাহাবাদের থেকে বর্ণনার ভিত্তিতে। যেমন : ইমাম মুসলিম রহ. সাঈদ ইবনে জুবায়ের থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে ইবনে আব্বাস রা. বলেন, সুরা ফুরকানের ৬৮ নম্বর মাক্কি আয়াতটি সুরা নিসার ৯৩ নম্বা মাদানি আয়াতের মাধ্যমে রহিত হয়ে গেছে। (সহিহ মুসলিম)। অনুরূপ হজরত আয়েশা রা. বলেন, সুরা কমারের ৪৬ নাম্বার আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছে মক্কায় যখন আমি শৈশবে খেলাধূলা করি (সহিহ বুখারি)।

দুই. শরয়ি গবেষণার ভিত্তিতে। এই পদ্ধতিটিও কার্যত প্রথম পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করেই বের করা হয়েছে। যেসব সুরা ও আয়াত মাক্কি ও মাদানি হওয়ার ক্ষেত্রে স্পষ্ট কোনো আলামাত কিংবা ইশারা পাওয়া যায়নি তাতে তাফসির বিশারদ উলামায়ে কেরাম কিছু মূলনীতি নির্ধারণ করেছেন এবং ওই মূলনীতির আলোকে মাক্কি ও মাদানি আয়াতের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করেছেন।

মাক্কি সুরার কিছু বৈশিষ্ট্য
পবিত্র কোরআনের যেসব সুরায় ‘কাল্লা’ শব্দটি এসেছে তা মাক্কি। যেসব সুরায় মহান আল্লাহ ‘ইয়া আইয়্যুহান নাস’ বলে সম্বোধন করেছেন ‘ইয়া আয়্যুহাল্লাজিনা আমানু’ বলেননি তা মাক্কি তবে সুরা হজ ছাড়া। যেসব সুরায় নবী ও পূর্ববর্তী উম্মতদের আলোচনা হয়েছে তা মাক্কি সুরা তবে সুরা বাকারা ছাড়া। যেসব সুরায় আদম আ. ও ইবলিসের কথা এসেছে তা মাক্কি সুরা, সুরা বাকারা এর বাইরে। যেসব সুরার সূচনা হুরুফে মুকাততায়াত (আলিফ-লাম-মীম, হামিম ইত্যাদি) দিয়ে তা মাক্কি, সুরা বাকারা ও আলে ইমরান ছাড়া। একইসাথে মাক্কি সুরাগুলো তাওহিদ এবং রিসালাতের প্রতি আহবান জানানো হয়েছে। মৃত্যু-পরবর্তী পুনরুত্থান, পার্থিব জীবনের সকল কৃতকর্মের হিসাব-নিকাশ বর্ণিত হয়েছে। মাক্কি সুরাগুলো আকারে ছোট হলেও অতীব ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ। মাক্কি সুরাগুলোতে বিধর্মীদের রক্তপাত ও হত্যাযজ্ঞের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে, অন্যায়ভাবে ইয়াতিমদের সম্পদ ভোগ, কন্যা সন্তানদের জীবন্ত দাফন প্রভৃতি কুসংস্কার ও খারাপ আচরণ-সম্পর্কিত বিষয় বর্ণিত হয়েছে। মাক্কি সুরায় প্রসিদ্ধ বস্তুগুলোর নামে শপথের মাধ্যমে উপস্থাপিত বিষয়ের প্রতি জোর দেয়া হয়েছে, বহু দেবতায় বিশ্বাসীদের দাবিকে মিথ্যা প্রতীয়মান করে আল্লাহর সাথে কারো শরিক নেই- এ বিষয়ে বর্ণনা উপস্থাপিত হয়েছে এবং এতে বিভীষিকাময় কিয়ামত, বেহেশতের অনুপম শান্তি এবং জাহান্নামের কঠোর শাস্তির বর্ণনা প্রাধান্য পেয়েছে।

মাদানি সুরার কিছু বৈশিষ্ট্য
মাদানি সুরাগুলোতে ইবাদত, সামাজিক আচার-ব্যবহার, রীতিনীতি, পরস্পরের লেনদেন, হালাল-হারাম, উত্তরাধিকার আইন, জিহাদের ফজিলত, ব্যবসা-বাণিজ্য, পররাষ্ট্রনীতি, বিচার ব্যবস্থা, দণ্ডবিধি, পারিবারিক, আর্থ সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও সমষ্টিগত জীবনের যাবতীয় সমাধানবিষয়ক আলোকপাত করা হয়েছে। তা ছাড়া বিশেষভাবে আহলে কিতাব তথা ইহুদি ও খ্রিস্টানদের প্রতি ইসলাম গ্রহণের জন্য আহবান জানানো হয়েছে মাদানি সুরায়। একইসাথে এতে আহলে কিতাবদের সত্যবিমুখতার কথা এবং তাদের কিতাবগুলো বিকৃতি সাধনের কথা বর্ণিত হয়েছে। মুনাফিকদের কপটতা ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্র বিবৃত হয়েছে। এককথায় বলা যায়, শরিয়তের সামগ্রিক বিধি-বিধানকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে মাদানি সুরাগুলাতে। আর তুলনামূলকভাবে মাদানি সুরাগুলো এবং সুরার আয়াতগুলো কিছুটা দীর্ঘ।


আরো সংবাদ



premium cement