২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

শবেবরাত

- ছবি : নয়া দিগন্ত

আমাদের দেশে শবেবরাত সাড়ম্বরে পালিত হয় এবং দিনটি থাকে সরকারি ছুটির দিন। রেডিও-টেলিভিশনে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়, পত্র-পত্রিকায় বিশেষ ফিচার লেখা হয় এবং মসজিদে মসজিদে দোয়া অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। গ্রামীণ জীবনে শবেবরাতের প্রভাব আরো বেশি ছিল। ঘরে ঘরে হালুয়া-রুটি বিতরণ ও ভালো খানার ব্যবস্থা এবং বাড়ি বাড়ি মিলাদ অনুষ্ঠান ছিল সাধারণ বিষয়। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এসব আচার-অনুষ্ঠান এখন আর নেই বললেই চলে। কুরআন-হাদিস চর্চার কারণে এর আবেদন ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে এবং দ্বীনি শিক্ষার প্রসারে এখন আর মানুষ কোনো কিছু চোখ বন্ধ করে মেনে নেয় না। ইবাদতের নামে যেকোনো আচার-আচরণের পেছনে তারা দলিল (কুরআন-হাদিসের সমর্থন) তালাশ করে।

ইসলামের দৃষ্টিতে ইবাদত তখনই ইবাদত হয়, যখন তার সমর্থনে কুরআন ও হাদিসের প্রমাণ পাওয়া যায়। কুরআন ও হাদিসে সমর্থন না থাকলে তা নতুন উদ্ভাবন বা বিদয়াত হিসেবে বিবেচিত হয়। আর বিদয়াত সম্পর্কে ইসলামের বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট- ‘সকল বিদয়াতই গোমরাহি এবং তা জাহান্নামে যাওয়ার যোগ্য।’ ইসলামে ইবাদতসমূহকে ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত/নফল তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। ফরজ-ওয়াজিব স্পষ্ট এবং উম্মাহর মধ্যে এ ব্যাপারে কোনো মতপার্থক্য নেই। ফরজ-ওয়াজিব পালন করতে প্রতিটি মুসলিম নর-নারী বাধ্য এবং এর অন্যথা কবিরা গুনাহ। সুন্নত/নফল পরিপূরক হিসেবে কাজ করে এবং এসব আমল বান্দার মর্যাদা বাড়িয়ে দেয়।

প্রথমেই বলা যায়, শবেবরাত ফরজ-ওয়াজিব পর্যায়ের কোনো ইবাদত নয়; তাই এত ঘটা করে পালন করা ও সরকারি ছুটি থাকার মতো গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নয়। একটি রাতকে কুরআন-হাদিসে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ ছাড়াই এত গুরুত্ব দেয়া নিঃসন্দেহে বাড়াবাড়ি। পবিত্র কুরআনে শবেবরাতের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। সূরা দুখানের ‘ইন্না আনযালনাহু ফি লাইলাতিম মুবারাকাতিন ইন্না কুন্না মুনজিরিন। ফিহা ইউফরাকু কুল্লু আমরিন হাকিম’ অর্থ- ‘নিশ্চয়ই আমি এটি (আল কুরআন) এক বরকত ও কল্যাণময় রাতে নাজিল করেছি। নিশ্চয়ই আমি তো (জাহান্নাম থেকে) সতর্ককারী। এই রজনীতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়’। কেউ কেউ বরকতময় রাত বলতে শবেবরাতকে (নিসফে শাবান অর্থ মধ্য শাবান) বুঝিয়েছেন। কুরআন থেকে কুরআনের ব্যাখ্যা হলো সর্বোত্তম ব্যাখ্যা। সূরা কদরে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তিনি কুরআনকে কদরের রাতে নাজিল করেছেন। আর কদরের রাত যে রমজান মাসে তাও বোঝা যায় সূরা বাকারায় উল্লিখিত রমজান মাসে কুরআন নাজিলের কথা উল্লেখ করায়। শবেবরাতে নয়, কুরআন রমজান মাসে কদরের রাতে নাজিল হওয়া বিষয়ে উম্মাহর মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে।

শবেবরাতের বিষয়টি আমরা হাদিসে তালাশ করতে পারি। শবেবরাত নামে কুরআন-হাদিসে কোনো উল্লেখ নেই বা থাকার কথা নয়, হাদিসে নিসফে শাবানের উল্লেখ রয়েছে। সিহাহ সিত্তাহ হাদিসের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বুখারি ও মুসলিম এবং এ হাদিস দু’টিতে শবেবরাতের (নিসফে মিন শাবান) কোনো উল্লেখ নেই। ইবনে মাজাহ কর্তৃক বর্ণিত। আলী রা:-এর বরাত দিয়ে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন, ‘১৫ শাবানের রাতে তোমরা বেশি বেশি করে ইবাদত করো এবং দিনের বেলায় রোজা রাখো। এ রাতে আল্লাহ তায়ালা সূর্যাস্তের সাথে সাথে দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন এবং বলতে থাকেন : কে আছো আমার কাছে গুনাহ মাফ চাইতে? আমি তাকে মাফ করতে প্রস্তুত। কে আছো রিজিক চাইতে? আমি তাকে রিজিক দিতে প্রস্তুত। কে আছো বিপদগ্রস্ত? আমি তাকে বিপদমুক্ত করতে প্রস্তুত। কে আছ...’ এভাবে (বিভিন্ন প্রয়োজনের নাম নিয়ে) ডাকা হতে থাকে সুবহে সাদিক পর্যন্ত। ইমাম আহমদ বিন হাম্বলিসহ প্রখ্যাত হাদিস বিশারদরা হাদিসটি জইফ (দুর্বল) বলে আখ্যায়িত করেছেন।

আয়েশা রা: বলেন, ‘একদিন রাসূল সা:কে বিছানায় না পেয়ে অনেক খোঁজাখুঁজির পর জান্নাতুল বাকিতে দোয়া করা অবস্থায় তাঁকে পেলাম। তিনি আমাকে বললেন, রাতটি ফজিলতপূর্ণ তুমি ইবাদত-বন্দেগি করো’ (তিরমিজি)। সাধারণভাবে এ হাদিসটি ব্যাপকভাবে প্রচারিত নয় এবং এ হাদিস দুটি সম্পর্কে ইমাম বুখারিসহ অনেক হাদিস বিশেষজ্ঞ দুর্বল বলেছেন। দুর্বল বললেও ফজিলতের হাদিস বলে কিছুটা আমলে নেয়া যায়। বুখারি ও মুসলিম শরিফে বিশেষ একটি রাতকে ফজিলতপূর্ণ না বলে প্রতিটি রাতকে বিশেষ করে রাতের শেষ এক-তৃতীয়াংশ বাকি থাকতে আল্লাহ পাকের নিকটবর্তী আসমানে অবতরণের কথা বলা হয়েছে এবং বান্দা আল্লাহর কাছে কিছু চাইলে তা পূরণের কথাও উল্লেখ রয়েছে। তবে এ কথাও বলা হয়েছে, যার মধ্যে শিরক ও হিংসা রয়েছে সে ক্ষমা পাবে না। ইমামদের মধ্যে ইমাম মালেক রহ: ও তার অনুসারীরা শবেবরাতের (নিসফে মিন শাবান) ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেন এবং ইমাম শাফেয়ি রহ: ব্যক্তিগতভাবে নিজ গৃহে ইবাদত-বন্দেগির পক্ষে। আর ইমাম আবু হানিফা রহ: ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলি রহ: এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো মতামত ব্যক্ত করেননি।

রমজানের প্রস্তুতিস্বরূপ রজব ও শাবান মাসে স্বাভাবিকের তুলনায় রাসূল সা: বেশি ইবাদত করতেন। তিনি বলতেন, ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রজব ওয়া শাবান ওয়া বাল্লিগনা রমজান’। হে আল্লাহ, আমাদের জন্য রজব ও শাবান মাসকে বরকতময় করে দিন এবং আমাদেরকে রমজান মাস পর্যন্ত পৌঁছে দিন। আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত ‘অন্য যেকোনো মাসের তুলনায় শাবানে রাসূলুল্লাহ সা: বেশি বেশি রোজা রাখতেন’।শবেবরাতের (নিসফে মিন শাবান) রোজা না বলে আইয়ামে বিজের তিনটি রোজা ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ যে কেউ রাখতে পারেন। আশা করা যায় অন্যান্য মাসের তুলনায় শাবান মাসে একটু বাড়তি সওয়াব পাওয়া যাবে। কোনো রকম আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই নিজ গৃহে নফল নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত ও দোয়া-দরূদ পাঠ করে আল্লাহর কাছে চাওয়া যেতে পারে। শেষ রাতে (তাহাজ্জুদ নামাজ) উঠে নামাজের মধ্যে বিশেষ করে সেজদায় নিজের সব প্রয়োজন আল্লাহর কাছে পেশ করা যায়। এটা শুধু শবেবরাতেই নয়, প্রতিটি রাতেই আল্লাহর কাছে ধরনা দেয়া যায় এবং প্রতিটি রাতই ফজিলতপূর্ণ।
আমাদের মনে রাখতে হবে, নফল ইবাদত-বন্দেগির সওয়াব তাদেরই জন্য যারা ফরজ-ওয়াজিবসমূহ নিষ্ঠার সাথে পালন করে। এটা এমন, আবশ্যিক বিষয় সমূহে পাস করার পরই কেবল ঐচ্ছিক বিষয়সমূহের অতিরিক্ত নম্বর একজন ছাত্রের যোগ হয়ে থাকে। যেহেতু শর্তসাপেক্ষে শবেবরাতে বিপুলসংখ্যক মানুষকে ক্ষমা ঘোষণার কথা উল্লেখ রয়েছে, সেহেতু আমাদের সবার উচিত শিরক ও হিংসামুক্ত জীবন যাপন করা।

আমাদের সমাজে খুঁটিনাটি বিষয়ে বেশ মতপার্থক্য রয়েছে এবং এসব ব্যাপারে অনেকে চরমপন্থা অবলম্বন করে থাকে। আমাদের বুঝতে হবে, কম গুরুত্বপূর্ণ বলেই মতপার্থক্য। ফলে এসব বিষয়ে যেকোনো একটি মত গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বাড়াবাড়ি করা, অপরের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ ও হেয় করা এবং দলাদলি করাটাই হলো গুনাহের কাজ। তাই এসব ব্যাপারে আমাদের সতর্ক হওয়া দরকার।

সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত এবং সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় সর্বক্ষণ আল্লাহর হুকুম পালনের নামই ইবাদত। একজন মুসলিম একটি মুহূর্তও আল্লাহর ইবাদতের (গোলামির) বাইরে থাকতে পারে না। সার্বক্ষণিক আল্লাহর গোলামিতে নিয়োজিত করার লক্ষ্যেই প্রস্তুতিস্বরূপ নামাজ-রোজার মতো আনুষ্ঠানিক ইবাদত ফরজ করা হয়েছে। সূর্যোদয়ের আগে ঘুম থেকে জেগেই আল্লাহর ঘরে হাজিরা দিয়ে তাকে বলতে হয়Ñ ‘আমি তোমারই ইবাদত করি, তোমারই কাছে সাহায্য চাই’ এবং কর্মব্যস্ততার মাঝে জোহর, আছর, মাগরিব ও ঘুম যাওয়ার আগে এশায় আল্লাহর ঘরে হাজিরা দিয়ে একই প্রতিশ্রুতির পুনরাবৃত্তি। প্রতিদিন শুধু নয়, দৈনিক পাঁচবার আল্লাহর এই স্মরণ যদি বান্দাসুলভ অনুভূতি নিয়ে কেউ করে তাহলে সে পরিশুদ্ধ না হয়ে পারে না। তাই তো আল্লাহ জোর দিয়েই বলেছেন- ‘নিশ্চয়ই নামাজ মানুষকে অশ্লীল ও অন্যায় কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখে’। তাই বছরের বিশেষ একটি দিনের নয়, দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজই পারে মানুষকে পরিশুদ্ধ করে জান্নাতে পৌঁছে দিতে।

লেখক : উপাধ্যক্ষ (অব:), কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ


আরো সংবাদ



premium cement